মানুষের রোগসৃষ্টিকারী ভাইরাসের তালিকা

ভাইরাস
Virus

ভাইরাস হলো এক প্রকার অতি-আণুবীক্ষিক এজেন্ট বিশেষ। ল্যাটিন শব্দ ভাইরাস (বিষ) থেকে এই শব্দটি গৃহীত হয়েছে। ভাইরাস প্রাকৃতিক পরিবেশে জড় পদার্থের মতো অবস্থান করে। এই অবস্থায় একে বলা হয় ভিরিয়ন (Virion) ভিরিয়ন হিসাবে এরা পৃথিবীর যে কোনো স্থানে, যে কোনো পরিবেশে থাকতে পারে। জীবকোষের সংস্পর্শে এরা যখন জৈবিক আচরণ শুরু করে অর্থাৎ জীবকোষকে ক্ষতি করা শুরু করে তখনই তাকে ভাইরাস বলা হয়। তাই যেখানে কোনো সজীব জৈব-উপকরণ থাকবে, সেখানেই ভাইরাস থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

মানুষ, বহু রোগের কারণ হিসাবে জীবাণুর কথা জানতে পেরেছিল। কিন্তু ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর, নানা ধররনের জীবাণু সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেছে। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে এ্যাডলফ মায়ার তামাক গাছের মোজাইক রোগের কারণ হিসেবে জীবকণিকার কথা উল্লেখ করেন। এই সময় তিনি এই ভাইরাসকে 'তামাক গাছের রোগ' হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে রুশ বিজ্ঞানী আইওয়ানোওস্কি (Iwanowsky) তামাক গাছের মোজাইক রোগের কারণ হিসাবে একটি বিশেষ জীবকণিকাকে চিহ্নিত করেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ মার্কিন বিজ্ঞানী স্ট্যানলি (Stanly) প্রথম অণুবীক্ষণযন্ত্র দ্বারা পরীক্ষা করে এই জীবকণিকার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেন এবং তামাকের মোজাইক রোগের উৎস হিসেবে ভাইরাসকে শনাক্ত করে, তাকে কেলাসিত করতে সক্ষম হন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে  পিরি ও বদেন ভাইরাসের স্ফটিক থেকে এর প্রোটিন  ও নিউক্লেইক এ্যাসিড সম্পর্কে ধারণা দেন। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে গ্যালো মানুষের মারণব্যধি এইডস যে ভাইরাস থেকে হয়, তা ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপন করেন।

ভাইরাসের উদ্ভব
ভাইরাসের ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। সম্ভবত  ইয়ো-আর্কিয়ান যুগ (৪০০-৩৬০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ-ভিত্তিক আদি জীবকণিকা উদ্ভব হয়েছিল। ৪০০ কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের ভিতরে সৃষ্টি হয়েছিল ফসফরিক এ্যাসিড, নানা ধরনের চিনি, নাইট্রোজেন ঘটিত ক্ষারক (পিউরিন ও পিরামিডিন)। আদি সমূদ্রের উপযুক্ত পরিবেশে এই সকল জটিল অণুসমূহের ক্রম-সংযোজনে সৃষ্টি হয়েছিল আদি নিউক্লেইক এ্যাসিড এই এ্যাসিডে বংশগত তথ্য সংরক্ষণ করা ও সুনির্দিষ্ট প্রোটিন অণু তৈরি করার ক্ষমতার সূত্রে এক ধরনের আক্ষেপ সৃষ্টি হয়েছিল। রাসায়নিক আসক্তির সূত্রে এই এ্যাসিডগুলো গড়ে তুলেছিল আরএনএ [ribonucleic acid (RNA)] । মূলত এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ভিতর মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছিল আদি জীবকোষ।
আদি জীবকোষের এই দশা থেকেই সম্ভবত আদি জীবকণিকারূপে ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছিল। তবে প্রাচীন শিলাস্তরে এর কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি। জীববিবর্তনের ধারায় এই ধারণা করা হয়, শুধু ভাইরাসের আদিম কোষীয় উপকরণ বিবেচনা করে।

মূলত আদিম এ সকল কোষের আদি দশায় ছিল ডিএনএ বা আরএনএ। এর সাথে ছিল অন্যান্য সহায়ক জলীয় উপকরণ। এসকল উপকরণের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল প্রোটিনের আবরণ তৈরি। এই আবরণ ডিএনএ বা আরএনএ-কে রক্ষা করতো। ফলে এই কোষগুলো হয়ে উঠেছিল নিউক্লিওপ্রোটিন মাত্র। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ-গুলো আদিম ভাইরাসে পরিণত হয়েছিল। এরা সজীব হয়েও ছিল জড়পদার্থের মতো। এদের ভিতরে প্রাণের প্রকাশ ঘটলো তখনই যখন এরা অন্য আদি জীবকণিকা অধিকার করে বংশবৃদ্ধি শুরু করেছিল। এবং নিজেদের পরিবর্তন করার ক্ষমতা অর্জন করেছিল। এই ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ভাইরাস জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী সত্তায় পরিণত হয়েছিল। এদের দেহ তৈরি হয়েছিল ডিএনএ বা আরএনএর দ্বারা। এই দুই ধরনের নিউক্লিক এ্যাসিডের সূত্র ভাইরাসগুলো ডিএনএ ভাইরাস এবং আরএনএ ভাইরাসে পরিণত হয়েছিল।

কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন এই জীবকিণিকার কোষে ক্ষুদ্রাকার ডিএনএ-অণু তৈরি হয়েছিল। এই বিশেষ অণুকে বলা হয় প্লাসমিড। এদের ভিতরে নিজের অনুরূপ নতুন অণু তৈরির ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে এই অণু একটি কোষ থেকে অন্য কোষে প্রবেশ করার ক্ষমতা অর্জন করেছিল। এই দুটি গুণের কারণে প্লাসমিড থেকে উদ্ভুত এই বিশেষ অণু থেকে ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছিল। এই সূত্রে আদি জীবকণিকা থেকে ভাইরাস এবং ব্যাক্টেরিয়ার উদ্ভব হয়েছিল।  আবার অনেকে মনে করেন ব্যাক্টেরিয়া থেকে ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছিল।

 

ভাইরাসের গঠন প্রকৃতি
নিষ্ক্রিয় দশায় ভাইরাসকে ভিরিয়ন (Virion) বলা হয় এর গঠনের কারণে। যে সকল নিউক্লেইক এ্যাসিড প্রোটিন আবরণ নেই তাদেরকে ভিরিয়েড বলা হয়। আর প্রিয়ন হল নিউক্লিক এ্যাসিড বিহীন প্রোটিন। উভয় বৈশিষ্ট্য অনুসারে, যে সকল জীবকণিকায় নিষ্ক্রিয় দশায় প্রোটিন আবরণ এবং নিউক্লিক এ্যাসিড উভয় থাকে, তাদেরকে ভিরিয়ন বলা হয়। ভিরিয়ন-এর শরীরকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো- ক্যাপাসিড ও নিউক্লিক এ্যাসিড।  

আকারের বিচারে অনেকসময় ভাইরাসকে চিহ্নিত করা হয়। যেমন

ডিএনএ/আরএনএ-ভিত্তিক ভাইরাসের বাল্টিমোর শ্রেণিকরণ
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জীববিজ্ঞানী
David Baltimore ডিএনএ/আরএনএ-ভিত্তিক এই শ্রেণিকরণ করেছেন। এর ভিত্তি হলো- mRNA । এই বিভাজনে mRNA (Messenger RNA) -কে প্রাথমিক মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে mRNA -কে ধরা হয়েছে বার্তাবাহক অণু হিসেবে। এই অণু ডিএনএ থেকে রাইবোজোম-এ জিনঘটিত তথ্যাদি বহন করে। প্রতিটি ভাইরাস তার জিনোম থেকে অবশ্যই mRNA উৎপন্ন করে থাকে। এই সূত্রে তৈরি হয় আবশ্যকীয় প্রোটিন। আর এসবের মধ্য দিয়ে একটি ভাইরাস নিজের অনুরূপ অপর একটি ভাইরাস উৎপন্ন করতে পারে। এই জাতীয় কর্মকাণ্ডের বিচারে প্রতিটি ভাইরাসের রয়েছে নিজস্ব ধরণ। এই ধরণ নির্ভর করে- ভাইরাসের জিনোমের গঠনের উপরে। ভাইরাসে জিনম হতে পারে এক-সূত্রক ও দ্বিসূত্রক। সাধারণত ডিএনএ দ্বিসূত্রক হয় এবং আরএনএ একসূত্রক হয়। কিন্তু প্রজাতিভেদে ভাইরাসে এই সংখ্যার হেরফের দেখা যায়। এক্ষেত্রে দ্বিসূত্রক ডিএনএ -কে বলা হয় double-stranded DNA (dsDNA) । পক্ষান্তরে এক সূত্রে ডিএনকে বলা হয় single-stranded DNA (ssDNA) । একইভাবে double-stranded RNA (dsRNA) বা single-stranded RNA (ssRNA) হয়ে থাকে। এই বিচারে ভাইরাসগুলো নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই সকল বৈশিষ্ট্য-সহ অন্যান্য বিষায়াদির বিচারে, ভাইরাসের শ্রেণিকরণে আন্তর্জাতিক কমিটি আইসিটিভি [International Committee on Taxonomy of Viruses (ICTV)] ভাইরাসের শ্রেণিকরণের একটি কাঠামো প্রণয়ন করেছে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে এদের প্রণীত কাঠামোটি আন্তর্জাতিকভাবে মান্য করা হয়। এই কাঠামোটি হলো-
Phylum (-viricota)
Subphylum (-viricotina)
Class (-viricetes)
Order (-virales)
Suborder (-virineae)
Family (-viridae)
Subfamily (-virinae)
Genus (-virus)
Subgenus (-virus)
Species


পোষকের বিচারে ভাইরাসের শ্রেণি-বিভাজন
প্রতিটি ভাইরাস কিছু নির্বাচিত সজীব জীবকোষকে আক্রমণ করে থাকে। সেই হিসাবে ভাইরাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন-ন-

১. উদ্ভিদ ভাইরাস : যে সকল ভাইরাস জীবনধারণের জন্য উদ্ভিদকে বেছে নেয়।
২. প্রাণী ভাইরাস : যে সকল ভাইরাস জীবনধারণের জন্য প্রাণীকে বেছে নেয়।
৩. ব্যাকটেরিয়ার ভাইরাস : যে সকল ভাইরাস জীবনধারণের জন্য ব্যকটেরিয়াকে বেছে নেয়।

পোষক দেহে অবস্থানকারী ভাইরাসের কলাভিত্তিক ভাইরাস

পোষকদেহে ভাইরাস থাকাকালে ভাইরাসগুলি শরীরের যে কলাসমূহকে অবলম্বন করে বংশবিস্তার করে থাকে তার উপর ভিত্তি করে ভাইরাসকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন 

ক. ডারমাট্রপিক: এই জাতীয় ভাইরাস প্রাণীর চর্মকে আক্রমণ করে। যেমন: হাম, বসন্ত ইত্যাদি।
খ. নিউরোট্রপিক: এই জাতীয় ভাইরাস স্নায়ুকে আক্রমণ করে। যেমন: এনসেফালাইটিস।
গ. ভিসেরোট্রপিক: এই জাতীয় ভাইরাস দেহের অভ্যন্তরের কলাকে আক্রমণ করে। যেমন: হেপাটইটিস
, পীতজ্বর।
ঘ. প্যানট্রপিক: এই জাতীয় ভাইরাস একসাথে একাধিক কলাকে আক্রমণ করে। যেমন : ডেঙ্গু ভাইরাস।
ঙ. মাইকোফাজ: এই জাতীয়
ভাইরাস ছত্রাককে আক্রমণ করে।
চ. পত
ভাইরাস: এই জাতীয় ভাইরাস পতঙ্গ আক্রমণ করে।


ভাইরাসের বংশ বিস্তার
ভাইরাস প্রকৃতিতে জড় পদার্থের ন্যায় স্থবির অবস্থায় থাকে। এদের সংস্পর্শে কোন সজীব কোষ এলে, এদের ভিতর উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। এরা প্রথমে দেখে যে, সজীব জীবকোষটি তার উপযুক্ত কিনা। যদি এই উক্ত জীবকোষটিকে ভাইরাস কণা উপযুক্ত মনে করে, তাহলে ভাইরাস তার বাইরের ক্যাপাসিডকে উন্মুক্ত করে সজীব জীবকোষের কোষ প্রাচীরের ভিতর দিয়ে- নিজের ডিএনএ বা আরএনএ প্রবেশ করিয়ে দেয়। এরপর উক্ত ডিএনএ বা আরএনএ দ্রুত নিজেকে বিভাজিত করে অসংখ্য ডিএনএ বা আরএনএ তৈরি করে। পরে প্রতিটি ডিএনএ বা আরএনএ-কে ঘিরে প্রোটিন অণুর প্রাচীর গড়ে তুলে ক্যাপাসিড তৈরি করে। ফলে আক্রান্ত জীবকোষের ভিতর অসংখ্য ভাইরাসের সৃষ্টি হয়। এর পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিটি ভাইরাস কণা পাশ্ববতী কোষগুলোকে আক্রমণ করে এবং উক্ত কোষগুলোতে পুনরায় অসংখ্য ভাইরাস কণার সৃষ্টি করে। এইভাবে ভাইরাস তার ক্রমাগত বংশ বৃদ্ধি করে চলে।

ভাইরাস প্রতিষেধক
আক্রান্ত কোষ থেকে ভাইরাসকে অপসারণ বা হত্যা করাটা অত্যন্ত কঠিন। মূলত আক্রান্ত ভাইরাস কখনওই আর কর্মক্ষম হয়ে উঠে না। তবে নূতন কোন কোষ যাতে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত না হতে পারে
, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। মূলত টিকা প্রদান পদ্ধতিতে ভাইরাস আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। অনেকেই মনে করেন যে এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার দ্বারা ভাইরাস আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ্যান্টিবায়োটিক ব্যাক্টেরিয়াকে প্রতিরোধ করে থাকে। ভাইরাস আক্রমেণের কারণে শরীরের কিছু জ্বর, প্রদাহ ইত্যাদি পাশ্ব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই সকল পাশ্ব প্রতিক্রিয়া রোধের জন্য কিছু ড্রাগ ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায় বটে কিন্তু ভাইরাস আক্রমণ ঠেকানো যায় না।

ভাইরাস প্রতিষেধক মূলত শরীরের সহজাত প্রতিরোধ ব্যবস্থার পাশাপাশি কোন সুনির্দিষ্ট ভাইরাসের জন্য একটি বাড়তি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ফলে উক্ত ব্যবস্থাধীনে উক্ত ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে না। ভাইরাসের প্রকৃতি অনুসারে বিভিন্ন প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করতে হয়। যেমন গুটিবসন্ত, পোলিও ইত্যাদির জন্য সুনির্দিষ্ট টিকা গ্রহণ করতে হয়। ক্যান্সার বা এইডস উৎপাদক ভাইরাসের প্রতিষেধক এখনও গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে।