ডিএনএ
DNA
(Deoxyribo Nucleic
Acid)
[অভিধান
ডিএনএ]
জীবের বংশগতি নির্ধারক জটিল অনুর দ্বারা গঠিত
দীর্ঘ পলিমার বিশেষ।
সু-প্রাণকেন্দ্রিক
কোষ (Eukaryotic
cell)-এর
নিউক্লিয়াসে ডিএনএ থাকে। পক্ষান্তরে
প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ (
Prokaryotes)
ডিএনএ কোষে সাইটোপ্লাজমে থাকে।
যেমন
ব্যাক্টেরিয়া।
উৎসেচকের (enzyme)
মতই ডিএনএ অধিকাংশ জৈবরসায়ন বিক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেয় না। মূলত, বিভিন্ন উৎসেচক
ডিএন-তে কার্যকরী ভূমিকা রেখে তথ্য নকল করে এবং আরো বহু ডিএনএ তৈরি করে।
প্রাথমিক বিশ্লেষণ ডিএনএ-কে দুটি প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই উপাদান দুটি হলো−
ডিএনএ
মেরুদণ্ড:
এই অংশটি ডিএনএর দুটি প্রান্তে সুতার মতো থাকে। এর মূল উপাদান হলো
ডিঅক্সিরাইবোজ এবং
ফসফেট ভিত্তিক দীর্ঘ অণু। একে অনেক সময় ডিএনএ সূত্র বলা হয়।
ভিত্তি: দুটি ক্ষারের সমন্বয়ে গঠিত দীর্ঘাকার অণু ডিএন-এর ভিত্তি। এই কারণে একে বলা হয় জোড়া ভিত্তি (Base pairs)। মূলত চারটি ক্ষার পর্যায়ক্রমে জোড়া বেঁধে বেঁধে থাকে। এই চারটি ক্ষার হলো−
A= adenine (এডেনিন)
G =guanine (গুয়ানিন)
C=cytosine (সাইটোসিন)
T=thymine (থাইমিন)
একটি শিকলের ভিত্তি বা (Base)-
এর নির্দিষ্ট অবস্থানের হাইড্রোজেন পরমাণুটি পজিটিভ চার্জ ধারণ করে। আবার অন্য
শিকলের নির্দিষ্ট অবস্থানের অক্সিজেন অথবা নাইট্রোজেন পরমাণুটি নিগেটিভ চার্জ ধারণ
করে থাকে। তখন এই দুই বিপরীত মুখী চার্জের মধ্যে আকর্ষণের ফলে উভয় শিকল বাধা পড়ে
যায়। এক্ষেত্রে দুর্বল হাইড্রোজেন-বন্ধন কাজ করে। এই কারণে কোষ বিভাজনের সময় সহজেই
দুটি শিকল পৃথক হতে পারে।
ডিএনএ-র মেরুদণ্ড এবং
ভিত্তিসমূহ নিয়ে তৈরি হয়ে একটি দ্বৈত এবং দীর্ঘ পলিমার তৈরি হয়। এই পলিমার প্যাঁচানো অবস্থায় থাকে।
এর এক প্যাচ থেকে অন্য প্যাচের মধ্যকার দূরত্ব ৩.৪ ন্যানোমিটার আর ব্যাস ১
ন্যানোমিটার। মানুষের ক্রোমোজোমে এই দূরত্ব প্রায় ৮৫ মিলিমিটার হয়ে থাকে।
এউ দুটি প্যাচানো পলিমার দুটি পরস্পরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। উল্লেখ্য, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক জীব বিজ্ঞানী জেমস ডি ওয়াটসন এবং
তাঁর দুজন সহকারী ফ্রান্সিস ক্রিক ওয়াটসন ও মরিস ভিকিনস ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে
ডিএনএর কিছু উপাদান আবিষ্কার করেন। এই সময় তাঁরা প্রথম প্যাচানো
দীর্ঘ পলিমারের সন্ধান পান। ।
ভিত্তি হিসেবে অবস্থিত ক্ষারগুলোর সংযোগের
ভিত্তি হিসেবে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটি
হলো−
নিউক্লিওসাইড: কোনো ক্ষার যখন চিনির ডিএনএ সূত্রের চিনির অণুর সাথে যুক্ত থাকে, তখন তাকে বলা হয় নিউক্লিওসাইড।
নিউক্লিওটাইড : কোনো ক্ষার যখন ডিএনএ সূত্রের একটি চিনি ও এক বা একাধিক ফসফেট অণুর সাথে যুক্ত থাকে তাকে বলে নিউক্লিওটাইড।
ডিঅক্সিরাইবোজ ফসফেট গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে পাশাপাশি ডিঅক্সিরাইবোজ -এর মধ্যে তৃতীয় ও পঞ্চম কার্বন পরমাণুর স্থানে ফসফোডিয়েসটার বন্ধন গঠন করে। এই অপ্রতিসম বন্ধন বোঝায় যে ডিএনএ অণুর মেরু বা দিক আছে। দ্বৈত হেলিক্সে এক সূত্রের নিউক্লিওটাইডের দিক অন্য সূত্রের ঠিক বিপরীত দিকে থাকে। ডিএনএ সূত্রের এই ধরনের বিন্যাসকে প্রতিসমান্তরাল বলে। ডিএনএর অপ্রতিসম প্রান্তকে বলে ৫’ (ফাইভ প্রাইম) এবং ৩’ (থ্রি প্রাইম) প্রান্ত। ডিএনএ ও আরএনএর মধ্যকার একটি প্রধান পার্থক্য হলো চিনিতে, যেখানে ডিএনএতে ২-ডিঅক্সিরাইবোজ ব্যবহৃত হয় সেখানে আরএনএতে আরেকটি পেন্টোজ চিনি রাইবোজ ব্যবহৃত হয়।
ডিএনএ শিকলের যে অংশটি বংশগতির সংকেত বহন করে সেই অংস কে বলে জিন (GENE)। এর বাকি অংশ বংশগতির সংকেতকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন প্রজাতির বংশগতির সংকেত একটি সুদৃঢ় প্যাকেটের মতো থাকে। একে জীববিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ক্রোমোজোম (Chromosome)। এই প্যাকেট সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে হিস্টোন (Histone) নামক এক ধরনের বিশেষ প্রোটিন। প্রতিটি প্রজাতির ক্রোমোজোম নির্দিষ্ট সংখ্যায় থাকে। যেমন হোমো স্যাপিয়েন্স তথা মানুষের ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৩ জোড়া। মানুষের শরীরের প্রত্যেকটি কোষের প্রাণকেন্দ্রের ভিতর প্রায় ৩০০ কোটি বেজ পেয়ারযুক্ত ডিএনএ কুণ্ডলিত আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১ মিটার।
ডিএন-এর মধ্যে রক্ষিত বংশগতির সঙ্কেত
অনুসারে প্রতিটি প্রজাতি প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে টিকে থাকার পথ খুঁজে পায়।
এক্ষেত্রে এই সঙ্কেত যথাসম্ভব পরিবেশ উপযোগী শারীরীক পরিবর্তন ঘটায়। দীর্ঘদিন ধরে
এই শারীরীক পরিবর্তন যদি ধরে রাখতে হয়, তাহলে প্রজাতির ডিএন-এর ভিতর তা লিখিত হয়ে
যায়। প্রজাতির এই সূক্ষ্ম শারীরীক পরিবর্তনের সূত্রে আরও কিছু পরিবর্তন ঘটে। বিষয়টি
বংশ পরম্পরায় চলতে চলতে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। প্রথমদিকের প্রজন্মের সাথে আদি
প্রজন্মের এই পার্থক্য ধরা পড়ে না। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দুটি পৃথক প্রজাতি হিসেবে
আত্মপ্রকাশ করে। কোনো প্রজাতি যদি এই বংশগতির সংকেত বংশধরদের পাঠাতে ব্যর্থ হয়,
তাহলে নবজাতক মৃত্যুবরণ করে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে, এক সময় পুরো প্রজাতিটিই
বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ডিএনএ-র গবেষণার ইতিহাস
এরভিন শ্র্যোডিঙার এর- “What is
Life?” নামক বইটি ছিল বিংশ শতাব্দীর
একটি বিশেষ আলোচিত গ্রন্থ। বইটি পড়ে কিছু পদার্থবিজ্ঞানী জীববিজ্ঞানের প্রতি
আকৃষ্ট হন এবং সেই আকর্ষণের সূত্র ধরেই একসময় ডিএনএ’র গঠনপ্রকৃতি আবিষ্কৃত হয়।
শ্র্যোডিঙার অ্যাপিরিয়ডিক
ক্রিস্টাল নামক একটি অণুর কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে এই বিশেষ অণুটিই হলো জীবনের বাহক। এই
ভবিষ্যৎবাণীর প্রায় ১০ বছর পর ডিএনএ অণুর গঠনপ্রকৃতি আবিষ্কৃত হয়।
১৮৬৮-৬৯
খ্রিষ্টাব্দের দিকে তরুণ সুইডিস চিকিৎসক ফ্রেডরিক মীসার
রক্তের শ্বেত কণিকার উপাদান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ডিএনএ-এর সন্ধান পান। এরপর থেকে
বিজ্ঞানীদের ধারণা জন্মে প্রোটিনই বংশগতির মূল বৈশিষ্ট্য বহন করে। আর ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক অ্যাসিড বা ডিএনএ
গঠিত হয় প্রোটিন দ্বারা। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানী অসওয়ার্ড এভরি, কলিন
ম্যাকলিওড এবং ম্যাকলিন ম্যাকার্থি নিউমনোকক্কাস ব্যাকটিরিয়ার ওপর গবেষণা করে
সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রোটিন নয় বরং নিউক্লিয়িক অ্যাসিড দিয়ে গঠিত ডিএনএ-ই
প্রাণীর বংশগতির উপাদান।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ফ্রান্সিস ক্রিক এবং
জেমস ডি ওয়াটসন ডিএনএর গঠন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। নিউক্লিক অ্যাসিডের আণবিক গঠন
এবং জীবিত বস্তুতে তথ্য স্থানান্তরের ক্ষেত্রে এদের তাৎপর্য সংক্রান্ত আবিষ্কারের
জন্য ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে এঁরা নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ আমেরিকার জেডি ওয়াটসন, এমএইচএফ উইলকিন্স এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এফএইচসি ক্রিক ডিএনএর রাসায়নিক গঠন বর্ণনা করে জিনতত্ত্বকে হঠাৎ করেই কয়েক দশক এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁরা বের করেন যে, ডিএনএতে চারটি উপাদান বিদ্যমান- এডিনিন, গুয়ানিন, থায়ামিন ও সাইটোসিন। কিন্তু তখনও তাঁরা এ সকল উপাদানে ক্রমনির্দেশ উপস্থাপন করতে সক্ষম হন নি। জর্জ গ্যামো এই সমস্যা সমাধানের পথনির্দেশ দিয়েছিলেন।
১৯৬৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল
টিম প্রথম জিন শনাক্ত করে এর আচরণ ব্যাখ্যা করেন।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকান প্রাণরসায়ণবিদ স্ট্যানিল কোহেন এবং হারবার্ট বয়ার
আফ্রিকান ব্যাঙের ওপর পরীক্ষা চালান। এই পরীক্ষা চালানো হয়েছিল আফ্রিকান ব্যাঙের
জিনকোডে একপ্রকার ব্যাকটিরিয়ার জিন প্রবেশ করিয়ে । এই পরীক্ষাটিকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভিত্তি হিসেবে
বিবেচনা করা হয়। মূলত সে সময় থেকে জেনেটিক কোম্পানি স্থাপনের চিন্তাভাবনাও করেন
অনেকে। এই সূত্রে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে প্রথম জেনেটিক
ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি স্থাপিত হয়।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী মার্টিন কলিন এবং তাঁর সহকর্মীরা এক প্রাণীর জিন অন্য
প্রাণীর দেহে স্থানান্তর করিয়ে সর্বপ্রথম ট্রান্সজেনিক ইঁদুর তৈরি করেন।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে লিচেস্টারশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যালেক জেফ্রিস জেনেটিক
ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে অপরাধী শনাক্তকরণে ডিএনএ ব্যবহার আবিষ্কার করেন এবং
পরবর্তী বছর থেকেই পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে স্কটল্যান্ডের রজলিনবার্ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী আয়ান ভিলমুট
ক্লোনিঙের মাধ্যমে একটি ভেড়া উৎপন্ন করেন। একটি স্ত্রী ভেড়ার শরীর থেকে কোষ নিয়ে
সেটিকে বহুবিভাজিত করে তিনি ডলি নামের ভেড়াটি উৎপন্ন করার মাধ্যমে জিনতত্ত্বের এ
পর্যন্ত সেরা উদ্ভাবনটি করেন। তিনি যে পদ্ধতিতে ভেড়া উৎপন্ন করেন, সে পদ্ধতিতে যে
কোনো প্রাণী এমনকি মানুষও উৎপন্ন করা যাবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।