এটি একটি
এক সূত্রক
আরএনএভাইরাস। এই ভাইরাস সম্পর্কে প্রথম জানা যায়,
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে। সে সময়ে মুরগির
ব্রঙ্কাইটিস ধরনের রোগের অনুসন্ধানে এই ভাইরাসের কথা জানা যায়।
এ ছাড়া সর্দি-কাসি হয়েছে এমন মানুষের নাসারন্ধ্র থেকে এই ভাইরাসের দুটি প্রকরণ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এর নাম দেওয়া হয়েছিল- human coronavirus 229E
এবং
human coronavirus OC43
। এরপর এই ভাইরাসের আরও বেশ কিছু নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ভাইরাসগুলো হলো-
SARS-CoV (2003), HCoV NL63 (2004), HKU1 (2005), MERS-CoV (2012)
এবং
2019-nCoV (2019)
।
করোনা ভাইরাসের আণুবীক্ষিক চিত্র
গ্রিক
κορώνη
শব্দের অর্থ হলো- মাল্য বা জয়মাল্য। ইলেক্ট্রোনিক
অণুবীক্ষণ যন্ত্রে গোলাকার এই ভাইরাসের গায়ে ছোটো ছোটো বুদ্বুদের মতো অংশ দেখা যায়।
দেখতে অনেকটা কদম ফুলের মতো মনে হয়। বিজ্ঞানীরা একে
সূর্যের
Corona
(ছটামণ্ডল)-এর সাথে তুলনা করে
নাম রেখেছিলেন- করোনা ভাইরাস। পরে ভাইরাসের নাম প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব ট্যাক্সনমি অব ভাইরাসেস এই ভাইরাসটিকে সার্স-সিওভি-২ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।
জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নামকরণ করেছে 'করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯'। এর সংক্ষিপ্ত নাম 'কোভিড-১৯।"
জীববিজ্ঞানের শ্রেণিবিভাজন মতে- এটি
Coronaviridae
গোত্রের অন্তর্গত কিছু ভাইরাস। উপগোত্র হিসেবে এদেরকে
রাখা হয়েছে
Orthocoronavirinae
উপগোত্রের অধীনে।
বাল্টিমোর
শ্রেণিকরের বিচারে এরা
+ssRNA
ভাইরাস। অর্থাৎ এদের দেহে রয়েছে এক সূত্রক
আরএনএ।
কোভিড-১৯-এর আত্মপ্রকাশ ও মহামারীতে রূপ লাভ
novel coronavirus(2019-nCoV)
। চীনের হুবেই প্রদেশের বৃহত্তম শহর উহানে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের
ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে এই ভাইরাস স্থানীয় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমে ক্রমে মহামারীতে রূপ লাভ
করে। সে সময়ে সাধারণভাবে এই ভাইরাসকে অভিহিত করা হয়েছিল 'উহান ভাইরাস'। এই ভাইরাসটি
করোনা ভাইরাসের একটি প্রকরণ হিসেবে চিহ্নিত করার পর, নামকরণ করা হয়, উহান করোনা ভাইরাস
(Wuhan coronavirus )
। প্রথম দিকে একে
Coronaviridae
গোত্রের অন্তর্গত
Betacoronavirus
গণের ভাইরাস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
পরে এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিচার করে, একে
Betacoronavirus
গণের অন্তর্গত Sarbecovirus
উপগণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছ।
প্রাথমিকভাবে এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত রোগীদের পর্যবেক্ষণ করে, ধারণা করা হয়েছিল-
এই ভাইরাস সংক্রামিত হয়েছিল উহান শহরের একটি খাবারের বাজারে মাংসের দোকানগুলো থেকে।
সে সময় মনে করা হয়েছিল এই ভাইরাস বন্যপশু বা সামুদ্রিক সাপের মাংস থেকে সংক্রামিত হয়েছিল। এরপর
কিছু গবেষকের সন্দেহ করেন যে, এই ভাইরাসটি মানুষের দেহে আশ্রয় নিয়েছিল বাদুর থেকে।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর শুরুর দিকে এই ভাইরাসের দ্বারা স্থানীয় কিছু মানুষ আক্রান্ত হলেও,
এর লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে। প্রথম দিকে আক্রান্ত মানুষের জ্বর, কাশি
ও শ্বাস-কষ্ট দেখে ডাক্তাররা প্রথমে ভেবেছিলেন ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা থেকে
সৃষ্ট সাধারণ রোগ। কিন্তু যখন আক্রান্তদের কেউ কেউ নিউমোনিয়া এবং ফুসফসের
প্রদাহে মৃত্যুবরণ করতে থাকে, তখন চিকিৎসক এবং জীবাণু গবেষকরা এর কারণ
অনুসন্ধান শুরু করে। এই সূত্রে জানা যায়, এ সকল রোগের প্রধান কারণ
করোনা ভাইরাস।
চীনা কর্তৃপক্ষ এই করোনা ভাইরাসজনিত
এই রোগ হিসেবে প্রথম শনাক্ত করেছিলেন ৩১শে জানুয়ারি।
চীনের লি ওয়েনলিয়াং নামের একজন চিকিৎসক সর্বপ্রথম
এই প্রাণঘাতী ভাইরাস সম্পর্কে
জানতে পারেন এবং বিপদের সতর্কবাণী করেছিলেন। পরে
তিনিও এ ভয়ংকর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছেন।
উল্লেখ্য, সে সময়ে পুলিশ ডাক্তার লি’কে এই
ভাইরাস সম্পর্কে মুখ বন্ধ করে রাখতে বলেছিলেন।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি প্রথম দিকে ক্রমে ক্রমে উহান শহরে এই ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১১
জানুয়ারি প্রথম একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষ এই ভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর চীন এই রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
তারপরেও দ্রুত ভাইরাসটি উহান এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থেকে।
এ ছাড়াচীনের এই গুরুত্বপূর্ণ শহরের সাথে বিমান পথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ থাকার কারণে,
এই ভাইরাস চীনের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাসজনীত রোগে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়,
চীনের উহান শহরের বাইরের এলাকা, জারমানি, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, জাপান, নেপাল, ভারত, মালোয়েশিয়া
ইত্যাদি দেশে। এবং দেখা যায় এ সকল রোগিদের সাথে উহান শহরের প্রত্যক্ষ সংম্পর্ক ছিল।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
WHO
বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৭ জন আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। আর মৃত্যুর
সংখ্যা ছিল ৩৬১ জন। তবে চীনের সরকারিভাবে দেওয়া তথ্য সঠিক ছিল
না।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে চীনে
দুই সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয় এবং ৮০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়।
এই
সময়
চীনে এই
রোগের সংক্রমণ কিছুটা কমে এলেও- চীনের বাইরে ৩০টি দেশে
এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। এর ভিতরে ২৭ জনের মৃত্যু ঘটে এবং
হাজার হাজার লোক আক্রান্ত হয়। এর ভিতরে দক্ষিণ কোরিয়া,
ইরান ও ইতালিতে এই ভাইরাসে কয়েকজনের মৃত্যু হলে, ওই সব দেশে ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
তবে এই তিনটি দেশে এই রোগের সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।করোনা ভাইরাসের লক্ষণ ও প্রতিরোধ
জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাএই ভাইরাস আক্রান্ত
রোগীদের যে লক্ষণের কথা উল্লেখ করেছে, তা হলো- প্রাথমিকভাবে জ্বর, হাঁচি, শুষ্ক কাসি,
গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট হয়। এবং চূড়ান্ত অবস্থায়
তা নিউমোনিয়াতে রূপ লাভ করে। এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটে থাকে। তবে এই ভাইরাস আক্রান্ততের
মৃত্যুর হার মাত্র ২%। দুর্বল শ্বাসন্তের অধিকারী, বয়স্ক মানুষ এবং শিশুদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি।
এই ভাইরাস আক্রান্ত রোগের কাশির সাথে এই রোগ ছাড়ায়। তাই এর প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য মাস্ক
ব্যবহার করা সঙ্গত। এছাড়া আক্রান্ত এলাকায় বিভিন্ন স্থানে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এ সব জায়গার
দ্রব্যাদি স্পর্শ করলে হাতে এই ভাইরাস চলে আসে। এই অবস্থায় হাত দিয়ে নাক, মুখ স্পর্শ করলে, ভাইরাস
দ্বারা সংক্রামণের সম্ভাবনা থাকে। তাই হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার না করে, মুখ বা নাক স্পর্শ করতে
নিষেধ করা হয়।
চীনে আটকা পরা বাংলাদেশের নাগরিক
ব্যবসা, শিক্ষাগ্রহণ, ভ্রমণ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশী নাগরিক থেকে চীনে নিয়মিত যাতাওয়াত করে থাকেন।
চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে বহু বাংলাদেশী নাগরিক চীনে আটকা পড়ে। প্রথম দিক এক্ষেত্রে চীন স্বাস্থ্যগত
নিরাপত্তার কারণে এদের চীন ত্যাগ করার অনুমতি দেয় নি। পরে বাংলাদেশের উদ্যোগে এদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা
করা হয়। প্রথমে উহানে থাকা ৩৬১ জন বাংলাদেশী দেশে ফেরার জন্য নিবন্ধন করেন।
শেষ পর্যন্ত ৩১৪ জনের দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত হলেও দু’জনের শরীরে অধিক তাপমাত্রা থাকায় তাদের রেখে আসা হয়। ফলে
৩১২ জন নাগরিক ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারি শনিবার দুপুর ১১টা ৫৫ মিনিটে উহান থেকে ৩১২ যাত্রী নিয়ে বিমানের বিশেষ ফ্লাইটটি ঢাকার
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছায়। এরপর বিআরটিসির ৮টি বাসে ৩০২ জনকে আশকোনা হজ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে তাদেরকে ১৪ দিনের জন্য চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ফিরে আসা যাত্রীদের মধ্যে ৭ জনের শরীরের জ্বর থাকায়,
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়।
পরে এদের দেহে কোনো করোনা না পাওয়ায় সবাইকে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার
অনুমতি দেওয়া হয়।