ভারতীয়
আর্য ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গীতজ্ঞদের মাধ্যমে
ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু এর যাত্রা শুরু হয়েছিল দূর অতীত থেকে।
ধারণা করা হয়, একদল মানুষ
১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর আগে আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ইউরোপ,
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। ৭৫ হাজার বৎসর আগে এদের একটি দল
আরব উপদ্বীপে পৌঁছায়। আর ৬০ হাজার বৎসরের ভিতরে এরা এশিয়া সংলগ্ন ইউরোপে বসতি
স্থাপন করে। ৪০ হাজার বৎসরে ভিতরে ইউরোপের
রাইন নদী থেকে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে
ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫ হাজার বৎসরের দিকে এদের একটি দানিয়ুব নদীর
তীরবর্তী বিশাল তৃণাঞ্চলে বসবাস করা শুরু করে। সে সময়ে বসবাস এদের ছিল মূল পেশা ছিল
পশুপালন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আন্তঃগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের সূত্রে এদের একটি দল এই
অঞ্চল ত্যাগ করে দার্দেনেলিশ প্রণালী হয়ে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫
হাজার বৎসরের দিকে এরা ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস নদী পার হয়ে মধ্য এশিয়ার বিস্তৃর্ণ
অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এদের একটি দল চলে যায় ইউরোপের দিকে, অপর দলটি চলে আসে ইরানের
দিকে। আর খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দের দিকে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা ভারতে
প্রবেশ করা। ইরানে যারা থেকে গিয়েছিল তাদেরকে বলা হয় ইন্দো-ইরানীয়।
ভারতে প্রবেশ করা জাতি গোষ্ঠীকে বলা হয় ভারতীয়
আর্য ভাষাভাষী।
বহিরাগত এই নৃগোষ্ঠীর মানুষের ছিল নিজের ভাষা ও সঙ্গীত। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০
থেকে ১৫০০ অব্দের ভিতরে এদের ভাষার পরিবর্তন ঘটেছিল। তাদের এই নব্যভাষায় রচিত
হয়েছিল বেদ। নবতর এই বেদের ভাষাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা বলে থাকে বৈদিক ভাষা। ভাষাগত
পরিবর্তনের পাশাপাশা এদের ধর্ম-দর্শনে এবং সঙ্গীতের পরিবর্তন এসেছিল।
আদিতে ঋষিরা ধর্মীয় উপলব্ধিতে থেকে নানা ধরনের শ্লোক তৈরি করেছিল। বৈদিক
যজ্ঞানুষ্ঠানে এ সকল শ্লোকের পাঠ করা হতো। আর
কিছু অংশ সুরে গাওয়া হতো। গান হিসেবে
ব্যবহৃত এই
শ্লোকগুলোকেই সাম বলা হতো।
ঋক্-ভিত্তিক বেদের নাম ঋগ্বেদ। একইভাবে বলা যায় সাম-ভিত্তিক বেদের সামবেদ। এই সাম
শব্দটি বৈদিক ভাষায় সেমেটিক বা ইন্দো-ইউরোপিয়ান শব্দ থেকে কৃতঋণ শব্দ হিসেবে গৃহীত
হয়েছিল। অবশ্য নিরুক্তিকার যাস্কের মতে- ঋকের দ্বারা যার পরিমাপ করা হয়েছে, তাই সাম।
