সত্তাতত্ত্ব
বানান বিশ্লেষণ :  স্+অ+ত্+ত্++ত+অ+ত্+ত্+অ
উচ্চারণ : ʃɔ.a (শত্. তা)।

সত্তা=শত্.তা [এই শব্দের স ধ্বনি শ-এর মতো উচ্চারিত হয়। এর পরবর্তী ত্.তা ধ্বনির ত্ আগের শ ধ্বনির সাথে যুক্ত হয়ে, একাক্ষর শৎ ধ্বনি তৈরি করে। এরপর অবশিষ্ট তা ধ্বনি একাক্ষর ধ্বনি হিসেবে প্রকাশ পায়]

শব্দ-উৎস: সংস্কৃত सत्ता + तत्त्व (সত্তা+তত্ত্ব)>বাংলা সত্তাতত্ত্ব।
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: সত্তা বিষয়ক যে তত্ত্ব/মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস।
পদ: বিশেষ্য

ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা {| অধিবিদ্যা | দর্শন | মানবিক বিজ্ঞান | জ্ঞান-শাখা | জ্ঞানস্বক্ষেত্র | ্রজ্ঞা | জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক বিষয় | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্ত | সত্তা |}
অর্থ: অধিবিদ্যার অংশ হিসেবে প্রাকৃতিক যে কোনো বিষয় বা যার সম্পর্কে ধারণা বিদ্যমান আছে, এমন সকল কিছুর বৈশিষ্ট্যের ভিতর দিয়ে জানার প্রচেষ্টা।

ইংরেজি:
ontology<ল্যাটিন ontologia< গ্রিক ont (সত্তা সম্বন্ধে)+ logy হলো- বিজ্ঞান, অনুশীলন, সূত্র।
 

দর্শনের বিচারে সত্তাতত্ত্ব
১৬১৩ থেকে ১৭২১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ইংরেজি ভাষায় শব্দটি অনুপ্রবেশ করেছে
Ontology হিসাবে। বাংলাতে এর সমার্থ হতে পারে- সত্তাতত্ত্ব (সত্তা বিষয়ক তত্ত্ব=সত্তাতত্ত্ব/কর্মধারয় সমাস)। অনেকে Ontology-র বাংলা তত্ত্ববিদ্যা উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু বাংলাতে তত্ত্ব এবং বিদ্যা সমার্থক শব্দ। তাছাড়া Ont শব্দের অর্থ তত্ত্ব নয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৫৫০ অব্দের ভিতরে গ্রিক দার্শনিক থ্যালেস
(Thales) সমকালীন পৌরাণিক দর্শন ত্যাগ করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল সৃষ্টির মূলে রয়েছে পানি। এবং সমতল চাকার মতো পৃথিবীটা একটি বিশাল পানির উৎসের উপরে ভাসছে। বলাই বাহুল্য, থ্যালেসের এই মতকে নিশ্চয়ই একনিষ্ঠতার সাথে এখন কেউ মানতে রাজি হবেন না, কিন্তু তারপরেও তাঁর এই ভাবনা চিন্তাজগতের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। সত্তা সম্পর্কিত ধারণার সূত্রপাত এখান থেকেই। এই ধারণার আগে গ্রিসে জাগতিক ও অধ্যাত্মিক বিশ্বাস আচ্ছন্ন করে রেখেছিল পৌরাণিক কাহিনি। প্রাচীন গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনি মতে, সৃষ্টিতত্ত্বের আমরা যে বিশ্বাসের নমুনা পাই, তা হলো

