উখিয়া

চট্টগ্রাম [বাংলাদেশ] বিভাগের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। ভৌগোলিক অবস্থান ২১.১° উত্তর দ্রাঘিমাংশ ৯২° পূর্ব অক্ষাংশ। এর উত্তরে রামু উপজেলা, পূর্বে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ এবং নাইক্ষ্যাংছড়ি, দক্ষিণে  টেকনাফ উপজেলাএবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। এর মোট আয়তন ২৬১.৮ বর্গকিলোমিটার।

প্রশাসন
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে এই উখিয়ায় থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে থানাকে কক্সবাজার জেলার একটি উপজেলায় পরিণত করা হয়।
এই উপজেলাটি মোট ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এই ইউনিয়নগুলো হল হলদিয়া পালং, জালিয়া পালং, রাজা পালং, রত্না পালং ও পালং খালী। এর মৌজা সংখ্যা ১৩টি এবং গ্রাম ৫৪টি।

সংসদীয় আসন: ২৯৭ কক্সবাজার-৪

দর্শনীয় স্থান:

  • ইনানী সমুদ্র সৈকত: উখিয়া উপজেলার বঙ্গোপসাগরের উপকূলভূমি। কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই সৈকতটি প্রবাল। পশ্চিমে সমুদ্র আর পূর্বে পাহাড়ের এক অপূর্ব সংমিশ্রণে গঠিত জায়গাটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্ররূপে পরিগণিত হয়ে আসছে।
     
  • কানা রাজার গুহা:উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের পাটুয়ারটেক সৈকতের নিকটে নিদানিয়া পাহাড়ের অভ্যন্তরে একাধিক সুরঙ্গের সমাহারকে এই গুহাটি অবস্থিত। উখিয়া সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। সুড়ঙ্গগুলোর মুখ ১২'x ১০'। এর প্রধান সুড়ঙ্গটি প্রবেশ মুখ থেকে সোজা ১২০-১৫০ ফুট দূরত্বের পরে, দু’দিকে দুটো দরজা রয়েছে। এই দরজার দু’দিকেই একটি করে দু’টি বিরাট কক্ষ রয়েছে। কথিত আছে টেকনাফ-উখিয়া এলাকাটি রাখাইন শাসনাধীনে থাকার সময়- কোনো এক, এক চোখ অন্ধ রাখাইন রাজা চিন পিয়ান আত্মরক্ষার্থে এই গুহা নির্মাণ করেছিলেন। একসময় এই গুহার অভ্যন্তরে প্রচুর ধন রত্ন ছিল বলে স্থানীয়রা এ গুহাকে অাঁধার মানিক নামেও সম্বোধন করে থাকেন। বর্মী সেনা ও বর্মী অনুগত আরাকানিদের ওপর অত্যাচার করার কারণে প্রতিপক্ষরা তাঁর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালায়। চিন পিয়ান পরাজিত হয়ে, বৃহত্তর চট্টগ্রামে পালিয়ে এসে আত্মগোপন করেন। তাকে গ্রেফতার করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। এ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্য চিন পিয়ান পুনরায় আরাকানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানেও বর্মীদের পাল্টা প্রতিরোধের কারণে তিনি রামুর পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয়  নেন। এখানে থাকাকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ের গভীরে খনন করা হয়েছিল এই গোপন সুড়ঙ্গ বা দুর্গ।

    ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সর্বপ্রথম রাশিয়ান তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী দল এ গুহাটি আবিষ্কার করেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রেলিয়ার এক বিশেষজ্ঞ দল এ অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালিয়েছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের দ্বারা এ গুহার কথা প্রচারিত হয়।
     
  • পাতাবাড়ী বৌদ্ধ বিহার: কক্সবাজার সদর হতে ৩২কিমি এবং উখিয়া সদর থেকে ১কিমি পূর্বদিকে এই বৌদ্ধ বিহারটি অবস্থিত। উখিয়া উপজেলার একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের  জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ধারণা করা হয় প্রায় ২০০ বছর পূর্বে স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই বিহারটি তৈরি করেছিল।

ইতিহাস
উখিয়ার উল্লেখযোগ্য তেমন প্রাচীন ইতিহাস নেই। পাহাড় এবং গভীর অরণ্যের জন্য এই অঞ্চল মূলত দুর্গম ছিল। এই কারণে এই অঞ্চলে লোকবসতিও তেমন গড়ে উঠেন। যতদূর জানা যায়, ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আরাকান থেকে বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি সদলবলে পালিয়ে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর এলাকায় চলে আসে। এই সকল লোক বড় ফালং, হারবং (হারবাং চকরিয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন), বড়ইছড়ি (সম্ভবতঃ চকরিয়া উপজেলার বর্তমান বরইতলী ইউনিয়ন) ও বহলতলী (চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের একটি গ্রাম) নামক জায়গায় বসতি স্থাপন করে। ব্যবসা বাণিজ্য বা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রবাদির জন্য আরকানের যোগাযোগ ছিল। এরা এই অঞ্চল থেকে আরাকনের যাওয়ার পথে একটি স্থানে ঘাটের কর প্রদান করতো। স্থানীয় লোকেদের  মতে
এই ঘাটের কর তুলতো ‘উখি’ নামের জনৈক ব্যক্তি। কালক্রমে ওই স্থানের নাম হয়ে যায় উখিয়ার খাটা। ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেকর্ড-পত্রে 'উখিয়ার ঘাট' নাম পাওয়া যায়। কালক্রমে 'ঘাট' শব্দটি বাদ পড়ে উখিয়া নামে ওই স্থান পরিচিতি লাভ করে। অনেকের মতো এক সময় এই অঞ্চলে প্রচুর বাঘ ছিল।

১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে জোঁ আ দ্যা বেরোস’ বা ‘জোঁ আ দ্যা বারোস' নামক একজন পতুর্গীজ ঐতিহাসিক সর্ব প্রথম বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের
`descripcao do reino de bengalla’ নামের একটি মানচিত্র তৈরি করেন। উক্ত ম্যাপে দ্বীপ বাকোলীয়ার দক্ষিণে ইংরেজীতে ওরিয়াতন (Oriatan) নামের একটি জায়গার নাম পাওয়া যায়। উক্ত ম্যাপে বাঁকখালী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনার উত্তর পার্শ্বে 'বাকোলী' চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এর দক্ষিণ পার্শ্বে চিহ্নিত করা হয়েছে 'উরিয়াতন' নামের একটি দ্বীপ। জোঁ আ দ্যা বেরোস নদী পথে ইন্দোনেশিয়া উপকূল হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েই ওই মানচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। ফলে নাফ নদীর মোহনা থেকে বাঁকখালী নদীর মোহনা পর্যন্ত অংশকে দ্বীপ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। ধারণা করা হয়, জোঁ আ দ্যা বেরোস-এর অঙ্কিত  'উরিয়াতন' দ্বীপই বর্তমানকালের উখিয়া।

১৫৭৭-১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ চট্টগ্রাম আরাকানের করদ রাজ্য ছিল এবং সেখানে আদম শাহ নামে একজন মুসলমান আরাকার রাজার সামন্ত ছিলেন, তাঁর কর্মস্থল বা প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল চকরিয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপচার্য ড. আবদুল করিমের মতে ‘আদম শাহ রামু-চকরিয়ার শাসক হলেও তার প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো চকরিয়াতেই। ত্রিপুরা রাজা অমর মানিক্য-এর পুত্র রাজদাহার নারায়ণ-এর নেতৃত্বে ত্রিপুরা বাহিনী ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান আক্রমণ করে। রাজদাহার নারায়ণ চট্টগ্রামের কর্ণফূলী নদী অতিক্রম করে আরাকানিদের ৬টি আস্তানা দখল করেন। এঁদের অভিযান শেষ হয়েছিল রামু পর্যন্ত। এরপর রাজদাহার নারায়ণ রামুর দক্ষিণ পার্শ্বের উরিয়া রাজাকে (Uria Raja ) আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উরিয়া রাজার আমলে তাঁর রাজ্যের সীমানা কি রকম ছিল এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। অনুমান করা যায় নাফ নদীর উত্তর ভাগ থেকে শুরু করে পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে নাফনদী ও আরাকানের কিছু অংশ এবং উত্তরে বর্তমান বাঁকখালী নদী পর্যন্ত উরিয়া রাজার উত্তর সীমানা ছিল।


তথ্যসূত্রঃ
১. http://bn.banglapedia.org/