অর্থনীতি
কৃষি: মাটি ও পানির লবণাক্ততা এবং পাথুরে অঞ্চল গুজরাটের বেশিরভাগ কৃষির অনুপোযুক্ত।
এই রাজ্যের প্রধান ফসল গম, মিলেট, জোয়ার, ধান। অর্থকরী ফসলের মধ্যে রয়েছে তুলা, তৈলবীজ চিনাবাদাম, তামাক ও আখ।খনিজ পদার্থ: গুজরাটে প্রচুর চুনাপাথর, ম্যাঙ্গনিজ, জিপসাম, ক্যালসাইট ও বক্সাইট প্রভৃতি খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। এখানে প্রচুর লিগনাইট, কোয়ার্টজ বালি, এ্যাগেট ও ফেল্ডস্পারেরও মজুত রয়েছে। কাথিয়াবাড় উপদ্বীপের পোরবন্দরের পাওয়া যায় উৎকৃষ্ট নির্মাণ পাথর। এছাড়াও গুজরাট পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপন্ন হয়।
কলকারখানা: এই রাজ্যের প্রধান কারাখানা শিল্প হলো- রাসায়নিক, ফার্মাসিউটিক্যালস্ ও পলিয়েস্টার টেক্সটাইল। রাজ্যের প্রধান শিল্পবলয় গড়ে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চলে। ভাদোদরার কাছে
কোয়ালিতে একটি বৃহৎ তৈল শোধনাগর রয়েছে। কাথায়াবাড় উপদ্বীপে ক্ষুদ্র আকারের কৃষিভিত্তিক
শিল্প গড়ে উঠেছে। এছাড়া রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে ভোজ্য তেল, তুলা বয়ন ও সিমেন্ট শিল্প।
পরিবহন: গুজরাটের
শহর-নগরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা
খুবই চমৎকার। আন্তঃনগর ও ভারতের বাকি
অংশের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত রয়েছে।
রাজ্যের উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের জন্য বেশ কিছু বন্দর রয়েছে। এদের ভিতরে কাঁদলা রয়েছে আন্তর্জাতিক
জাহাজ টার্মিনাল। রাজ্যের অভ্যন্তরের বিভিন্ন
নগর এবং ভারতের অন্যান্য
প্রধান নগরের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে ।
সাংবিধানিক কাঠামো এবং বিচার ব্যবস্থা: গুজরাটের স্থানীয় সরকার-কাঠামো ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের মতই
এবং তা
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংবিধান অনুযায়ী
নির্ধারিত। ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত গভর্নর হচ্ছেন রাজ্যের প্রধান নির্বাহী।
রাজ্যের সরকার প্রধান হলেন মুখ্যমন্ত্রী। গুজরাটের বিধানসভা এক কক্ষবিশিষ্ট।
হাই কোর্ট হচ্ছে রাজ্যের সর্বোচ্চ বিচারিক
কর্তৃপক্ষ। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন অধঃস্তন আদালত, নগর
আদালত, জেলা ও সেশন আদালত
পরিচালিত হয়
জেলা-প্রশাসনের অধীনে। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চায়েত (স্থানীয়
সরকার পরিচালন পর্যদ) চালু হয়।
স্বাস্থ্য ও কল্যাণ: ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, এইচআইভি/এইডস এবং
অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি এবং অন্ধত্ব
নিবারণ এবং কুষ্ঠ ও পোলিও চিকিৎসার জন্য গুজরাটে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা চালু রয়েছে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পারিবারিক স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যশিক্ষার
ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে রাজ্যজুড়ে রয়েছে বহু প্রাথমিক
স্বাস্থ্য কেন্দ্র। রাজ্যের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও
মেডিক্যাল কলেজসমূহ প্রধানত শহর এলাকায় অবস্থিত। ঐতিহ্যগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং
শিক্ষাগতভাবে সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়গুলোর
সহায়তার জন্য সরকার বিশেষ কর্মসূচিও
পরিচালনা করে আসছে।
শিক্ষা:গুজরাজটে নিম্নস্তর থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে
ভাদোদরার মহারাজা সয়াজীরাও ইউনিভার্সিটি অফ বরোদা (১৯৪৯), আহমদাবাদের গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৪৯)। প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আহমদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি (১৯৪৭, জাতীয়
