মীরসরাই উপজেলা

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের সদর জেলা- চট্টগ্রাম জেলা অন্তর্গত একটি উপজেলা। এই উপজেলার অবস্থান উত্তর অক্ষাংশের ২২°৩৯' এবং ২২°৫৯' এর মধ্যে, ৯১°২৭' এবং ৯১°৩৯' দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। এর পূর্বে ফটিকছড়ি, দক্ষিণে সীতাকুণ্ড, পশ্চিমে সন্দ্বীপ চ্যানেল ও সন্দীপ উপজেলা, নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা, ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলা এবং উত্তরে ফেনী জেলার ফেনী সদর উপজেলা, ছাগলনাইয়া উপজেলা ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ৬০ কি:মি।

বর্তমানে এই উপজেলায় দুটি থানা, ২টি পৌরসভা এবং ১৬টি ইউনিয়ন রয়েছে। মোট গ্রামের সংখ্যা ২০৯ এবং মৌজা ১১৩টি।

মোট আয়তন ৪৮২.৮৮ বর্গ কিলোমিটার। জেলার প্রধান দুটি নদী হলো- ফেনী ও মুহুরী।

ইতিহাস
১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ‌-এর চট্টগ্রাম বিজয়ের পূর্বকাল পর্যন্ত, চট্টগ্রাম এবং এর আশপাশের অঞ্চলের কোনো ইতিহাস সুষ্পষ্টভাবে জানা যায় না।
১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ চট্টগ্রাম অধিকার করেন। স্বাধীন সোনারগাঁও রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।

১৩৫২‌-৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ফকরুদ্দীন মোবারক শাহ-এর পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহকে হত্যা করে সুলতান ইলিয়াস শাহ বাংলার মসনদ দখল করেন। এই সময় চট্টগ্রামও তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম বাংলার প্রধান বন্দর হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধররা চট্টগ্রাম শাসন করা শুরু হয়। এরপরে বাংলায় হাবসি বংশ প্রতিষ্ঠা হয়।

১৪৩৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আরাকানরা চট্রগ্রাম অভিমুখে যুদ্ধাভিযান শুরু করে। ১৪৩৭ খ্রিষ্টাব্দ রামু এবং ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম দখল করে নেন।

১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে হোসেন শাহ বাংলার সুলতান হোন। তিনি চট্টগ্রামের অধিকার নিতে গেলে
ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্যের সাথে সংঘাত সৃষ্টি হয়। ১৫১৩-১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উভয় রাজার ভিতর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাজা ধনমানিক্যের মৃত্যুর পর হোসেন শাহ‌ চট্টগ্রাম তাঁর দখলে আনেন এবং উত্তর আরাকান পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পোর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসা শুরু করে। এরা প্রথমাস্থায় বাণিজ্য করতে এলেও, পরে তারা জলদস্যু হয়ে যায়। সুলতান এদের দমন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সময় আফগান শাসক শের শাহ বাংলা আক্রমণ করতে পারে, এই আশঙ্কায় তিনি পোর্তুগিজদের সহায়তা কামনা করেন।

পরবর্তীতে এই অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা লাভ করেন নসরৎ শাহ। ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে নসরৎ শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন।  এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ। ফিরোজ শাসনকার্যে অনুপযুক্ত ছিলেন। তাঁর কুশাসনের বিরুদ্ধে আমিররা বিদ্রোহ করেন। বাংলার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাকান- এর ১৩তম রাজা মিন বিন, ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই অক্টোবর, চট্টগ্রাম দখল করে নেন।

আরাকানদের দমন করার জন্য পোর্তুগিজদের সহয়তা নেন। সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। এই সময় তারা বন্দর এলাকার শুল্ক আদায়ের অধিকার লাভ করে। এতকিছুর পরেও ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ‌-র সেনাপতি চট্টগ্রাম দখল করেন। কিন্তু শের শাহ‌-এর এই সেনপাতি চট্টগ্রামের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করতে পারেন নি। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আফগানদের ত্রিপুরা আর আরাকানীদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে।

১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজা চট্টগ্রাম অধিকার করেন এবং ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকান রাজাদের অধীনে থেকে যায়। এই সময় পোর্তুগিজরা আবার দস্যুতা শুরু করে। এদের দৌরাত্ম অত্যন্ত বৃদ্ধি পেলে, আরাকান রাজা ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এই অভিযানের ফলে পোর্তুগিজদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করা সম্ভব হয় নি। বিশেষ করে সন্দীপ অঞ্চল পোর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালেস দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম মোগলদের হস্তগত হওয়ার পূর্বকাল পর্যন্ত পোর্তুগিজরা তাদের দস্যুতা চালিয়ে যেতেই থাকে।

১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে সুবেদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ ফেনী নদী পার হয়ে বর্তমান মিরসরাই দখল করেন। বিজয়ী সেনাপতির নামে মীরসরাইয়ের ওই স্থানের নাম রাখা হয় বুজুর্গ উমেদনগর। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চল স্থায়ীভাবে মুগলদের শাসনে চলে যায়। জব চার্নক ১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কাপ্তেন হিথের চট্টগ্রাম দখল করতে ব্যর্থ হয়। ১৬৭০ ও ১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানীরা চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।  ১৭২৫ আরাকানরা বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম দখল করতে সক্ষম হয়, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই মোগলরা আরাকানদের বিতারিত করে।

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর, ইংরেজরা  মীরজাফরকে সিংহাসনে বসায়। ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দরের অধিকার লাভের জন্য নবাব মীর জাফরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু মীরজাফর ইংরেজদের কাছে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব দিতে তুলে দেন নি। ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে মীর জাফরকে অপসারণ করে মীর কাশিম বাংলার নবাব বানানো হয়। এই সময়  ইংরেজরা বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের অধিকার লাভ করে। চট্টগ্রামের শেষ ফৌজদার রেজা খাঁ সরকারিভাবে চট্টগ্রামের শাসন প্রথম ইংরেজ চিফ ভেরেলস্ট-এর হাতে সমর্পন করেন। শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। কোম্পানির শাসনামলে চট্টগ্রামবাসীর ওপর করারোপ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। মীরকাসেমের সাথে ইংরেজদের বৈরী সম্পর্ক তৈরি হলে, ইংরেজরা মীরজাফরকে পুনরায় সিংহসনে বসায়।

ইংরেজ আমলে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। ইংরেজ শাসনামলের শেষদিকে চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের তৎপরতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল মিরসরাই উপজেলার দূর্গাপুর ও করেরহাট এলাকা।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই চট্টগ্রাম জেলার ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে মীরসরাই থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই থানার কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল ক্যাপ্টেন অলি আহমদের নেতৃত্বে মিরসরাই সদরের দক্ষিণে ফেনাফুনি ব্রিজের পাশে মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রায় ১০০ সৈন্য নিহত হয়। এছাড়াও শুভপুর সেতু, হিঙ্গুলী সেতু, অছি মিয়ার সেতু ও মস্তাননগরসহ গোটা এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াই সংঘটিত হয়।

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল এই থানাকে উপজেলায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। তবে উপজেলার কার্যক্রম শুরু হয় ৬ই অক্টোবর থেকে।


সূত্র: