বাইজি
সংস্কৃত ভগিনী>
হিন্দি,
মারাঠি, গুজরারটি বহিনী>বাই>+জি (সম্মানার্থে)
বাংলা
বাইজি
পেশাদার নৃত্যগীতকারিণীর পেশাগত নাম বাই।
সম্মানার্থে পেশাগত নাম হিসেবে বাইজি শব্দ ব্যবহার করা
হয়। তবে পেশাদার নর্তকী ও গায়িকাকেও বাইজি বলা হয়।
মুসলমান শাসনামালে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে,অল্প বয়সী মেয়েদের বিশেষভাবে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের তালিম দিয়ে কণ্ঠশিল্পী ও
নৃত্যশিল্পী হিসেবে গড়ে তোলার রীতি চালু হয়েছিল। এদেরকে মূলত রাজদরবারে সঙ্গীত পরিবেশনার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হতো।
পূর্ণ শিক্ষাগ্রহণের পর এঁরা দরবারে নৃত্যগীত পরিবেশনের সুযোগ লাভ করতেন। মূলত এঁরা
রাজা, মহারাজা, জমিদার, আমলাবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, আসরে, রঙমহলে, বাগানবাড়িতে, প্রমোদবিহারে
নৃত্যগীত পরিবেশ করতেন। নৃত্যগীতে পটিয়সিনী ছাড়াও এঁদের সৌন্দর্যের বিশেষ কদর ছিল। কারণ অর্থ প্রাপ্তির সূত্রে
অধিকাংশ রাজা বা নবাবদের আসরে নৃত্যগীত পরিবেশন শেষে, তাঁদের দেহদান করতে হতো। ফলে নৃত্যগীতের জন্য এঁরা যেমন সম্মানিত
ছিলেন, তেমনি দেহদানের জন্য এঁরা নিন্দিতও ছিলেন। বাইজীদের নাচ-গানে মোহগ্রস্ত হয়ে
কোনো কোনো নবাব-রাজা-মহারাজা বা ধনাঢ্য ব্যক্তির পারিবারিক ও আর্থিক জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছিল।
সুন্দরী এবং নৃত্যগীতে পারদর্শিনী বাইজির অনেক সময় নিজদের বাড়িতে বাবুদের আসর
বসাতেন। এঁদের অনেকের বাঁধা খরিদ্দার ছিলেন। যাঁদেরকে রক্ষিতা হিসেবে বিবেচনা করা
হতো। কখনো কখনো কোনো কোনো রাজদরবারে সভা-শিল্পী হিসেবে দীর্ঘ দিন থাকতেন। এক্ষেত্রে
এঁরা আসরে নিয়মিত নৃত্যগীত পরিবেশেনের পাশাপাশি রাজার অঙ্কশায়িনী হতেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু দিকে বাইজিদের আনগোনো ছিল মূলত লক্ষ্ণৌ ও বেনারসে। এই সময় বঙ্গদেশের কোনো কোনো নৃপতি নিজেদের রাজদরবারে বাইজির আসর বসাতেন। খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বঙ্গদেশে বাইজিদের ব্যাপক আনাগোণা শুরু হয়েছিল অযোধ্যার বিতাড়িত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ-এর মাধ্যমে। ওয়াজেদ আলী শাহ-এর (১৮২২-১৮৯৭) কলকাতার মেটিয়া বুরুজ এলাকায় নির্বাসিত জীবনযাপনকালে, তাঁর রাজ দরবারে নিয়মিত সঙ্গীতের আসর বসতো। এই সভায় আসতেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুণী শিল্পীরা। সেই সাথে আসতেন স্বনামধন্য বাইজীরা। এসব বাইজার রাগসঙ্গীত ধ্রুপদ ও খেয়াল পরিবেশন করততেন। আধা শাস্ত্রীসঙ্গীত হিসেবে পরিবেশন করতেন ঠুমরী ও টপ্পা। আসরে বিশেষভাবে কদর ছিল কথক
নাচের। সব মিলিয়ে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাইজিদের জন্য পরিচিত ছিল লখনৌ, এলাহাবাদ, বেনারস, কানপুর, পাটনা, আগ্রা, বরোদা, কলকাতা, দিল্লি প্রভৃতি স্থান।
প্রাথমিক যুগের নামকরা বাইজিদের মধ্যে ছিলেন নিকি, আসরন,
জিন্নাত, বেগমজান, হিঙ্গুলা, মীর্জাজান, নান্নীজান, সুপনজান প্রমুখ।
উল্লেখ্য, নিকি বাইজি ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে
রাজা
রামমোহন রায়
-এর বাগানবাড়ীতে নৃত্যগীত পরিবেশন করে দেশী-বিদেশী রসিকজনের
মুগ্ধ করেছিলেন বলে যান যায়।।
পরবর্তীকালে খ্যাতিলাভকারী বাইজীদের মধ্যে ছিলেন শ্রীজান, মুশতারী,
মালকাজান
(বড়),
গহরজান, জদ্দনবাঈ, জানকী বা ছাপ্পান্ন ছুড়ি, জোরোবাঈ, আবদনবাঈ, নাছমীবাঈ, নীলম, রোশনারা, আসতারী, রসুলুন, কালীবাঈ, হীরাবাঈ, কেশরবাঈ, সরস্বতী, মুন্নী, কানীজান, আমিরজান, গাঙ্গু, বিদ্যাধরী, সিদ্ধেশ্বরী প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ঢাকায় বাইজীদের নাচগান শুরু হয়েছিল মুগল আমলে।
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সুবাহদার ইসলাম খাঁর দরবারে
বাইজিরা নৃত্যগীত পরিবেশন করতেন। তখন এদের বলা হতো ছিল ‘কাঞ্চনী’।
উনিশ শতকে ঢাকার নবাব নুসরাত জং, নবাব শামসুদ্দৌলা, নবাব কমরুদ্দৌলা এবং নবাব আবদুল গণি ও নবাব আহসানুল্লাহর সময়
বাইজিরা মেহফিল
মাতাতেন। সে সময়ে মেহফিল বসতো আহসান মঞ্জিল-এর রংমহল, শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল, দিলকুশার বাগানবাড়িতে। ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যেসব বাইজিদের
ভিতরে বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, লখনৌর প্রখ্যাত গায়ক ও তবলাবাদক মিঠন খানের নাতি সাপান খানের স্ত্রী সুপনজান।
১৮৭০-এর দশকে ঢাকার শাহবাগে নবাব গণির এক অনুষ্ঠানে মুশতারী বাই,ৰ
সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবদুল গফুর নাসখানের নজরে পড়েছিলেন। নবাব গণির দরবারে নাচ-গান করতেন পিয়ারীবাই,
হীরাবাই, ওয়ামুবাই, আবেদী বাই, আন্নু নান্নু ও নওয়াবীন বাই। ঢাকার অন্যান্য খ্যাতিমান বাইজীদের মধ্যে ছিলেন বাতানী, জামুরাদ, পান্না, হিমানী, আমিরজান, রাজলক্ষ্মী, কানী, আবছন প্রমুখ। এছাড়া কলকাতা থেকে মাঝে মধ্যে ঢাকায় মুজরো নিয়ে আসতেন মালকাজান বুলবুলি, মালকাজান আগরওয়ালী, জানকীবাই, গহরজান, জদ্দনবাই, হরিমতী প্রমুখ।
ঢাকার নবাবদের আসরে স্থান পেতেন প্রখ্যাত বাইরা। কিন্তু নিচের সারির বাইরা জীবিকার
জন্য গড়ে তুলেছিলেন উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাইদের সান্নিধ্য জন্য সাধারণ
বাইজি পাড়া। সে সময় বাইজী পাড়া হিসাবে পরিচিত ছিল গঙ্গাজলি ও সাচিবন্দর ছিল। ঢাকার ইসলাম পুর ও পাটুয়াটুলীর মোড় থেকে যে পথটি ওয়াইজঘাট নামে বুড়ি গঙ্গার দিকে চলে গেছে তার নাম ছিল গঙ্গাজলি। সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে তবলার বোল, সেতারের ঝঙ্কার আর নুপুরের নিক্কর গঙ্গাজলির পরিবিশ মুখরিত হয়ে উঠত।
সেখানে সৌখিন বাবুরা আসতেন। এদের ভিতরে একটু উঁচু দরের বাইজিরা থাকতেন দোতলা বাড়িতে।
দোতলায় ছিল তাঁদের আসরের জায়গা। আর নিচ তলায় থাকতো তাদের চাকর-বাকর ও বাবু
ধরার লোক। নাচ-গানের সাথে এরা দেহব্যবসা সমানভাবে চালিয়ে যেতো।
বাইজিদের ভিতরে অনেকে অভিনয় ও সঙ্গীতে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এদের মধ্যে
গহরজান ছিলেন উপমহাদেশে গ্রামোফোন রেকর্ডে কণ্ঠদানকারী প্রথম শিল্পী। তাঁর গানের রেকর্ড নং পি-০১ (হিজ মাস্টার ভয়েস)।
জদ্দনবাই চলচ্চিত্রে জড়িত হয়েছিলেন। প্রখ্যাত ভারতীয় চিত্রাভিনেত্রী নার্গিস (১৯২৯-১৯৮১)
ছিলেন তাঁরই কন্যা। বিশ ও তিরিশের দশকে ঢাকার আরেক নামকরা বাইজী দেবী বাঈ ঢাকার প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস (১৯৩১)-এ অভিনয় করেন। হরিমতী বাইজী গ্রমোফোন রেকর্ডে গান, বিশেষ করে নজরুল গীতি গেয়ে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে শ্রোতাচিত্ত জয় করেছিলেন।