শ্রবণ নমুনা:
|
ভূমিকা
প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে
প্রথম দিনের উষা নেমে এল যবে
প্রকাশপিয়াসি ধরিত্রী বনে বনে
শুধায়ে ফিরিল সুর খুঁজে পাবে কবে॥
এসো এসো সেই নবসৃষ্টির কবি
নবজাগরণযুগপ্রভাতের রবি—
গান এনেছিলে নব ছন্দের তালে
তরুণী উষার শিশিরস্নানের কালে
আলো-আঁধারের আনন্দবিপ্লবে॥
সে গান আজিও নানা রাগরাগিণীতে
শুনাও তাহারে আগমনীসঙ্গীতে
যে জাগায় চোখে নূতন-দেখার দেখা।
যে এসে দাঁড়ায় ব্যাকুলিত ধরণীতে
বননীলিমার পেলব সীমানাটিতে,
বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা।
অবাক আলোর লিপি যে বহিয়া আনে
নিভৃত প্রহরে কবির চকিত প্রাণে,
নব পরিচয়ে বিরহব্যথা যে হানে
বিহ্বল প্রাতে সঙ্গীতসৌরভে
দূর আকাশের অরুণিম উৎসবে॥
নবজাতক/'উদ্বোধন'
প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনে
প্রথম দিনের ঊষা নেমে এল যবে
প্রকাশ-পিয়াসি ধরিত্রী বনে বনে
শুধায়ে ফিরিল সুর খুঁজে পাবে কবে॥
আমি বুঝি সেই নবসৃষ্টির কবি
নবজাগরণ যুগ-প্রভাতের রবি,
গান এনেছিনু নব ছন্দের তালে
তরুণী ঊষার শিশির স্নানের কালে,
আলো আঁধারের আনন্দ বিপ্লবে॥
সে গান আজিও নানা রাগ রাগিণীতে
শুনাই তাহারে আগমনী সঙ্গীতে
যে জাগায় চোখে নূতন দেখার দেখা।
যে এসে দাঁড়ায় ব্যাকুলিত ধরণীতে
বন নীলিমার পেলব সীমানাটিতে,
বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা।
অবাক্ আলোর লিপি যে বহিয়া আনে
নিভৃত প্রহরে কবির চকিত প্রাণে,
নব পরিচয়ে বিরহব্যথা যে হানে
বিহ্বল প্রাতে সঙ্গীত সৌরভে
দূর আকাশের অরুণিম উৎসবে ॥
১৩।১০।৩৮
শান্তিনিকেতনপ্রবাসী (জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ), ২২১ পৃষ্ঠায় গানটি 'কষ্টিপাথর' অংশে 'উদ্বোধন' শিরোনামে এই গানটি প্রকাশিত হয়। এই পাঠটি বর্তমান পাঠের চেয়ে কিছুটা ভিন্নতর। পত্রিকায় প্রকাশিত এই পাঠটি নিচে দেওয়া হলো।
উদ্বোধন
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুকতারকার প্রথম প্রদীপ হাতে
অরুণ-আভাস-জড়ানো ভোরের রাতে
আমি এসেছিনু তোমারে জাগাব বলে
তরুণ আলোর কোলে,—
যে জাগার জাগে পূজার শঙ্খধ্বনি,
বনের ছায়ায় লাগায় পরশমণি,—যে জাগায় মোছে ধরার মনের কালি
মুক্ত করে সে পূর্ণ মাধুরী-ডালি॥
জাগে সুন্দর জাগে নির্মল জাগে আনন্দময়ী—
জাগে জড়ত্বজয়ী।
জাগো সকলের সাথে
আজি এ সুপ্রভাতে
বিশ্বজনের প্রাঙ্গণতলে লহ আপনার স্থানী—
তোমার জীবনে সার্থক হোক
নিখিলের আহ্বান।এই পাঠটি সম্পর্কে রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্বিংশ খণ্ডের (বিশ্বভারতী, বৈশাখ ১৩৯৩) ৪৬৬ পৃষ্ঠায়- উল্লেখ আছে-
"...'উদ্বোধন' কবিতাটির যে পাঠ সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল তাহা অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত ছিল। উক্ত পাঠ অনুসারে, নিম্নোদ্ধৃত নূতন চারিটি ছত্রের অনুবৃত্তিস্বরূপ নবজাতকে মুদ্রিত পাঠের শেষ একাদশ ছত্র (পৃষ্ঠা ৭) পড়িতে হইবে—
শুকতারকার প্রথম প্রদীপ হাতে
অরুণ-আভাস-জড়ানো ভোরের রাতে
আমি এসেছিনু তোমারে জাগাব ব'লে
তরুণ আলোর কালে—
কবিতাটির আরম্ভের কুড়িটি ছত্র, রবীন্দ্রসদনে-রক্ষিত পাণ্ডুলিপি অনুসারে, ১৯৩৮ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে শান্তিনিকেতনে স্বতন্ত্র কবিতা আকারে প্রথম লিখিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। সেই আকারে উহা দ্বিতীয় সংস্করণ গীতবিতান-এর 'ভূমিকা' রূপে মুদ্রিত হইয়াছিল।''
গীতবিতানের বিভিন্ন সংস্করণে এই গানটির কয়েকটি ছত্রে নিম্নরূপ ভিন্নতা পাওয়া যায়-
এস এস সেই নবসৃষ্টির কবি [গীতবিতান- প্রথম খণ্ড (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)]
এসো এসো সেই নবসৃষ্টির কবি [গীতবিতান (বিশ্বভারতী, কার্তিক ১৪১২)শুনাই তাহারে আগমনী সংগীতে [গীতবিতান- প্রথম খণ্ড (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)]
শুনাও তাহারে আগমনীসঙ্গীতে [গীতবিতান (বিশ্বভারতী, কার্তিক ১৪১২)
এছাড়া গীতবিতান- প্রথম খণ্ড (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)- এর পাঠে কিছু শব্দের মাঝে হাইফেন ছিল, গীতবিতান 'কার্তিক ১৪১২' এর পাঠে হাইফেন তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রথম খণ্ড (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) -এর সাথে বর্তমান গীতবিতানের যে সকল শব্দবিন্যাসের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, তার তালিকা দেওয়া হলো।
গীতবিতান- প্রথম খণ্ড (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)- এর শব্দবিন্যাস।
'উদয়-দিগঙ্গনে', 'প্রকাশ-পিয়াসি', 'নব জাগরণ যুগ-প্রভাতের', নূতন দেখার', 'বন-নীলিমার', 'বিহ্বল-প্রাতে', 'সংগীত সৌরভে'।
ভাবসন্ধান
ঊষাদেবী আলোকের বাণীবহ
হয়ে আবির্ভূত হন। পৃথিবীতে প্রথম ঊষার আগমনে উদ্ভাসিত ধরিত্রী অন্তরের উচ্ছ্বাস
প্রকাশের অনুকূল সুরের সন্ধানে ব্যাকুল হয়েছিল। সুরের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে-তোলা
সূর্যই নতুন সঙ্গীতের, নতুন সৃষ্টির কবি। নব জাগরণের সুর আর ছন্দে উত্সারিত
আনন্দ স্মরণ করছেন এ কবিতা তথা গানের স্রষ্টা।
ঊষার আগমে প্রতি প্রভাতে নব নব রাগরাগিণীর জন্ম হয়। আর সেই সুরে সুরে
প্রভাতসূর্যকে আগমনী গান গেয়ে শোনান ধরিত্রী। প্রভাতের সূর্যালোক এসে চোখে নতুন
দৃষ্টি খুলে দেয় বলেই সঙ্গীত জেগে ওঠে। শ্যামল বনের প্রান্তে সংসার-জনতার
ঊর্ধ্বে সূর্যের একক-অনন্য আবির্ভাব ধরণীকে উদ্বেল করে। আদি কবির আলোকিত পত্র
পেয়ে পৃথিবীর কবির প্রাণ সচকিত হয়ে ওঠে। প্রভাতী গীতসুর আলোকস্পর্শে উন্মীলিত
হূদয়ে অভূতপূর্ব বিরহবেদনা জাগিয়ে তোলে। সে বেদনার বসতি সঙ্গীতেরই সুরে।
ঊষালোকের বিকাশে যুগপত্ রাগরাগিণীর উত্সার আর কবিত্বের উদেবাধন প্রসঙ্গ রয়েছে
গীতবিতানের ভূমিকার এই গানে। ঊনশেষ ছত্রে 'সঙ্গীতসৌরভে' পদবন্ধ শ্রবণেন্দ্রিয়ের
অনুভূতিকে আঘ্রাণের এলাকায় টেনে নিয়ে বোধের সীমানা বাড়িয়ে দিয়েছে।
কাব্যগীতিটিতে মৃদু সুরের সিঞ্চন আর মধ্যলয়ের গতি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এনেছে।
রাগ-রাগিণী বা লোকসুরের ব্যবহার নয়, এ গানের সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বকীয়তা
মুদ্রিত। 'মজ্ঞা' বা 'কোমল ণি'-র ব্যবহারে রাবীন্দ্রিক সুরের স্বাভাবিক ধারা
বজায় রয়েছে।
—সন্জীদা
খাতুন
তথ্যানুসন্ধান
ক. রচনাকাল ও স্থান:
RBVMS 191
পাণ্ডুলিপিতে এর প্রাথমিক পাঠে
[পাণ্ডুলিপি
৫২ পৃষ্ঠা
ও
৫৩ পৃষ্ঠা]
গানটি কাটাকুটি করা হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথের বহু রচনার মতো
এই কাটাকুটিটি চিত্ররূপী। এর নিচে তারিখ
উল্লেখ আছে '১২/১০/৩৮'। একই পাণ্ডুলিপির ৫৮ ও ৫৯ পৃষ্ঠায় [পাণ্ডুলিপি] সামান্য কাটাকুটি ও সংশোধন-সহ একটি পাঠ দেখা যায়।
এর শিরোনামে লেখা আছে, 'নবজাতক/ উদ্বোধন'। এর নিচে রচনাকাল ও
স্থান
আছে '১৩/১০/৩৮ শান্তিনিকেতন'।
১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ, কালিম্পং-এ
অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৭৭তম জন্মদিনে কবিতাটিকে গানে রূপান্তর করেন।
উল্লেখ্য,
'উদ্বোধন'
শিরোনামে কবিতাটি
রচনার সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ৭৬ বৎসর। কিন্তু এই কবিতাটিতে সুর দিয়ে গানে পরিণত
করেছিলেন ৭৭তম জন্মদিনে।
[দেখুন:
৭৭
বৎসর অতিক্রান্ত বয়সে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিকা]
রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্বিংশ খণ্ড (বিশ্বভারতী, বৈশাখ ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ)। নবজাতক, উদ্বোধন, পৃষ্ঠা: ৬-৭।
স্বরবিতান ঊনষষ্টিতম (৫৯) খণ্ডের (জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩ বঙ্গাব্দ) প্রথম গান। পৃষ্ঠা: ৫-৯। [নমুনা]
পত্রিকা:
প্রবাসী (জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ)। গানটির আদিপাঠ। শিরোনাম- উদ্বোধন, কষ্টিপাথর। পৃষ্ঠা: ২২১। [নমুনা]
বিশ্বভারতী পত্রিকা (বৈশাখ-আষাঢ় ১৮৮২ শকাব্দ, ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ)। শৈলজারঞ্জন মজুমদারকৃত স্বরলিপিসহ মুদ্রিত হয়েছিল। পৃষ্ঠা: ৩৫০-৫৪।
প্রকাশের কালানুক্রম:
রবীন্দ্রনাথ ১৩৪৫-এর ভাদ্রে নিজ সম্পাদনায় গীতবিতান প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। ছাপার ভুলের দরুন গ্রন্থটি বিরল প্রচারিত থেকে যায় (সূত্র: গীতবিতান প্রথম খণ্ড, কার্তিক ১৪১৫)। ডিসেম্বর ২০০৭-এ দে'জ পাবলিশিং কলকাতা 'বিরলপ্রচার সংস্করণ অবলম্বনে' প্রবীর গুহ ঠাকুরতার 'তথ্যসম্পূরণ ও সংযোজনসহ' গীতবিতান প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে 'রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত বিরলপ্রচার গীতবিতান' শিরোনামে প্রবীর গুহ ঠাকুরতা লিখেছেন— "ভূমিকা-গান হিসেবে 'প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে' গানটি বহুলপ্রচার সংস্করণে মুদ্রিত হলেও বিরলপ্রচারে ছিল না, যদিও গানটির প্রথম ছত্র ভূমিকা হিসেবে শেষোক্তের দ্বিতীয় খণ্ডের বর্ণানুক্রমিক সূচীতে তালিকাভুক্ত হয়েছিল।" (পৃষ্ঠা ১৪)।
Ms. 271 পাণ্ডুলিপি-তে এই গানটির পাঠে উল্লেখ আছে, 'নবজাতকে যুগান্তর পূজা সংখ্যা, ১৩৪৬। উল্লেখ্য যুগান্তরের উক্ত 'পূজা সংখ্যা'টির সন্ধান পাওয়া যায় নি। পরের বছর অর্থাৎ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে, গানটি নবজাতক কাব্যগ্রন্থে 'উদ্বোধন' শিরোনামে কবিতা হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই বছরের জ্যৈষ্ঠ মাসে এই কবিতাটি সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকার 'জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায়। বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত গীতবিতান-এর প্রথম খণ্ডের ভূমিকা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে। [দেখুন: ভূমিকা]
গ. সঙ্গীতবিষয়ক তথ্যাবলী:
স্বরলিপি: [নমুনা] [স্বরবিতান ঊনষষ্টিতম (৫৯) খণ্ডের (জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩ বঙ্গাব্দ)]
স্বরলিপিকার: শৈলজারঞ্জন মজুমদার।
রাগ ও তাল:
স্বরবিতান ঊনষষ্টিতম খণ্ডে (পুনর্মুদ্রণ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩) গৃহীত স্বরলিপিতে রাগ-তালের উল্লেখ নেই। উক্ত স্বরলিপিটি ৩।৩ মাত্রা ছন্দে 'দাদরা' তালে নিবদ্ধ।
রাগ: কাফি-কানাড়া। [রবীন্দ্রসংগীত: রাগ-সুর নির্দেশিকা। সুধীর চন্দ। (প্যাপিরাস, ডিসেম্বর ২০০৬)। পৃষ্ঠ: ৬৫]
রাগ: গৌড়মল্লার (জ্ঞ),
বারোয়াঁ। তাল: দাদরা। [রাগরাগিণীর এলাকায় রবীন্দ্রসংগীত, প্রফুল্লকুমার
চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমী, জুলাই ২০০১। পৃষ্ঠা: ১১৩]
সুরাঙ্গ: রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুর।
গ্রহস্বর: ন্সা।
লয়: মধ্য।
বিশেষ নির্দেশ: স্বরবিতান ঊনষষ্টিতম খণ্ডের (পুনর্মুদ্রণ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩) পঞ্চম পৃষ্ঠায় মুদ্রিত স্বরলিপির শিরোদেশে উল্লেখ আছে – গানটি মীড়-প্রধান। তারযন্ত্রে মধ্যলয়ে গেয়'।
সর্বশেষ সংস্করণ : ১৭ পৌষ ১৩২৪ বঙ্গাব্দ, বৃহস্পতিবার। ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ বঙ্গাব্দ