১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ল্যাবরেটারি থিয়েটারের অন্যতম সহকারী টেকনিকাল ডিরেক্টর পদে উন্নীত করে।
এই বছরের শেষের দিকে তিনি প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালকের পদ লাভ করেন। তাঁর এই
পেশাগত জীপনযাপনের মাঝে, নর্মান বেলগেড্ডেস-এর তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন করেন আলো
প্রক্ষেপণের মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি, সেট নির্মাণে বহুমাত্রিকা আনা, নাটকের চরিত্র অনুযায়ী মঞ্চসজ্জার প্রয়োগ ইত্যাদি। এই সময়েই থিয়েটারে সহকারী পরিচালনার পাশে বলিস্লাভস্কির পরিচালনায় ‘মিকাডো’ চলচ্চিত্রেও সতু সেন সহকারী পরিচালনার দায়িত্বভার
পালন করেন।
সূত্র:
১৯২৮ টেকনিকাল ডিরেকটার পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময়ের ভিতরে তিনি বেশ কিছু মঞ্চ-সফল প্রযোজনা
করেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল- আন্তন চেকভ-এর ত্রি সিস্টার্স, আঙ্কল ভানিয়া, লিও তলস্তয়ের রেজারেকশন, ওয়ার অ্যান্ড পিস, বেলজিয়ান নাট্যকার মরিস মেটারলিঙ্কের ব্লু বার্ড, ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপিয়ারের মিড সামার নাইটস ড্রিম, এবং ফরাসী নাট্যকার জাঁ জাক বার্নার্ড-এর দি সালকি ফায়ার। এছাড়া
তিনি আমেরিকার রূপক ধর্মী নাট্যকার ইউজিন ও নীলের মার্কো মিলিয়নস-এ এবং মিগুয়েল সার্ভেন্টাসের রচিত দি প্রিন্টেড বাস্ক এবং দি জেলাস ওল্ড ম্যান নাটকের মঞ্চসজ্জা ও আলোক সম্পাত করেছিলেন।
এই বছরে গৌতম বুদ্ধের জীবনী নিয়ে ইংরেজ কবি ও সাংবাদিক স্যার এডউইন আর্নল্ডের লেখা নাটক লাইট অব এশিয়া
(১৮৭৯)-র প্রযোজনায় যুগ্ম পরিচালকের দায়িত্ব সামলেছেন। এ ছাড়া আমেরিকার ব্রডওয়ে প্রযোজনা মিঃ মানিপেনী নাটকে বলিস্লাভস্কির সঙ্গে যুগ্ম পরিচালনাযর
দায়িত্ব পালন করেন। এরপর জনৈক ফরাসী নাট্যকারের লা বুফ এ তে সালতুয়া নাটকটি একাধারে মঞ্চসজ্জা ও পরিচালনা করেন।
তাঁর পরিচালিত অপর একটি নাটক ছিল সোফক্লিসের আন্তিগোনে। এই বছরেই তিনি অভিনেতা ক্রিশ্চিয়ান হেগেনের
সাথে মিলিত ভাবে আমেরিকার উডস্টক হিলসে প্রতিষ্ঠা করেন উডস্টক প্লে হাউস। উল্লেখ্য,
এখানে গরমের ছুটির সময় সপ্তাহে চার দিন নাট্যাভিনয় হতো।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ল্যাব্রেটারি থিয়েটার থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে সতু সেন ইউরোপ
ভ্রমণ করেন। প্রথমে তিনি বার্লিনের বিশ্ববিখ্যাত ম্যাক্স রাইনহার্ড থিয়েটার পরিদর্শন
করেন। এরপর তিনি প্যারিসের জাক কোপোরের থিয়েটার দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৯২৯
খ্রিষ্টাব্দে মস্কো ভ্রমণ করেন। মস্কোর আর্ট থিয়েটার এবং বলশয় থিয়েটার দেখেন।
এছাড়া সুইজারল্যান্ডে গিয়ে প্রবাদপ্রতীম নাট্যকার বরিস স্তানিস্লাভস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সতু সেন ব্রিটেন গ্ররডন ক্রেগের মঞ্চ নাটক
এবং নটকের মহড়া দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
এরপর নানা কারণে অর্থাভাবে পড়েন। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং
রংমহল থিয়েটার
প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে সেখালের প্রখ্যাত নাট্যগবেষক
সতু সেন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসেন। এই সময় রবি রায়ের সাথে
উদ্যোগে এই নাট্যমঞ্চ তৈরি করা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এই নাট্যশালাটি স্থাপিত হয়েছিল কলকাতার ১৮৯৩ ৬৫/১ কর্ণওয়ালিশ স্টি্ট (বিধান
সরণি)-তে। নাট্যশালার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ১ মে ১৯৩১ (১৭
বৈশাখ ১৩৩৮)। নতুন এই থিয়েটারের দ্বারোদঘাটন
করেন সেকালের আর্ট থিয়েটারের পরিচালক ও নাট্যকার
অভিনেতা অপরেশচন্দ্র মুখোপাব্যায়। প্রতিষ্ঠার সময়ে
অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন দেনমনোরঞ্জন
ভট্টাচার্য, বীরাজ ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরী, নরেশ মিত্র, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায়,
শেফালিকা, শান্তি গুপ্তা. সরযূ দেবী প্রমুখদ।
শিল্প নির্দেশনা এবং আলোক সম্পাতের দায়িত্বে ছিলেন
সতু সেন।
এই সময় এ্ই মঞ্চে যোগদান করেছিলেন
শিশিরকুমার ভাদুরী। উল্লেখ্য, ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি
নাট্যদল নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফিরে এসে একটি
নাট্যমঞ্চের সাথে যুক্ত জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন। এই সময় রংমহলের অধিকর্তারা তাঁকে ১০
হাজার টাকা বোনাস দিয়ে গ্রহণ করেন।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ আগস্ট যোগেশ চৌধুরীর লেখা 'শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া'
নাটক দিয়ে রঙমহলের যাত্রা শুরু
হয়েছিল। পরিচালনায় ছিলেন
শিশিরকুমার এবং সঙ্গীত-পরিচলানায়
ছিলেন কৃষ্ণন্দ্র দে। মঞ্চ
তৈরি করেছিলেন সতু সেন
এবং মঞ্চ সজ্জাকর ছিলেন ভূতনাথ দাস। অভিনয়ে
ছিলেন-
শিশিরকুমার ভাদুরী (নিমাই)
প্রভাদেবী (বিষ্ণুপ্রিয়া), কঙ্কাবতী
(শচীমাতা)। এছাড়া অন্যান্য
চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যোগেশ চৌধুরী, কৃষ্ণচন্দ্র
দে, রবি রায়, সরযূ দেবী, রাজলক্ষ্মী।
সতু সেন এই নাটকেই প্রথম বাংলা মঞ্চে শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ শুরু করেন। মঞ্চে আলো আলো
ব্যবহারের তিনি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে ছিলেন।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ জুন, উৎপলেন্দু
সেন-এর রচিত সিন্ধুগৌরব
মঞ্চস্থ হয়
রংমহল থিয়েটারে।
এই নাটকে সতু সেন
মঞ্চসজ্জা ও আলোক সম্পাতে
অভিনব পরিবেশ সৃষ্টি করে
দর্শকদের চমকে দিয়েছিলেন। তিনি মঞ্চ জুড়ে সিন্ধুনদের উপকূল
বোঝাতে বিশাল নৌকা নির্মাণ করেছিলেন। এই বছরের শেষের দিকে তিনি রংমহল ছেড়ে দিয়ে
নাট্যনিকেতন-এ যোগদান করেন।
নাট্যনিকেতন-এ এসে তিনি মঞ্চসজ্জা ও পরিচালনার কাজ করেছিলেন
শচীন সেনগুপ্তের রচিত 'ঝড়ের রাতে' নাটক।
নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ নভেম্বর
(শনিবার, ২৮ কার্তিক ১৩৩৮)। এই বছরের ১৯ ডিসেম্বর
(শনিবার, ৩ পৌষ, ১৩৩৮),
নাট্যনিকেতন-এ
কাজী নজরুল ইসলামের
রচিত গীতিনাট্য
আলেয়া
মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন সতু সেন। বিভিন্ন চরিত্র রূপায়ণ
করেছিলেন- ধীরাজ ভট্টাচার্য, ভূপেন রায়, নিরূপমা দেবী, তারাসুন্দরী প্রমুখ।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের
শেষের দিকে এই থিয়েটার আর্থিক অসুবিধার মধ্য পড়ে যায়।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যামিনী মিত্র ও শিশির মল্লিক থিয়েটার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের তিনি আবর রঙমহল থিয়েটারে ফিরে আসেন।
ফেব্রুয়ারি মাসে নলিনী চট্টোপাধ্যায়ের
'দেবদাসী' মঞ্চস্থ হয়। এরপর যামিনী মিত্র ও
শিশির মল্লিক যৌথভাবে রঙমহল-এর নতুন মঞ্চ নির্মাণ তৈরির উদ্যোগ
নেন। এবারে এই নির্মাণের দায়িত্ব পান সতু সেন। তাঁরই পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় 'ঘূর্ণায়মান মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, বাংলা তথা ভারতে
রংমহল থিয়েটারেই প্রথম এই
ধরনের মঞ্চ প্রবর্তন করা হয়। এই মঞ্চ তৈরি করতে সে সময়ে খরচ হয়েছিল
প্রায় এগারো হাজার তিনশ টাকা।
এই নতুন মঞ্চে অভিনয়ের প্রথম অভিনীত হয়েছিল অনুরূপা দেবীর জনপ্রিয় উপন্যাস
'মহানিশা' নাট্যরূপ।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ ডিসেম্বর অভিনীত হলো মন্মথ রায়ের
'অশোক' মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকেও সতু সেন
মঞ্চসজ্জা ও আলোকসম্পাত উচ্চমানের হয়েছিল।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের উল্লেখযোগ্য নাটক ছিল নন্দরাণীর সংসার। এই নাটকেও সতু সেন
মঞ্চসজ্জা ও আলোকসম্পাতের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে শিশির মল্লিক রঙমহল-এর
দায়িত্ব ছেড়ে দেন। নতুন দায়িত্ব নেন অমর ঘোষ।
এরপর মঞ্চস্থ করা হয়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'চরিত্রহীন' উপন্যাসের নাট্যরূপ।
নাট্যরূপ দিয়েছিলেন যোগেশ চৌধুরী। ২০ ডিসেম্বর
নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাটকটির যুগ্ম পরিচালনায় ছিলেন
নরেশ মিত্র ও সতু সেন।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের মে সুধীন্দ্রনাথ রাহার 'সর্বহারা' নাটক
মঞ্চস্থ হয়।
নাটকটির পরিচালনায় ছিলেন
সতু সেন।
সিন্ধুগৌরব এবং পতিব্রতা নাটক দুটির পরিচালনার পর তিনি ঘূর্নায়মান মঞ্চ নির্মান করেন এবং সেই মঞ্চে প্রথম্বার অভিনীত হয় মহানীশা নাটকটি। এরপর রঙমহলের ঘূর্ণায়মান মঞ্চে পরপর অভিনীত হয় বাংলার মেয়ে (১৯৩৪), নন্দরাণীর সংসার (১৯৩৪), মহামায়ার চর (১৯৩৯), চরিত্রহীন (১৯৩৫), আশোক (১৯৩৩) প্রভৃতি নাটক। নবিন তুরস্কের জন্মদাতা ও মহান সঙ্গগ্রামী দেশপ্রেমিক কামাল পাশার কীর্তিগাঁথা নিয়ে শচীন সেনগুপ্ত লিখে ফেলেন কামাল আতাতুর্ক। বিপুল অর্থ ব্যয় ও আড়বম্বরে নিউ এম্পায়ারে নাটকটি মঞ্চস্থ করেন সতু সেন। ১৯৩৯ সালে তার পরিচালনায় সিরাজদৌল্লা, মীরকাশেম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপ্ন্যাস অবলম্বনে পথের দাবী নাটক খুবই প্রশংসিত হয়। ১৯৪২ সালে তিনি পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন নাট্যভারতী রঙ্গমঞ্চে। মঞ্চস্থ হয় চন্দ্রশেখর, দুই পুরুষ, ধাত্রীপান্না। ১৯৫৭ সালে তার পরিচালনায় শেষ প্রযজনা কর্ণ কুন্তী কৃষ্ণ মিনার্ভায় অভিনীত হয়।