অগ্নিদেবতা
[অভিধান:
অগ্নিদেব,
অগ্নিদেবতা]
অগ্নি নামক শক্তিকে
দেবতা হিসেবে যাকে পূজা করা হয়।
মানব-সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারায়- আকাশের অগ্নিরূপী বিদ্যুৎ, আগ্নেয়গিরির
থেকে উত্থিত অগ্ন্যুৎপাত, দিগন্তবিস্তৃত বনভূমির প্রজ্জ্বলিত দাবানল থেকে রক্ষা
পাওয়ার উপায় আদিম মানুষের জানা ছিল না। একালের মানুয প্রাকৃতিক এই ভয়াবহ কাণ্ডগুলোর
কারণ সম্পর্কে জানে। আদিম মানুষ এর কারণ জানতো না। তাদের সেই অজ্ঞতা থেকে তারা
মুক্তির উপায় হিসেবে আগুনকে দেবতা হিসেবে গ্রহণ করে পূজা করা শুরু করেছিল। মানব
সভ্যতার ঊষা-লগ্নে যে কয়েকটি প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতার স্থান দিয়েছিল, তাদের মধ্যে
অাগুন ছিল একটি। উল্লেখ্য বায়ু দেবতাকে বলা গ্রহণ করা হয়েছিল আগুনে বন্ধু হিসেবে।
প্রায় ২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
পাথরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার আদিম কৌশল উদ্ভাবন করেছিল
হোমো হ্যাবিলিসরা ।
নানা ধরনের পাথুরে অস্ত্র তৈরি করার সময় এরা লক্ষ্য করেছিল, প্রস্তরখণ্ডে আঘাত করলে
আগুনের ফুলকি বেড়িয়ে আসে। এই স্ফুলিঙ্গ শুকনো ঘাস জাতীয় দ্রব্যাদিতে পতিত হলে, তা
জ্বলে উঠে। প্রাকৃতিক এই ঘটনাকে অনুসরণ করে এরা আগুন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
অচিরেই এরা আগুনের নানাবিধ গুণের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। প্রাধমিক পর্যায়ে এরা
আগুনকে তিনটি উদ্দেশ্যে ব্যবহার শুরু করেছিল।
এরপর
হোমো গণের পরবর্তী প্রজাতিসমূহের মধ্যে আগুনের
ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারপরেও আদিম মানুষ তথা
হোমো স্যাপিয়েন্সরা-দের আবির্ভাবের আগের প্রজাতিগুলোর
ভিতরে আগুনের ব্যবহার ছিল- তিনটি ক্ষেত্রের ভিতরে সীমাবদ্ধ। এগুলো ছিল- মাংস
পুড়িয়ে খাওয়ার জন্য আগুনের ব্যবহার, শীতের প্রকোপ থেকে
রক্ষা পাওয়ার জন্য আগুনের ব্যবহারএবং হিংস্র পশুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আগুনের
ব্যবহার।
হোমো স্যাপিয়েন্সরা- আগুনের ব্যবহারকে সম্প্রসারিত করেছিলে।
আদিম মানুষ
আগুনের তাপ ও আলো দেওয়ার ক্ষমতাকে ভয় এবং শ্রদ্ধা করতে শিখেছিল। বিশেষ
করে অগ্ন্যুৎপাৎ, বজ্রপাত, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক ঘটনায় আগুনের লৌকিক ভয়ঙ্কর রূপ দেখে,
এর ভিতরে অলৌকিক শক্তি কল্পনা করেছিল। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল অগ্নি দেবতা।
পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিকশিত সনাতন ধর্মে অগ্নিদেবতা
(god of fire)
নানা নামে নানা রূপে পাওয়া যায়।
আইনু সনাতন
ধর্মের অগ্নিদেবতা: আইনুরা হল একটি উত্তর জাপান এবং দক্ষিণ-পূর্ব রাশিয়ায়
বসবাসকারী
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী। এই ধর্মমতে কামুয়-হুচি অগ্নিদেবী। এই দেবী চুলার ভেতরে থাকেন। কামুয়-হুচির উৎপত্তি
সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত গল্প হলো- তিনি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিলেন, তাঁর সাথে বজ্রপাত ও বিদ্যুৎপ্রবাহের কামুয়ী কান্না কামুয়িও। অন্যমতে তিনি অগ্নি-উৎপাদনকারী
গর্ত থেকে জন্মগ্রহণ করেন এবং শিকারের দেবী হাসিনাও-উক-কামুয়ের বোন । তৃতীয় ধারণা অনুযায়ী, তিনি প্রধান উৎস কান্দা-কোরো-কামুয়ের একটি এলম গাছের কন্যা।
আজটেক সনাতন
ধর্মের অগ্নি দেবতা: ল্যাতিন আমেরিকার আজটেক সভ্যতায় অগ্নি দেবতার নাম-মিক্সকোটল।
ইয়োরবা সনাতন
ধর্মের অগ্নি দেবতা:
আফ্রিকা ইয়োরবাদের ধর্মমতানুসারে অগ্নিদেবতার নাম
শাঙ্গো (Shango)।
এই দেবতাকে একই সাথে বজ্রপাত, নৃত্য এবং বিচারের দেবতা হিসেবে মান্য করা হয়।
চীনা সনাতন
ধর্মের অগ্নি দেবতা: চীনা সনাতন ধর্মেমতে অগ্নিদেবতার নাম ঝু রোং ।
তিনি মানুষকে আগুন জ্বালানো এবং এর ব্যবহার করার বিষয়ে জ্ঞান দবান করেছিলেন।
তিনি আগুনের সাহায্যে শীতের দিনে ঘর গরম রাখা, খাবার তৈরি করা ইত্যাদি
শিখেয়েছিলেন। এছাড়া অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ড্রাগন, বা বাঘের পিঠে চড়ে
অগ্নিরূপে যুদ্ধ করতেন।
জাপানি সনাতন
ধর্মের অগ্নি দেবতা: জাপানের সনাতন ধর্মে দুই জন অগ্নদেবতার নাম পাওয়া যায়।
এঁরা হলেন-
কাগু-ৎসুচ ও কোজিন
গ্রিক সনাতন
ধর্মে অগ্নি দেবতা: অলিম্পিয়ায় বসবাসরত দেবতারা আগুনের ব্যবহার জানতেন।
দেবতাদের আগুন চুরি করে
প্রোমেথেয়ুস নামক দেবতা মানুষকে দিয়েছিলেন। এই কারণে
দেবরাজ জিউস প্রোমেথেয়ুসকে
শাস্তি দিয়েছিলেন। আবার এই ধর্মে
হেস্টিয়া বলা হয়ে
চুলার দেবতা।
গ্রিক সনাতন
ধর্মে অগ্নি দেবতা: তুরস্কের সনাতন ধর্মে প্রচলিত অগ্নি দেবতা
আলাজ।
নর্স সনাতন
ধর্মে অগ্নি দেবতা: নর্স সনাতন ধর্মমতে অগ্নি দেবতার নাম লোগি। অনেক সময়
তাঁকে অগ্নি-দানব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
পারশ্যের সনাতন
ধর্মে অগ্নি দেবতা: পারশ্যের প্রাচীন জরথুষ্ট্রীয় ধর্মে -আতর হলেন পবিত্র
আগুন এবং অগ্নি দেবতা।
ভারতীয় সনাতন
ধর্মে অগ্নি দেবতা: ভারতের সনাতন ধর্মের বিচারে অগ্নিদেবতাকে পাওয়া চারটি
ধর্মে।
সনাতন হিন্দু ধর্ম:অগ্নি দেবতা।
ভারত, নেপাল ও অন্যান্য অঞ্চলে সনাতন হিন্দু
ধর্মাবলম্বীদের কাছে পূজ্য।
সনাতন বৌদ্ধ ধর্ম: হৃদয় বা অগ্নির প্রতীক হিসেবে মান্য করা হয়-
অগ্গী নামক দেবতাকে। পালি সাহিত্যে, তাকে অগ্গী-ভাগব , জাতবেদ এবং ভেসানরও বলা হয়।
সনাতন জৈন ধর্মমত: জৈন ধর্মে অগ্নি হলেন সৃষ্টি জগতের অভিভাবক দেবতা।
মিশরের সনাতন
ধর্মে অগ্নি দেবতা: মিশরের সনাতন ধর্মমতে সূর্য ও অগ্নি দেবতার নাম রা।
রোমান সনাতন
ধর্মে অগ্নি দেবতা: গ্রিক সনাতন ধর্মের বিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল
রোমান সনাতন ধর্ম। কালের বিবর্তনের ধারায় রোমান সনাতন্ ধর্মের ধারায় কিছু
স্বতন্ত্র রূপ প্রকাশ পেয়েছিল। রোমান অগ্নিদেবতা ছিলেন ভোলকানো
(volcano)
। এর সমতূল্য গ্রিক দেবতা হেফস্টাস।
রোমান দেবী জুনোর গর্ভে এই দেবতা জন্মগ্রহণ করেছিলেন অলিম্পিয়াসের বাইরে। তিনি
ছিলেনন জন্মগতভাবে খোঁড়া। এই পঙ্গুদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর, জুনো তাঁকে দক্ষ
কামার হিসেবে গড়ে তোলেন। ভোলকানো এবং তার হাতুরি রোমানদের কাছে পূজ্য ছিল।
হাওয়াইয়ান সনাতন
ধর্মে অগ্নি দেবতা: হাওয়াইনা দ্বীপাঞ্চলে অগ্নিদেবীর নাম পেলে। এঁদের
ধর্মানুসারে পেলে হলেন শাক্তশালিনী, অগ্নি ও অগ্ন্যুৎপাতের দেবী।