যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম

লুপ্ত রাগের পুনরুদ্ধার এবং তার প্রচারের উদ্দেশ্যে, কাজী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় 'হারমাণি' নামক একটি অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল  ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টায়। এই অনুষ্ঠানটি অনিমিয়ত হলেও ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়েছিল ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে নজরুলের অসুস্থ হওয়ার পূর্বকাল পর্যন্ত। মূলত এর শেষ অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে জুন রাত ৮.৪০ মিনিটে। এর ভিতরে বেতারে তাঁর রচিত গান বা গীতি-আলেখ্য প্রচার হয়েছে। এ সবের ভিতরের একটি বিশেষ গীতি-আলেখ্য ছিল 'যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম'। এটি কলকাতা বেতারে প্রচারিত হয়েছিল ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জুন। 

ভারতীয় রাগসঙ্গীতের নানা দিক নিয়ে নজরুল ইসলাম নানা রকমের গবেষণা করেছিলেন। 'যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম' হলো তার একটি। ভারতীয় রাগ-সঙ্গীত শাস্ত্রে রাগ-পরিবেশনায় দিনের বিভিন্ন সময় এবং ঋতু বৈচিত্র্যের প্রভাব রয়েছে। দিনের বিচারে ভারতীয় সঙ্গীতঋষিরা দিবারাত্রির বিভাজিত অংশ হিসেবে প্রহর বা যাম নামক এককটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই এককটি তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র থেকে। উল্লেখ্য,
প্রাচীন ভারতের রাজদরবারে, ধাতব ঘণ্টায় বা ঢাকে প্রহার করে যাম (আধুনিক তিন ঘন্টার সমতূল্য সময়) ঘোষণা করা হতো। ধারণা করা হয়, প্রহার থেকে প্রহর শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশ করেছিল। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত 'বঙ্গীয় শব্দকোষে' প্রহর শব্দের সংজ্ঞা দিয়েছেন 'যামঢক্কাদিবাদন-কাল'। অনেকের মতে, রাজবাড়িতে তিন ঘণ্টা পর পর ঢাক বাজিয়ে সময় ঘোষণা করার সময়, প্রহরীরও পরিবর্তন ঘটতো। সেই কারণে যাম ঘোষণার সময় প্রহর নামে প্রচলিত হয়।

ভারতীয় সময় পরিমাপক একক

২৪ সেকেন্ড= ১ পল
৬০ পল= ১ দণ্ড= ২৪ মিনিট

সাড়ে সাত দণ্ড (৭৷৷৹)=১ প্রহর=১ যাম= ৩ ঘণ্টা
৮ প্রহর= ১ দিন =২৪ ঘণ্টা

ভারতীয় সঙ্গীতঋষিরা প্রহরে পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে পরিবেশগত পরিবর্তনের বিষয়টি অনুভব করেছিলেন। তাঁরা এটাও ভেবেছিলেন যে প্রহর পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনোগত দশারও পরিবর্তন হয়। সুতরাং প্রকৃতি ও মনের সাথে মিলিয়ে ভারতীয় সঙ্গীতগুরুরা প্রহরভিত্তিক রাগের শ্রেণিকরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। এই সূত্রে প্রহরভিত্তিক রাগ তালিকাও তাঁরা তৈরি করেছিলেন। প্রহরভিত্তিক রাগগুলোর একপ্রান্তে থাকে প্রহরের সূচনার রাগ, কিছু থাকে প্রহর শেষের রাগ। সূচনা ও শেষের রাগগুলোর ভিতরে থাকে দুই প্রহরে সন্ধি-প্রকাশক সুরবিন্যাস। প্রহরভিত্তিক রাগগুলোর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে, নজরুল ইসলাম এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, সন্ধি-প্রকাশক সুরবিন্যাসে কড়ি মধ্যমের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। এই সূত্রে তিনি মোট ৮টি রাগকে বিশেষভাবে শনাক্ত করেন এবং সেগুলো দিয়ে একটি গীতি-আলেখ্য তৈরি করেন। এই গীতি-আলেখ্যটিই কোলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জুন 'যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম' নামে সম্প্রচারিত হয়।   

নজরুল ইসলামের পাণ্ডুলিপি:
কোলকাতা বেতারের জন্য লিখিত এই গীতি-আলেখ্যটির পাণ্ডুলিপি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। কোলকাতার রাস্তায় পড়ে থাকা অল-ইন্ডিয়া রেডিওর কাগজপত্রের ভিতর থেকে এই পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন আসাদুল হক। এ বিষয়ে তিনি তাঁর 'নজরুল যখন বেতারে' (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, মার্চ ১৯৯৯, পৃষ্ঠ: ১৫৩) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-

'...এই অপ্রকাশিত গীতি-আলেখ্যটি আমি কুড়িয়ে পাই কলকাতার রাস্তার পাশে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা কিছু অল্-ইন্ডিয়া রেডিওর কাগজ পত্রের মধ্যে। গীতি-আলেখ্যটি নজরুলের হাতে লেখা আট পাতায় সমাপ্ত।'

আসাদুল হক রচিত 'নজরুল যখন বেতারে' (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, মার্চ ১৯৯৯) অনুসরণে  'যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম' -এর পাঠ এখানে যুক্ত করা হলো।

প্রহর অনুসারে কাজী নজরুল ইসলাম যে গানগুলো লিখেছিলেন, তার তালিকা

এই 'গীতিআলেখ্যে' নজরুল ইসলাম মধ্যমকে প্রহরভিত্তিক রাগের 'সেতু' হিসেবে উল্লেখ করেছে। একটি প্রহরের রাগ থেকে পরবর্তী প্রহরের রাগে পৌঁছানোর জন্য নানন্দনিক পরিবর্তনের যে সামঞ্জস্য থাকার প্রয়োজন, তার সঞ্চালকের দায়িত্ব দিয়েছেন। 

অন্যদিক থেকে এই গানগুলো বিশেষ কিছু অর্থ বহন করে। মূলতর এই গীতি আলেখ্যের গানগুলিতে নজরুল রাগগুলোর নিটল চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন রূপকতার মধ্য দিয়ে। বলাই বাহুল্য, প্রতিটি রাগের রয়েছে নিজস্ব রূপ। আবার প্রকৃতিতে প্রহরেও রয়েছে নিজস্ব। এই গানগুলোর বাণীর ভিতরে রয়েছে রাগরূপের সাথে প্রকৃতির রূপে সমন্বয় করার প্রচেষ্টা। এক্ষেত্রে নজরুল তাঁর গানের বাণীতে নানান প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করেছেন। একই সাথে বাণী ও সুরে সমন্বয়ে রাগের বিমূর্তরূপকে মূর্তমান করেছেন। ফলে সুর-বাণীর নানন্দনিক সংমিশ্রণ ঘটেছে এই গানগুলোতে। এই বিচারে এই গানগুলো রূপকতার আশ্রয়ে রাগের লক্ষণগীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু রাগসঙ্গীতের চিরাচরিত লক্ষণগীতির রূপ এতে নেই।

সুরাঙ্গের বিচারে 'যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম'-এর গানগুলো নিতান্তই রাগাশ্রয়ী নয়। কারণ এই গীতি-আলেখ্যে যুক্ত রাগরূপের বর্ণনার পরে ব্যবহারিক নমুনা দেখানো হয়েছে, তার চারটি গানের সাথে 'খেয়াল শুনুন' জাতীয় নির্দেশনা আছে। যেমন-

পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম রাগগুলোর পরে  কোনো পৃথক নির্দেশনা নেই। হয়তো কবি একই অনুষ্ঠানের গান হিসেবে 'খেয়াল শুনুন' জাতীয় শব্দ বার বার ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ করেন নি। তাই এই গানের সুরাঙ্গ খেয়ালাঙ্গ না বলে সরাসরি খেয়াল বলাই বাঞ্ছনীয়। এমনি খেয়াল গান হিসেবে পরিবেশন করলে, হয়তো আরো যথার্থ হয়।