অগ্নি-গিরি ঘুমন্ত উঠিল জাগিয়া।
বহ্নি-রাগে দিগন্ত গেল রে রাঙিয়া॥
রুদ্র রোষে কি শঙ্কর ঊর্ধ্বের পানে
লক্ষ-ফণা ভুজঙ্গ-বিদ্যুৎ হানে
দীপ্ত তেজে অনন্ত-নাগের ঘুম ভাঙিয়া॥
লঙ্কা-দাহন হোমাগ্নি সাগ্নিক মন্ত্র
যজ্ঞ-ধূম বেদ-ওঙ্কার ছাইল অনন্ত।
খড়গ-পাণি শ্রীচণ্ডী অরাজক মহীতে
দৈত্য নিশুম্ভ-শুম্ভে এলো বুঝি দহিতে,
বিশ্ব কাঁদে প্রেম-ভিক্ষু আনন্দ মাগিয়া॥
'জীবনস্রোতে গানের ভিতর দিয়ে যে দার্শনিকতার সূচনা করা হয়েছে তা রসিক মনকে স্পর্শ করবে বলে আমার ধারণা'। সম্ভবত কবি এমনি একটি জীবনদর্শনকে উপস্থাপন করেছেন- 'বিশ্ব কাঁদে প্রেম-ভিক্ষু আনন্দ মাগিয়া' পংক্তিতে। হয়তো কবি শান্তিবিঘ্নকারী সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মধ্য খুঁজে পেতে চেয়েছেন প্রবহমান জীবনস্রোতের আনন্দ-বেদনা। জগতসংসারের সুপ্ত হিংসা-বিদ্বেষ কখনো কখনো অনিবার্যভাবে জেগে উঠে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো। জগত-সংসার যখন হিংসা-বিদ্বেষের তীব্রদহনে উৎপীড়িত হয়,তখন আনন্দের প্রত্যশায় বিশ্বজগৎ প্রেম-ভিক্ষু হয়ে বিলাপ করে।
শান্তিবিঘ্নকারী দানবীয় শক্তির অশুভ উত্থানে, জগতে যে অকল্যাণের সূচনা হয়,
তারই বিবরণ সনাতন ধর্মের পৌরাণিক চরিত্রে রূপকতায় উপস্থাপন করা হয়েছে এই গানে।
এ গানের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হলো- জীবনস্রোতের শান্তিবিঘ্নকারী দানবীয় শক্তি। জীবনস্রোতের সমান্তরাল অনুভবকে প্রচ্ছন্ন রেখে,
ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি সক্রিয় হওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এই গানে। কবি এই ঘুমন্ত
ভয়ঙ্কর শক্তিকে উপস্থাপন করেছেন- পাতালের অনন্ত নাগের লক্ষ-ফণা যুক্ত
সর্প-বিদ্যুতের রূপকতায়। যেন এই অশুভ শক্তি জগৎজুড়ে অনন্ত নাগরূপে মহাদেবের তীব্র ক্রোধ
হয়ে জেগে উঠেছে। তার তীব্র তেজরূপী লক্ষ ফণায় হিংসা-বিদ্বেষের তীব্র বিষবাস্প
জগৎ সংসার হয়ে উঠেছে বিষময়।
গানটির সঞ্চারী ও আভোগে শান্তিবিঘ্নকারী দানবীয় শক্তির তীব্রতাকে বিস্তারিতভাবে
উপস্থাপন করেছেন- নানা ধরনের পৌরাণিক রূপকল্পে। যেমন
রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণের রাজধানী লঙ্কার সাগ্নিক মন্ত্রে দহন, ধ্বংসযজ্ঞের উচ্চারিত বেদমন্ত্রের তেজ, যজ্ঞের ধোঁয়া, শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্যের
হত্যাকারিণী ভয়ঙ্করী শ্রীচণ্ডীর তেজদীপ্ত রূপ- এ সবই শান্তিবিঘ্নকারী দানবীয়
শক্তিকে নির্দেশিত করে। এই দানবীয় শক্তির অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভের
আনন্দ-প্রত্যশায় প্রেম-ভিক্ষু হয়ে ক্রন্দসী হয়ে ওঠে জগৎবাসী।