ইয়ো-আর্কিয়ান যুগের ভূপ্রকৃতি:
এই যুগে পৃথিবী
নামক গোলকটি ঢাকা ছিল গভীর, ফুটন্ত সমুদ্রের নিচে। এই সমুদ্র থেকে
অসংখ্য কালো ধোঁয়া নির্গত হতো। এর ভিতরে পুরো পৃথিবী জুড়ে অগ্ন্যুৎপাতের ঘটেই
চলেছিল এবং উগীর্ণ লাভা সমুদ্রতলকে উচ্চতর করে তুলছিল।
৪০০ থেকে ৩৯৬
কোটি খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ:
এই সময়ে
ব্যাপক অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পৃথিবীর উপরিতলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে
ভূ-গোলকের উপরিতলের
ম্যাগ্মা
অপেক্ষাকৃত কম ঘন ছিল এবং ভূত্বকও বেশ পাতলা ছিল। এর ফলে সে সময়ের প্রায় অখণ্ড
জলরাশির তলদেশের শীতলতা, তরল
ম্যাগ্মাকে
দ্রুত শীতল করে আগ্নেয়শিলাস্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু
পৃথিবীর
জলাশয়ের
বাইরের পাতলা ভূত্বকের উপরিতলের আবরণের নিচের
ম্যাগ্মা
যথেষ্ঠ কঠিন না হয়ে উঠায়, সেখান থেকে উৎপন্ন গ্যাস প্রবল ভাবে ভূত্বকে চাপের
সৃষ্টি করেছিল। এর ফলে ভূত্বকের কোনো কোনো অংশ
হয়তো
বেলুনের মতো ফুলে উঠেছিল। আবার
ভূত্বকের কোনো কোনো অংশ ফেটে গিয়ে লাভা স্রোত সৃষ্টি করেছিল।
এর ফলে ভূত্বকের কোথাও কোথাও
সৃষ্টি হয়েছিল উঁচু-নিচু ভূখণ্ড। কোথাও কোথাও সৃষ্টি
হয়েছিল আগ্নেয় দ্বীপ। সে সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
আগ্নেয়-দ্বীপগুলো বার বার
প্লাবিত হয়েছে লাভাস্রোতে।
এরই মাঝে মাঝে
সমুদ্রের ভিতর থেকে ছোট ছোট ব্যাসল্টিক দ্বীপ বা ক্রাস্টাল খণ্ড ভেসে উঠত। পরে
ধীরে ধীরে সেগুলো হারিয়ে যেতো। মূলত এই সময় কোনো মহাদেশের অস্তিত্বই ছিল না। ব্যাসল্টিক দ্বীপ বা ক্রাস্টাল খণ্ডগুলো
থেকে মহাদেশীয় ক্র্যাটানগুলোর আদিরূপ গড়ে ওঠা শুরু হয়েছিল। এই সময়ে সবচেয়ে প্রাচীন ক্র্যাটনের (যেমন পিলবারা, কাপভাল) প্রথম
ভিত্তি এই সময়েই তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু তখনো খুব ছোট ছিল। বর্তমানে পৃথিবীর যে
পাত সঞ্চালনের কথা বলা হয়, সে সময়ে এর কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
তবে এর ভিতরেও চলছিল
ভাঙাচোরার খেলা। নিচের তরল ম্যাগমার চাপে, উপরে ভাসমান ভূখণ্ডগুলো পরস্পরের
ধাক্কায় ভেঙে পড়ছিল অবিরত। আবার নিচের তরল ম্যাগমার প্রবাহে ভূ-ভগ্নাংশগুলো
ভাসতে ভাসতে যুক্ত হয়ে বড় ভূখণ্ডের ভিত্তি তৈরিও করছিল।
প্রথম দিকের এই
ভূখণ্ডগুলোর পুরুত্ব বেশি ছিল না। তবে এদের নিচের তরল পাথর ক্রমাগত তাপ হারিয়ে
কঠিনতর হয়ে উঠছিল। এই সূত্রে ভূখণ্ডগুলো ভারি হয়ে উঠার পাশাপশি, নিচের তরল
পাথরের সমুদ্রের প্রোথিত হচ্ছিল। এ সকল প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে নানাভাবে
ভূখণ্ডগুলো সুদৃঢ় হয়ে উঠছিল। এরই মধ্য দিয়ে কিছু বড় বড় ভূখণ্ডের উদ্ভব হয়েছিল।
ভূবিজ্ঞানীরা এই সুদৃঢ় বিশাল ভূখণ্ডগুলোকে ক্র্যাটন নামে অভিহিত করে থাকেন।
এই পরিবেশে সে সময়ের
ক্র্যাটনগুলো আদিম দশায় ছিল। পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে এদের ভিতর ক্রমাগত
ঠোকাঠুকি চলছিল। পরস্পরের দিকে অবিরাম ধাক্কা এবং চাপ সৃষ্টির কারণে,
৩৯৬ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে
ক্র্যাটনগুলোর সীমানা বরাবর উঁচু উঁচু টিলা তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল। ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, বরফযুগের প্রভাবে
এ সকল শৃঙ্গ ভেঙে পড়েছিল।
![]() |
|
কানাডিয়ান ঢাল-ভূখণ্ডের আদি ক্র্যাটনসমূহ |
৪০০-২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে
ছয়টি আদি
ক্র্যাটন
যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল
কানাডিয়ান ঢালভূখণ্ড।
এই
ক্র্যাটনগুলো
হলো- ওয়াইয়োমিং,
নাইন,
রেই,
সুপিরিয়র,
স্ল্যাভ ও
হেয়ার্ন।
এরপর পর্যায়ক্রমে
কানাডিয়ান ঢাল-ভূখণ্ড বিস্তার ঘটেছিল কুইবেকের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্ব
প্রান্তের হাডসন উপসাগর পর্যন্ত।
আবার দক্ষিণ দিকে অন্টারিও-এর উত্তরাঞ্চল থেকে
হুরোন হ্রদের উত্তর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে সুপিরিয়র হ্রদ পর্যন্ত। আবার অন্টারিও-এর
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে মানিটিবার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার ঘটেছিল। এছাড়া
মিন্নেসোটার পশ্চিমাঞ্চল থেকে ডাকোটার উত্তর দক্ষিণ বরাবর এর বিস্তার ঘটেছিল।
এর আয়তন
ছিল প্রায় ৮০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার।
৩৯৩ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে
এই ঢালভূখণ্ড-সহ মহাদেশীয় অন্যান্য ঢালভূখণ্ডগুলো কিছুটা সুস্থির এবং সুদৃঢ় দশায় পৌঁছেছিল।
বলা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের ঢাল তৈরির
প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ হয়েছিল এই সময়ে।
৩৯৩-৩৮৫ কোটি খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ:
এই সময় প্রচুর ভারি উল্কাখণ্ডের পতন ঘটেছিল। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা
কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। আবার একই সময় প্রবল বৃষ্টিও ছিল।
উভয় মিলে পৃথিবীর তাপমাত্রা একটি অস্থির দশায় পৌঁছেছিল।
এই অস্থির তাপমাত্রার প্রভাব পড়েছিল অগভীর এবং ভাসমান স্থলভূমিতে। বিশেষ
করে এর দ্বারা ৩৮৫ কোটি
খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের দিকে ভূত্বকে রূপান্তরিত শিলা সৃষ্টির প্রক্রিয়া সচল
হয়ে উঠেছিল নতুন ধারায়। এই সময় গ্রিনল্যান্ডের ফসফেটসমৃদ্ধ খনিজ পদার্থের সৃষ্টি
হয়েছিল।
এই সময়েই গ্রিনল্যান্ডের ইসুয়া সুপ্রাক্রাস্টাল বেল্ট (Isua Supracrustal Belt, ~৩৮৫-৩৭০
কোটি বছর) এবং আকাস্তা গ্নাইস (Acasta Gneiss, ~৪.০৩-৩.৯৪
কোটি বছর)
এর মতো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মেটামরফিক শিলা গঠিত ও রূপান্তরিত হয়।
ফসফেট-সমৃদ্ধ খনিজ (যেমন অ্যাপাটাইট)।
৩৮৫ -৩৮০
কোটি
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ:
পৃথিবীর প্রথম স্থিতিশীল যুগের সূচনা
হয়। উল্কাপাতের হার হঠাৎ কমে যাওয়ায় পৃথিবীর ভূত্বক দ্রুত ঠান্ডা ও স্থিতিশীল হতে শুরু করে।
৩৮০-৩৭০ কোটিখ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ:
এই সময়ের ভিতরে
ছোটো ছোটো ক্র্যাটন ও ঢাল-ভূখণ্ড মিলিত হয়ে প্রথম মহাদেশীয় ক্র্যাটনের
উদ্ভব হয়েছিল। এই সময় গ্রানাইড ব্লক তৈরি হয়েছিল এবং ইউক্রেইন
ঢাল-ভূখণ্ড এবং ভোরোনেঝ মাসিফ সংযুক্ত অবস্থায়
পূর্ব ইউরোপীয় ক্র্যাটনের সুসংহত দশায় পৌঁছেছিল। এই নতুন রূপ লাভের সূত্রে
ইউক্রেইন ঢাল-ভূখণ্ড এবং ভোরোনেঝ মাসিফের প্রাচীন পাথরগুলো
ভূত্বকের আরো গভীরে প্রবেশ করেছিল। পশ্চিম গ্রিনল্যাণ্ডের আদি পাললিক শিলাও
উৎপন্ন হয়েছিল এই সময়। এছাড়া ভাল্বারা মহা-মহাদেশের
কাপ্ভাল ক্র্যাটন উৎপন্ন হয় এই
সময়।
এর আয়তন ছিল প্রায় ১২ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে এই ক্র্যাটন
দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত।১. পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত অগ্ন্যুৎপাত
২. মিথেনোজেনিক আর্কিয়ার মিথেন উৎপদান। উল্লেখ্য এই ব্যক্টেরিয়া বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও হাইড্রোজেন গ্রহণ করে মিথেন উৎপন্ন করতো।
৪০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে সাগরজলে
এ্যামিনো
এ্যাসিড সৃষ্টির মধ্য দিয়ে জীব সৃষ্টির সূত্রপাত হয়েছিল। ক্রমবিবর্তনের
ধারায় ৪০০-৩৯০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে
আরএনএ ভিত্তিক জীবকণিকার বিকাশ ঘটেছিল এই সময়ের
ভিতরে। এই জীবকণিকা থেকেই
উদ্ভব হয়েছিল
প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ
এবং এই জাতীয় কোষ ভিত্তিক জীব। এই কোষে সুসংগঠিত ডিএনএ, মাইটোকণ্ড্রিয়া, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম, লাইসোজোম, গলজি বস্তু ছিল না। সেকালের এই কোষের আকার এক থেকে দশ মাইক্রোমিটার (µm) এর মধ্যে ছিল।
৩৯৬ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে পৃথিবীর আদিম সাগর ভরে উঠেছিল। এই সময়ে উৎপন্ন
নিউক্লেইক
এ্যাসিড এবং প্রোটিনের সম্মিলনে সৃষ্টি হয়েছিল
নিউক্লিয়োপ্রোটিন (Nucleoprotein)।
এই নিউক্লিয়োপ্রোটিন গঠনের মধ্য দিয়ে জীবজগত সৃষ্টির পথে আরও একধাপ এগিয়ে
দিয়েছিল। এই সময়
নিউক্লিয়োপ্রোটিনের অন্যতম অংশ নিউক্লিক এ্যাসিড বংশগতির ধারকের ভূমিকা গ্রহণ
করলে- জৈব-অণু হয়ে উঠলো জীবের আদি সদস্য। এক্ষেত্রে
বিশেষ ধরেনের কিছু প্রোটিন আদি জীবকোষে গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এই বিশেষ
ধরনের প্রোটিনকে বলা হয় উৎসেচক
(Enzyme)।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন আরএনএ জগতের সূচনার ভিতর দিয়ে শুরু হয়েছিল
জীবজগতের প্রকৃত যাত্রাপথ। এই ধারণা অবলম্বন করে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন
জীববিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার রিখ (Alexander Rich
(November 15, 1924 – April 27, 2015)
প্রথম একটি কল্প-প্রস্তাবনা উপস্থাপন
করেন। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে অপর মার্কিন জীববিজ্ঞানী ওয়াল্টার গিলবার্ট
(Walter
Gilbert) এই
ধারণার সাথে আরও কিছু বিষয় যুক্ত করেন। যদিও অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন যে,
আরএনএ-ভিত্তিক জীব সৃষ্টির আগেও অন্য ধরনের জীব সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত
প্রমাণ ও ব্যাখ্যার সূত্রে 'আরএনএ জগৎ' ধারণা অনেকটাই সুপ্রতিষ্ঠিত।
এই জটিল অণুগুলোর ভিতর ছিল
বংশগত তথ্য সংরক্ষণ করা
ও সুনির্দিষ্ট প্রোটিন অণু তৈরি করার ক্ষমতা। রাসায়নিক আসক্তির সূত্রে এই
এ্যাসিডগুলো গড়ে তুলেছিল
আরএনএ [ribonucleic acid (RNA)]
।
আরএনএ মূলত
জীবের বংশগতি নির্ধারক
জটিল অনুর দ্বারা গঠিত দীর্ঘ পলিমার বিশেষ। এর
মূল উপাদান
নিউক্লেইক এ্যাসিড । Phoebus
Levene নামক একজন রাশিয়ান বায়োকেমিষ্ট ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি ইস্ট
থেকে পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট একটি শর্করা অনু নিষ্কাষণ করেন এবং এর নাম দেন রাইবোজ
(Ribose)। সেখান থেকে এই নিউক্লিক এসিডের নামকরণ করা হয়েছে।
জীবের বংশগতি
নির্ধারক আরও একটি উপকরণ সৃষ্টি হয়েছিল এই সময়। একে বলা হয় ডিএনএ[deoxyribonucleic
acid (DNA)] ডিএনএ-কে
সাধারণভাবে বলা যায়-
জীবের বংশগতি নির্ধারক জটিল অনুর দ্বারা গঠিত
দীর্ঘ পলিমার বিশেষ।
সু-প্রাণকেন্দ্রিক
কোষ (Eukaryotic
cell)-এর
নিউক্লিয়াসে ডিএনএ থাকে।
পক্ষান্তরে
প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ (
Prokaryotes)
ডিএনএ কোষে সাইটোপ্লাজমে
থাকে। যেমন ব্যাকটেরিয়া। উৎসেচকের (enzyme)
মত ডিএনএ অধিকাংশ জৈবরসায়ন বিক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেয় না। মূলত, বিভিন্ন
উৎসেচক ডিএন-তে কার্যকরী ভূমিকা রেখে তথ্য নকল করে এবং আরো বহু ডিএনএ তৈরি
করে।
সময়ের ভিতরে
জীবনের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ তৈরি হয়েছিল সত্য, কিন্তু পুরোপুরি জীবের
জীবনযাত্রার পথ গড়ে উঠেনি। এসকল ডিএন বা আরএনএ সাগরজলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে
রাখার জন্য নিজস্ব পরিবেশ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এই পরিবেশ তৈরির সূত্রে এ সকল
উপকরণকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল আবরণ। এই আবরণের ভিতরে ডিএন বা আরএনএ
এবং অন্যান্য সহায়ক জৈব অণু দিয়ে তৈরি হয়েছিল অর্ধতরল পদার্থ। এই প্রক্রিয়ার
ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক
কোষ এবং এই জাতীয় কোষ ভিত্তিক জীব।
গ্রিক শব্দ
Pro
(আদি বা পূর্ব) ও karyotic
(নিউক্লিয়াস বা প্রাণকেন্দ্র) -এর সমন্বয়ে এই শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে।
এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল
আর্কিয়া জীব-স্বক্ষেত্রের
আদি জীবসমূহ। এরা মিথেনোজেন বা অ্যাসিটোজেন
(methanogens, acetogens)
– অর্থাৎ H₂ + CO₂ ব্যবহার করে মিথেন বা অ্যাসিটেট তৈরি করত। অনেকে গন্ধক-শ্বসনকারী
(sulfur respirers) ছিল।
এরা বাস করতো গভীর সমুদ্রতলের হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট (ব্ল্যাক ও হোয়াইট স্মোকার)
এবং ছিদ্রযুক্ত গরম শিলাৱ উপরিভাগে। সমুদ্রের উপরিভাগে এরা থাকতো না। এদের
বাসস্থানের তাপমাত্রা ছিল ৭০-১১০°সে। উল্কাপাতে পৃথিবীর উপরিতলের জীব ধ্বংস হয়ে
গেলেও নিচের স্তরের জীব বেঁচে গিয়েছিল।
ধারণা করা হয়, সবচেয়ে প্রাচীন জীব সম্ভবত হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট বা গরম ঝরনার আশেপাশে বাস করত।
কেমোলিথোট্রফ বা কেমো-অর্গানোট্রফ (H₂, H₂S, Fe²⁺, CO ইত্যাদি থেকে শক্তি পেত)।
এসব কোষের আদি দশায় ছিল ডিএনএ
বা আরএনএ এবং অন্যান্য সহায়ক জলীয় উপকরণের চারপাশে প্রোটিনের
আবরণ তৈরি হয়েছিল। এই আবরণ ডিএনএ বা
আরএনএ-কে রক্ষা করতো। ফলে এই কোষগুলো হয়ে উঠেছিল নিউক্লিওপ্রোটিন মাত্র। এই
প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে
প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ-গুলো
আদিম ভাইরাসে পরিণত হয়েছিল। এরা সজীব হয়েও ছিল জড়পদার্থের মতো। এদের ভিতরে
প্রাণের প্রকাশ ঘটলো তখনই যখন এরা অন্য আদি জীবকণিকা অধিকার করে বংশবৃদ্ধি শুরু
করেছিল। এবং নিজেদের পরিবর্তন করার ক্ষমতা অর্জন করেছিল।
এই ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ভাইরাস জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী সত্তায় পরিণত
হয়েছিল। এদের দেহ তৈরি হয়েছিল ডিএনএ বা আরএনএর দ্বারা। এই দুই ধরনের নিউক্লিক
এ্যাসিডের সূত্র ভাইরাসগুলো ডিএনএ ভাইরাস এবং আরএনএ ভাইরাসে পরিণত হয়েছিল।
৩৯০-৩৮০
কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ:
প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ-ভিত্তিক
আদি জীবকণিকা
থেকে ব্যাক্টেরিয়ার উদ্ভব হয়েছিল। বর্তমানে ব্যাক্টেরিয়াকে জীবস্বক্ষেত্র
(Domain)
হিসেবে
বিবেচনা করা হয়।
এই জাতীয় কিছু জীবকণিকার দেহে ভিন্নতর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদিম
ব্যাক্টেরিয়ার উদ্ভব হয়েছিল। এদের দেহের পলিপেপটাইড এবং
পলিস্যাকারাইড হাইড্রোকার্বন দিয়ে তৈরি হয়েছিল পিচ্ছিল ও আঠালো স্তর। একে বলা
হয় ব্যাক্টেরিয়ার ক্যাপসুল। এই ক্যাপসুলের ভিতরে সৃষ্টি হয়েছিল
প্রোটিন,
লিপিড,
পলিস্যাকারাইডের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল ১০ থেকে ২৫ মাইক্রোমিটার পুরু কোষপ্রাচীর।
কোষপ্রাচীরের ভিতরের দিকে ফসফোলিক এ্যাসিড ও প্রোটিনের সমন্বয়ে কোষীয় পর্দা বা
প্লাসমা মেমব্রন তৈরি হয়েছিল। এই কোষীয় পর্দার ভিতরে আবদ্ধ হয়েছিল অর্ধস্বচ্ছ,
বর্ণহীন, জেলির মতো অর্ধ-তরল আঠালো সজীব পদার্থ। তবে এতে অজৈব পদার্থও ছিল। এতে
ছিল প্রচুর পানি। এই পানিতে মিশে ছিল নানা ধরনের জৈব পদার্থ। যেমন-
প্রোটিন,
কার্বোহাইড্রেড
ও
লিপিড। অজৈব পদার্থ হিসেবে ছিল-
অক্সিজেন,
হাইড্রোজেন,
নাইট্রোজেন,
কার্বন,
তামা,
দস্তা,
পটাশিয়াম,
সোডিয়াম,
ম্যাগনেশিয়াম,
ক্যালসিয়াম,
গন্ধক,
লৌহ ইত্যাদি।
তবে এদের দেহে কোনো
নিউক্লিয়াস তৈরি হয় নি তখনও। এদের প্রোটিন সংশ্লেষণের
নিউক্লেইক এ্যাসিড ও হিস্টোন জাতীয়
প্রোটিন
দিয়ে তৈরি হয়েছিল জন্য
সৃষ্টি হয়েছিল রাইবোজম। একারণে এদেরকে বলা হয় রাইবো-নিউক্লিয়িক প্রোটিন
পারটিকল বা সংক্ষেপে আরএনপি (RNP)।
এদের দেহ দ্বি-স্তরী ঝিল্লী দ্বারা আবৃত। ব্যাস প্রায় ৯০-১৬০ অ্যাংস্ট্রম। এদের
আকার গোলাকার বা ডিম্বাকার হয়ে থাকে। রাইবোজোম মুলত
70S ও 80S এই দুই প্রকার
হয়ে থাকে।
প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ-এ
70S রাইবোজোম পাওয়া যায়।
পক্ষান্তরে
সু-প্রাণকেন্দ্রিক
কোষ -এ
পাওয়া যায় 80S রাইবোজোম। তাই বলা
যায়, এই সময় 70S রাইবোজোম সৃষ্টি
হয়েছিল।
এতে তখনও
কোনো
সুষ্পষ্ট
প্রাণকেন্দ্র
তৈরি হয় নি।
এই জাতীয় কোষ নিয়ে গঠিত অধিকাংশ প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষযুক্ত জীবদেহ একটি
মাত্র কোষ দ্বারা গঠিত হয়েছিল। এই কোষে সুসংগঠিত ডিএনএ, মাইটোকণ্ড্রিয়া,
এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম, লাইসোজোম, গলজি বস্তু ছিল না। সেকালের এই কোষের আকার
এক থেকে ১০-২৫ মাইক্রোমিটার (µm)
এর মধ্যে ছিল।
![]() |
|
এ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট (ATP) |
এই কারণে এই সময়ে বাতাসে অক্সিজেন পরিমাণ বৃদ্ধি পায় নি। কিন্তু উৎপন্ন শর্করাকে শক্তিতে পরিণত করার জন্য জীবদেহে শ্বসন প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জীব ব্যবহার করে বাতাসের অক্সিজেন। কিন্তু সে সময়ে বাতাসে অক্সিজেন খুবই কম ছিল। এই কারণে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে এই যুগে জীবদেহে ঘটেছিল অবাত শ্বসন। মূলত এই অবাত শ্বসনের দ্বারাই ব্যাক্টেরিয়া শর্করা থেকে শক্তি অর্জন করতো। জীববিজ্ঞানীরা এই অবাত শ্বসনের প্রক্রিয়াকে বলে থাকেন গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis)।
৩৮০-৩৬০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ: এই সময়ের ভিতরে ব্যাক্টেরিয়াকুলে বিবর্তন চলছিল। এদের কিছু কিছু প্রজাতির দেহে আলোক-শোষণ ক্ষমতার উদ্ভব হয়েছিল। এ সকল উপকরণ দ্বারা শোষিত আলো এবং ব্যাক্টেরিয়ার দেহগত উপকরণ দ্বারা প্রক্রিয়াজাত হয়ে শক্তিতে পরিণত হতো। এই সময়ের ভিতরে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পাশাপাশি ব্যাক্টেরিয়ার জৈবিক কার্যক্রমের সূত্রে গন্ধকের আধিক্য ঘটেছিল সাগরের জলে। কোনো ব্যাক্টেরিয়ার সূত্রে লৌহঘটিত উপাদানও সাগরের তলদেশে জমা হয়েছিল। এরই ভিতরে ব্যাক্টেরিয়া জগতে নতুন দিগন্ত খুলে দিল সায়ানোব্যাক্টেরিয়া। এদের দেহে কার্বন , হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও ম্যাগনেশিয়াম-এর একটি যৌগিক অণুর সাথে- হাইড্রোকার্বন যৌগ যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছিল ক্লোরোফিল। সায়ানোব্যাক্টেরিয়াগুলোতে দুই ধরনের ক্লোরোফিলে যুক্ত হয়েছিল। ধরন দুটি হলো−
প্রতিটি বিভাগের সাথে যুক্ত থাকে পর্ফাইরিন (porphyrin) বলয়। এর কেন্দ্রে থাকে ম্যাগনেসিয়াম Mg++) আয়ন। এই আয়নগুলো ছিল -CHO, -CH=CH2, CH3, -CH2CH3, -CH2CH2COO। এর ভিতরে Chlorophyll f -এর আদি নমুনা পাওয়া গেছে পশ্চিম অষ্ট্রেলিয়ার শার্ক উপসাগরীয় অঞ্চলের পাথরে।
এতসব ব্যাক্টেরিয়ার ভিতরে জড় ও জীবজগতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছিল অক্সিজেনত্যাগী ব্যাক্টেরিয়াগুলো। এদের কারণে এই যুগের পরবর্তী সময়ে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমে গিয়েছিল এবং পৃথিবীতে প্রথম বরফ যুগের আবির্ভাব হয়েছিল। অক্সিজেনত্যাগী ব্যাক্টেরিয়াগুলোর ভিতরে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় 'সায়ানোব্যাক্টেরিয়া' পর্বের জীবসত্তাগুলোকে।
সায়ানোব্যাক্টেরিয়া
পর্বের
ব্যাক্টেরিয়াগুলো দেহে সি-ফাইকোসায়ানিন নামক নীল কণিকা এবং সবুজ বর্ণের
ক্লোরোফিল
থাকায় এদের দেহের রঙ দেখায় নীলাভসবুজ। সালোকসংশ্লেষণ
প্রক্রিয়ার কারণে এরা হয়ে উঠেছিল অক্সিজেনত্যাগী স্বভোজী। এদের দেহে কোনো
ফ্লাজেলা (চাবুকের মতো সরু অঙ্গ) না থাকায় চলাচলে অক্ষম ছিল। এদের
বংশবিস্তার হতো অযৌন প্রক্রিয়ায়। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল ডিএনএ বা
আরএন সমৃদ্ধ সেন্ট্রোজোম। সবুজ কণিকা সৃষ্টির কারণে এদের দেহে সৃষ্টি
হয়েছিল ক্রোমোপ্লাজম। দেহে সৃষ্টি হয়েছিল ছোটো ছোটো গ্যাসপূর্ণ কোষগহ্বর।
এদেরকে বলা হয় সিউডুভ্যাকুওল।
ধারণা করা হয় এই পর্বের
ব্যাক্টেরিয়াই
প্রথমবারের জৈবিক প্রক্রিয়ায় মুক্ত
অক্সিজেন
বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই
অক্সিজেন
লৌহের সাথে বিক্রিয়া করে আয়রন অক্সাইড (Fe3O4)
বা ম্যাগনেটাইট উৎপন্ন করতে থাকে এবং তা সাগরতলের মাটিতে জমা হয়। একে
বিজ্ঞানীরা
স্ট্রোমাটোলাইটস
নামে
চিহ্নিত করে থাকেন। এদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে অস্ট্রেলিয়ার
পশ্চিমাঞ্চলের পিলবারা অঞ্চলে। এছাড়া এদের নোস্টোক গণের প্রজাতিগুলো
বাতাসের মুক্ত নাইট্রোজেন গ্রহণ করে, বাতাসের নাইট্রোজেনের আধিক্য কমিয়ে
দিয়েছিল।
এই যুগের পরে শুরু হয় প্যালেয়োআর্কিয়ান যুগ। এর ব্যাপ্তীকাল ছিল ৩৬০ কোটি থেকে ৩২০ কোটি পূর্বাব্দ।
সূত্র
http://en.wikipedia.org/wiki/Paleogene