জব চার্নক
Job Charnock
১৬৩০ –১৬৯৩ খ্রিষ্টাব্দ
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক কর্‌মকর্তা, কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত। অবশ্য ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দেকলকাতা উচ্চ আদালতে এক ঐতিহাসিক আদেশে এই তথ্য ভুল ঘোষণা করেন।

১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের ল্যাংকশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম রিচার্ড চার্নক। তাঁর শৈশব  এবং কৈশোরকাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ১৬৫০ থেকে ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থানীয় ব্যবসায়ী মারিচ থমসনের অধীনে কাজ করেন। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তিনি ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পাতে নিম্নপদস্থ প্রশাসনিক কর্মী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি তিনি হুগলির কাশিমবাজারের কোম্পানির বাণিজ্যিক কেন্দ্রে যোগদান করেন। এই সময় কোম্পানি এই অঞ্চলে পটাশিয়াম নাইট্রেটে উৎপাদনের সাথে জড়িত ছিল। ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এই কোম্পানি পটাশিয়াম নাইট্রেট কারখানা বন্ধ করে দিলে, জব জার্নক ভারতে থেকে যান এবং কোম্পানি তাঁকে এই কাশিমবাজার বাণিজ্যকেন্দ্রের প্রধান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।

১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব -এর শাসনাধীন বঙ্গদেশের শাসনকর্তা মীরজুমলার মৃত্যু হয় । এরপর বাংলার শাসনকর্তা হন শায়েস্তা খান। তিনি সে সময়ে
চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্তুগিজদের ঘাঁটি ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খান আরাকান রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চট্টগ্রামকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর শায়েস্তা খান পর্তুগিজ দস্যুদেরকে বিতারিত করে সন্দীপ দখল করে নেন। এরপর শায়েস্তা খান কোম্পানির কার্যক্রমের উপর নজর দেন। বাংলায় ইংরেজ কুঠি স্থাপনের পর থেকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজরা বিশেষ সুবিধা লাভ করতে পারে নি। মোগল কর্মকর্তারা নানাভাবে কোম্পানির কর্মচারীরাদের কাছ থেকে কর আদায় করতো। ফলে ইংরেজদের সাথে মোগলদের সংঘাত সৃষ্টি হয়। মোগলরা হুগলীর ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করে। ইংরেজরা জব চার্নকের নেতৃত্বে হুগলী ত্যাগ করে সুতানটিতে আশ্রয় নেয়। মোগলরা পুনরায় আক্রমণ করলে, জব চার্নক সুতানটি পরিত্যাগ করে বালেশ্বরে চলে যায়। এরপর মোগলবাহিনী বালেশ্বর অধিকার করে। উল্লেখ্য, ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে চার্নক উচ্চপদস্থ বাণিজ্যিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

বঙ্গদেশে কোম্পানির ব্যাপক বিস্তারের কারণে, ১৬৮১ খ্রিষ্টাব্দে, কোম্পানি বেঙ্গল এজেন্সি (Bengal Agency নামে নতুন প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নেয়। সেই সূত্রে বেঙ্গল এজেন্সির প্রথম গভর্নর হন উইলিয়াম হেজেস
(William Hedges)। তিনি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ১৬৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই পদে থাকেন। এই সময় জব চার্নক-এর সাথে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। ফলে কোম্পানি সুচারুরূপে বঙ্গদেশের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে নি। এই অবস্থায় মাদ্রাজের ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম জিফোর্ড (William Gyfford) বাংলার গরভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জুলাই এই জন এই পদে নিয়োগ পান জন বিড (John Bead)। ১৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ আগষ্ট জন বিড মৃত্যুবরণ করলে, নতুন গভর্নর হন জব চার্নক।  

১৬৮৬ খ্রিষ্টাবজব চার্নক হুগলী দখল করে লুণ্ঠন চালান এবং অধিকার সুপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এর ফলে মোগল সৈন্যদের সাথে ইংরেজদের পুনারয় সংঘাতের সৃষ্টিমোগল বাহিনী হুগলী আক্রমণ করে দখল করে নেয়। ফলে জব চারনক হুগলী ত্যাগ করে

১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে
শায়েস্তা খান এবং কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জব চার্নককে কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণে উলুবেড়িতে বাণিজ্যকুঠি নির্মাণের অনুমতি দেন। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র সুরাট থেকে বোম্বাইতে স্থানন্তরিত করে। বোম্বাই উপকূলে মোগল সৈন্যদের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ শুরু হলে শায়েস্তা খান, জব চার্নককে দেওয়া অনুমতি প্রত্যাহার করে নেন। এছাড়া এই সময় কোম্পানির সৈন্যরা ক্যাপ্টেন হিথ-এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মোগল যুদ্ধ জাহাজ সিদি ইয়াকুবের নেতৃত্বে বোম্বাই নগরী অবরোধ করে। প্রায় ১ বৎসর অবরুদ্ধ থাকার পর, কোম্পানির সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। ইংরেজরা সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মোগল সম্রাট তাদের ক্ষমা করেন এবং ইংরেজদের পুনরায় বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন। এই সময় কোম্পানির পক্ষ থেকে সম্রাটকে দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করা হয়। এই বৎসরে বাংলার শাসনকর্তা ইব্রাহিম খাঁ জব চার্নবকে মাদ্রাজ থেকে ডেকে এনে বাৎসরিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বাণিজ্য করার অধিকার দেওয়া হয়। একই সাথে জব চার্নবকে বাংলার জমিদারি ক্রয় করার অধিকার দেওয়া হয়।

১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে আগষ্টে
চার্নক সুতানটিতে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। কালক্রমে তা কলকাতা মহানগরীতে পরিণত হয় তিনি দুই বৎসর সুতানটির উন্নয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৬৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।

চার্নক স্থানীয় একটি নিম্নবর্গীয় সুন্দরী বিধবাকে সতীদাহ থেকে উদ্ধার করে বিয়ে করেন। খ্রিষ্টীয় রীতি অনুসারে তাঁর নামকরণ করেন মারিয়া। মারিয়ার গর্ভে তার চারটি কন্যার জন্ম হয়। এই স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁকে সেন্ট জন্ গির্জ্জায় সমাহিত করা হয়।