শিশিরকুমার ভাদুরী
(১৮৮৯-১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ)
মঞ্চ অভিনেতা, নাট্যকার এবং নাট্যপরিচালক
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২ অক্টোবর
ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার রামরাজাতলার পৈত্রিক নিবাসে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম হরিদাস ভাদুরী।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতার বঙ্গবাসী স্কুল থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এরপর তিনি ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে। এখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত
লেখাপড়ার পাশাপাশি নাট্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এই সময় তিনি নাটক ও সাহিত্যে-বিষয়ক
শিক্ষা লাভ করেছিলেন মন্মথ বসু, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো পণ্ডিতদের কাছে। সে
সময় সাধারণত ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে মঞ্চস্থ নাটকগুলোতেই তিনি অংশগ্রহণ করতেন।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'মেরি গোল্ড ক্লাব' নাট্যদল তৈরি করে অভিনয় হ্যামলেট ও
কুরুক্ষেত্র নাটকে অভিনয় করেন। হ্যামলেট চরিত্রে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের কাছে
বিশেষভাবে নন্দিত হন।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন।
এই বছরে 'মেরি গোল্ড ক্লাব' নাট্যদলের 'বুদ্ধদেব চরিত' নাটক
মঞ্চস্থ হয় এবং এই নাটকে তিনি অভিনয় করেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে অভিনয় করেন
চন্দ্রগুপ্ত নাটকে। এই নাটকে চাণক্য চরিত্রে শিশিরকুমারের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং তিনি শিশিরকুমারকে মাল্যভূষিত করেন।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকে অসাধারণ অভিনয় করে তিনি প্রশংসিত হন। এই
নাটকে কেদারের ভূমিকায় শিশিরকুমারে অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথ ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এছাড়া এই বছরে তিনি অভিনয় করেছিলেন বৈকুণ্ঠের খাতা ও জনা
নাটকে।
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করেন।
এরপর তিনি পেশাগত জীবনের প্রথমে শিশিরকুমার মেট্রোপলিটন
ইনস্টিটিউট ও বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা করতেন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
ম্যাডান
থিয়েটারে অধীনস্থ
কর্ণওয়ালিস থিয়েটার-এ
এক হাজার টাকা মাসিক চুক্তিতে পেশাদার অভিনেতা রূপে
নিযুক্ত হন। ছরে তিনি পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে আসেন। এই বছরে তাঁর
পরিচালিত 'মোহিনী' মুক্তি পায়। এই বছরের ১০ই ডিসেম্বর তিনি ক্ষিরোদপ্রসাদ নাটকে 'আলমগীর' নাটকে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করে
ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
এই সময় তিনি এই থিয়েটারের আরও দুটি নাটকে আভিনয় করেন। নাটক দুটি
হলো- রঘুবীর ও চন্দ্রগুপ্ত। পরে বনিবনা না হওয়ায় তিনি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের
আগষ্ট মাসে এই থিয়েটার ত্যাগ করেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে মঞ্চনাটকের জগতে ফিরে আসেন। তিনি একটি নাট্যদল গঠন করেন এবং ২৫ ডিসেম্বর ইডেন গার্ডেন্স-ক্যালকাটা একজিবিশনে মঞ্চায়িত
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সীতা নাটকে রামচন্দ্রের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয়-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।
এই সময় নাট্যদলের যোগাদনকৃত অভিনেতার ছিলেন- বিশ্বনাথ ভাদুড়ি,
ললিতমোহন লাহিড়ী, রমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরী,
তুলসীচরণ বন্দোপাধ্যায়, রবি রায়, জীবন গঙ্গোপাধায়। পেশাদারী অভিনেত্রীরা ছিলেন-
মালিনী, নীরদাসুন্দরী, প্রভাদেবী, শেফালিকা (পুতুল) প্রমুখ। এই নাটকটি দর্শক নন্দিত
হওয়ায় তিনি সাধারণ রঙ্গালয়ে ফিরে আসার উদ্যোগ নেন। তিনি হ্যারিসন রোডে 'আলফ্রেড
থিয়েটার'-এ সীতা অভিনয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু আর্ট থিষেটার চক্রান্ত
করে 'সীতা'র স্বত্ব কিনে নেয়। ফলে শিশিরকুমারের এই উদ্যোগ ব্যার্থ হয়ে যায়। এরপর
তিনি মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে 'বসন্তলীলা' রচনা করান এবং মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ
নেন।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের
২২শে মার্চ (শনিবার, ৯ চৈত্র ১৩৩০) মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের রচিত 'বসন্তলীলা' নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। এই নাটকের পরিচালক ছিলেন শিশির ভাদুরী। এই নাটকের
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে
কাজী নজরুল ইসলাম আমন্ত্রিত ছিলেন।
তিনি অনুষ্ঠানে তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতা আবৃত্তি করেন।
এই সূত্রে
নজরুলের সাথে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সদ্য কারমুক্ত
নজরুলের তখন দারুণ অর্থকষ্টে ছিলেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য, ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল (বুধবার, ২৭ চৈত্র ১৩৩০)
কলকাতার আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে শিশিরকুমার ভাদুড়ী এবং তাঁর নাট্যগোষ্ঠীর সদস্যরা নজরুলকে সংবর্ধনা দেন। এই অনুষ্ঠানে নজরুলের প্রশংসাসূচক বক্তৃতা
রেখেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস, নির্মলচন্দ্র চন্দ, মৃণালকান্তি রায়, প্রফুল্লকুমার সরকার, কুমার শিবশেখর রায়, গিরিজাকুমার বসু, দেবকুমার রায় চৌধুরী, নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত,
মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়, ঋষিকেশ মিত্র প্রমুখ। তৎকালীন ফরোয়ার্ড পত্রিকার '১১ এপ্রিল ১৯২৪' সংখ্যায় এই সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
সমাচার পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, এই অনুষ্ঠান থেকে ১৯০০ টাকার সংগৃহীত হয়েছিল। এই
টাকা শিশিরকুমার ভাদুরী নজরুলের
হাতে
তুলে দিয়েছিলেন।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পরপর মঞ্চস্থ করেন পুরানো নাটক আলমগীর, রঘুবীর, চন্দ্রগুপ্ত।
এই বছরের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে তিনি
মনোমোহন
থিয়েটার
লিজ নিয়ে 'নাট্যমন্দির' প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্য দিয়ে
মনোমোহন
থিয়েটারের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটেছিল।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ৬ আগস্ট (বুধবার ২১ শ্রাবণ ১৩৩১) নাট্যমন্দিরে মঞ্চায়িত যোগেশ চৌধুরীর সীতা নাটকে
শিশিরকুমারের অভিনয়ে অভিভূত হয়ে রসরাজ অমৃতলাল বসু তাঁকে থিয়েটারের নবযুগের
প্রবর্তক বলে ঘোষণা করেন। এরপর একে একে তিনি বহু নাটকে অভিনয় ও পরিচালনা করেন।
এসবের ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল-
১৯২৫-২৬ খ্রিষ্টাব্দে তাজমহল ফিল্ম কোম্পানির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন
শিশিরকুমার ভাদুরী। সে সময়ে তিনি বিশ্বভারতীকে ৩০,০০০ টাকা দিয়ে বিসর্জন-এর স্বত্ব কেনে নিয়েছিলেন। এই সময়
শিশিরকুমার উদ্যোগী হন আরও কয়েকটি রবীন্দ্রনাটকের চিত্রগ্রহণ করতে।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে শিশির কুমার ম্যাডোনা থিয়েটারসের
কর্ণওয়ালিস থিয়েটার-
তিন বছরের জন্য লিজ নেন। এই সময় কর্নাওয়ালিস থিয়েটার-এর পরিবর্তে নাট্যমন্দির নামে
অভিনয় শুরু করেন। এই সময় এর নাম হয় নাট্যমন্দির লিমিটেড কোম্পানি। ১৯২৬
খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটক
দিয়ে এই নাট্যদলের যাত্রা শুরু হয়। এই দল ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।
এরপর আর্থিক অনটনে, তিনি ম্যাডোনা কোম্পানির কাছে মালিকানা হস্তান্তরে করেন। ফলে
কর্ণওয়ালিস থিয়েটার আগের অবস্থায় চলে আসে। এই তিনি বছরে নাট্যমন্দির লিমিটেড যে সকল
নাটক মঞ্চস্থ করেছিল, তা হলো-
- বিসর্জন (রবীন্দ্রনাথ,
২৬ জুন, ১৯২৬)
- পাণ্ডবের
অজ্ঞাতবাস (গিরিশচন্দ্র, ১
জুলাই, ১৯২৬)
- নরনারায়ণ (ক্ষীরোদপ্রসাদ,
১ ডিসেম্বর, ১৯২৬)
- প্রফুল্ল
(গিরিশচন্দ্র, জুন, ১৯২৭)
- সধবার একাদশী (দীনবন্ধু
মিত্র, জুলাই, ১৯২৭)
- যোড়শী (শরৎচন্দ্রের
দেনা-পাওনা উপন্যাসের নাট্যরূপ, ৬ আগস্ট, ১৯২৭)
- শেষরক্ষা (রবীন্দ্রনাথ,
৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২৭)।
- সাজাহান (দ্বিজেন্দ্রলাল, নভেম্বর,
১৯২৭)
- বলিদান (গিরিশচন্দ্র,
২৫ জানুয়ারি, ১৯২৮)
- বিল্বমঙ্গল ঠাকুর
(গিরিশচন্দ্র, ২৯ মে,
১৯২৮)
- হাসনেহানা (বরদাপ্রসন্ন
দাশগুপ্ত, ২৫ আগস্ট, ১৯২৮),
- দিগ্বিজয়ী
(যোগেশ চৌধুরী, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯২৮)
- বিবাহ-বিভ্রাট (অমৃতলাল
বসু, ৩ মে, ১৯২৯)
- বুদ্ধদেব (গিরিশচন্দ্র,
৮ জুন, ১৯২৯)
- রমা (শরৎচন্দ্রের পঙ্লীসমাজ-এর
নাট্যরাপ, আগস্ট, ১৯২৯)
- শঙ্খধ্বনি (The
Bell নাটকের রূপান্তর : ভূপেন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায়, ২ নভেম্বর ১৯২৯)
- তপতী (রবীন্দ্রনাথ,
ডিসেম্বর, ১৯২৯)
- সীতা ও ষোড়শী (২৫
মার্চ ১৯৩০)
এর ভিতরে শিশিরচন্দ্র অভিনয়ের জন্য নন্দিত হয়েছিলেন- ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রফুল্ল নাটকে যোগেশ চরিত্রে, ১৯২৬
খ্রিষ্টাব্দে ষোড়শী নাটকে জীবানানন্দ চরিত্র, ১৯২৮
খ্রিষ্টাব্দে দিগ্বিজয়ী নাটকে নাদির শাহ চরিত্র, ১৯২৮
খ্রিষ্টাব্দে সধবার একাদশী নাটকে নিমচাঁদ চরিত্র
এবং ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে চিরকুমার সভা নাটকে চন্দ্রবাবু চরিত্রের
জন্য। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তপতী নাটকে বিশেষ
অভিনয় পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন। তবে এই নাটকটি দর্শক-নন্দিত না
হওয়ায়, তিনি প্রচুর আর্থিক দেনায় পড়ে যান।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে আর্থিক অনটনে, তিনি ম্যাডোনা কোম্পানির কাছে
মালিকানা হস্তান্তরের পর, তিনি কিছুদিন কিছুদিন আর্ট থিয়েটারে
চলে আসেন। এখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের চিরকুমার সভা, অনুরূপা
দেবীর উপন্যাসের নাট্যরূপ মন্ত্রশক্তি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত
এবং অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের কর্ণার্জুন নাটকে অভিনয় করেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আমেরিকা চলে যান। মূলত কলকাতায় স্কচ
অভিনেতা এরিক ইলিয়ট কলকাতায় সীতা নাটকে তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে- আমেরিকার শিল্প
সংগঠক মিস মারবেরিককে জানান। পরে তাঁই আমন্ত্রণে শিশিরকুমার সদলবলে আমেরিকা যান।
কিন্তু মারবেরি চুক্তি ভঙ্গ করলে, তিনি সতু সেনের সহায়তায় ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি
নিউইয়র্কের ভ্যান্ডারবিল্ট থিয়েটারে সীতা মঞ্চায়নের মাধ্যমে বিপুল খ্যাতি
অর্জন করেন। এই বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসেন।
ফেরার পথে বড়লাট লর্ড আরউইনের অনুরোধে তিনি দিল্লীতে সীতা মঞ্চস্থ করেন। রাষ্ট্রীয়
অনুষ্ঠান হিসেবে এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল- ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মার্চ।
আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর একটি
নাট্যমঞ্চের সাথে যুক্ত জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন। এই সময় নতুন নাট্যমঞ্চ
রংমহল থিয়েটার
অধিকর্তারা তাঁকে ১০
হাজার টাকা বোনাস দিয়ে গ্রহণ করেন। ১৯৩১-এর ৮ আগস্ট যোগেশ চৌধুরীর লেখা 'শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া'
নাটক দিয়ে
রংমহল থিয়েটার-এর যাত্রা শুরু
হয়েছিল। এরপর প্রবোধ গুহের নাট্যনিকেতনে যোগ দেন। এখানে
তিনি চন্দ্রশেখর (১৯৩২), গৈরিকপতাকা (১৯৩২), দক্ষযজ্ঞ (১৯৩২) নাটকে অভিনয় করেন।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নাট্যনিকেতন ছেড়ে দিয়ে
আর্ট থিয়েটারে যোগ দেন। এখানে তিনি বৈকুণ্ঠের খাতা, রমা এবং
রিজিয়া নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে করনানি ইন্ডস্ট্রিয়াল
ব্যাংক আর্ট থিয়েটারের উপর অধিকার লাভ করে। এই থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতাদের
অন্যতম সদস্য প্রবোধকুমার গুহ আগষ্ট মাসে আর্ট থিয়েটার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে দানীবাবু তথা সুরেন্দ্রনাথ ঘোষের সহযোগিতায় আর্ট থিয়েটার সচল ছিল। ১৯৩৩
খ্রিষ্টাব্দের ২৮ নভেম্বর দানীবাবুর মৃত্যুর পর আর্ট থিয়েটার দুর্বল হয়ে পড়ে। এই
সময় দেনার দায়ে আর্ট থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৪-এর জানুয়ারি
মাসে, এখানে শিশিরকুমারের নব-নাট্যমন্দির নামক নাট্যদল গড়ে তোলেন। ১৯৩৪
খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মে অপরেশ মুখোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন।
এরই মধ্য
আর্ট থিয়েটার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
'নবনাট্য মন্দিরের যাত্রা শুরু হয়েছিল যদুনাথ খাস্তগীরের লেখা 'অভিমানিনী' নাটক দিয়ে।
এর প্রথম অভিনয় শুরু হয়েছিল ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের , ১৯ জানুয়ারি। এই নাট্যদলে
শিশিরকুমার যে সকল নাটকে অভিনয় করেছিলেন- তা হলো-
- অভিমানী (যদুনাথ
খাস্তগীর, ১০ জানুয়ারি ১৯৩৪)
- ফুলের আয়না (নরেন্দ্রদেব,
ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪)
- বিরাজ বৌ (শরৎচন্দ্রে
উপন্যাসের নাট্যরূপ) ২৮ জুলাই, ১৯৩৪)
- মায়া (সুরেন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায়, সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪)
- সরমা (সুরেন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪)
- প্রতাপাদিত্য (ক্ষীরোদপ্রসাদ,
নভেম্বর, ১৯৩৪)
- দশের দাবী (শচীন
সেনগুপ্ত, ২৪ নভেম্বর, ১৯৩৪)
- বিজয়া (শরৎচন্দ্রে
'দত্তা'র নাট্যরূপ, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৩৪)
- শ্যামা (সত্যেন্দ্রনাথ
গুপ্ত, ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৩৫)
- রীতিমত নাটক (জলধর
চট্টোপাধ্যায়, ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৩৫)
- অচলা (শরৎচন্দ্রের
'গৃহদাহ'র নাট্যরূপ, ২২ অক্টোবর, ১৯৩৬)
- যোগাযোগ (রবীন্দ্রনাথের
উপন্যাসের নাট্যরূপ, ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৬)।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন
মাসে স্টার থিয়েটারের মালিকের সঙ্গে শিশিরকুমারের মামলা হয়। এই মামলায় হেরে গিয়ে
তিনি সেখানে নাট্যাভিনয় বন্ধ করতে বাধ্য হন। এরপর থেকে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত
তাঁর নিজের কোনো মঞ্চ ছিল না। ফলে
সম্মিলিত অভিনয় করা ছাড়া তিনি ও তার দলের কোনো কিছু করার
ছিল না। এই
সময়ে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনার দিকে মন দেন।
তাঁর নির্দেশনায় ও অভিনীত
সীতা, দস্তরমত টকী
(রীতিমত নাটকের চিত্ররূপ),
চাণকা শক্তি মুক্তি পায় ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯
খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে প্রবোধ গুহের রাজকিষেণ স্ট্রিটের নাট্যনিকেতন
বন্ধ হয়ে গেলে তিনি
নাট্যনিকেতন ভাড়া নেন। এই বছরে তিনি এর নাম পরিবর্তন করে নাম দেন ‘শ্রীরঙ্গম’।
যা বর্তমানে বিশ্বরূপা থিয়েটার নামে পরিচিত। ১৯৪১
খ্রিষ্টাব্দের ২৮ নভেম্বর
শ্রীরঙ্গম মঞ্চের উদ্বোধন হয়েছিল তারাকুমার
মুখোপাধ্যায়ের 'জীবনরঙ্গ' নাটক দিয়ে। এই মঞ্চে তিনি যেসকল নাটকে
অভিনয় করেছিলেন, তা হলো-
- জীবনরঙ্গ (তারাকুমার
মুখোপাধ্যায়, ২৮ নভেম্বর ১৯৪১)