প্রাচীন গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে ইনি আদিদেবী। ক্যায়োস নামক আদি দেবতা এঁর পিতা। মূলত শূন্যতার দৈবশক্তি দৈবশক্তি ক্যায়োস থেকে নগ্ন অবস্থায় জন্ম নেন ইউরিনোমে। এই কারণে একে বলা হয় ক্যায়োসের কন্যা। জন্মের পর সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ইনি পা রাখার কোন জায়গা পেলেন না। কারণ তখন আকাশ ও সাগর একত্রে ছিল। সে কারণে ইনি আকাশ থেকে সাগর পৃথক করলেন। আদি পুরাণ মতে এই সাগর ছিল একটি জলধারার মতো। এর দেবতা ছিলেন ওসিনাস। এরপর সাগরের তরঙ্গে উপর ইনি একাকী নৃত্য করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে ক্যায়োস অন্ধকারের সাথে মিলিত হয়ে উৎপন্ন করলেন রাত্রি, দিন, অন্ধকার  ও বাতাস। তাই ইউরিনোমে যখন নাচতে নাচতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলেন, তখন এর অনুগামী হলো বাতাস। এরপর ইনি বাতাসের গতিকে নির্ধারণ করে দিলেন। এরপর ইনি উত্তরের বাতাস ধরলেন এবং দুই হাতের ভিতর উক্ত বাতাসকে ঘসলেন। এরপর ইনি ক্যায়োস থেকে উৎপন্ন  ওফিয়োন নামক একটি বিরাট সাপ দেখতে পেলেন। ইউরিনোমে এরপর বিশাল অঞ্চল জুড়ে নাচতে থাকলেন। ধীরে ধীরে এই নাচের সাথে সাথে ওফিয়োন কামাশক্ত হয়ে পড়লেন। সে তার কুণ্ডলী দিয়ে ইউরিনোমেকে আকর্ষণ করলেন। এরপর ইউরিনোমে একটি ঘুঘুর রূপ ধরে ডিম প্রসব করলেন, আর ওফিয়োন সাতটি পাকে কুণ্ডলি তৈরি করে উক্ত ডিমকে তা দিতে থাকলেন। অবশেষে এই ডিম দুটি ভাগে বিভক্ত হলো এবং সেখান থেকে তৈরি হলো সূর্য, চন্দ্রসহ অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্র। একই সাথে ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর পাহাড়, নদী সাগর ইত্যাদি দ্বারা সুসজ্জিত হলো। সৃষ্টি হলো বিভিন্ন গাছপালা ও প্রাণীকুল। এরপর ইউরিনোমে ও ওফিয়োন অলিম্পাস পর্বতের উপর একটি বাড়ি তৈরি করলেন। কিছুদিন পর এরা একসাথে থাকার পর পরস্পরের প্রতি বিরক্তকর হয়ে উঠলেন। একসময় ইউরিনোমে পায়ের গোড়ালি দিয়ে ওফিয়নের মাথা গুঁড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীর অন্ধকার গুহাতে ফেলে দিলেন। অন্যত্র পাওয়া যায় ইনি পরবর্তীকালে টাইটানদের উপর সাতটি গ্রহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। এরপর এই দেবী তৈরি করলেন সাতটি গ্রহনিয়ন্ত্রক শক্তি।

এই পৌরাণিক সৃষ্টি-তত্ত্বকে পাশ কাটিয়ে, থ্যালেস চরম সাহসিকতা দেখিয়ে তাঁর জলতত্ত্বের কথা বলেছিলেন। এ্যারিস্টোটল এই জলতত্ত্বকে গ্রহণ না করেও থ্যালেস-এর চিন্তাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। যেমন- থ্যালস মনে করেছিলেন- যেহেতু সকল পুষ্টিকর পদার্থের মূলে আছে আর্দ্রতা, প্রাণের বিকাশে পানির অত্যাবশ্যকীয়তা এ সবই জলতত্ত্ব সমর্থন করে। যদিও বার্ট্রেন্ড রাসেলের মতে- থ্যালেসের ভাবনা ছিল অপরণিত, কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে- জগতের এই অপরিমিত অঙ্গনে একক সম্বন্ধসূত্রের অনুসন্ধানে থ্যালেস অবশ্যই অগ্রগণ্য ছিলেন।  থ্যালেসের পরে এ্যানাক্সিম্যান্ডার (Anaximander), এ্যানাক্সিমিনিস্ (Anaximenes), পিথাগোরাস (Pythagoras), জেনোফোনেস  (Xenophanes) প্রমুখ দার্শনিকরা দর্শনের নূতন নূতন ভাবনা উপস্থাপন করলেন। এর ভিতরে জেনোফোনেস-ই প্রথম একক সত্তা হিসাবে ঈশ্বরকে কল্পনা করলেন। খ্রিষ্ট-পূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক পারমেনিদেজ (Parmenides) নূতন ভাবে সত্তা-ভাবনাকে উপস্থাপন করলেন। তাঁর মতে- সত্তা হলো- চির-বিরাজমান, বিকারবিহীন, অবিভাজ্য, অচঞ্চল হিসাবে যা ভাবা যায়, তাই সত্তা। এই বিচারে চিন্তা এবং সত্তা এক এবং অভিন্ন। পরবর্তী সময়ে সত্তা বিষয়ক বিচার বিশ্লেষণ করেছিলেন প্লেটো এবং এ্যারিস্টোটল। এখন দার্শনিকরা সত্তার বিচার করেই চলেছেন নিজ নিজ যুক্তির বিচারে।

দার্শনিকরা সত্তাকে একটি পরমমানে স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। এই পরমমান হলো সত্তার ধর্ম। ঈশ্বর অদ্বিতীয় এটা ঈশ্বরের ধর্ম। আবার ঈশ্বর আলো তৈরি করেছেন। এই আলোরও ধর্ম আছে। ঈশ্বরের নিজস্ব ধর্ম নিয়ে যদি ঐশ্বরিক সত্তার প্রকাশ ঘটে, তবে আলোর ধর্ম নিয়ে- আলোক-সত্তার প্রকাশ ঘটবে। ঈশ্বরে অখণ্ড সত্তা বটে, কিন্তু আলো ঈশ্বরের অংশ বলেই- আলো ঈশ্বরের খণ্ড সত্তা।

ভাষাতত্ত্বের বিচারে সত্তাতত্ত্ব:
দর্শনের লেনাদেনা ভাবের হাটে। ভাষার কাজ হলো সে লেনা-দেনার ধ্বনিগত অনুভূতিতে প্রাণ দেওয়া। দর্শনে ঈশ্বর একটি ভাব, কিন্তু ভাষাতে তা একটি শব্দ মাত্র। এই শব্দের যে অর্থ তা দর্শনের ভাবকে ধারণ করে। তাই শব্দের অর্থ বা ভাব বুঝতে গেলে যেমন দর্শনের দ্বারস্থ হতে হয়, তেমনি ওই ভাবানুসারে শব্দের শ্রেণিবিন্যাসে প্রয়োজন পরে দর্শনের। এই স্বরূপ নির্ধারিত হয় উপলব্ধির দ্বারা। অর্থাৎ একটি শব্দ কি অর্থ বহন করে, তার উপরে সত্তার স্বরূপ নির্ধারিত হয়। আমাদের চারপাশের বস্তু জগৎ এবং মনোজগতের যা কিছু একক পরিচিত নিয়ে বিদ্যমান, তার সবই এক একটি সত্তা। যেমন আমদের বস্তু জগতের কথাই ধরা যাক। আস্ত একটি মানুষ যেমন একটি সত্তা। আবার মানুষের শরীরে এবং মনের যে কোন অংশ বা দশাও সত্তা। শরীরে অংশ হিসাবে সত্তা হতে পারে- চোখ, চোখের পাতা, চোখের পাতার পশম। আবার একজন মানুষের স্বপ্ন, আনন্দ, বেদনা, চিন্তা, ভাবনা ইত্যাদি অবস্তুবাচক এবং মানসিক অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়ও হতে পারে সত্তা। আর এই সত্তা বিষয়ক বিদ্যাই হলো- সত্তাতত্ত্ব। এই বিচারে

১. মানুষের বাক্-অঙ্গ দ্বারা প্রকাশযোগ্য সকল ধ্বনিই শব্দ-তত্ত্ববিদ্যার বিষয়।
২. কোনো সুনির্দিষ্ট ভাষার বিচারে এই ধ্বনির যদি অর্থ পাওয়া যায়, তবে তা হবে- অর্থবোধক ধ্বনি। অপর দিকে যার কোন অর্থ পাওয়া যাবে না, তা হবে অর্থহীন ধ্বনি।