বঙ্গীয় শব্দকোষে সাম শব্দের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও অর্থগত ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে-
√
সো
(অবসান করা)+
মন্
(মনিন্),
কর্তৃবাচ্য
...যজ্ঞসম্পাদনার্থ যে সকল ঋক গীত হয়'।
উল্লেখিত শব্দের বিশ্লেষণে 'সাম' শব্দের উৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। মূলত
ভক্তিমূলক গান হিসেবে সেমেটিক ভাষায় এই জাতীয় গানের অস্তিত্ব ছিল। দাউদের রচিত এরূপ
বহুগান হিব্রু বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সংকলিত এই গ্রন্থের হিব্রু নাম ছিল
সেফের তেহিল্লিম (sefer tehillim) ।
এর অর্থ ছিল প্রশস্তি-গ্রন্থ। ধারণা করা হয় এই
সঙ্গীত-সংকলনটি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর আগেই রচিত হয়েছিল। এতে ছিল দাউদের
৭৩টি গান, আসাফের ১২টি গান এবং কোরাহ-বংশীয় বাদক দলের ১১টি গান। হিব্রু থেকে গ্রিক
ভাষার বাইবেল রচনার সময় এর
নাম দেওয়া হয়েছিল প্সাল্মই (Psalmoi)
পরে এই শব্দ থেকে গ্রিক শব্দ।
psalmos
শব্দের উৎপত্তি ঘটেছিল। এই গানের সাথে সংঙ্কলনের
এর অর্থ গ্রহণ করা হয়েছিল- 'এমন ধর্মসঙ্গীত যা তারযন্ত্রের সাথে গীত হয়ৱ। এই সময় সেমেটিক ভাষা থেকে
ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষায় কৃতঋণ শব্দ হিসেবে যুক্ত হয়েছিল
psalmos শব্দ। ল্যাটিন ভাষায় এর নাম হয়েছিল
psalmus । আর
প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় শব্দটি প্রবেশ করেছিল psealm
হিসেবে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৫০০ অব্দের ভিতরে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠী যখন ভারতে
আর্য ভাষা-ভাষী হিসেবে প্রবেশ করেছিল, তখন প্রাক্-বৈদিক ধর্মদর্শন এবং
ধর্মানুষ্ঠানের নির্ধরিত গানের ব্যবহার তাদের জানা ছিল। বৈদিক যুগে ভাষার বিবর্তনে
psealm হয়ে গিয়েছিল সাম গান। বাংলায় বাইবেল অনুবাদের সময়
এই গানকে সামসঙ্গীত নামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আর্য ঋষিরা যজ্ঞের উপযোগী কতিপয় স্বর- অনুদাত্ত স্বরিত ও উদাত্ত স্বরস্থানে আবৃতি
করতেন। এগুলো ছিল একালের গানের উদারা মুদারা তারা স্বরাষ্টকের পরিমণ্ডলে। একালেও
এমন আবৃত্তি পাওয়া যায় গীতা পাঠ বা কোরান তেলাওয়াতে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সুরেলা আবৃত্তি
করেন- 'বৌদ্ধং শরণ গচ্ছামি'। বৈদিক যুগে খাঁটি গান করতেন লোকশিল্পীরা। যেখান থেকে
এসেছিল ষড়্জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম ধৈবত ও নিষাদ।
রাগ -এর
উৎপত্তি ও তার শ্রেণিকরণ
আর্য পল্লীতে গান ছিল, কিন্তু শাস্ত্রীয় বিধি ছিল না। ঋষি পল্লীতে ধর্মীয় অনুশাসনে
নিবদ্ধ সুরেলা আবৃ্ত্তি ছিল, কিন্তু গান ছিল। সেকালের কোনো কোনো ঋষি সকল গানকে
শাস্ত্রীয় বিধিতে সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর নিয়েছিলেন লোক শিল্পীদের কাছ থেকে