- উড়োচিঠি (নিতাই
ভট্টাচার্য, ১১ মার্চ, ১৯৪২)
- দেশবদ্ধু (মনোরঞ্জন
ভট্টাচার্য, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২)
- মাইকেল (নিতাই ভট্টাচার্য, ২৩ এপ্রিল, ১৯৪৩)
- বিপ্রদাস (শরৎচন্দ্রের
উপন্যাসের নাট্যরূপ, ২৫ নভেম্বর, ১৯৪৩)। [বিপ্রদাসের পরিচালনা ও
নামভূমিকায় ছিলেন বিশ্বনাথ ভাদুড়ি। প্রথমে শিশিরকুমার অভিনয় করেননি,
পরে কয়েকবার বিপ্রদাস চরিত্রে অভিনয় করেন।]
- তাইতো (বিধায়ক ভট্টাচার্য,
ডিসেম্বর, ১৯৪৩)।
- বন্দনার বিয়ে (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ১৯৪৩)
[এর পরিচালনা ও মুখ্য চরিত্রে বিশ্বনাথ ভাদুড়ি।]
- দুঃখীর ইমান (তুলসী লাহিড়ী,
১৯৪৬) [পরিচালনা করেন শিশিরকুমার কিন্তু অভিনয় করেননি]
- বিন্দুর ছেলে (শরৎচন্দ্রে গল্পের নাট্যরূপ দেবনারায়ণ গুপ্ত, ডিসেম্বর, ১৯৪৪)
- সিরাজদৌল্লা (গিরিশ, ডিসেম্বর, ১৯৪৭)।
- পরিচয় (জিতেত্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ১০ আগস্ট,
১৯৪৯)
- যোড়শী (শরৎচন্দ্রের
দেনা পাওনা'র নাটারূপ, ১৯৫১)
- তখত-এ-তাউস (প্রেমাঙ্কুর
আতর্থী, ১০ মে. ১৯৫০)।
- আলমগীর (ক্ষীরোদপ্রসাদ,
১০ ডিসেম্বর, ১৯৫১)। [শিশিরকুমারের অভিনয়
জীবনের ত্রিশ বংসর পূর্তিতে এই
দিন তীর প্রথম নাটক আলমগীর পুনরভিনয় করেন]
- প্রশ্ন (তারাকুমার
মুখোপাধ্যায়, ও জানুয়ারি, ১৯৫৩)।
এর পরে প্রায় তিন বছর শ্রীরঙ্গমে নতুন কোনো
নাটকের অভিনয় করেন নি। মূলত
পুরনো নাটকগুলির পুনরভিনয়ে তিনি
মঞ্চে নেমেছেন। শেষের দিকে তিনি আলমগীর নাটকে
আলমগীর এবং রাজসিংহ ও সাজাহান
নাটকে সাজাহান ও ঔরঙ্গজেব-এর
ভূমিকায় অভিনয় ছাড়া অন্য চরিত্রে অভিনয় করা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নতুন নাটকে অভিনয় করা শুরু করেন। এই
বছরের ২টি নতুন নাটক এবং ১টি পুরানো নাটকে অভিনয় করেন।
- মিশরকুমারী (বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, ২২
জানুয়ারি, ১৯৫৬)।
- চন্দ্রগুপ্ত (দ্বিজেন্দ্রলাল ২৩
জানুয়ারী, ১৯৫৬)।
- প্রফুল্ল (গিরিশ, ২৪
জানুয়ারি, ১৯৫৬)। এটিই ছিল শ্রীরঙ্গমে
শিশিরকুমারের শেষ অভিনয়। অভিনয় করেছিলেন যোগেশ চরিত্রে।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে শিশিরকুমার এই
বাড়ির দখল নিয়ে একটি মামলায় জড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যনত আদালতের মাধ্যমে ১৯৫৬
খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি, এই বাড়ির দখলিস্বত্ব পায় মেসার্স সরকার ব্রাদার্স
অ্যান্ড প্রোপার্টি (প্রাইভেট) লিমিটেড। পরে এখানে গড়ে ওঠে
বিশ্বরূপা থিয়েটার ।
এরপর থেকে শিশিরকুমারের অভিনয় প্রায়
ছেড়ে দিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যে দুএকটি নাটকে তিনি মঞ্চে নেমেছেন।
এর মধ্যে ছিল- মিনার্ভা মঞ্চে 'জীবনরঙ্গ'
(ভুমিকা : অমরেশ)। ভবানীপুরে
থিয়েটার সেন্টারের ক্ষুদ্র প্রেক্ষাগৃহে সধলার একদশী (নিমচাঁদ),
এন্টালি কালচারাল কনফারেন্সে মাইকেল
(মাইকেল) অভিনয় করেন। কখনো
আমন্ত্রিত হয়ে অভিনয় করেছেন
কলকাতার বাইরে। এই সময় তাঁর বেশিরভাগ সময় কেটেছে
তরুণ শিল্পী সাংবাদিক সমালোচক ও নাট্যোৎসাহী বাক্তিদের
নিয়ে। তিনি এঁদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন
'বাংলা নাটা পরিষদ'। শিশিরকুমার এখানে অভিনয় এবং
নাট্য-বিষয়ক শিক্ষামূলক আলোচন করতেন।
মাঝে মাঝে এই দল নিয়ে
কলকাতার বাইরে যেতেন।
১৯৫৮ খিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পরপর
চারদিন তিনি ইউনিভারসিটি ইনস্টিটিউট
মঞ্চে তিনটি নাটকের অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন।
নাটক তিনটি হলো-মাইকেল (দুদিন), ষোড়শী
ও বিজয়া। এই নাটকগুলোতে তিনি
অভিনয়ে অংশ নেন। জীবনান্দ,
রাসবিহারী এবং মাইকেল চবিত্রে তিনি অনবদ্য অভিনয় করেন।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি তাঁকে ভারত সরকার 'পদ্মভূষণ' উপাধি দেন। তবে
তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মানের
চেয়ে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাছে একটি 'থিয়েটার
হল" চেয়েছিলেন, যেখানে তিনি নিজের মনের মতো করে অভিনয়ের বাবস্থা কবতে
পারবেন।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে মহাজাতি সদনে 'আলমগীর' এবং ১০ মে 'রীতিমত
নাটক' অভিনয় করেন। এটিই ছিল তাঁর শেষ অভিনয়।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন কলকাতার বরাহনগরস্থিত নিজ বাসভবনে ৬৯ বয়সে পরলোক গমন করেন।
শিশিরকুমার ভাদুরীর পরিচালিত সিনেমার তালিকা
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৯টি ছবি
পরিচালনা করেছেন। এর ভিতরে ৮টি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন।
- মোহিনী (১৯২১)
- কমলে কামিনী (১৯২২)
- বরের বাজার (১৯২২)
- আঁধারের আলো (১৯২২)
- বিচারক (১৯২৮)
- পল্লীসমাজ (১৯৩২)
- সীতা (১৯৩৩)
- বিচারক (১৯২৮)
- Talkie of Talkies (১৯৩৭)
- চাণক্য (১৯২৮)
তাঁর অভিনীত উল্লেঢখযোগ্য নাটক
- আলমগীর (১৯২১)
- রঘুবীর (১৯২২)
- চন্দ্রগুপ্ত (১৯২২)
- বসন্ত লীলা (১৯২৩)
- সীতা (১৯২৪)
- বিসর্জন (১৯২৬)
- পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস (১৯২৬)
- মুক্তার মুক্তি (১৯২৬)
- প্রফুল্ল (১৯২৭)
- ষোড়শী (১৯২৭)
- শেষ রক্ষা (১৯২৭)
- শাহজাহান (১৯২৭)
- সধবার একাদশী (১৯২৭)
- বলিদান (১৯২৮)
- বিল্বমঙ্গল (১৯২৮)
- বিবাহ বিভ্রাট (১৯২৯)
- বুদ্ধবেদ (১৯২৯)
- রমা (১৯২৯)
- প্রতাপাদিত্য (১৯৩০)
- বিষ্ণুপ্রিয়া (১৯৩২)
- বিরাজ বৌ (১৯৩৪)
- শ্যামা (১৯৩৫)
- যোগাযোগ (১৯৩৬)
- দেশবন্ধু (১৯৪২)
- মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৯৪৩)
- বিন্দুর ছেলে (১৯৪৪)
সূত্র :
- বঙ্গীয় নাট্যশঠালার ইতিহাস। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্গীয়
সাহিত্য পরিষদ মন্দির, ১৩৪৬
- বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস। দর্শন চৌধুরী। পুস্তক বিপনী কলকাতা ১৯৯৫।
- বাংলা থিয়েটারের পূর্বাপর। নৃপেন্দ্র সাহা। তূণ প্রকাশ। ১৯৯৯।
- বাংলা নাটকের ইতিবৃ্ত্ত। হেমেন্দ্র নাথ দাশগুপ্ত
- বাংলা নাটকের ইতিহাস। অজিতকুমার
ঘোষ
- বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস। আশুতোষ ভট্টাচার্য
- বাংলা নাট্যসাহিত্যের পূর্ব্ব-কথা। শ্রীশরচ্চন্দ্র ঘোষাল। নারায়ণ
[পৌষ ১৩২১ বঙ্গাব্দ]
- বাংলা নাটকের বিবর্তন। সুরেশচন্দ্র
মৈত্র। মুক্তধারা। ১৯৭১