মহাকাশ বিভাগের একটি সংস্থা), আহমদাবাদ টেক্সটাইল ইন্ড্রাস্ট্রিজ রিসার্চ এসোসিয়েশন (১৯৪৯), ভাবনগরের সেন্ট্রাল সল্ট এন্ড মেরিন কেমিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (১৯৫৯) এবং আহমদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইন (১৯৬১) এবং সর্দার প্যাটেল ইনস্টিটিউট অফ ইকোনমিক এন্ড সোস্যাল রিসার্চ (১৯৬৫) উল্লেখযোগ্য।
গবেষণা কেন্দ্র ছাড়াও গুজরাটে ক্ষুদ্রতর টার্সিয়ারি প্রতিষ্ঠানে বিশেষায়িত
শিক্ষযাকার্যক্রমের আওতায় রয়েছে বহু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও কারিগরি বিদ্যালয়। আহমদাবাদের ইন্ডিয়ার ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (আইআইএমএ) ভারতের অন্যতম সেরা একটি শিক্ষায়তন।
সাংস্কৃতিক জীবন: গুজরাটের সংস্কৃতির বড় অংশ জুড়ে আছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। পুরাণে বর্ণিত হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের (বিষ্ণুর
অবতার) জীবনের বিভিন্ন আখ্যান নির্ভর সংস্কৃতিচর্চা। জনপ্রিয় গর্বা নাচে কৃষ্ণের রাসলীলা বা রাসনৃত্যের সমকালীন পরিবেশনা পরিলক্ষিত হয়।
এই নাচটি সাধারণত নবরাত্রি উৎসবে পরিবেশিত হয়। গর্বা নাচে নারী-পুরুষ হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে হাতে তালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচে। নবরাত্রিতে গ্রামে ভাবাই
নামক জনপ্রিয় কৌতুকনাট্য পরিবেশিত হয়। এই নাটকের নারীপুরুষ সব চরিত্রে পুরুষ নটরাই অংশগ্রহণ করে।
স্থানীয় বৈষ্ণবদের রয়েছে কাব্য ও গানের নানা ধরনের চর্চা। বিখ্যাত বৈষ্ণব সাধু, কবি ও সংগীতজ্ঞের মধ্যে আছেন
পঞ্চদশ শতাব্দীতে পদকর্তা নরসিন (নরসিংহ মেহতা)। এরপর বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন
করেছিলেব রাজপুত রাজকন্যা মীরা বাঈ। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত ভজন ভারতের সকল প্রদেশেই
পরমভক্তিতে চর্চিত হয়ে থাকে। এছাড়া রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত কবি ও লেখক প্রেমানন্দ এবং
একই শতাব্দীর দয়ারাম যিনি সংগীত রচনা করে ভক্তিবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
জৈন ধারায় দ্বাদশ শতাব্দীর সৃজনশীল লেখক হেমচন্দ্র ভারতীয় দর্শনের ওপরঅনেকগুলো পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেন। তিনি সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ব্যাকরণগত ব্যাখ্যাও
তিনি রচনা করেছেন। তিনি জৈন দৃষ্টিভঙ্গীতে
মহাকাব্যিক বিশ্ব ইতিহাস রচনা করেন।
এছাড়া রয়েছে তাঁর অনেক কবিতা।
স্থাপত্যকীরতি: গুজরাটের প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তিতে রয়েছে শৈল্পিক ঐতিহ্য। রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সোমনাথ
ও দ্বারকা মন্দির এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া উত্তরে মোধেরা, ঘুমলি (পোরবন্দরের কাছে)-র থান, গিরনার পাহাড় এবং কাঠিয়াবর উপদ্বীপের পালিটানার মন্দির স্মৃতিসৌধের সৌন্দর্য বিস্ময়কর।
মুসলিম শাসনামলের বিশেষ স্থাপত্যিক রীতিতে হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের সন্নিববেশ ঘটেছে। আহমদাবাদে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর মসজিদ ও স্মৃতিসৌধ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়াও রাজ্যের নানাস্থানে আছে বহু
সিঁড়িকূপ, প্রাচীন অন্তভৌম নির্মাণ ও জলাধার। এখনও এসব সিঁড়িকূপের জল ব্যবহৃত হয়। পাতনে রানি কা ভাব (রানীর সিঁড়িকূপ) ২০১৪
খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত হয়।
কুটিরশিল্প: গুজরাটের কুটির শিল্প খুবই উচ্চমানের। বিশেষ করে হাতের কাজের
বিলাসী দ্রব্যে জন্য গুজরাট বিখ্যাত। এছাড়া রয়েছে যে সুরাটের সোনা ও রুপার জরির কাজ
করা জামনগরের বন্ধনী, উত্তর গুজরাটের পাতনের পাটোলা সিল্ক শাড়ির নাম উল্লেখযোগ্য। উত্তরাঞ্চলের ইদারের খেলনা, পালানপুরের সুগন্ধী দ্রব্য,
কানোদারের তাঁতের কাজের কথা সুবিদিত।
ইতিহাস
গুজরাটে রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় সবরমতী ও মাহি নদী উপত্যকায় প্রস্তর যুগের নির্দশন পাওয়া গেছে।
এ সকল নিদর্শন অনুসারে ধারণা করা হয় সিন্ধু (হরোপ্পা) সভ্যতার সঙ্গে এদের সম্পর্ক
ছিল। সম্ভবত গুজরাটে এই সভ্যাতর বিকাশ হটেছিল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দে।
কাথাইয়াড় উপদ্বীপের লোথাল, রংপুর, আমরি,
লখাববাল এবং রোযদিতে এই সভ্যতার নমুনা
পাওয়া যায়। গুজরাটের ইতিহাসের সাথে বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে মৌর্য রাজবংশের সাথে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী
এই রাজবংশের প্রভাব ছিল। সম্রাট অশোকের
কাথিয়াবর উপদ্বীপের গিরনার পর্বতের
শিলালিপি থেকে এ বিষয়ে অনুমান করা যায়। মৌর্য রাজ্যের পতনের পর গুজরাট শক বা পশ্চিমা ক্ষত্রপা (খ্রিস্টীয় ১৩০-৩৯০) শাসনাধীনে
চলে যায়। শক নেতৃত্বের সর্বোত্তম শাসক মহাক্ষত্রপা রুদ্রদমন সৌরাষ্ট্র (কাথিয়াবর উপদ্বীপের নিকটবর্তী) ও কচ্ছ এবং প্রতিবেশী মালবা ও অন্যান্য এলাকায় (যা এখন মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান) তাঁর শাসনাধীনে
এনেছিলেন। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত গুজরাট গুপ্ত সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। বালভি রাজ্যের মৈত্রক রাজবংশের হাতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
এরপর মৈত্রকরা প্রায় তিনশো বছর গুজরাট ও মালবা শাসন করে। রাজধানী বালভিপুরা
(কাথিয়াবাড় উপদ্বীপের পূর্ব উপকূলের নিকটবর্তী) ছিল বৌদ্ধ,বৈদিক ও জৈন শিক্ষাধারায় বড় কেন্দ্র। গুরজার প্রতিহারদের হাতে মৈত্রক রাজবংশের পতন ঘটে। এঁরা খ্রিষ্টীয়
অষ্টম ও নবম শতাব্দী পর্যন্ত এতদঞ্চল
শাসন করেন। এদের শাসনকালের অবসান ঘটে সোলাঙ্কি রাজবংশের উত্থানের ফলে। সোলাঙ্কিদের শাসনামলে গুজরাটের সর্বোচ্চ বিস্তৃতি ঘটে। এসময় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে।
পরবর্তী বাগেলা রাজবংশের কর্ণদেব বাগলাকে পরাস্ত করে
১২৯৯ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটে মুসলমান শাসনের পত্তন করেন আলাউদ্দিন খিলজি। গুজরাটের প্রথম স্বাধীন
সুলতান আহমদশাহ ১৪১১ খ্রিষ্টাব্দে আহমদাবাদ নগরের প্রতিষ্ঠা করেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ গুজরাট মুঘল শাসনাধীন হয়। এতদঞ্চলে তাদের শাসনক্ষমতা অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরে মারাঠারা গুজরাটে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দেব্দে গুজরাট ব্রিটিশ ইস্ট উন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক শাসনভুক্ত হয়। ১৮৫৭-৫৮
খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের পর গুজরাট ব্রিটিশ রাজশক্তির কর্তৃত্বাধীন হয় এবং ১০ হাজার বর্গ মাইল (২৬ হাজার বর্গ কিমি)
এলাকা এবং সৌরাষ্ট্র ও কচ্ছসহ অসংখ্য স্থানীয় রাজ্য নিয়ে গুজরাট প্রদেশ আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতার পর গুজরাট প্রদেশ বোম্বে রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত
হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এর সঙ্গে
কচ্ছ ও সৌরাষ্ট্রকে যুক্ত করা হয়। ১৯৬০
খ্রিষ্টাব্দের ১ মে ভারতের বোম্বে রাজ্য বর্তমানের গুজরাট
ও মহারাষ্ট্র বিভক্ত হয়।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কচ্ছের রণ্ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পয়লা জুলাই অস্ত্রবিরতি ঘটে। পরে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য উত্থাপিত হয়। ট্রাইবুনাল ভারতকে বিতর্কিত
ভূখণ্ডের নয়-দশমাংশ এবং পাকিস্তানকে এক-দশমাংশ প্রদানের রায় দেয়। দুই দেশের যুদ্ধ গুজরাটে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটে আবার সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে তপসিলি শ্রেণির সুরক্ষা
আন্দোলনের সূত্রে। নপরে তা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় পরিণত হয়। এ দাঙ্গা প্রায় পাঁচমাস
স্থায়ী হয়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে কচ্ছ জেলার ভুজে এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
সূত্র: