রস
ভারতীয় নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার
শাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি পারিভাষিক শব্দে। রসের আক্ষরিক অর্থ হলো− আস্বাদনীয় বা
রসনাগ্রাহ্য গুণবিশেষ। এই বিচারে রস ছয় প্রকার। এগুলো হলো −মধুর, অম্ল, লবণ, কটু,
কষায়, তিক্ত। কিন্তু ভারতীয় নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে রসের রূপ ভিন্নতর। এই
রস সৌন্দর্যবোধের একটি ভিন্নতর দশায় উপস্থাপন করা হয়। প্রত্যক্ষ
স্বস্তি-অস্বস্তিবোধের সূত্রে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তা প্রত্যক্ষভাবে ইন্দ্রিয়ের অধীন। মানুষ একে বাস্তব সত্য দিয়ে অনুভব করে।
এই জগতের
নিয়ন্ত্রক হলো '
আমি
'
নামক সত্তা। এর অন্যতম অংশ হলো
মন আমি
মনের এই ব্যাপ্ত তিনটি স্তরে বিভাজিত।
-
মনোজগতের উপরিতল:
এই স্তরের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নির্ভর। এই কারণে এই স্তরটি বাস্তব ঘটনা বা
প্রপঞ্চের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। ধরা যাক, একটি ফুলের গন্ধ কাউকে
আনন্দ দান করে। এই আনন্দটি প্রত্যক্ষভাবে মনকে আলোড়িত করবে।
এই বিষয়টি ঘটবে মনের উপরিতলে। আবার আমি যদি বাস্তব জগতের কোনো বিষয়
সম্পর্কে জানতে চায়, তাহলে সে প্রথমে ইন্দ্রিয় দ্বারা তথ্য সংগ্রহ করবে।
এই বিষয় সম্পর্কে যদি সে তুলনা করতে চায়, তাহলে স্মৃতিতে রক্ষিত তথ্যের
সাহায্যে বর্তমান বিষয়ের তুলনা করবে। এই ঘটনাটি ঘটবে মনের উপরিতলে।
এই তলে মানুষ কোনো কল্পলোক
তৈরি করতে পারে না বা করে না।
-
মনোজগতের মধ্যতল: এই তল বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি স্তর।
একে বলা হয় কল্পজগৎ। এই জগতের মানুষ তৈরি করে নানা
কল্প-বাস্তব বিষয়। এর বিষয় সম্পূর্ণরূপে কল্পনার আশ্রয়ে গড়ে উঠতে পারে আবার
বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। এই স্তরে ঘটে মানুষের মনোগত সৃজনশীল বিকাশ।
বাস্তবতার সাথে সুসমন্বয়ে গড়ে উঠা সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে এর প্রকাশ ঘটে। এর
মধ্য দিয়ে শিল্পী এমন একটি ভিন্নতর জগৎ তৈরি করে, যার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়
বিশেষ কিছু আর্শিক দিক। এই সৃজনশীল দশায় সৃষ্টি হয়, 'তা হতে পারে' বা 'হয়ে থাকে'
এমন বিষয়। এক্ষেত্রে শিল্পী তার মনোজগতে একটি কল্পজগত
তৈরি করে এবং তার ভিতরে সত্যের সন্ধান করে।
ধরা যাক, আপনার একজন প্রিয় মানুষের উপর কেউ অত্যাচার করছে। এই মনের উপরিতলকে
আলোড়িত করবে। এই ঘটনা আপনাকে উত্তেজিত করবে। এর বহিঃপ্রকাশ হবে রাগ, দুঃখ
ইত্যাদি ভাবপ্রকাশের দ্বারা। এটি বাস্তব জগতের বিষয়। কিন্তু
কোনো নাট্যকার যখন রচনার মধ্য দিয়ে এর প্রকাশ ঘটাবে, তখন
তিনি নিজের মতি করে ঘটনাটি সাজাবেন। তাতে শিল্পীর কল্পনাও থাকবে, আবাস্তবতাও
থাকবে। এর ফলে তৈরি হবে- একটি সৃজনশীল শিল্পকর্ম। এই শিল্পকর্মটি যখন মঞ্চস্থ
হবে, তখন শ্রোতার কাছে যাতে বিশ্বাযোগ্যতা পায় তার নিরন্তর চেষ্টা থাকবে
অভিনেতারা। এখানে যদি ওই প্রিয়মানুষটি ওই নাটকে অংশগ্রহণ
করে, এবং নাটকের চরিত্র হিসেবে প্রিয়মানুষটি
অত্যাচারিত হয়। আপনি শিল্পকর্ম হিসেবেই সেটা নেবেন।
আপনার প্রিয়মানুষটির উপর অত্যাচারের এই
দৃশ্য দেখে আপনার বাস্তব জগতের প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। কারণ, ওই মুহূর্তে আপনি
নিজেও মনোজগতের দ্বিতীয় স্তরে থাকবেন। এই অবস্থায় আপনি এক ধরনের সততার সন্ধান করবেন
বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা দিয়ে। আপনার প্রিয় মানুষটি যখন অত্যাচারিত হতে থাকবে,
তখন আপনি বিচার করবেন- অত্যাচারীরা অত্যাচার করছে তার ধরন বাস্তব অত্যাচারের
মতো হয় কিনা। আপনার প্রিয় মানুষটি অত্যাচারিত হওয়ার সময়, যথাযথভাবে বাস্তবসম্মত
অভিনয় করছে কিনা। যদি সবই বাস্ততার অনুরূপ হয়, তা হলে আপনি
তাঁকে বাহবা দেবেন। না হলে আপনি তার মুণ্ডুপাত করবেন।
-
মনোজগতের গভীরতল:
এই তলে মানুষ অনেকাংশেই বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। মূলত
দেহটা থাকে ত্রিমাত্রিক বস্তুজগতে থাকে, কিন্তু মন থাকে নিজের বা অন্যের গড়া
বিমূর্ত-জগতে, তাতে বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা থাকে, কিন্তু সে অভিজ্ঞতা নব নব রূপে
প্রকাশ পায় একান্তই আপনার মতো করে, আপনার জন্য। মনোজগতের উপরিতলের আনন্দ
মধ্যতলে পরিণত হয় রসে। আর গভীরতলে তাই হয়ে উঠে রসোত্তীর্ণ। তাই এই জগতে মানুষ
নাটক দেখে কাঁদে।
এক্ষেত্রে দ্বিতীয়তলে সৃষ্ট সৌন্দর্য রসগ্রাহীকে এতটাই গভীরে টেনে নেয় যে, সে
রসজগতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে কারণে অভিনয় দেখে মানুষ কাঁদে, হাসে, ক্ষিপ্ত হয়ে
উঠে। শোনা যায় ইতালি অভিযান
শেষ নেপোলিয়ানের একদল সৈন্য,
লিওনার্দো দ্যা ভিন্সি
যে ঘরটিতে
The Last Supper
ছবিটি এঁকেছিলেন, সেই ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। যিশুখ্রিষ্টের
পরম ভক্তদের কেউ কেউ তখন, যিশুর সাথে প্রতারণাকারী জুডাথের উদ্দেশ্য জুতো ছুঁড়ে
মারে। ফলে সে সময়ও ছবিটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মূলত এই সৈনিকরা প্রথমে মনোজগতের
দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করে একটি রৌদ্ররস দ্বারা দ্রবীভূত হয়েছিল। এরপর এরা
ছবিটির বিষয়বস্তুটির সাথে এতটাই গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল যে, তাদের কাছে ছবির
জুডাথ মনের গভীরতলে বাস্তব হয়ে উঠেছিল। এখানে ছবির সৌন্দর্য নিয়ে সৈনিকরা মাথা
ঘামায় নি। ছবিটি নষ্ট হয়ে যাবে এটা নিয়ে তারা ভাবে নি। এই ছবিটি ঘটনাক্রমে একদল
মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তিকে নষ্ট করে দিয়েছিল। এই কারণে একে নষ্ট ছবিও বলা
যেতে পারে। কিন্তু একটি কারণে ছবিটি সৌন্দর্যের দাবিদার হয়ে উঠে। তা হলো এর
সততা এবং উপাদানের সমন্বয়ে যে সত্যটি প্রকাশিত হয়েছিল, তা সৈনিকদের বাস্তব জগত থেকে
ভুলিয়ে ঠেলে দিয়েছিল কল্পজগতে এবং একই সাথে কল্পজগতের ভিতরে বাস্তব সত্যের
সন্ধান লাভ করেছিল। সবমিলিয়ে ছবিটি ওই সৈনিকদের কাছে রসোত্তীর্ণ মানে পৌঁছেছিল।
রস ও রসের জগৎ
কল্পলোকের ভাবনার সাথে বাস্তবজগতের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টার ভিতরে
সামঞ্জস্য রক্ষা করাটা জরুরি। সততা এবং সামঞ্জস্যের ভিতর দিয়ে অভিনেতারা ছোটো ছোটো
আনন্দ তৈরি করেন। এই সব আনন্দের সমন্বয়ে গড়ে উঠে সুন্দর উপস্থাপন। আর ভিতর দিয়ে
মনের গভীরে যে নানারূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি এবং মনকে দ্রবীভূত করে, তাই হলো রস। ভারতীয়
দর্শনে নানান শাস্ত্রে নানাভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন −
-
ভরতের নাট্যশাস্ত্র বিচারে রস ৮ প্রকার। এগুলো হলো−শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ,
রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত। নাট্যশাস্ত্রের শান্তরসকে করুণ রসের
অন্তর্গত বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
-
কাব্যশাস্ত্রে রস ৯ প্রকার। এগুলো হলো−শৃঙ্গার, বীর, করুণ, অদ্ভুত, হাস্য,
ভয়ানক, বীভৎস, রৌদ্র ও শান্ত। কেউ কেউ এর সাথে বাৎসল্য নামক একটি অতিরিক্ত
রসের কথা বলে থাকেন। এই অতিরিক্ত প্রকরণ যুক্ত করলে রসের সংখ্যা দাঁড়ায়
১০টি।
কাব্যশাস্ত্রের ১০টি রস
১. শৃঙ্গার:
শৃঙ্গ শব্দের অর্থ হলো কামেদেব। শৃঙ্গের আর (আগমন) হয় যাতে, তাই শৃঙ্গার।
এর অপর নাম আদিরস। নরনারীর দৈহিক সম্ভোগের ইচ্ছায় যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়,
তাকেই শৃঙ্গার একেই বলা হয়। প্রেমপ্রকাশ কাব্যে এই রসের উপস্থিতি লক্ষ্য
করা যায়।
২.
বীর:
দয়া, ধর্ম, দান এবং যুদ্ধের
নিমিত্তে এই রসের উদ্ভব হয়। এর প্রত্যেকটির ভিতরে জয় লাভের ভাব থাকে। যার
দ্বারা প্রতিকুল পরিবেশকে পরাজিত করে জয়ী হওয়ার উদ্দীপনা প্রকাশ করা হয়।
একই সাথে এতে থাকে বীরোচিত প্রতীজ্ঞা। ভায়নক, শান্ত রস বিরোধী। যেমন
−
বারিদপ্রতিম স্বনে স্বনি
উত্তরিলা
সুগ্রীব; "মরিব, নহে মারিব রাবণে,
এ প্রতিজ্ঞা শূরশ্রেষ্ঠ, তব পদতলে!
-মেঘনাদ বধ, সপ্তম সর্গ। মধুসূদন
৩. করুণ:
আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হলে, অকল্যাণ
হলে, প্রিয়জন বিয়োগ ইত্যাদিতে এই রসের সৃষ্টি হয়। মূলত শোকের ভাব এতে
প্রকাশ পায়। শৃঙ্গার এবং হাস্যরস এর বিরোধী। যেমন
−
কাঁদিলা রাক্ষসবধূ তিতি
অশ্রুনীরে
শোকাকুলা। ভবতলে মূর্ত্তিমতী দয়া
সীতারূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
কহিলা−
সজল আঁখি সখীরে;−
"কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
-মেঘনাদ বধ, নবম সর্গ। মধুসূদন
৪. রৌদ্র: ক্রোধ রস
থেকে এই রস উৎপন্ন হয়। ক্রোধের উগ্রতা এবং ভয়ঙ্কর রূপ হলো এই রস। এই কারণে
ক্রোধকে এর স্থায়ীভাব হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অলঙ্কার শাস্ত্রে একে রক্তবর্ণ
ও রুদ্রদৈবত নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন
−
"কি কহিলি, বাসন্তি?
পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
-মেঘনাদ বধ, তৃতীয় সর্গ। মধুসূদন
৫. অদ্ভুত:
আশ্চর্যজনক কোনো বিষয় থেকে উদ্ভুত বিস্ময়কর ভাবই হলো অদ্ভুত রস। সাধারণ
অলৌকিক কোনো বিষয়কে এই রসকে উজ্জীবিত করা হয়। [বিস্তারিত:
অদ্ভুতরস
]
৬. ভয়ানক: ভয়
থেকে এই রসের উদ্ভব। বিপদজনক বা ভীতিপ্রত কোনো বিষয় থেকে মনে যে ভাবের
সঞ্চার হয়, প্রকাশই ভয়ানক।
৭. বীভৎস: কোনো কুৎসিৎ বিষয়ের প্রতি ঘৃণা থেকে বিভৎস
রসের সৃষ্টি হয়।
৮. হাস্য:
কৌতুকজনক বাক্য বা আচরণ থেকে এই রসের উদ্ভব হয়।
৯. শান্ত:
চিত্তকে প্রশান্ত দেয় এমন ভাব থেকে শান্ত রসের উদ্ভব হয়।
১০.বাৎসল্য:
সন্তানের প্রতি স্নেহের যে ভাবের উদ্ভব ঘটে, তাই বাৎসল্য
রস
রসাস্বাদনের স্বরূপ
প্রতিটি রসের রয়েছে নিজস্ব রূপ।
ছোটো ছোটো মৌলিক রূপের সমন্বয়ে রস পূর্ণরূপ লাভ করে। আবার এই রসের অনুভব সবার
ভিতরে সমান উদ্দীপনা জাগায় না বলে রসের কোনো সর্বজনীন আদর্শ রূপ নেই। তবে
ব্যক্তি বিশেষের কাছে কোনো আদর্শ রূপ গড়ে উঠতে পারে। তাই বলা যায়, প্রতিটি
ব্যক্তির কাছে রসের স্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন রকমের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু
রসের অনুভব অনেকের সাথে প্রায় এক হতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি এক হয় না। এর ফলে
সমমনা মানুষের কাছে রসের একটি গড় মান তৈরি হয়। এই গড় মানের বিচারে সমমনা
মানুষগুলো সমস্বরে বলতে পারে ওই গানটি করুণ। একই নাটক দেখে কেউ কাঁদে কেউ ততটা
বেদানার্ত হয়ে উঠে না। তাই একই শিল্পকর্ম কাউকে রসে সিক্ত করে, আবার কাউকে
রসোত্তীর্ণ করে।
শিল্পকর্মের রসের আস্বাদনে
কতকগুলো বিধি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। এই সকল বিধি গড়ে উঠে কিছু অবস্থার উপর, যা
রসগ্রাহীর মনের উপর প্রভাব ফেলে। এই সকল বিধিই মানুষকে রসজগতে বা রসোত্তীর্ণ জগতে
টেনে নিয়ে যায়। যেমন
১. অভিজ্ঞতা:
রসের সৃষ্টি এবং গ্রহণ, উভয় ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাটা প্রয়োজন। এই অভিজ্ঞতা গড়ে উঠবে
বিশেষ ধরনের মাধ্যমের দ্বারা সৃষ্ট রসের প্রকৃতি অনুসারে। যেমন রাগ সঙ্গীত একটি
মাধ্যম। রাগের মাধ্যমে রস সৃষ্টির অভিজ্ঞতা যেমন শিল্পীর থাকা দরকার তেমনি
শ্রোতারও থাকা দরকার। মূলত রসের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয় রসিক মন। এই
মনের অধিকর্তা 'আমি'। তাই 'আমি'-ই হলো মূল রসিক। আমি'র ভাণ্ডারে থাকে নানা
ধরনের আনন্দের অনুভূতি। আবার নানা ধরনের আনন্দের দ্বারা সৃষ্ট নানা ধরনে
সৌন্দর্যের স্মৃতিও আমি স্মরণ করতে পারে। মনের দ্বিতীয় স্তরে যে রসের জন্ম হয়,
কিন্তু তার মৃত্যু নেই। মনের গভীরে তার রূপ ঘুমিয়ে থাকে। যখনই 'আমি' কোনো
সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়ায়, মনের ভিতরের রসের অভিজ্ঞতা তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা
করে। মনের গভীরে ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো নতুন সৌন্দর্যে সংস্পর্শে সে জেগে উঠে।
মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রক্রিয়কের সাথে দ্রুত ভাব বিনিময় হয়।
২. নিবিড় নৈকট্য:
রসের সৃষ্টি এবং গ্রহণের জন্য শিল্পী এবং রসগ্রহণকারীর উভয়েরই বিষয়ের গভীরে
যাওয়ার ইচ্ছা থাকাটা জরুরী। শিল্পী যদি নিজে রসকে নিবিড়ভাবে অনুভব না করেন এবং
ওই অনুভব অনুসারে যথাযথ রসকে উপস্থাপন করতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে
সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে তাঁর নিবিড় নৈকট্য ঘটে নি। যাচ্ছে-তাইভাবে রসের উপস্থাপন
করাটা শিল্পের জন্য ক্ষতিকারক। একই ভাবে তাচ্ছিল্যের সাথে শিল্পকে গ্রহণ করাটা
উচিৎ নয়। বরং এটা অনেক সময় অপরাধের পর্যায়ে চলে যায়। সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রায়ই
দেখা যায়, সঙ্গীতানুষ্ঠান চলাকালে নিজেদের ভিতর অন্য বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন।
এটি শিল্পীকে অপমান করার পর্যায়ের অপরাধ। এই জাতীয় শ্রোতারা সারাজীবনে অসংখ্য
আসরে বসেও সঙ্গীতের রস নিতে পারেন না। এঁরা মূলত নিজেকে সঙ্গীতবোদ্ধা বা
সঙ্গীতরসিক হিসেবে জাহির করার জন্য আসরে আসেন। এটা তাদের একটি অহঙ্কারের বিষয়
হয়ে উঠে এই ভাবে 'আমিও ওই আসরে ছিলাম।'
৩. কল্প-বাস্তবতার দ্বন্দ্ব নিরসন: অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো বিষয়ের
সাথে বাস্তব কোনো বিষয়ের নিকট সম্পর্ক থাকে। শিল্পের প্রয়োজনে শিল্পী
বাস্তবতাকে অনেক সময় ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন। ঐতিহাসিক নাটকের ক্ষেত্রে দেখা
যায়, কাহিনি ফুটিয়ে তুলবার জন্য নাট্যকার নানা রকম সংলাপ ব্যবহার করেন। বাস্তবে
ঐতিহাসিক চরিত্রটি হয়তো ওইভাবে কথা বলতেন না। এক্ষেত্রে কাহিনির সাথে সামঞ্জস্য
রেখে সংলাপ রচিত হয়েছে কিনা সেটা দেখার বিষয়। ঐতিহাসিক নাটকের পোশাক,
আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে সততটা থাকা দরকার, কিন্তু সংলাপ, সঙ্গীত অঙ্গভঙ্গি
ইত্যাদির ভিতরে বাস্তবতা খুঁজতে যাওয়াটা রসগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটায়। এক্ষেত্রে
বাস্তবে সত্য আর শিল্পের সত্য একটি বিন্দুতে মিলিত হয় বটে, কিন্তু কোথাও কোথাও
বাস্তব সত্যকে শিল্পের সত্য অতিক্রম করে যায়। আর এই অতিক্রমের দ্বারাই মনের
দ্বিতীয় স্তরে রসের সৃষ্টি হয়। এই রস সৃষ্টির জন্য নাট্য পরিচালক আলো, শব্দ
ব্যাবহার করেন নানা ভাবে। মঞ্চকেও ব্যবহার করেন নান্দনিক অনুভূতি থেকে। নাটকের
রসকে দর্শকের মাঝে ফুটিয়ে তোলার জন্য এগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সংলাপের
দ্বারা যে করুণ রসের সৃষ্টি হবে, একটি বাঁশি বা বেহালার সুর তাকে আরও তীব্রতর
করে থাকে। অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টি মঞ্চে দেখানো হয়। বাস্তবতা অনুসরণ করে, মঞ্চে
গিয়ে বৃষ্টির ফোটা খোঁজাটা বোকামি। বুদ্ধমানের কাজ হবে নাটকটি দেখার সময়
ঝড়-বৃষ্টির অনুভূতিটা জাগে কিনা। যা নয় তাই দিয়ে বাস্তবের অনুভূতি প্রদানের
ভিতরই রয়েছে রস সৃষ্টির সার্থকতা। আবার শিল্পের নামে যথেচ্ছাচারও চলে না। যার
জন্য যতটুকু, তাতে ততটুকু সৌন্দর্যই মেশাতে হয়। কল্প-বাস্তবতার দ্বন্দ্ব নিরসনে
প্রয়োজন পরিমিতি বোধ। এই সংমিশ্রণে থামতে জানতে হয়। গল্পের গরু গাছে উঠে
রূপকথায়। সেখানে মানায়, কিন্তু শরৎচন্দ্রের মহেষ নামক গল্পের গরুকে গাছে চড়ালে,
নাট্যকার নিজেই নাট্যগুরু না হয়ে নাট্যগরু হয়ে যাবেন।
৪. সামঞ্জস্য:
রস সৃষ্টির জন্য শিল্পের ছোটো সৌন্দর্যকে সুসমন্বিত করা প্রয়োজন। কোনো কোনো
অভিব্যক্তি একাধিক রসকে জাগ্রত করে থাকে। চোখের জল কান্নার প্রতীক আবার তীব্র
আনন্দেরও প্রতীক। শুধু চোখের জল ফেললেই হয় না, সাথে মুখভঙ্গি, সামঞ্জস্যপূর্ণ
অঙ্গভঙ্গি না থাকলে, অভিনয়টাই নষ্ট হয়ে যায়। এরূপ রয়েছে পাগলের হাসি আর রসিকের
হাসি, বেদনার আহ্ আর শীৎকারের আহ্, গোগ্রাসে খাওয়া আর শান্ত হয়ে খাওয়া ইত্যদির
ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য থাকা রস সৃষ্টির জন্য জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, কণ্ঠ
সঙ্গীতের সাথে উৎকট সঙ্গীতযন্ত্রের ব্যবহার। বাদ্যযন্ত্রের যথাযথ ব্যবহারে
সঙ্গীতের রসকে উজ্জীবত করে, নইলে যন্ত্রের যন্ত্রণা বাড়ে। শিল্পী একই সাথে
স্রষ্টা এবং রসিক। তাই তাকে শুধু সৃষ্টির কথা ভাবলে হয় না, রসের কথাও ভাবতে হয়।
নইলে সৃষ্টিতে ভেজাল ঢুকে পড়ে।