আফজাল-উল-হক
(১৯০৬-১৯৮২)
সাংবাদিক ও প্রকাশক।
আফজাল-উল-হকের জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু জানা যায় না।
মোসলেম
ভারত পত্রিকা এবং
কাজী নজরুল ইসলামের সাথে বিশেষ
সম্পর্কের কারণে, তাঁকে বহুক্ষেত্রে আলোচ্য ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
আফজাল-উল-হকের পিতা ছিলেন- শান্তিপুর নিবাসী
কবি মোজাম্মেল হকের পুত্র।
তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কলকাতায় কিভাবে বসবাস শুরু হয়েছিল, তা জানা যায় না।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি পল্টন ভেঙে যাওয়ার পর,
কাজী নজরুল ইসলাম
শেষ পর্যন্ত '৩২ নং কলেজ স্ট্রীটস্থ
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে
আশ্রয় পেয়েছিলেন, সমিতির তৎকালীন কর্ণধর ভোলা নিবাসী
মোজাম্মেল
হকের আনুকূল্যে।
এই সময় আফজাল-উল হক এই বাড়ির একটি কক্ষ মাসিক ২২টা ভাড়ায় বসবাস
শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে
মোজাম্মেল হক ও
মুজাফ্ফর আহমদ
এর লেখা থেকে '৩২ নং কলেজ স্ট্রীটস্থ 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'
সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির
আপিসের কার্যক্রম পরিচালিত হতো- ৪৭/১ নম্বর মীর্জাপুর সড়কস্থ বাড়ির নিচ তলার একটি
ছোট ঘরে। মাসিক ভাড়া ছিল ২ টাকা। এই ঘরে
মোজাম্মেল হক
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র ফ্রি রিডিং লাইব্রেরি স্থাপন
করেছিলেন। ক্রমে ক্রমে লাইব্রেরির সদস্য ও পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়, ৩২ নম্বর
কলেজ স্ট্রিটের ২/৩ কে শীল, এল. এম. এস-এর দোতলার সামনের দিককার বারান্দা-সহ
দুটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছিল মাসিক ৬০ টাকায়। এই বাড়ির এই অংশটি বাড়ীর অন্য অংশের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।
অফিসে প্রবেশের জন্য রাস্তা থেকে ওপরে উঠে আসার সিড়ি ছিল।
সামনের দিককার দু'খানা ঘরের একখানায় ছিল সাহিত্য সমিতির আফিস। আর একখানা ঘর সাহিত্য
সমিতির নিকট হতে মাসিক ২২টাকা হিসেবে ভাড়া নিয়েছিলেন আফজালুল হক সাহেব। উল্লেখ্য,
৩ নম্বর কলেজ স্কোয়ারে কুমিল্লার
আশরাফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর সঙ্গ যুক্ত মালিকানায় আফজালুল হক সাহেবের পুস্তকের দোকান ছিল। তার নাম ছিল-
"মোসলেম পাবলিশিং" হাউস।'
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের শুরুর দিকে নদীয়া আফজাল-উল হক
মোসলেম
ভারত নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে মুজফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে [পৃষ্ঠা: ৫৩] লিখেছেন-
নজরুল যেদিন এসেছিল সে রাত্রেই তাকে দিয়ে আফজাল
সাহেবের ঘরে আমরা গান গাইয়ে নিয়েছিলেম একথা আমি আগে
বলেছি। মোসলেম ভারতের কিছু কিছু লেখা প্রেসে চলে
গিয়েছিল। পরের মাসেই তো বা'র হবে কাগজখানা। আমার
সম্মুখে সেই রাত্রেই 'মোসলেম ভারতে' লেখা দেওয়ার বিষয়ে
আফজালুল হক সাহেবের সঙ্গে নজরুলের কথাবার্তা হয়ে গেল।
আফজাল সাহেব সে রাত্রে নজরুলের ওপরে কতটা ভরোসা করতে
পেরেছিলেন তা জানিনে, তবে তার কাছ থেকে লেখা তিনি
চেয়েছিলেন।'
তিনি পত্রিকার প্রচার ও প্রসারের জন্য এই পত্রিকার সম্পাদকের নাম হিসেবে
তাঁর পিতা
মোজাম্মেল হকের
নাম ব্যবহার করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে পত্রিকাটির সম্পাদনা থেকে যাবতীয় কর্মকাণ্ড
পরিচালনা করতেন
আফজাল-উল হক। সে সময়ে ৩ কলেজ
স্কোয়ারে
আফজাল-উল হকের 'মোসলেম পাবলিশিং হাউস' নামক একটি প্রকাশনা সংস্থা
ছিল। ফলে তাঁর জন্য পত্রিকা প্রকাশের জন্য বাড়তি সুবিধা ছিল।
আফজাল-উল হক ছিলেন সফল ব্যবসায়ী। তাই পতত্রিকার কাটতির জন্য যেমন
পিতা
মোজাম্মেল হকের
নাম ব্যবহার করেছিলেন। একই সাথে
নজরুলের
সৃজনশীল রচনার ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি
করে নিয়েছিলেন।
পত্রিকার সম্পাদক
মোজাম্মেল হক
সে সময়ে বয়সের কারণে নিষ্ক্রিয় থাকলেও নজরুল এই পত্রিকা নিয়ে মেতে উঠেছিলেন।
ফলে এই
মাসের প্রথম থেকেই তিনি এই পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। পত্রিকাটির
প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল
১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (এপ্রিল
১৯২০)।
১৯২০ ডিসেম্বর মাসের দিকে
তৎকালীন রাজনৈতিক ভাবনা এবং সমসাময়িক নানাবিধ কারণে
নজরুল বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।
সম্ভবত পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক
ফজলুল হকের
সাথে তাঁর কিছুটা মতানৈক্য ঘটেছিল।
এই অবস্থা থেকে
নজরুলকে কিছুদিন কলকাতার বাইরে থাকার
পরমার্শ দেন
আফজাল-উল হক। তাঁদের পরামর্শে
নজরুল ডিসেম্বর মাসে কলকাতা ত্যাগ করে দেওঘর যান। উল্লেখ্য, দেওঘর বর্তমানে
ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশের দেওঘর জেলার
জেলাসদর। সে সময়ে দেওঘর ছিল সাঁওতাল পরগণার অংশ। দেওঘরে থাকার ব্যবস্থা হিসেবে
'মোসলেম ভারত' পত্রিকার পরিচালক আফ্জাল-উল হক,
নজরুলের সাথে একটি চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুসারে নজরুল দেওঘরে যা কিছু রচনা
করবেন, তার সবই '
মোসলেম ভারত'-এ প্রকাশিত হবে এবং এর জন্য নজরুলকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা দেওয়া
হবে।
দেওঘরে থাকার সময় নজরুলের
কাছ থেকে উল্লিখিত ৩টি গানের ২টি এবং ২টি কবিতা পেয়ে
'মোসলেম ভারত' পত্রিকার পরিচালক আফজাল-উল হক বিরক্ত হন। তিনি আশা করেছিলেন, অখণ্ড
অবসরের থাকায়, নজরুল প্রচুর কবিতা ও গান রচনা করবেন। এই সময় আফজাল-উল হক তাঁকে
নিয়মিত টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন। ফলে দেওঘরে
নজরুল আথিক সঙ্কটে পড়েন। এছাড়া
কলকাতার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের ছেড়ে বাস করতে গিয়ে
নজরুল হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। এই
অবস্থায়
মুজাফ্ফর আহমদ এবং তাঁর বন্ধু ইমদাদুল্লাহ দেওঘরে নজরুলের সাথে দেখা করার
জন্য যান। সেখানে নজরুলের আর্থিক দুরবস্থা দেখে, মুজফ্ফর আহমেদ তাঁর বন্ধু
ইমদাদুল্লাহর কাছ থেকে টাকা ধার করে, নজরুল এবং তাঁর রান্না ছেলে আব্দুল্লাহকে
কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং মুজফ্ফর আহমেদের
১৪/২ চেতলা হাট রোডে বাসায় উঠেন।
দেওঘর থেকে
নজরুলের ফিরে আসার সংবাদ পেয়ে আফজাল-উল হক, ১৪/২ চেতলা হাট রোডের বাসায় এসে নজরুলের সাথে দেখা করেন। তিনি নজরুলের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবেন এই আশ্বাস দিয়ে
৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির অফিসে
নিয়ে যান।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের
শেষের দিকে নজরুল ইসলাম, কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাসায়, তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী'
রচনা করেন। মুজাফ্ফর আহমদ ছিলেন এই কবিতাটির প্রথম শ্রোতা।
একটু বেলা বাড়ার পর,
আফজাল-উল হক আসেন।
নজরুল তাঁকেও কবিতাটি শোনান। পরে কবিতাটির একটি কপি করে মোসলেম ভারতে প্রকাশের
জন্য
আফজাল-উল হককে দেন।
১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬ শ্রাবণ (শুক্রবার ১১ আগষ্ট ১৯২২
খ্রিষ্টাব্দ),
৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিট থেকে,
ধূমকেতু
পত্রিকাটির
প্রকাশনা শুরু হয়েছিল। এর সারথী (সম্পাদক) ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন
কাজী নজরুল ইসলাম।
কর্মসচিব (ম্যানেজার) ছিলেন শান্তিপদ সিংহ। প্রকাশক ও মুদ্রাকর ছিলেন
আফজাল-উল হক।
ধূমকেতুর প্রথম বর্ষ বিংশ সংখ্যা প্রকাশের পরের দিন [৮ ই নভেম্বর (মঙ্গলবার ২২ কার্তিক ১৩২৯)] রাজদ্রোহিতার অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায়, পত্রিকার সম্পাদক নজরুল ইসলাম এবং মুদ্রাকর প্রকাশক
আফজাল-উল হকের বিরুদ্ধে গ্রফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এই সময় ৩২ কলেজ স্ট্রিট থেকে আফজাল-উল হককে গ্রেফতার করা হয়।
নজরুল গ্রেফতার এড়ানোর জন্য সমস্তিপুরে চলে যান।
২৩শে নভেম্বর (বৃ্হস্পতিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৩২৯) বেলা ১২টার সময়
নজরুলকে পুলিশ গ্রেফ্তার করে। এই উৎসুক জনতা তাঁকে দেখার জন্য জড় হতে থাকলে, প্রশাসন নজরুলকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
২৯শে নভেম্বর (বুধবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩২৯)
নজরুলকে ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিটের পুলিশ কোর্টের চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাশে হাজির করা হয়। এই দিন রাজাদ্রোহিতার
মামলা শুরু হয়। এই মামলায় বিনা পারিশ্রমিকে কবির পক্ষে মামলা চালান আইনজীবী মলিন মুখোপাধ্যায়। এই মামলায় পত্রিকার প্রকাশক
আফজাল-উল হককে সরকার পক্ষের সাক্ষী করা হয়েছিল। শুনানি শেষে
নজরুলকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়।
আফজাল-উল হকের পরবর্তী জীবনাচার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা
যায় না।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র:
-
নজরুল ইসলাম ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন।
নজরুল-স্মৃতিচারণ। রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত। নজরুল একাডেমী, ঢাকা। ২৫ মে, ১৯৯৫।
- নজরুল-জীবনী। রফিকুল ইসলাম। নজরুল ইন্সটিটউট, ঢাকা।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ।
-
কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা। মুজফ্ফর আহমদ। ন্যাশনাল
বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। ১২ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা-১২।
প্রথম সংস্করণ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫।৫।
- বিদ্রোহী-রণক্লান্ত, নজরুল জীবনী। গোলাম মুরশিদ। প্রথমা,
ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ।
- 'সওগাত' ও নজরুল। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। নজরুল-স্মৃতিচারণ। রফিকুল ইসলাম
সম্পাদিত। নজরুল একাডেমী, ঢাকা। ২৫ মে, ১৯৯৫।