সুরের কাঠামো আর, ঋষি পল্লী থেকে নিয়েছিলেন সুর ও স্বর-বিষয়ক গবেষণালব্ধ পাঠ। এই
দুয়ের সম্মিলনে সৃষ্টি হয়েছিল সুরের চলনের বিধিবদ্ধ রূপ। তাঁরা দেখেছিলেন কিছু কিছু
গানের সুরে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। তখন তাঁরা এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের
বিচারে এ সকল সুরশৈলীর পৃথক পৃথক নামে চিহ্নিত করেছিলেন। এগুলো গবেষণার সূত্রেই রাগ
নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সঙ্গীতগুরুদের কেউ কেউ রাগকে যখন শাস্ত্রীয় বিধিতে বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন তখন, এর
সাথে সম্পর্কিত বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করে পারিভাষিক শব্দ প্রদান করেছিলেন। যেমন
ধরা যাক, অংশস্বর বা বাদী স্বরের কথা। এমন নয় যে, রাগ তৈরির আগেই বাদীস্বর তৈরি
হয়েছিল এবং এর সাথে সমবাদী স্বর, অনুবাদী স্বর, বিবাদী স্বর ইত্যাদি নির্ধরাণ করে
রাগ রচিত হয়েছিল। বরং এটাই সত্যিই যে বেশ কিছু সৃষ্টরাগের সুরশৈলী অনুসরণ করে, এসকল
স্বরের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বেশ কিছু রাগের সৃষ্টি হওয়ার পর যখন এদের শ্রেণিকরণের বিষয় এলো- তখন একাধিক রাগের
সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে অনুসরণ করার প্রয়োজন ছিল। এর জন্য প্রয়োজন হলো- একটি মৌলিক
ভিত্তি। এই ভিত্তিটি প্রথম পর্যায়ে নাম দেওয়া হয়েছিল গ্রাম। গ্রাম মূলত একালের
পাশ্চাত্য সঙ্গীতের স্কেলের মতো। ভারতীয় রীতিতে স্বরসপ্তক সপ্তক হিসেবে গণ্য করা
যায়। শুরুর দিকে সঙ্গীতগুরুর প্রতিটি স্বর থেকে গ্রামের বিন্যাস করেছিলেন। শেষ
পর্যন্ত টিকে ছিল ষড়্জ গ্রাম, মধ্যম গ্রাম এবং গান্ধার গ্রাম। ভরত তাঁর
নাট্যশাস্ত্রে শুধু ষড়্জ গ্রাম, মধ্যম গ্রামকেই গ্রহণ করেছিলেন।
গ্রাম থেকে স্বরের আরোহ-অবরোহের ভিত্তিতে অনুক্রমিক বিন্যাস তৈরি করা হয়েছিল। এর
নাম দেওয়া হয়েছিল মূর্চ্ছনা। মূর্ছনা ছিল মূলত একালের মেল বা ঠাটের অনুরূপ। শুরুর
দিকে গ্রাম এবং মূর্চ্ছনা-ভিত্তিক রাগের বর্গীকরণ শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত মৌলিক
কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল রাগ।
- বৈদিক যুগের
শেষে পৌরাণিকযুগে ভারতীয় সঙ্গীতধারায় সঙ্গীতের 'জাতি রাগ'-এর সূচনা হয় । খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে
রচিত রামায়ণ সাতটি শুদ্ধজাতির
রাগের কথা জানা যায়। একালের রাগের জাতি যে অর্থে
মান্য করা হয়, সে অর্থে রামায়ণের জাতি একই কিনা তা জানা যায় না। প্রাথমিকভাবে আমরা
ধরে নিতে পারি খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে জাতি রাগের সূত্রে রাগের বর্গীয়করণের
সূত্রপাত ঘটেছিল।
-
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী বা তার আগে আদি-নারদ
লিখিত 'শিক্ষা' নামক গ্রন্থ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থটি 'নারদীয় শিক্ষা'
নামেই অধিক পরিচিত। এ গ্রন্থে বৈদিক গানের আঙ্গিক বিশ্লেষণ এবং বৈদিক অবরোহী
স্বরের প্রকৃতি বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া এতে আছে গান্ধর্ব গানের রূপ নিয়ে বিশেষ
আলোচনা, লৌকিক আরোহী সপ্ত স্বরের বৈশিষ্ট্য, সামগানের সুরের সাথে লৌকিক স্বরের
ধ্বনিগত বিচার এবং ষড়্জ ও অন্যান্য স্বরের সৃষ্টি বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে।
এই গ্রন্থে প্রথম শ্রুতির উল্লেখ পাওয়া যায়। নারদ শ্রুতি সম্পর্কে বলেছেন–
দীপ্তায়তা করুণানাং মৃদুমধ্যময়োস্তথা
শ্রুতিনাং যোহবিশেষজ্ঞো ন স আচার্য উচ্যতে।
[দীপ্তা, আয়তা, করুণা ইত্যাদি পঞ্চশ্রুতি বিষয়ে যিনি বিশেষজ্ঞ নন, তাঁকে
আচার্য বলা যায় না।]
নারদের এই শ্রুতি মূলত স্বরের নামান্তর।
৫টি শ্রুতি ছিল মূলত স্বরের জাতি। তাই একে বলা হয় জাতি শ্রুতি।
এই
গ্রন্থে রাগ শব্দটি প্রথম পাওয়া যায়। নারদীয় শিক্ষায় বলা
হয়েছে-
তান রাগ স্বর গ্রাম মূর্চ্ছনাং তু লক্ষণম্
পবিত্রং পাবণং পুণ্যং নারদেন প্রকীর্তিতম।
এই শ্লোকে তান রাগ গ্রাম মূর্চ্ছনাকে পবিত্র ও কল্যাণকর
বলে আখ্যায়িত করেছেন।
শ্রেণিকরণে গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই গ্রামগুলোর নাম পাওয়া
ষড়্জ, গান্ধার ও মধ্যম (ষড়্জ-মধ্যম-গান্ধারা ত্রয়ো গ্রামঃ প্রকীর্তিতঃ)। এই তিনটি
গ্রামের আদ্যস্বরের নামকরণ করেছেন 'রাগস্বর'। গ্রামের অধীনস্থ মূর্চ্ছনা রাগের
অনুরূপ। তাই মূর্চ্ছনাকে রাগের আদ্যরূপ ধরলে, গ্রামকে ঠাট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে
পারে। এই গ্রামের অধীনে ছিল
গ্রামরাগ। নারদীয় শিক্ষায় গ্রামরাগের তালিকা পাওয়া যায়। এগুলো হলো ষড়্জগ্রাম,
পঞ্চম, কৈশিক, কৈশিকগ্রাম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিত, ষাড়ব ইত্যাদি। উল্লেখ্য গ্রামের
মূর্চ্ছনা থেকে এই গ্রামরাগের উৎপত্তি হয়েছিল।
-
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে ভরত রচনা
করেন 'নাট্যশাস্ত্র'। এই গ্রন্থে গ্রামের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় দুটি। এই গ্রাম
দুটি হলো- ষড়্জ গ্রাম ও মধ্যম গ্রাম (দ্বৌগ্রামৌ ষড়্জোমধ্যমশ্চেতি)। এই
গ্রন্থে শ্রুতি, স্বর, মূর্চ্ছনা, নৃত্য, নাট্য ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ বিবরণ
পাওয়া যায়। তাঁর বইতে দুটো বিকৃত স্বর পাওয়া যায়। এই স্বরদুটি হলো–
অন্তর
গান্ধার ও কাকলী নিষাদ। এই গ্রন্থে নারদের ৫টি শ্রুতি ২২টি শ্রুতিতে পরিণত হয়।
এর অর্থ স্বরসমূহের সুক্ষ্ম ব্যবধানের ভিত্তিতে ভরত ২২টি শ্রুতিকে প্রতিষ্ঠিত
করেছিলেন। যেহেতু স্বরের ধারণা তখন প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই কোনো শ্রুতিতে কোন স্বর
স্থাপিত হবে, তার নির্দেশনা এই গ্রন্থে ছিল। তবে
শ্রুতিগুলোর কোনো নাম পাওয়া যায় না।
-
খ্রিষ্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতাব্দী মতঙ্গমুনি রচনা
করেন 'বৃহদ্দেশী' নামক গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি ভরতে নাট্যশাস্ত্রের পরে রচিত
হলেও গান্ধার গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি তিনটি গ্রাম এবং মূর্চ্ছনা নিয়ে
বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে টকী, সাবীরা, মালবপঞ্চম, ষাড়ব, বট্টরাগ,
হিন্দোলক ও টক্ককৌশিক নামক সাতটি জাতির উল্লেখ করেছেন।
-
খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দীতে
লিখিত কুড়ুমিয়ামালাই প্রস্তর লিপিতে ৭টি স্বর, ৩টি গ্রাম, ২১টি মূর্চ্ছনা এবং
তান ৫১টি। আর এর সমবেত রূপের নাম দেওয়া হয়েছে 'স্বরমণ্ডল'।
সপ্ত স্বরাস্ত্রয়ো গ্রামা মূর্চ্ছনাস্ত্বেকবিংশতি।
তানা একোনপঞ্চাশদিত্যেতৎ স্বরমণ্ডলম্॥
-
খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ
শতাব্দীর ভিতরে গ্রাম, শ্রুতি, স্বর ইত্যাদি নিয়ে নানারূপ গ্রন্থ রচিত হয়। এর
পাশাপাশি রাগের শ্রেণিকরণে রাগ-রাগিণীর ধারণা প্রচলিত হয়। ফলে গ্রামরাগ ও
রাগ-রাগিণীর দুটি বর্গীয়করণ রীতি পাশাপাশি চালু হয়ে যায়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এই দুটি ধারার ভিতরে
ধারাবাহিকতা বা আন্তঃসম্পর্ক ছিল না। রাগ-রাগিণীর
ধারণা জন্মলাভ করেছিল, অনেকটা লেখকদের স্বচ্ছাচারিতায়। এ বিষয়ে কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়
তাঁর 'গীতসূত্রসার' গ্রন্থে রাগের এরূপ শ্রেণি-বিন্যাসের ত্রুটিকে এই ভাবে উল্লেখ
করেছন–
কোন একটি স্থায়ী নিয়ম
অবলম্বন করিয়া রাগ-রাগিণীগুলি শ্রেণীবদ্ধ হয় নাই। উহা গ্রন্থাকারগণের
স্বেচ্ছাধীন কল্পনা মাত্র। তাঁহারা সুরের মধ্যে প্রবেশ না করিয়া যাহা পাইয়াছেন
সমস্ত ষড়ে-সাপ্টায় সংগ্রহ করিয়া গ্রন্থীকৃত করিয়াছেন। স্বরবিন্যাসের প্রকৃতিগত
সাদৃশ্যানুসারে রাগ-রাগিনী শ্রেণীবদ্ধ করিয়া যাইলে হিন্দুসঙ্গীতের আরো গৌরব
হইত, তাহাতে সন্দেহ নাই।'
রাগ-রাগিণীর শ্রেণি-বিভাজনে নানা মতও ছিল।
তবে সকল মতেই রাগের শ্রেণীকরণ করা হয়েছিল পরিবারের আদলে। এত রাগ ছিল গৃহস্বামীর মতো। প্রতিটি রাগের স্ত্রী ছিল। এদেরকে বলা হতো রাগিণী। এছাড়াও কেউ কেউ এই রাগ-রাগিণীদের পুত্র ও
পুত্রবধুদের নিয়ে বিশাল সংসার কল্পনা করেছেন। এই সব রাগ এবং এর পরিবারের সদস্যদের
নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত ছিল। এর ভিতরে চারটি মত অধিক প্রচলিত। এই মতগুলো হলো−
ব্রহ্মা মত: এই মতে রাগের সংখ্যা
৬টি। আর প্রত্যেকটি রাগের অধীনে ছিল ৬টি করে রাগিণী। এই মতানুসারে রাগ-রাগিণীর
তালিকা দেওয়া হলো।
-
১. রাগ: ভৈরব
-
রাগিণী :
ভৈরবী, গুর্জ্জরী,
রামকলী, গুণকলি, সৈন্ধবী, বাঙ্গালী
-
২.
রাগ: শ্রী
-
রাগিণী:
মালশ্রী, ত্রিবেণী, গৌরী, কেদারী,
মধুমাধবী, পাহাড়ী
-
৩. রাগ: মেঘ
-
রাগিণী:
মল্লারী, সৌরাটি, সাবেরী, কৌশিকি,
গান্ধারী, হরশৃঙ্গারী
-
৪. রাগ: বসন্ত
-
রাগিণী: দেশী, দেবগিরী,
বরাটী, তোড়ি, ললিতা, হিন্দোলী
-
৫.রাগ: পঞ্চম
-
রাগিণী: বিভাষ, ভূপালী,
কর্নাটী, বড়হংসিকা, মালবী, পটমঞ্জরী
-
৬. রাগ: নট
-
রাগিণী: কামোদী, কল্যাণী,
আভিরী, নাটিকা, সারঙ্গী, হাম্বির
কল্পিনাথ
মত: এই মতে রাগের সংখ্যা ৬টি। আর প্রত্যেকটি রাগের অধীনে ছিল ৬টি করে
রাগিণী। এই মতানুসারে রাগ-রাগিণীর তালিকা দেওয়া হলো।
- রাগ: শ্রী
- রাগিণী:
গৌরী, কোলাহল, ধবল, বরোরাজী বা রদারঙ্গী,
মালকোষ, দেবগান্ধার
- রাগ: পঞ্চম
- রাগিণী:
ত্রিবেণী, হস্তান্তরিহতা বা
স্তম্ভতীর্থীকা-খমাইচী, আভিরা বা আহিরী, কোকভ, বরারী, আশাবরী
- রাগ: ভৈরব
- রাগিণী:
ভৈরবী, গুর্জ্জরী, বেলাবেলী,
বিহাগ বা বাদহংসী, কর্ণাট, কানাড়া বা ভাষা
- রাগ মেঘ
- রাগিণী:
বাঙ্গালী, মধুরা বা মুদ্রা, কামোদী, ধানশ্রী,
দেবতীর্থী, দেবলী বা তীর্থকী
- রাগ: নটনারায়ণ
- রাগিণী:
তরবঙ্কী বা দেবলী, তিলঙ্গী বা তিলকি, পুর্ব্বী,
গান্ধারী, রাম বা বিরাম, সিন্ধুমল্লারী বা শুদ্ধমল্লারী
- রাগ: বসন্ত
- রাগিণী:
আন্ধালী, গমকী, পটমঞ্জরী, গৌড়গিরি, ধামকী বা
টঙ্কা, দেবশাখ
হনুমন্ত
মত: এই মতে রাগের সংখ্যা ৬টি। আর প্রত্যেকটি রাগের অধীনে ছিল ৫টি করে
রাগিণী। এই মতানুসারে রাগ-রাগিণীর তালিকা দেওয়া হলো।
-
রাগ: ভৈরব
-
রাগিণী:
মধ্যমাদি, ভৈরবী, বাঙ্গালী, বরাটিকা, সৈন্ধবী
-
রাগ: কৌশিক
-
রাগিণী:
তোড়ি, খাম্বাবতী, গৌরী, গুণকিরি, ককুভা
-
রাগ: হিন্দোল
-
রাগিণী:
বেলাবেলী, রামকিরি, দেশাখ্য, পটমঞ্জরী, ললিতা
-
রাগ: দীপক
-
রাগিণী:
কেদারী, কানাড়া, দেশী, কামোদী, নাটিকা
-
রাগ: শ্রী
-
রাগিণী:
বাসন্তী, মালবী, মালশ্রী, ধন্যাসীকা, আশাবরী
-
রাগ: মেঘ
-
রাগিণী:
মল্লারী, দেশকারী, ভূপালী, গুর্জ্জরী, টঙ্ক
ভরত মত: এই ভরত নাট্যশাস্ত্রের
রচয়িতা ভরত নন। এই মতে মোট রাগের
সংখ্যা ৬টি রাগ। প্রতিটি রাগের রয়েছে ৫টি রাগিণী ৫টি পুত্র এবং ৫টি পুত্রবধু
হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ভাগের তালিকা নিচে দেওয়া হলো।
-
রাগ: ভৈরব
-
রাগিণী:
মধুমাধবী, ভৈরবী, বাঙ্গালী, বরারী, সৈন্ধবী
-
পুত্র:
বিলাবল, পঞ্চম, দেসাখ্য, দেবগান্ধার, বিভাষ
-
পুত্রবধূ: রামকলী,
সুহাই, সুঘরাই, পটমঞ্জরী, তোড়ি
-
রাগ: মালকোষ
-
রাগিণী:
গুণকলী, খাম্বাবতী, গুর্জ্জরী, ভূপালী, গৌরী
-
পুত্র: সোম, পরাশন,
বড়হংস, ককুভ, বাঙ্গাল
-
পুত্রবধূ: সুরঠী,
ত্রিবেণী, কর্ণাটি, আশাবরী, গোড়গিরি
- রাগ: হিন্দোল
-
রাগিণী: বেলাবলী, দেশাখী, ললিতা, ভীমপলাশী, মালবী
- পুত্র: রেখবহংস,
বসন্ত, লোকহাস, গান্ধর্ব্ব, ললিত
- পুত্রবধূ: কেদারা, কামোদী, বেহাগরা, কাফি, পরজ
- রাগ: দীপক
-
রাগিণী: নট, মল্লারী, কেদারী, কানাড়া, ভারেকা
- পুত্র: শুদ্ধকল্যাণ, সোরাঠ, দেশকার, হাম্বির, মারু
- পুত্রবধূ: বড়হংসী, দেশবরাটি, বৈরাটি, দেবগিরি, সিন্ধুরা
- রাগ: শ্রী
-
রাগিণী: বাসন্তী, মালবী, মালশ্রী, সাহানা, ধনাশ্রী
- পুত্র: নট, ছায়ানট,
কানাড়া, ইমন, শঙ্করাভরণ
- পুত্রবধূ: শ্যাম, পুরিয়া,
গুর্জ্জরী, হাম্বিরী, আড়ানা
- রাগ: মেঘ
-
রাগিণী: সারঙ্গ, বঙ্গা, গান্ধর্ব্ব, মল্লারী, মূলতানী
- পুত্র: বাহাদুরী,
নটনারায়ণ, মালব, জয়তি, কামোদ
- পুত্রবধূ: পাহাড়ী, জয়ন্তী, গান্ধারী, পুরবী, জয়জয়ন্তী
- খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে
শার্ঙ্গদেব রচনা করেন 'সঙ্গীত রত্নাকর'। এই গ্রন্থে গ্রামের ভিত্তিতে রাগের
বর্গীয়করণের বিষয়টই প্রাধান্য পেয়েছে।
- খ্রিষ্টীয় ১৪শ-১৫শ শতাব্দীর ভিতরে রাগের বর্গীকরণে
নূতন ধারার সূচনা হয়। এই সময়ে রচিত মাধব বিদ্যাবরণ-এর রচিত 'সঙ্গীতসার' গ্রন্থে
প্রথম 'মেল' নামক রাগ বর্গীকরণের কথা জানা যায়। এই গ্রন্থে মাধব বিদ্যাবরণ মোট ১৫টি মেল
এবং ৫০টি জন্যরাগের পরিচয়ও পাওয়া
যায়।
- ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পণ্ডিত রামামাত্য রচনা করেন 'স্বরমেলকলানিধি'
গ্রন্থ। এই গ্রন্থটিতে তিনি ২০টি মেলের উল্লেখ পাওয়া যায়। একই সাথে ৬৪টি
জন্যরাগের ধারণা পাওয়া যায় এই গ্রন্থ থেকে। রামাদিত্য এই গ্রন্থে আদি ও শুদ্ধ
মেল হিসেবে উল্লেখ করেছেন 'মুখারী'। তিনি এই গ্রন্থে গ্রামের কথা স্বীকার
করেছেন। তাঁর মতে, এই গ্রামের মূর্চ্ছনা মধ্যশ্রুতি থেকে শুরু। বীণা প্রকরণ,
মেল প্রকরণ বর্ণনা করে রাগ প্রকরণে গ্রন্থ শেষ করেছেন। তিনি রাগের পুরুষ-স্ত্রী
বিভাগ অগ্রাহ্য করেছেন।
- ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দের পুণ্ডরীক বিট্ঠল্
তাঁর রচিত 'সদ্রাগচন্দ্রোদয়' গ্রন্থে ১৯টি মেলের উল্লেখ করেছেন। পরে তিনি তাঁর
'রাগমঞ্জরী' গ্রন্থে মেল বা মেলরাগ হিসেবে রামামাত্য-এর মত মেনে নিয়ে ২০টি
মেলের ধারণা দেন। মুণ্ডরীকও রামাদিত্যের মতানুসারে এই গ্রন্থে আদি ও শুদ্ধ মেল
হিসেবে উল্লেখ করেছেন 'মুখারী'।
- ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পণ্ডিত সোমনাথ
রচনা করেন 'রাগবিরোধ' নামক একটি গ্রন্থে মেল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই
গ্রন্থে ২২টি শ্রুতিকে স্বীকার করেছেন। এই গ্রন্থে মেলের সংখ্যা নির্ধারণ করেন
২৩টি এবং ৭৭টি জন্যরাগের ধারণা দেন। এই গ্রন্থে তিনি মেলের সমার্থক শব্দ হিসেবে
ঠাট শব্দও ব্যবহার করেছেন। তিনি রাগ-রাগিণীর শ্রেণিবিভাজন না মানলেও আলোচনার
ক্ষেত্রে এই শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন।
- ১৬৩০-৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পণ্ডিত
ব্যাঙ্কটমখী তাঁর 'চতুর্দণ্ডিপ্রকাশিকা' গ্রন্থে মেলের সংখ্যা ৭২টি উল্লেখ
করেন। তবে কাজের সুবিধার জন্য ১৯টি মেলের কথা উল্লেখ করেছেন।
- খ্রিষ্টীয় ১৭শ শতাব্দীর সঙ্গীতজ্ঞ লোচন
পণ্ডিত (জন্ম আনুমানিক ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর 'রাগ তরঙ্গিনী'
গ্রন্থে ১২টি মেলের বিচারে রাগের শ্রেণিকরণকে নির্দেশিত করেছেন।
- খ্রিষ্টীয় ১৮শ
শতাব্দীতে রাজা তুলাজীরাও ভোঁশলে 'রাগলক্ষণম' একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই
গ্রন্থে ব্যাঙ্কটমখীর ৭২ মেল বা ঠাট মেনে নিয়ে যে তালিকা তৈরি করেন, তাতে কিছু
ঠাটের নামগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
- ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে পাটনার রইস মুহম্মদ
রজা সাহেব 'নগমাতে আসফী' নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এ গ্রন্থে সর্বপ্রথম
বিলাবলকে শুদ্ধ ঠাট বলে প্রচার করেন। রাগ বর্গীকরণে তিনি পুরানো রাগ-রাগিণী
পদ্ধতির সংস্কার সাধন করে নতুন ভাবে ছয় রাগ ও ছত্রিশ রাগিণী নির্ধারিত করেছেন।
উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত মিলে ঠাট বা রাগের
যে তালিকা পাওয়া যায়, তার তালিকা দেখুন।
[দক্ষিণ ভারতীয়:
মেল
তালিকা (সঙ্গীতকোষ)]
[ভাতখণ্ডে প্রণীত উত্তরভারতীয় ঠাট:
ঠাট (সঙ্গীত কোষ)]
সূত্র:
-
বঙ্গীয় শব্দকোষ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস । প্রথম খণ্ড। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ ভারতীয়
-
সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরী। বৈশাখ ১৩৭২। রাগ ও রূপ। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ। জুলাই ১৯৯৯।
-
সঙ্গীত কথা। অপূর্বসুন্দর মৈত্র। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপুস্তক পর্ষদ। এপ্রিল ১৯৮৬।
-
সঙ্গীত পরিচিত (উত্তরভাগ)।
শ্রীনীলরতন বন্দ্যোপাধ্যায়। হসন্তিকা প্রকাশিকা। জন্মাষ্টমী: ৫ই ভাদ্র '৮০। ২১
আগষ্ট '৭৩
-
সঙ্গীত শাস্ত্র। তৃতীয় খণ্ড। শ্রীইন্দু ভূষণ রায়।
-
সরল বাংলা অভিধান। সুবলচন্দ্র মিত্র
-
হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পদ্ধতি
(১-১১
খণ্ড)।
পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে।
সম্পাদনা: ধরিত্রী রায়, অসী,কুমার চট্টোপাধ্যায়