অগ্নি-গিরি ঘুমন্ত উঠিল জাগিয়া।
বহ্নি-রাগে দিগন্ত গেল রে রাঙিয়া॥
রুদ্র রোষে কি শঙ্কর ঊর্ধ্বের পানে
লক্ষ-ফণা ভুজঙ্গ-বিদ্যুৎ হানে
দীপ্ত তেজে অনন্ত-নাগের ঘুম ভাঙিয়া॥
লঙ্কা-দাহন হোমাগ্নি সাগ্নিক মন্ত্র
যজ্ঞ-ধূম বেদ-ওঙ্কার ছাইল অনন্ত।
খড়গ-পাণি শ্রীচণ্ডী অরাজক মহীতে
দৈত্য নিশুম্ভ-শুম্ভে এলো বুঝি দহিতে,
বিশ্ব কাঁদে প্রেম-ভিক্ষু আনন্দ মাগিয়া॥
জীবনস্রোতে গানের ভিতর দিয়ে যে দার্শনিকতার সূচনা করা হয়েছে তা রসিক মনকে স্পর্শ করবে বলে আমার ধারণা’। সম্ভবত কবি এমনি একটি জীবনদর্শনকে উপস্থাপন করেছেন- 'বিশ্ব কাঁদে প্রেম-ভিক্ষু আনন্দ মাগিয়া' পংক্তিতে। হয়তো কবি শান্তিবিঘ্নকারী সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছেন প্রবহমান জীবনস্রোতের আনন্দ-বেদনা। জগতসংসারের সুপ্ত হিংসা-বিদ্বেষ কখনো কখনো অনিবার্যভাবে জেগে উঠে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো। জগত-সংসার যখন হিংসা-বিদ্বেষের তীব্রদহনে উৎপীড়িত হয়, তখন আনন্দের প্রত্যশায় বিশ্বজগৎ প্রেম-ভিক্ষু হয়ে বিলাপ করে।‘
উল্লেখ্য, জীবনস্রোত
কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে। জীবনস্রোতের ৭টি গানই প্রকৃতি-কেন্দ্রিক। এর ভিতরে এই গানটিতেই পাওয়া যায়,
প্রকৃতির ভিতর দিয়ে জীবনস্রোতের মূল দর্শন। এই বিচারে এই গানটিকে বলা যায়- এই
গীতি-আলেখ্যের ভূমিকা।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল, কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়- সারং
অঙ্গ-ভিত্তিক গীতি-আলেখ্য
সারঙ্গ রঙ্গ। উক্ত এই গীতিআলেখ্যে এই গানটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন।
ভারতবর্ষ
পত্রিকার (বৈশাখ ১৩৪৭ (এপ্রিল- মে ১৯৪০) সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়েছিল জগৎঘট-কৃত
স্বরলিপি-সহ। স্বরলিপির শেষ
লঙ্কাদাহন সারং রাগের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও দিয়েছিলেন।
এই গানটি তিনি বেঁধেছিলেন- অপ্রচলিত লঙ্কাদহন-সারং রাগে। অপ্রচলিত
লুপ্তপ্রায় রাগকে প্রচলিত করার বাসনা থেকে হয়তো তিনি গানটি বেঁধেছিলেন
লঙ্কাদাহন সারং রাগে। তাঁর এই ভাবনার বিষয়টি সম্পর্কে জানা যায় মনোরঞ্জন সেনের 'সঙ্গীত স্রষ্টা নজরুল' প্রবন্ধে।
তাঁর মতে-
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি বেতার জগত পত্রিকায় এই গীতি-আলেখ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল-'নজরুল ইসলাম রাগ-রাগিণীর এই বৃহৎ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন বিভিন্নভাবে। গ্রামোফোন কোম্পানীতে তিনি ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খানের সান্নিধ্যে আসেন এবং কার্যত তাঁর শিষ্বত্ব গ্রহণ করেন। মুর্শিদাবাদ-নিবাসী ওস্তাদ কাদের বক্স ও মঞ্জু সাহেবের নিকটও তিনি বহু রাগ-রাগিণী আয়ত্ত করেন। ঠাকুর নবাব আলী চৌধুরী প্রণীত সঙ্গীত-পুস্তক থেকে তিনি বহু অপ্রচলিত ও লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীর হদিস পান। উদাহরণ হিসেবে লঙ্কাদহন-সারং রাগটি ধরা যায়। এই রাগে তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন' [সূত্র: মনোরঞ্জন সেন, সঙ্গীত স্রষ্টা নজরুল, সুধীজনের দৃষ্টিতে নজরুল সঙ্গীত, পৃষ্ঠা-১৫৬]
'জীবনস্রোতে গানের ভিতর দিয়ে যে দার্শনিকতার সূচনা করা হয়েছে তা রসিক মনকে স্পর্শ করবে বলে আমার ধারণা'। সম্ভবত কবি এমনি একটি জীবনদর্শনকে উপস্থাপন করেছেন- 'বিশ্ব কাঁদে প্রেম-ভিক্ষু আনন্দ মাগিয়া' পংক্তিতে। হয়তো কবি শান্তিবিঘ্নকারী সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মধ্য খুঁজে পেতে চেয়েছেন প্রবহমান জীবনস্রোতের আনন্দ-বেদনা। জগতসংসারের সুপ্ত হিংসা-বিদ্বেষ কখনো কখনো অনিবার্যভাবে জেগে উঠে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো। জগত-সংসার যখন হিংসা-বিদ্বেষের তীব্রদহনে উৎপীড়িত হয়,তখন আনন্দের প্রত্যশায় বিশ্বজগৎ প্রেম-ভিক্ষু হয়ে বিলাপ করে।
শান্তিবিঘ্নকারী দানবীয় শক্তির অশুভ উত্থানে, জগতে যে অকল্যাণের সূচনা হয়, তারই বিবরণ সনাতন ধর্মের পৌরাণিক চরিত্রে রূপকতায় উপস্থাপন করা হয়েছে এই গানে। এ গানের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হলো- জীবনস্রোতের শান্তিবিঘ্নকারী দানবীয় শক্তি। জীবনস্রোতের সমান্তরাল অনুভবকে প্রচ্ছন্ন রেখে, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি সক্রিয় হওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এই গানে। কবি এই ঘুমন্ত ভয়ঙ্কর শক্তিকে উপস্থাপন করেছেন- পাতালের অনন্ত নাগের লক্ষ-ফণা যুক্ত সর্প-বিদ্যুতের রূপকতায়। যেন এই অশুভ শক্তি জগৎজুড়ে অনন্ত নাগরূপে মহাদেবের তীব্র ক্রোধ হয়ে জেগে উঠেছে। তার তীব্র তেজরূপী লক্ষ ফণায় হিংসা-বিদ্বেষের তীব্র বিষবাষ্পে জগৎ সংসার হয়ে উঠেছে বিষময়।
গানটির সঞ্চারী ও আভোগে শান্তিবিঘ্নকারী দানবীয় শক্তির তীব্রতাকে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেছেন- নানা ধরনের পৌরাণিক রূপকল্পে। যেমন রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণের রাজধানী লঙ্কার সাগ্নিক মন্ত্রে দহন, ধ্বংসযজ্ঞের উচ্চারিত বেদমন্ত্রের তেজ, যজ্ঞের ধোঁয়া, শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্যের হত্যাকারিণী ভয়ঙ্করী শ্রীচণ্ডীর তেজদীপ্ত রূপ- এ সবই শান্তিবিঘ্নকারী দানবীয় শক্তিকে নির্দেশিত করে। এই দানবীয় শক্তির অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভের আনন্দ-প্রত্যাশায় প্রেম-ভিক্ষু হয়ে ক্রন্দসী হয়ে ওঠে জগৎবাসী।