১. অনার্য লোক সঙ্গীত: সেকালের ভারতের বসবাসকারী আদিবাসীদের গান, যা বংশ পরম্পরায় এখনো ভারতের বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যে চলে আসছে। এঁরা নানাভাবে আর্যদের দ্বারা নিগৃহীত হলেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা ছিল না। দু'একটি ছোটো বড় বিদ্রোহ দেখা দিলেও আর্য রাজারা তা কঠোরভাবে দমন করতেন। এঁরা মূলত আর্যদের এড়িয়ে চলার জন্য দুর্গম অরণ্যের ভিতরে নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে টিকে ছিলেন। আদিম আর্য লোকসঙ্গীত এবং অনার্য লোকসঙ্গীতের কোনো নমুনা আমাদের কাছে নেই।
ভারতের লোকসঙ্গীতের চর্চার ছিল প্রধানত ছিল সামাজিক অনুষ্ঠানাদি নির্ভর (বিবাহ, অন্নপ্রাসন, নবান্ন), মানবিক প্রেম, কিছু লোককাহিনি ও ধর্মীয় কাহিনিভিত্তিক গান। এ সকল গানের বাণী ছিল আঞ্চলিক ভাষারীতি (আঞ্চলিক উচ্চারণ এবং অর্থনির্ভর শব্দ) অনুসরণে। আঞ্চলিকতার বিচারে সুরের প্রকৃতিও ছিল ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। খাঁটি অনার্য জাতির সঙ্গীতের সুরের প্রকৃতির সাথে আর্যপল্লীগুলোর লোকসুরের পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। আবার আর্য-অনার্য লোকসঙ্গীতের সংগীতের মিশ্র ধারার সৃষ্ট লোকগানও ছিল। আঞ্চলিকতার বিচারে অনার্য লোকসঙ্গীতকে প্রাথমিক ভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ দুটি হলো-
- দ্রাবিড় লোকসঙ্গীত: এর বিকাশ ঘটেছিল দক্ষিণ ভারতে।
- উত্তরভারতীয় লোকসঙ্গীত: অরণ্যাচারী প্রোটো-অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর ভিতরে চর্চিত লোকগান।
২. আর্য-লৌকিক গান: আর্য পল্লীর সাধারণ মানুষের গান। উত্তর ভারত তথা আর্যবর্তের বসবাসকারী আর্য পল্লীর গায়করা আনন্দ-বেদনায়, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উপলক্ষে নিজেরা নতুন নতুন গান রচনা করে গান গাইতেন। অনেকাংশে এগুলো ছিল অব্রাহ্মণদের রচিত বা পরিবেশিত সংসারের আনন্দবেদনার গান। সামবেদের ভাষায় এসব গানকে উল্লেখ করা হয়েছে গ্রামগেয় গান। মতঙ্গমুনির রচিত বৃহদ্দেশী গ্রন্থে এই গানকে বলা হয়েছে দেশী গান। এই গানের চর্চা করতেন স্ত্রীলোকগণ, বালকগণ, রাখালগণ, রাজন্যবর্গ নিজের নিজের ইচ্ছানুসারে নিজের নিজের দেশভূমিতে অনুরাগ-সহকারে। এই সংজ্ঞা থেকে বিশেষভাবে জানা যায় আঞ্চলিক গানের উপস্থিতির কথা। বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ আর্যভাষাভাষীরা সাধারণভাবে নিজের নিজের দেশভূমিতে অনুরাগ-সহকারে পরিবেশন করতেন। আদিম ভারতী্য়-আর্যদের সাধারণ মানুষের সাথে ব্রাহ্মণদের গভীর সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক স্বার্থে। ঋষিরা সাধারণ অব্রাহ্মণদের যতই অস্পৃশ্য ভাবুক, তাদের অন্ন-বস্ত্রের যোগানদার হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে যেতেই হতো। অন্য দিকে পরকালের স্বর্গলোকে স্থান পাওয়ার উপায় এবং অবলম্বন ছিল ব্রাহ্মণরা। ফলে ধর্মের আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে তাঁরা ব্রাহ্মণদের সেবা করতেন।
৩. আদিম ভারতীয়-আর্যদের ধর্মগীত: আর্য ঋষিরা ধর্মীয় আদর্শে যে শ্রুতি রচনা করতেন, তার চর্চা শুধু তাদের শিষ্যদের ভিতরেই ছিল। এই সময় আর্য ঋষিরা তাঁদের ধর্মাদর্শনকে ছন্দে প্রকাশ করে তা শিষ্যদের শোনাতেন। এই ছন্দোবদ্ধ ধর্মবাণীর সাধারণ নাম ছিল ঋক। শিষ্যরা তা শুনে মুখস্থ করে নিতেন। এই শিষ্যরা আবার তাঁদের শিষ্যদের শোনাতেন। দীর্ঘকাল ধরে গুরুপরম্পরা এই ঋকসমূহ গুরু ও শিষ্যদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়েছিল। এই ঋকসমূহ শিষ্যরা শ্রবণের মাধ্যমে গ্রহণ করতেন, তাই এর নাম ছিল শ্রুতি। এই গানের বাণী ছিল বেদের ঋকসমূহ। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন (বেদব্যাস) ছন্দোবদ্ধ শ্রুতিসমূহের সংকলনের নাম দিয়েছিলেন বেদ।
বেদব্যাস বিষয়াঙ্গের বিচারে প্রাথমিকভাবে বেদকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ভাগ তিনটি হলো-
- ঋগ্বেদ:ঋগ্বেদ: দেবতাদের উদ্দেশ্যে রচিত ঋকের সংকলন।
- যজুর্বেদ: বৈদিক যুগে প্রচলিত যজ্ঞানুষ্ঠান বিষয়ক ঋকের সংকলন।
- অথর্ববেদ: লৌকিক জীবনের অবশ্যপালনীয় অংশের সংকলন।
এর বাইরে তিনি সাঙ্গীতিক আদর্শের বিচারে অতিরিক্ত অপর একটি বেদ যুক্ত করেছিলেন। এর নাম দেওয়া হয়েছিল সামবেদ। মূলত যজ্ঞানুষ্ঠানে যে সকল ছন্দোবদ্ধ ঋকসমূহ সুর-সহযোগে পরিবেশিত হতো- তার নাম ছিল সাম গান।
সামগানেরর ঋষিরা সুরেলা ওম্ ধ্বনি দিয়ে একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি করতেন। এরপর এরই রেশ ধরে ঋকগুলোকে সুরেলা করে পরিবেশন করতেন। এই সময় এঁরা একটি বিশেষ কম্পাঙ্কের ধ্বনিকে অনুসরণ করতেন। সামগানে অংশগ্রহকারী অন্যান্য ঋষিরা মূল গায়কের সাথে সুর মিলিয়ে সুরেলা ওম্ ধ্বনি উচ্চারণ করতেন। এরপর এঁরা নির্বাচিত কোনো শ্লোক ওই সুরে আবৃত্তি করতেন। এই বিচারে এই গান হয়ে উঠেছিল সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিতে নিবদ্ধ আবৃত্তি। হয়তো একটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি নির্ভর শ্লোকের আবৃত্তির এক ঘেঁয়েমি দূরীকরণের জন্য- তাঁরা আবৃত্তিতে অন্য ধ্বনি ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন। এর ফলে তাঁদের আবৃ্তিতে যুক্ত হয়েছিল দুটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি। সামবেদের সময় এসে এই সঙ্গীতোপযোগী তিনটি ধ্বনি বৃদ্ধি হয়েছিল।বৈদিক গানের ক্রমবিবর্তনের ধারার প্রাথমিক যে তিনটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির নাম পাওয়া যায়, তা হলো-
কালক্রমে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৭টি। বেদোত্তর কালের সঙ্গীতজ্ঞরা এই ৭টি ধ্বনিকে স্বরস্থানের বিচারে সাজিয়ে, প্রতিটি সঙ্গীতোপযোগীর ধ্বনির নাম দিয়েছিলেন। গানের কতগুলো স্বর ব্যবহৃত হবে, তার উপর ভিত্তি করে গানের জাতি নির্ধারিত হয়েছিল। এগুলো হলো-
- আর্চিক: একটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির গান
- গাথিক: দুটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির গান
- সামিক: তিনটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির গান। এই ধ্বনিগুলোর নাম ছিল- উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত।
- উদাত্ত: গলা ছেড়ে উচ্চস্বরে গাওয়া হতো। একালের বিচারে এগুলো ছিল তারার স্বর
- অনুদাত্ত: স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরের চেয়ে নিচু ও মোটা সুরে গাওয়া হতো। একালের বিচারে এগুলো ছিল উদারার স্বর।
- স্বরিত: উদাত্ত ও অনুদাত্তের মাঝে ব্যবহৃত ধ্বনি।
- আর্চিক: একটি স্বরের গান
- গাথিক: দুটি স্বরের গান
- সামিক: তিনটি স্বরের গান।
- স্বরান্তর: চার স্বরের গান। সামিকের তিনটি স্বরে অন্তরে চতুর্থ স্বর যুক্ত হয়েছিল। এই কারণে স্বরান্তর নামটি দেওয়া হয়েছিল।
- ঔড়ব: পাঁচ স্বরের গান। এর বৈদিক নাম ছিল ঔড়ুব।
- ষাড়ব: ছয় স্বরের গান
- সম্পূর্ণ: সাত স্বরের গান। উল্লেখ্য বৈদিক যুগে এই স্বরগুলোর নাম ছিল- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ক্রুষ্ট ও অতিস্বারয।
চর্চার বিচারে সামগানগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো-
- গ্রামগেয়: আর্যপল্লীর সাধারণ মানুষ এই গান পরিবেশন করতেন। এই গানগুলো ছিল মূলত আর্যপল্লীর লোকগান। অনেক সময় ঋষিরা যজ্ঞানুষ্ঠানের বাইরে এসে লোকালয়ের পূজাতে উদগীথ গান করতেন। ফলে লৌক-গান এবং যজ্ঞস্থালের গানের সংযোগ সাধিত হয়েছিল। সামবেদের এই গানগুলো সংকলিত হয়েছে পূর্বাচিকে।
- অরণ্যগেয়: এই গানের চর্চা করতেন আরণ্যে বসবাসকারী ঋষিরা। সামবেদের এই গানগুলো সংকলিত হয়েছে পূর্বাচিকে।
- উহ গান: রহস্যময় গান। ধারণা করা হয়, এই গান গ্রামগেয় গান থেকে উদ্ভব হয়েছিল। সামবেদের এই গানগুলো সংকলিত হয়েছে উত্তরার্চিকে।
- উহ্য গান: উহ গানের মতও এই গানকে রহস্যময় গান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধারণা করা হয়, এই গান গ্রামগেয় গান থেকে উদ্ভব হয়েছিল। সামবেদের এই গানগুলো সংকলিত হয়েছে উত্তরার্চিকে।
[বিস্তারিত পাঠ: সাম গান ]বৈদিক যুগের বাদ্যযন্ত্র
বৈদিক সাহিত্যসমূহ থেকে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের বিষয়ে জানা যায়। এসকল বাদ্যযন্ত্রের শ্রেণিকরণের বিষয়টি সে সময় গুরুত্ব পায় নি। এসকল বাদ্যযন্ত্রে প্রকৃতি হিসেবে বেদোত্তোর কালে শ্রেণিকরণ করা হয়েছিল। এই শ্রেণিকরণের সূত্রে উল্লেখ করা যায়- বৈদিক যুগে অবনদ্ধ, তত, শুষি যন্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল।
- অবনদ্ধ (চামড়া দ্বারা আচ্ছাদিত যন্ত্র): বৈদিক সাহিত্যে ছন্দ রক্ষা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান, যুদ্ধ-বিগ্রহে নানা ধরনের আনদ্ধ যন্ত্র ব্যবহৃত হতো। এগুলো ছিল- দুন্দুভি/ভূমি-দুন্দভি, গর্গর।
- তত (তারের যন্ত্র): নানা ধরণের তারের যন্ত্রের ভিতরে সবচেয়ে বেশী নাম পাওয়া যায় 'বীণা'। বীণার ছিল নান প্রকরণ। বীণার বাইরে পাওয়া যায় পিঙ্গ-নামক ছড় বাহিত তারের যন্ত্রের কথা। এছাড়া ধনুর্যন্ত্র হিসেবে ছিল পিঙ্গ। এর অন্য নাম রাবণাস্ত্র। বৈদিকযুগের ততযন্ত্রগুলো ছিল- পিঙ্গ।
- সুষির যন্ত্র: বায়ু তাড়িত যন্ত্রের ব্যবহার ছিল। বিশেষ ধরনের বাঁশ থেকে উৎপন্ন বাঁশি ব্যবহৃত হতো।
- ঘন যন্ত্র: কঠিন বস্তুর আঘাতে ছন্দ রক্ষার উপযোগী যন্ত্র। এই যন্ত্র তৈরিতে কাঠ বা ধাতু ব্যবহৃত হত।
পরবর্তী অধ্যায়: বেদোত্তর যুগ: (খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ -খ্রিষ্টীয় ১ম শতাব্দী)