ওরে দেখে যা তোরা নদীয়ায়
গোরার রূপে এলো ব্রজের শ্যামরায়॥
মুখে হরি হরি বলে
হেলে দুলে নেচে চলে
নরনারী প্রেমে গলে ঢলে পড়ে রাঙা পায়॥
ব্রজে নূপুর পরি নাচিত এমনি হরি
কূল ভুলিয়া সবে ছুটিত এমন করি
শচীমাতার রূপে কাঁদিছে মা যশোদা
বিষ্ণু প্রিয়ার চোখে কাঁদে কিশোরী রাধা
নহে নিমাই নিতাই ও যে কানাই বলাই
শ্রীদাম সুদাম এলো জগাই মাধাই-এ হায়॥
আজ এসেছে ভুবন ভুলাতে অসি নাই বাঁশি নাই
ও ভাই এবারে শূন্য হাতে এসেছে ভুবন ভুলাতে।
ও ভাই লীলা পাগল এলো প্রেমে মাতাতে
ডুবু ডুবু নদীয়া বিশ্ব ভাসিয়া যায়॥
- ভাবসন্ধান: বৈষ্ণবদের মতে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীচৈতন্য রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন নদীয়ায়। তাঁর শরীর ছিল স্বর্ণাভ ('গৌরবর্ণ)। তাই ভক্তরা তাঁকে 'গৌরাঙ্গ' বা গোরা নামে সম্বোধন করে থাকেন। এই গানের মূল বিষয় হলো শ্রীচৈতন্যের বন্দনা। এই সূত্রে কিন্তু এই গানে ব্রজধামের শ্রীকৃষ্ণের সাথে নদীয়ার শ্রীচৈতন্যের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছেন।
এই গানে কবি নদীয়ায় এসে গোরার রূপে আবির্ভুত ব্রজের শ্যামকে দেখে যাওয়ার আহবান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, নদীয়ায় গৌরাঙ্গের লীলা-ভিত্তিক ধর্মাচরণ বৈষ্ণব ধর্মে ভক্তি রসের এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছিল। নদীয়ায় তিনি হরি-সংকীর্তনে হেলে দুলে নেচে নেচে নগরের পথে চলতেন। আর ভক্তরা হরি-প্রেমে (বিষ্ণু, বিষ্ণুর অবতরা কৃষ্ণ) তাঁর রাঙা পায়ে লুটিয়ে পরতেন। কবি ব্রজের কৃষ্ণলীলাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে উল্লেখ করেছেন- ব্রজধামে নূপুর পরে যেমন করে কৃষ্ণ নাচতেন, আর সেই নাচের মোহে কূল ভুলে ব্রজের সবাই ছুটে আসতেন, তেমনি গৌরাঙ্গের নামকীর্তনের মোহে নদীয়ার নরনারী ছুটে আসতেন তাঁর কাছে।
কৃষ্ণের মা যশোদা যেমন কৃষ্ণকে হারিয়ে অপত্য স্নেহে কেঁদেছেন, চৈতন্যদেবের মা শচীদেবী- ঘর বিবাগী সন্তানের জন্য কেঁদেছেন। কৃষ্ণের প্রেমে বিরহিণী রাধার অশ্রুসজল চোখের মতো, চৈতন্যদেবের সঙ্গিনী বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখে ছিল বিরহের অশ্রুধারা। যেন ব্রজধামের কানাই (কৃষ্ণ) বলাই (বলরাম), নদীয়ায় আবির্ভূত হয়েছিলেন নিমাই (চৈতন্যদেব) ও নিতাই (নিত্যানন্দ প্রভু) রূপে। ব্রজের কৃষ্ণের সঙ্গী শ্রীদাম ও সুদামই নদীয়ায় চৈতন্যদেবের সঙ্গী হিসেবে ছিলেন জগাই (জগন্নাথ) ও মাধাই (মাধব) রূপে।
ব্রজধামে শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন। তাঁর হাতে ছিল প্রেমের বাঁশী। কংসের বিনাশ-সহ নানা যুদ্ধে তিনি বাঁশী ফেলে দিয়ে অসি তুলে নিয়েছিলেন হাতে। পক্ষান্তরে বাঁশী আর অসি ত্যাগ করে শূন্য হাতে নদীয়ায় চৈতন্যেদেব এসেছিলেন ভক্তি ও প্রেম রসে জগতকে মোহিত করতে। লীলা পাগল চৈতন্যদেবের প্রেম রসে প্লাবিত নদীয়ার মহিমায় বিশ্ব প্লাবিত। তাই চৈতন্যদেবের এই অপার লীলা দেখার জন্য তিনি বিশ্ববাসীকে নদীয়া আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ অক্টোবর (রবিবার ২৭ আশ্বিন ১৩৩৯) প্রকাশিত 'বনগীতি' গ্রন্থে গানটি প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৩ বৎসর ৪ মাস।
- গ্রন্থ:
- বনগীতি
- প্রথম সংস্করণ [১৩ অক্টোবর ১৩৩২ (রবিবার ২৭ আশ্বিন ১৩৩৯) । কীর্ত্তন-মিশ্র। পৃষ্ঠা: ৬৪]।
- নজরুল-রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, পঞ্চম খণ্ড। বাংলা একাডেমী। ঢাকা। জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮/মে ২০১১। বনগীতি। গান ৪৩। ভজন। মান্দ্-কার্ফা। পৃষ্ঠা ২০৪।
- গ্রন্থ: নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ [নজরুল ইনস্টিটিউট ফেব্রুয়ারি ২০১২। গান সংখ্যা ৭৮৫]
- রেকর্ড: টুইন [অক্টোবর ১৯৩২ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৩৯)। এফটি ২২৩২। শিল্পী: ধীরেন দাস]
- বেতার: শ্রীশ্রী চৈতন্য-লীলা কীর্তন। [৫ মার্চ ১৯৩৯ (রবিবার ২১ ফাল্গুন ১৩৪৫)]
- সূত্র
- বেতার জগৎ। ১০ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা পৃষ্ঠা: ১৭৯
- The Indian-listener Vol IV, No.5. p. 357
- স্বরলিপি ও স্বরলিপিকার: নিখিলরঞ্জন নাথ [নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, তেইশতম খণ্ড, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা। কার্তিক ১৪০৯ নভেম্বর ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ] চতুর্থ গান। [নমুনা]
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ: ধর্মসঙ্গীত। সনাতন হিন্দুধর্ম, বৈষ্ণব। শ্রীচৈতন্য। বন্দনা
- সুরাঙ্গ: কীর্তনাঙ্গ
- তাল: তালফেরতা (কাহারবা/ অর্ধঝাঁপতাল)
- গ্রহস্বর: ধা