রস
ভারতীয় নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি পারিভাষিক শব্দে। রসের আক্ষরিক অর্থ হলো− আস্বাদনীয় বা রসনাগ্রাহ্য গুণবিশেষ। এই বিচারে রস ছয় প্রকার। এগুলো হলো −মধুর, অম্ল, লবণ, কটু, কষায়, তিক্ত। কিন্তু ভারতীয় নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে রসের রূপ ভিন্নতর। এই রস সৌন্দর্যবোধের একটি ভিন্নতর দশায় উপস্থাপন করা হয়। প্রত্যক্ষ স্বস্তি-অস্বস্তিবোধের সূত্রে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তা প্রত্যক্ষভাবে ইন্দ্রিয়ের অধীন। মানুষ একে বাস্তব সত্য দিয়ে অনুভব করে।

এই জগতের নিয়ন্ত্রক হলো ' আমি ' নামক সত্তা। এর অন্যতম অংশ হলো মন আমি মনের এই ব্যাপ্ত তিনটি স্তরে বিভাজিত।
রসাস্বাদনের স্বরূপ
প্রতিটি রসের রয়েছে নিজস্ব রূপ। ছোটো ছোটো মৌলিক রূপের সমন্বয়ে রস পূর্ণরূপ লাভ করে। আবার এই রসের অনুভব সবার ভিতরে সমান উদ্দীপনা জাগায় না বলে রসের কোনো সর্বজনীন আদর্শ রূপ নেই। তবে ব্যক্তি বিশেষের কাছে কোনো আদর্শ রূপ গড়ে উঠতে পারে। তাই বলা যায়, প্রতিটি ব্যক্তির কাছে রসের স্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন রকমের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু রসের অনুভব অনেকের সাথে প্রায় এক হতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি এক হয় না। এর ফলে সমমনা মানুষের কাছে রসের একটি গড় মান তৈরি হয়। এই গড় মানের বিচারে সমমনা মানুষগুলো সমস্বরে বলতে পারে ওই গানটি করুণ। একই নাটক দেখে কেউ কাঁদে কেউ ততটা বেদানার্ত হয়ে উঠে না। তাই একই শিল্পকর্ম কাউকে রসে সিক্ত করে, আবার কাউকে রসোত্তীর্ণ করে। শিল্পকর্মের রসের আস্বাদনে কতকগুলো বিধি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। এই সকল বিধি গড়ে উঠে কিছু অবস্থার উপর, যা রসগ্রাহীর মনের উপর প্রভাব ফেলে। এই সকল বিধিই মানুষকে রসজগতে বা রসোত্তীর্ণ জগতে টেনে নিয়ে যায়। যেমন
১. অভিজ্ঞতা: রসের সৃষ্টি এবং গ্রহণ, উভয় ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাটা প্রয়োজন। এই অভিজ্ঞতা গড়ে উঠবে বিশেষ ধরনের মাধ্যমের দ্বারা সৃষ্ট রসের প্রকৃতি অনুসারে। যেমন রাগ সঙ্গীত একটি মাধ্যম। রাগের মাধ্যমে রস সৃষ্টির অভিজ্ঞতা যেমন শিল্পীর থাকা দরকার তেমনি শ্রোতারও থাকা দরকার। মূলত রসের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয় রসিক মন। এই মনের অধিকর্তা 'আমি'। তাই 'আমি'-ই হলো মূল রসিক। আমি'র ভাণ্ডারে থাকে নানা ধরনের আনন্দের অনুভূতি। আবার নানা ধরনের আনন্দের দ্বারা সৃষ্ট নানা ধরনে সৌন্দর্যের স্মৃতিও আমি স্মরণ করতে পারে। মনের দ্বিতীয় স্তরে যে রসের জন্ম হয়, কিন্তু তার মৃত্যু নেই। মনের গভীরে তার রূপ ঘুমিয়ে থাকে। যখনই 'আমি' কোনো সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়ায়, মনের ভিতরের রসের অভিজ্ঞতা তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। মনের গভীরে ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো নতুন সৌন্দর্যে সংস্পর্শে সে জেগে উঠে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রক্রিয়কের সাথে দ্রুত ভাব বিনিময় হয়।
২. নিবিড় নৈকট্য: রসের সৃষ্টি এবং গ্রহণের জন্য শিল্পী এবং রসগ্রহণকারীর উভয়েরই বিষয়ের গভীরে যাওয়ার ইচ্ছা থাকাটা জরুরী। শিল্পী যদি নিজে রসকে নিবিড়ভাবে অনুভব না করেন এবং ওই অনুভব অনুসারে যথাযথ রসকে উপস্থাপন করতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে তাঁর নিবিড় নৈকট্য ঘটে নি। যাচ্ছে-তাইভাবে রসের উপস্থাপন করাটা শিল্পের জন্য ক্ষতিকারক। একই ভাবে তাচ্ছিল্যের সাথে শিল্পকে গ্রহণ করাটা উচিৎ নয়। বরং এটা অনেক সময় অপরাধের পর্যায়ে চলে যায়। সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রায়ই দেখা যায়, সঙ্গীতানুষ্ঠান চলাকালে নিজেদের ভিতর অন্য বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। এটি শিল্পীকে অপমান করার পর্যায়ের অপরাধ। এই জাতীয় শ্রোতারা সারাজীবনে অসংখ্য আসরে বসেও সঙ্গীতের রস নিতে পারেন না। এঁরা মূলত নিজেকে সঙ্গীতবোদ্ধা বা সঙ্গীতরসিক হিসেবে জাহির করার জন্য আসরে আসেন। এটা তাদের একটি অহঙ্কারের বিষয় হয়ে উঠে এই ভাবে 'আমিও ওই আসরে ছিলাম।'

৩. কল্প-বাস্তবতার দ্বন্দ্ব নিরসন: অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো বিষয়ের সাথে বাস্তব কোনো বিষয়ের নিকট সম্পর্ক থাকে। শিল্পের প্রয়োজনে শিল্পী বাস্তবতাকে অনেক সময় ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন। ঐতিহাসিক নাটকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কাহিনি ফুটিয়ে তুলবার জন্য নাট্যকার নানা রকম সংলাপ ব্যবহার করেন। বাস্তবে ঐতিহাসিক চরিত্রটি হয়তো ওইভাবে কথা বলতেন না। এক্ষেত্রে কাহিনির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংলাপ রচিত হয়েছে কিনা সেটা দেখার বিষয়। ঐতিহাসিক নাটকের পোশাক, আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে সততটা থাকা দরকার, কিন্তু সংলাপ, সঙ্গীত অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদির ভিতরে বাস্তবতা খুঁজতে যাওয়াটা রসগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটায়। এক্ষেত্রে বাস্তবে সত্য আর শিল্পের সত্য একটি বিন্দুতে মিলিত হয় বটে, কিন্তু কোথাও কোথাও বাস্তব সত্যকে শিল্পের সত্য অতিক্রম করে যায়। আর এই অতিক্রমের দ্বারাই মনের দ্বিতীয় স্তরে রসের সৃষ্টি হয়। এই রস সৃষ্টির জন্য নাট্য পরিচালক আলো, শব্দ ব্যাবহার করেন নানা ভাবে। মঞ্চকেও ব্যবহার করেন নান্দনিক অনুভূতি থেকে। নাটকের রসকে দর্শকের মাঝে ফুটিয়ে তোলার জন্য এগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সংলাপের দ্বারা যে করুণ রসের সৃষ্টি হবে, একটি বাঁশি বা বেহালার সুর তাকে আরও তীব্রতর করে থাকে। অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টি মঞ্চে দেখানো হয়। বাস্তবতা অনুসরণ করে, মঞ্চে গিয়ে বৃষ্টির ফোটা খোঁজাটা বোকামি। বুদ্ধমানের কাজ হবে নাটকটি দেখার সময় ঝড়-বৃষ্টির অনুভূতিটা জাগে কিনা। যা নয় তাই দিয়ে বাস্তবের অনুভূতি প্রদানের ভিতরই রয়েছে রস সৃষ্টির সার্থকতা। আবার শিল্পের নামে যথেচ্ছাচারও চলে না। যার জন্য যতটুকু, তাতে ততটুকু সৌন্দর্যই মেশাতে হয়। কল্প-বাস্তবতার দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রয়োজন পরিমিতি বোধ। এই সংমিশ্রণে থামতে জানতে হয়। গল্পের গরু গাছে উঠে রূপকথায়। সেখানে মানায়, কিন্তু শরৎচন্দ্রের মহেষ নামক গল্পের গরুকে গাছে চড়ালে, নাট্যকার নিজেই নাট্যগুরু না হয়ে নাট্যগরু হয়ে যাবেন।
৪. সামঞ্জস্য: রস সৃষ্টির জন্য শিল্পের ছোটো সৌন্দর্যকে সুসমন্বিত করা প্রয়োজন। কোনো কোনো অভিব্যক্তি একাধিক রসকে জাগ্রত করে থাকে। চোখের জল কান্নার প্রতীক আবার তীব্র আনন্দেরও প্রতীক। শুধু চোখের জল ফেললেই হয় না, সাথে মুখভঙ্গি, সামঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি না থাকলে, অভিনয়টাই নষ্ট হয়ে যায়। এরূপ রয়েছে পাগলের হাসি আর রসিকের হাসি, বেদনার আহ্ আর শীৎকারের আহ্, গোগ্রাসে খাওয়া আর শান্ত হয়ে খাওয়া ইত্যদির ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য থাকা রস সৃষ্টির জন্য জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, কণ্ঠ সঙ্গীতের সাথে উৎকট সঙ্গীতযন্ত্রের ব্যবহার। বাদ্যযন্ত্রের যথাযথ ব্যবহারে সঙ্গীতের রসকে উজ্জীবত করে, নইলে যন্ত্রের যন্ত্রণা বাড়ে। শিল্পী একই সাথে স্রষ্টা এবং রসিক। তাই তাকে শুধু সৃষ্টির কথা ভাবলে হয় না, রসের কথাও ভাবতে হয়। নইলে সৃষ্টিতে ভেজাল ঢুকে পড়ে।