বিষয়: নজরুল
সঙ্গীত
শিরোনাম: কেন মনোবনে মালতী-বল্লরি দোলে
কেন মনোবনে
মালতী-বল্লরি দোলে
─
জানি না।
কেন মুকুলিকা ফুটে ওঠে পল্লব-তলে, জানি না॥
কেন উর্মিলা-ঝরণার পাশে
সে আপন মঞ্জরী-ছায়া দেখে' হাসে;
কেন পাপিয়া কুহু মুহু মুহু বোলে, জানি না॥
চৈতালি-চাঁপা কয়, মালতী শোন্
শুনেছিস্ বুঝি মধুকর গুঞ্জন,
তাই বুঝি এত মধু সুরভি উথলে
─
মধু-মালতী বলে, জানি না, জানি না॥
- ভাবার্থ: বর্ষার ফুলের স্নিগ্ধ এবং সুরভিত ফুল মালতি। বর্ষার সরস প্রকৃতিতে সে সৌন্দর্যনন্দিনী হয়ে বিকশিত, যৌবন চপলতায় আত্মহারা। তার এই যৌবনচাঞ্চল্য কিসের তরে, সে তা জানে না। এ গানের এ কথাগুলো আভরণ মাত্র। কারণ নজরুল ইসলামের এই গানের মালতী বর্ষণসিক্ত অরণ্যের কোলে দোলায়িত কোনো পুস্প নয়। এই মালতী মানবমনের চিরন্তন সৌন্দর্যপুষ্প। তাই এই মালতী দোলে মনোবনে। কবি জানেন না, কেমন করে এই সৌন্দর্যপুষ্প মনোলোকে মুকুলিকা হয়ে ফুটে উঠে। কেমন করে কখন তাদের দল মেলে দেয় অন্যকে মুগ্ধ করার জন্য, কিম্বা প্রকৃতিকে অলঙ্কৃত করার জন্য।
কেন? সৌন্দর্য পিপাসু কবির কাছে এক বড় জিজ্ঞাসা, বড় বিস্ময়। উর্মিলামুখর ঝরনা মতো প্রবাহিত জীবনধারাকে এই সৌন্দর্যপুষ্প কি করে নান্দনিক করে তোলে!? আবার আপন আনন্দময় জগৎ সংসারে নিজের আনন্দেই নিজেই বিভোর হয়ে রয়!? কেনই বা তারই সাথে গেয়ে উঠে মনোবনের পাপিয়া!?
এই মনোবনের মালতী ঋতুর খাঁচায় বন্দী নয়। তাই বর্ষার যে পুষ্প ঝর্নার সঙ্গীতমুখর ছন্দের দোলায় দুলে উঠে, সেই পুষ্পই বসন্তের চৈতালি-চাঁপাকে উদ্বেলিত করে তোল আপন মহিমায়। বসন্তের চাঁপা অনুভবে পায় যৌবনের বাসনা। সেখানে সৌন্দর্যপুষ্প হয়ে উঠে মিলনের আকাঙ্ক্ষায় আত্মাহারার নিয়ামক। তাই চাঁপার কাছে মালতীর উচ্ছ্বাসের ভিতরে প্রেমিকরূপী ভ্রমরের মিলন আহ্বানের সঙ্কেত খুঁজে পেতে যায়। কিন্তু চিরন্তন সৌন্দর্যপুষ্প ভ্রমরের খবর রাখে না। সে মনোবনে বিহার করে সৌন্দর্যের সৌরভ ছড়িয়ে। তাই নির্বিকারে বলতে পারে 'জানি না, জানি না'।
বাণী ও সুরের অপূর্ব মেলবন্ধনে এই গানটি অনির্বচনীয় হয়ে উঠেছে। গানের শুরু 'গা মা' স্বরদ্বয় 'কেন' শব্দের ভিতরে জিজ্ঞাসার ভাবকে জাগ্রত করে। এরপর পা থেকে সা-এ মীড় দিয়ে মনোজগতে প্রবেশ করে। তারপরে মালতী বল্লরী দোলা খায় 'গা মা পধা ণা। ধা পা মা ০।-এর সুরের দোলনায় 'জানি না জানি না' বলে। এরপর একটু থেমে আবার ধা ণধা পাঃ মঃ। মনে হয় শুধু সুর নয়, যেন মালতী বল্লরী মাথা দুলিয়ে বলছে 'জানি না জানি না'।
এর পরে 'কেন মুকুলিকা ফুটে উঠে, পল্লব তলে'র সুর বিন্যাস জিজ্ঞাসা এবং বিস্ময়ের সমন্বিত রূপ ফুটে উঠে সুরে ছোঁয়ায়। এখানে মীড়যুক্ত সা-পা বিস্ময় জাগায় একই সাথে তলের সাথে 'হ্ম' ভাবের গভীরতলকে স্পর্শ করে যায়।
গানের বাকি অংশই এমনি ভাবের সাথে সুরের নিবিড় খেলা চলে। মনোবনের দোলা সুরের দোলায় ভর করে আপন্ উচ্ছলতায় শ্রোতাকেও আন্দোলিত করে। তাই এই গানের প্রাণভোমরা এর সুর, বাণী সেই ভ্রমরের পাখায় ভর করে মনোবনে বিহার করে। কিন্তু কেন, কবি বা সুরকারের মতো আমরাও জানি না। এই সৌন্দর্যের লীলা শুধু উপভোগের। কেন!?, এটাই যেন অবান্তর।
নিতাই ঘটক-
তাঁর স্বরলিপির পাদটীকায় উল্লেখ করেছেন- 'মধ্যম'কে সুর করিয়া গাহিতে হইবে'।
অর্থাৎ মধ্ম্যকে ষড়জ করে গাইতে হবে।
সুধীন দাশ-কৃত
স্বরলিপিটি খাম্বাজে বাঁধা। যদি খাম্বাজের মধ্যমেকে ষড়্জ ধরে
খাম্বাজের সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ প্রয়োগ করা যায়, তা হলে তা
মাঝ-খাম্বাজ হয়ে যায়।
এই গানটিতে মাঝ -খাম্বাজের রূপটি পাওয়া যায়।
- রচনাকাল ও
স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪২
খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৪৯) মাসে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি
থেকে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪৩ বৎসর ৩ মাস।
- গ্রন্থ:
- অগ্রন্থিত
গান নজরুল-রচনাবলী─দশম খণ্ড [নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। বাংলা একাডেমী, জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬। মে ২০০৯] ১৩০ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২৬৫
- নজরুল গীতি, অখণ্ড
- প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
- দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
- তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪] কাব্য-গীতি। ২৩৬ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৬২-৬৩]
- পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ২৪০ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ৪৭।
- নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮] গান ৪। পৃষ্ঠা ২]
- নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)।
স্বরলিপিকার:
সুধীন দাশ। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫] ৪ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৩৬-৩৮
-
পটদীপ।
স্বরলিপিকার
নিতাই ঘটক।
প্রথম প্রকাশ [হরফ প্রকাশনী। ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ] ৯ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২৩-২৫]
[নমুনা]
- রেকর্ড:
এইচএমভি।
১৯৪২ (ভাদ্র-আশ্বিন
১৩৪৯)। এন-২৭৩১১। শিল্পী: ইলা ঘোষ।
সুর: কমল দাশগুপ্ত।
- স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:
- সুরকার:
কমল দাশগুপ্ত
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: সৌন্দর্য সন্দর্শন
- সুরাঙ্গ:
স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুর। [মাঝ-খাম্বাজ রাগের সুরাবলম্বনে
রচিত]