কুণ্ডলিনী
সমনাম নাম- কুণ্ডলী, কুণ্ডলিনী, কুলকুণ্ডলিনী, তপস্বিনী, নাগিনী, ভুজাঙ্গনা, বালবিধবা ইত্যাদি ।

সংস্কৃত কুণ্ডল শব্দ থেকে কুণ্ডলিনী শব্দের উদ্ভব হয়েছে।
    কুণ্ডল {√কুণ্ড্(রক্ষা করা) + অল্ (কলচ), কর্তৃবাচ্য}+ ঈ (ঈপ্)

সাধারণভাবে এর অর্থ দাঁড়ায়- পেঁচানো অবস্থায় থাকা। প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্রশাস্ত্র, বৌদ্ধ ও বাউল মতে, মানবদেহ অবস্থিত একপ্রকার শক্তি। এই শক্তি ষট্‌চক্র-এর অধীনস্থ মূলাধারে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। মূলাধারকে বলা হয় সকল নাড়ির কেন্দ্রবিন্দু। জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে অবস্থিত স্থানকে বলা হয় কুন্দস্থান। এই কুন্দস্থানে এই কুণ্ডলিনী নামক শক্তি সাড়ের তিন পাকে নিদ্রিত অবস্থায় থাকে। তাই এর নাম কুণ্ডলী, কুণ্ডলিনী, কুলকুণ্ডলিনী, নাগিনী, ভুজাঙ্গনা।

মূলত এই শক্তি হলো আধ্যাত্মিক শক্তি। দেহের অংশ হিসেবে এর অস্তিত্ব নেই। তাই আধ্যাত্ম শক্তির দ্বারা এই সর্পকে জাগিয়ে তোলা হয়। যোগ সাধনার তান্ত্রিক শাখায় এই শক্তিকে ঈশ্বরের দেহস্থ অংশকে বিবেচনা করা হয়। তন্ত্রমতে শরীরের পদ্মসূত্রের মতো সূক্ষ্ম আদ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তির মূল কুলকুণ্ডলিনী শক্তি কুন্দস্থানে ঘুমিয়ে আছেন। যোগীরা এই কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভ করার চেষ্টা করে থাকেন। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়- কুণ্ডলী যোগ।

তান্ত্রিকদের মতে- কুলকুণ্ডলিনী অত্যন্ত সূক্ষ্ম তন্তুর মত। অপান বায়ু নিচের দিকে এর উপর চাপ প্রয়োগ করে, তখন জীব শ্বাস ত্যাগ করে। আর যখন এই চাপ তুলে নেওয়া হয়, তখন জীব শ্বাস গ্রহণ করে। কুণ্ডলিনীর প্রাণশক্তিই সুষম্নার ভিতর দিয়ে ঊর্ধ্ব দিকে গমন করে এবং শেষ পর্যন্ত তা মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। তান্ত্রিকরা মনে করেন যে, চোখ বন্ধ করে চৈতন্যের মধ্য দিয়ে অনুভব করতে হয় কুণ্ডলিনীর অস্তিত্ব। যোগী অনুভব করেন ঘুমন্ত কুণ্ডলিনীকে ঘিরে রয়েছে অগ্নিবলয়। ধ্যানের ভিতর দিয়ে সাধক যখন ঘুমন্ত কুণ্ডলিনীশক্তিকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাবেন, তখনই তাকে জাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। মূলত সুপ্ত কুণ্ডলিনীকে জাগাবার চেষ্টার মধ্য দিয়ে সাধক একটি বিশেষ আধ্যাত্মস্তরে পৌঁছাবেন। শুরুর দিকে সাধক কুম্ভক প্রক্রিয়ায় শ্বাস রুদ্ধ করে রুদ্ধ বায়ুকে সবলে মস্তকের দিকে চালিত করে থাকে। যার কল্পনা শক্তি যত বেশি সে তত শীঘ্র ফল পায়, আর তার কুণ্ডলিনীও তত শীঘ্র জেগে উঠে।

বাউলের কায়া সাধানার মূলে রয়েছে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করার প্রক্রিয়া। এই মতে এই কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান প্রধান নাড়িগুলো উৎপন্ন হয়েছে। এর ভিতরে প্রধান তিনটি নাড়ি হলো-  ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। এই তিনটি নাড়ি হলো- দেহের মাধ্যমে ঐশ্বরিক শক্তি লাভের পথ। এর কেন্দ্রীয় পথ হলো সুষুম্না। এর বামে রয়েছে ইড়া এবং ডান দিকে রয়েছে পিঙ্গলা নামক নাড়ী

তান্ত্রিকরা মূলধারকে একটি কুণ্ডের মতো মনে করেন। এই কুণ্ডের ভিতরে শিবলিঙ্গস্বরূপ একটি দণ্ডকে ঘিরে কুণ্ডলিনী সাপের মতো পেঁচিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় আছে। এই বিশেষ স্থানটি মূলধার, এটি ত্রিকোণাকার। একে যোনির সাথে কল্পনা করা হয়েছে। এর অপর নাম শক্তিপীঠ। এই ত্রিকোণাকার শক্তিপীঠটি রয়েছে চারটি পাপড়ি বিশিষ্ট পদ্মফুলের ভিতরে।

অষ্টসিদ্ধি লাভের জন্য জন্য কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করার অত্যাবশ্যক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।