বিষয়: নজরুল সঙ্গীত।
শিরোনাম: জাগো বিরাট ভৈরব যোগ সমাধি মগ্ন
জাগো বিরাট ভৈরব যোগ সমাধি মগ্ন।
ভুবনে আনো নব দিনের শুভ প্রভাত লগ্ন॥
অনন্ত শয্যা ছাড়ি' অলখ লোকে
এসো জ্যোতির পথে,
দেব-লোকের তিমির-কারা-প্রাচীর কর ভগ্ন॥
ভয়হীন, দ্বিধাহীন উদার আনন্দে,
তোমার আবির্ভাব হোক প্রবল ছন্দে।
হোক মানব স্বপ্রকাশ আপন স্বরূপে
বিরাট রূপে, সফল কর আমার সোহং স্বপ্ন॥
- ভাবার্থ: গানটিতে পাওয়া যায় রাগ বিরাট ভৈরব এবং মহাদেবের (মহান দেব)
স্বরূপ দর্শন। সাঙ্গীতিক শ্রেণিকরণের বিচারে, এই রাগটি ভৈরব অঙ্গের একটি রাগ প্রকরণ।
পৌরাণিক দর্শনের বিচারে মহান ভৈরবের (শিব) একটি বিশেষ রূপ- যার নাম 'বিরাট ভৈরব'।
কবি বিরাট ভৈরবকে পৌরাণিক দর্শন এবং রাগের নান্দনিক দর্শনের সংমিশ্রণে সান্ধ্যভাষার
আশ্রয়ে গানটি রচনা করেছিলেন।
ভারতীয় পৌরাণিক উপাখ্যান মতে- শিব (ভৈরব) যোগ সাধনার চূড়ান্ত দশা তথা
সমাধি-তে
মগ্ন থাকেন। তাই শিবের মহিমা থেকে জগৎ সংসার বঞ্চিত থাকেন। কবি জগতের কল্যাণের জন্য
শিবের সমাধি
থেকে জেগে ওঠার জন্য প্রার্থনা করেছেন। এই রূপকতার ভিতর দিয়ে কবি রাগ বিরাট ভৈরবের
উপস্থপনার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। রাত্রি শেষে যখন চরাচর গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন থাকেন।
প্রকৃতির এই দশার ভিতর থেকে শুভ প্রভাতের শুভসূচনা ঘটাবে রাগ বিরাট ভৈরব। কবি মনে
করেন, রাগের ধ্যানমগ্ন সমাধি দশায় শিল্পী এই রাগ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জেগে উঠবেন,
জগৎকে জাগাবেন। এই বিচারে পৌরাণিক ও সাঙ্গীতিক- উভয় অর্থে রাগটি ভক্তি
মার্গের জাগরণের।
কবি মনে করেন শিবের জাগরণ বা এই রাগের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে সুপ্তিমগ্ন পৃথিবী
সৌন্দর্যের জ্যোতির্ময় আভায় বিভূষিত হবে। শিবে দেবলোকের অন্ধকার বন্দীদশা (শিবের
ধ্যনমগ্নতা) থেকে মুক্ত হয়ে পার্থিব জগতকে মহিমান্বিত করবে। এই রাগও পার্থিব জগতের
রাত্রির অবসান ঘটিয়ে শুভপ্রভাতের শুভ আলোকের পথ দেখাবে।
শিবের আবর্ভাবে জগৎ সংসার ভয় ও দ্বিধাহীন, আনন্দ ও কল্যাণময়। এর মধ্য দিয়ে
প্রতিষ্ঠিত হবে সোহং স্বপ্ন। বৈদিক দর্শনে সোহম বা সোহং হলো-
আমিই তিনি, আমিই ব্রহ্ম। যোগ সাধনার চূড়ান্ত দশা তথা
সমাধি-তে
সাধক নিজেকে অনুভব করেন
ব্রহ্মরূপে। জগতের কল্যাণের জন্য শিব যখন
সমাধি ত্যাগ
করে জেগে উঠবেন- তখন যেন তিনি মানুষের ভিতরে সঞ্চালিত করতে পারেন- জগতের সবকিছু
ব্রহ্মময়। সেখানে হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতার স্থান নেই। যার মাধ্যমে মানুষের
ভিতরে শাশ্বত মানবধর্ম প্রতিষ্ঠা পাবে। এই বিরাট (অপরিসীম শাশ্বত চৈতন্য) ভাবনা
নিহিত রয়েছে এই রাগে। তাই ভৈরব অঙ্গের এই রাগটি হয়ে উঠেছে বিরাট ভৈরব। এই রাগ
উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে সেই বিরাটের (রাগ বিরাট ভৈরব বা শিব) প্রতিষ্ঠা করার জন্য
কবির প্রার্থনা। কবি মনে করেন এই রাগ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সোহং স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠা
করার বাসনা সফল হতে পারে।
বিরাট ভৈরব ভৈরব ঠাটের রাগ। ঝাঁপতালে নিবদ্ধ এই গানটি সাদরা অঙ্গের। তবে সাদরা অঙ্গের দুটি রূপের ভিতরে এর চলন ধ্রুপদের মতো।
- রচনাকাল ও স্থান:
গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪
ফেব্রুয়ারি (বুধবার ১ ফাল্গুন ১৩৪৬), সন্ধ্যা ৭.২৫ মিনিটে রাগভিত্তিক অনুষ্ঠান
'হারমণি'র পঞ্চম অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল। এ অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল রাগ 'বিরাট
ভৈরব'। রাগের ব্যাখ্যা করেছিলেন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী।
এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ৯ মাস।
- গ্রন্থ:
নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট।
তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮। গান ৪২৩। পৃষ্ঠা
৩৬৬]
-
বেতার:
-
হারামণি-৫।
কলকাতা বেতার কেন্দ্র। সোমবার, ১১ মার্চ ১৯৪০
(২৭ ফাল্গুন ১৩৪৬)। সান্ধ্য অধিবেশন। ৭.১০-৭.২৪ মিনিট। রাগ:
বিরাট ভৈরব।
শিল্পী:
কাজী নজরুল ইসলাম
- সূত্র: বেতার জগৎ। ১১শ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা। অনুষ্ঠান সূচী। পৃষ্ঠা: ১৫৬
- ষট ভৈরব
(ছয়টি ভৈরব অঙ্গের রাগ নিয়ে সৃষ্ট
সঙ্গীতানুষ্ঠান)। ১৩ জুলাই ১৯৪১ (রবিবার ২৯ আষাঢ়। ১৩৪৮)। প্রচার সময়: ৮.২৫-৯.০৪।
- সূত্র:
- বেতার জগত [১২শ বর্ষ ১৩শ সংখ্যা, মঙ্গলবার, ১
জুলাই ১৯৪১, ১৭ আষাঢ় ১৩৪৮ পৃষ্ঠা ৭৭৮]
- The Indiann-Listener [22 Sepetember
1939/Vol. VI No. 13. Page 79]
- সুরকার:
কাজী নজরুল ইসলাম
- বিষয়াঙ্গ: ভক্তি [বিরাট-ভৈরবের লক্ষণগীত বা শিব-বন্দনা]
- সুরাঙ্গ: