রংমহল থিয়েটার
খ্রিষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে রবীন্দ্রমোহন রায় (রবি রায়) ও সতু সেনের উদ্যোগে একটি যৌথ এই নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

শুরুর দিকে রবি রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, ষষ্ঠী গাঙ্গুলি, নির্মলচন্দর চন্দ্র, এস. আহমেদ, ডি. এন. ধর, হরচন্দ্র ঘোষ. হেমচন্দ্র দে প্রমুখ একটি যৌথ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একটি যৌথ কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন অমর ঘোষ। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে সেখালের প্রখ্যাত নাট্যগবেষক সতু সেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসেন। এই সময় রবি রায়ের সাথে উদ্যোগে এই নাট্যমঞ্চ  তৈরি করা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

এই নাট্যশালাটি স্থাপিত হয়েছিল কলকাতার ১৮৯৩ ৬৫/১ কর্ণওয়ালিশ স্টি্ট (বিধান সরণি)-তে। নাট্যশালার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ১ মে ১৯৩১ (১৭ বৈশাখ ১৩৩৮)। নতুন এই থিয়েটারের দ্বারোদঘাটন করেন সেকালের আর্ট থিয়েটারের পরিচালক ও নাট্যকার অভিনেতা অপরেশচন্দ্র মুখোপাব্যায়। প্রতিষ্ঠার সময়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন দেনমনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, বীরাজ ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরী, নরেশ মিত্র, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, শেফালিকা, শান্তি গুপ্তা. সরযূ দেবী প্রমুখদ। শিল্প নির্দেশনা এবং আলোক সম্পাতের দায়িত্বে ছিলেন সতু সেন

এই সময় এ্‌ই মঞ্চে যোগদান করেছিলেন শিশিরকুমার ভাদুরী। উল্লেখ্য, ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি নাট্যদল নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফিরে এসে একটি নাট্যমঞ্চের সাথে যুক্ত জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন। এই সময় রংমহলের অধিকর্তারা তাঁকে ১০ হাজার টাকা বোনাস দিয়ে গ্রহণ করেন।

১৯৩১-এর ৮ আগস্ট যোগেশ চৌধুরীর লেখা 'শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া' নাটক দিয়ে রঙমহলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরিচালনায় ছিলেন শিশিরকুমার এবং  সঙ্গীত-পরিচলানায় ছিলেন কৃষ্ণন্দ্র দে। মঞ্চ তৈরি করেছিলেন সতু সেন এবং মঞ্চ সজ্জাকর ছিলেন ভূতনাথ দাস। অভিনয়ে ছিলেন- শিশিরকুমার ভাদুরী (নিমাই) প্রভাদেবী (বিষ্ণুপ্রিয়া), কঙ্কাবতী (শচীমাতা)। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যোগেশ চৌধুরী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রবি রায়, সরযূ দেবী, রাজলক্ষ্মী। সতু সেন এই নাটকেই প্রথম বাংলা মঞ্চে শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ শুরু করেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকেই এরা নতুন নাটক মঞ্চস্থ করা শুরু করে। এই বছরের উল্লেখযোগ্য নাটগুলো ছিল- এই বছরের শেষের দিকে সতু সেন রংমহল ছেড়ে দিয়ে নাট্যনিকেতন-এ যোগদান করেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে এই থিয়েটার আর্থিক অসুবিধার মধ্য পড়ে যায়। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যামিনী মিত্র ও শিশির মল্লিক থিয়েটার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় সতু সেন রংমহলে যোগদান করেন। ফেব্রুয়ারি মাসে নলিনী চট্টোপাধ্যায়ের 'দেবদাসী' মঞ্চস্থ হয়। এরপর যামিনী মিত্র ও শিশির মল্লিক যৌথভাবে রঙমহল-এর নতুন মঞ্চ নির্মাণ তৈরির উদ্যোগ নেন। এবারে এই নির্মাণের দায়িত্ব পান সতু সেন। তাঁরই পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় 'ঘূর্ণায়মান মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলা তথা ভারতে রঙমহল থিয়েটারেই প্রথম এই ধরনের মঞ্চ প্রবর্তন করা হয়। এই মঞ্চ তৈরি করতে সে সময়ে খরচ হয়েছিল প্রায় এগারো হাজার তিনশ টাকা। এই নতুন মঞ্চে অভিনয়ের প্রথম অভিনীত হয়েছিল অনুরূপা দেবীর জনপ্রিয় উপন্যাস 'মহানিশা' নাট্যরূপ। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন  যোগেশ চৌধুরী। পরিচালনায় ছিলেন নরেশ মিত্র। অভিনয় করেছিলেন- নরেশ মিত্র, যোগেশ চৌধুরী, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি রায়, ভূমেন রায়, শান্তিগুপ্তা, পুতুল, চারুবালা প্রমুখ।

১৯৩৩-এর ২ ডিসেম্বর অভিনীত হলো মন্মথ রায়ের 'অশোক‌' মঞ্চস্থ হয়। পরিচালনায় ছিলেন নরেশ মিত্র। অভিনেত্রী শান্তি গুপ্তা এই নাটকেই প্রথম রঙমহলে আউষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছিলেন। অন্য শিল্পীরা ছিলেন রবি রায়, ভূমেন রায়, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, চারুবালা প্রমুখ। এই নাটকেও সতু সেন মঞ্চসজ্জা ও আলোকসম্পাত উচ্চমানের হয়েছিল।

১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বেশকিছু নতুন ও পুরাতন নাটক মঞ্চস্থ হয়। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল- ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মে রঙমহল অভিনীত হয় অনুরূপা দেবীর 'পথের সাথী" নোট্যরূপ। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন যোগেশ চৌধুরী। এই ১৯৩৫ বছরে শিশির মল্লিক রঙমহল-এর দায়িত্ব ছেড়ে দেন। নতুন দায়িত্ব নেন অমর ঘোষ। এরপর মঞ্চস্থ করা হয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'চরিত্রহীন' উপন্যাসের নাট্যরূপ। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন যোগেশ চৌধুরী। ২০ ডিসেম্বর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাটকটির যুগ্ম পরিচালনায় ছিলেন নরেশ মিত্র ও  সতু সেন। অভিনয়ে ছিলেন- মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য (উপেন্দ্র), শেফালিকা (সাবিত্রী), শান্তি গুপ্তা (কিরণময়ী)। ধীরাজ ভট্টাচার্য (দিবাকর)। অন্যান্য শিল্পীরা ছিলেন- যোগেশ চৌধুরী, নরেশ মিত্র, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। চরিত্রহীন" একটানা দীর্ঘদিন চলে রঙমহলে সগৌরবে চলেছিল।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের এই থিয়েটারে উল্লেখযোগ্য নতুন-পুরাতন মিলিয়ে বেশকিছু নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। এই বছরের অধিকাংশ নাটক জনসমাদর পায় নি। ফলে থিয়েটার আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। এর ফলে, থিয়েটার-কর্তৃপক্ষ ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এই কারণে কিছুদিন থিয়েটার বন্ধ রাখতে হয়। এই ঋণ পরিশোধ করে নতুন করে নাট্যমঞ্চ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন- যামিনী মিত্র, যোগেশ চৌধুরী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রঘুনাথ মল্লিক প্রমুখ। এই বছরের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল-

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে যৌথ পরিচালনায় রংমহল চালু হর। যামিনী মল্লিক এবং রঘুনাথ মল্লিক থিয়েটারের দায়িত্ব নেন। নাট্য পরিচালক হিসেবে যোগ দেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। নতুন নাট্যকার হিসেবে যোগদান করেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। নাট্যকার হিসেবে বিধায়ক ভট্টাচার্যের ছিল অভিষেক। নতুন উদ্যোগে এবার অভিনয় শুরু হয়। এই বছরে মঞ্চস্থ হয়েছিল-

এছাড়া  অভিনীত হয়েছিল শচীন সেনগুপ্তের 'স্বামীস্ত্রী'।

১৯৩৭-৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে রঙমহলে অভিনেতা হিসেবে যোগ দিয়েছেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায, অহীন্দ্র চৌধুরী, নাট্যাকর বিধায়ক ভট্টাচার্য এবং পরিচালক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর শচীন সেনগুপ্তের রচিত 'তটিনীর বিচার" নামক নাটক মঞ্চস্থ হয়। এতে অভিনয় করেছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, (ডাঃ ভোস), রাণীবালা (তটিনী)। এছাড়া নাট্যকার দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধায়ও অভিনয় করেছিলেন একটি বিশেষ চরিত্রে। এরপর মঞ্চস্থ হয়েছিল- স্বামীস্ত্রী, বিদ্যুৎপর্ণা, ভোটভণ্ডুল ইত্যাদি। এসকল নাটকের মাধ্যমে রংমহলের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছিল।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের আতঙ্কষ, ব্লাক আউট, বোমা পড়ার ভয়ে কলকাতার জনজীব দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। এই অবস্থায় অন্যান্য থিয়েটারগুলোর মতো রঙমহলও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এই সময়ে কিছুদিন রঙমহল বন্ধ থাকে। এরপর ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুলাই বিধায়ক ভট্টাচার্যের লেখা নাটক “বিশ বছর আগে' নাটক দিয়ে রংমহল আবার যাত্রা শুরু করে। এছাড়া মঞ্চস্থ হয়েছিল রানীবালা, গৌর শী'র নাটক 'ঘর্ণি, বিধায়ক উট্টচার্যের “মালা রায়' মেঘমুক্তি' (৯.৯.৩৯) অভিনীত হয়। ১৯৪০-এর ২৪ ডিসেম্বর অভিনীত হয়েছিল প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'রত্নদীপ'-এর নাট্যরূপ। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন বিধায়ক ভট্টাচার্য।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট তুলসী লাহিড়ীর নাটক 'মায়ের দাবী' অভিনীত হলো। অভিনেতা হিসেবে তুলসী লাহিড়ীও এই নাটকে প্রথম মঞ্চে অবতীর্ণ হন। এই বছরেই ৩ ডিসেম্বর অভিনীত হয়েছিলবিধায়ক ভট্টাচার্যের 'তুমি ও আমি'।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের শুরু দিকে  মহেন্দ্র গুপ্তের 'মাইকেল' এবং অয়স্কান্ত বক্সীর "ভোলা মাস্টার' অভীনীত হয়েছিল। দুটি নাটকেই নাম ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরীর অসামান্য অভিনয করেছিলেন। এরপর রঙমহলের 'লেসী' হলেন অভিনেতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি সে সময়কার সেরা শিল্পীদের রংমহলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এঁরা ছিলেন- অহীন্দ্র চৌধুরী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, সন্তোষ সিংহ, জহর গাঙ্গুলি, তুলসী চক্রবর্তী, মিহির ভট্টাচার্য, রানীবালা, সুহাসিনী প্রভৃতিমুখ। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য নাটক ছিল মাকড়শার জাল, ডা. মিস কুমুদ, আগামীকাল, আঁধার শেষে, রক্তের ডাক ইত্যাদি। উল্লেখ্য, রঙমহলের “মালা রায় নাটকের অভিনয়েই প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক শম্ভু মিত্র প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন এবং পরবর্তী কালের বিখ্যাত অভিনেতা নীতিশ মুখোপাধ্যায় 'রক্তের ডাক' নাটকে অভিনয় জীবন শুরু করেন। এই সময়কার উল্লেখযোগ্য অভিনীত নাটক ছিল রবীন্দ্রনাথের  “গোরা' উপন্যাসের নাট্যরূপ। গোরা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পুরনো নাটক 'রিজিয়া' অভিনীত হয়। এই বছরের অনেকাংশই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বন্ধ ছিল।

১৯৪৪ থেকে আবার অভিনয় শুরু হয়। ২২ জুন শরৎচন্দ্রের 'রামের সুমতি'র নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। এই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর অয়স্কান্ত বক্সীর নাটক 'অধিকার' দিয়ে রঙমহল আবার চালু হয়েছিল। অভিনয়ে ছিলেন অমল বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তি গুপ্তা, পূর্ণিমা, সুহাসিনী, সন্তোষ সিংহ, জহর গাঙ্গুলি প্রমুখ শিল্পীবৃন্দ। ২৫ ডিসেম্বর তারাশঙ্করের নিজের লেখা নাটক 'বিংশ শতাব্দী অভিনীত হয়েছিল।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি বঙ্কিমচন্দ্রে 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের নাট্যরূপ সন্তান মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন বাণী কুমার। অভিনয় করেছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী (সত্যানন্দ), অমল বন্দ্যোপাধ্যায় (জীবানন্দ), মিহির ভট্টাচার্য (ভবানন্দ), শান্তি গুপ্তা (শান্তি)। এরপর অভিনীত হয়েছিল শরৎচন্দ্রের “অনুপমার প্রেম” গল্পের নাট্যরূপ। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। তবে এই বছরের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ছিল শচীন সেনগুপ্তের 'সিরাজদ্দৌলা।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের উল্লেখযোগ্য নাটক ছিল উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে 'রাজপথ' নাটক। নাট্যরূপ দেবনারায়ণ গুপ্ত। রবীন্দ্রনাথের 'চিরকৃমার সভা'। এই বছরে কলকাতায় ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল জনজীবনে। এই সময় কিছু কিছু পুরনো নাটক অভিনয় চালিয়ে থিয়েটারকে বাঁচাবার চেষ্টা করা হচ্ছিল। ১৮ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হয় বিধায়ক ভট্টাচার্যের 'সেই তিমিরে'। নাটকটি বেশ জনসমাদর পেয়েছিল।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট, স্বাধীনতা প্রান্তির পূর্বরাত্রে, অভিনীত হয়েছিল শচীন সেনগুপ্তের নতুন নাটক 'বাংলার প্রতাপ'।

বঙ্গদেশ বিভাজিত হয়ে যাওয়ার ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে বহু ছিন্নমূল মানুষ কলকাতায় চলে আসে। ফলে এই সময়ে কলকাতার কোনো রঙ্গমঞ্চই আর স্বাভাবিকভাবে চলে নি।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে অভিনীত হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ঐতিহাসিক নাটক 'রাণাপ্রতাপ', শচীন সেনপুপ্তের ‌আবুল হাসান'।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে রঙমহল এতটাই ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল যে, আদালত এক দেউলিয়া ঘোষণা করে। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য ১৯৪৯ থেকে দায়িত্ব নেন সীতানাথ মুখোপাধ্যায়। এই বছরের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল- ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের উল্লেখযোগ্য নাটক ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল সর্বাধিক। এই নাটকগুলোর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল- ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ১ জানুয়ারি সুধীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনীত হয়েছিল 'জীজাবাঈ'। এই বছরে দেবনারায়ণ গুপ্তের পরিচালনায় নরেশ সেনগুপ্তের 'বড় বৌ' অভিনীত হয়েছিল।

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে রংমহলে মঞ্চস্থ হয়েছিল বেশ কিছু নতুন নাটক। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল- এরপরে 'রঙমহল' আবার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে-জুন মাসের ভিতরে রঙমহলের পরিচালনার নতুন দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রাচী সিনেমার মালিক জীতেন বোস, জ্যোতি সিনেমার মালিক ভিটল ভাই মানসাটা। ব্যবস্থাপক হিসেবে নিযুক্ত হন নলিনী ব্যানার্জি এবং হেমন্ত ব্যানার্জি। পরিচালক হিসেবে ছিলেন কালীপ্রসাদ ঘোষ। আর প্রযোজনার নিয়ামক হন নেপাল নাগ।

নতুন মালিকাধীন রংমহলে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের 'দূরভাষিণী' উপন্যাসের নাট্যরূপটি মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেন। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন সলিল সেন। এই নাটকটি মঞ্চস্থ করার জন্য আহ্বান করা হয় 'বহুরূপী' নাট্য সম্প্রদায়ের কয়েকজন শিল্পীকে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, গঙ্গাপদ বসু প্রমুখ। সে সময়ে 'বহরূপী‌‌র তখন 'রক্তকরবী' নাটক সুখ্যাতির তুঙ্গে ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বহুরূপীর কলাকুশলীর সাথে মতান্তর হলে, পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন শম্ভু মিত্র। কিছুদিন মিলেমিশে এই কার্যক্রম চললেও শেষ পর্যন্ত এঁরা রঙমহল ছেড়ে দেন। তখন সলিল সেনের পরিচালনায় নীতিশ মুখোপাধ্যায়, জীবেন বোস, প্রণতি ঘোষ এরপর রঙমহলের নিয়মিত শিল্পীরা এগিয়ে এসে কোনক্রমে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জুলাই 'দূরভাষিণী' মঞ্চস্থ করেছিলেন।

এরপর নীহাররঞ্জনগুপ্তের উল্কা উপন্যাস অবলম্বনে নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২ অক্টোবর, এই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়। মূখ্য চরিতত্র অরুণাংশু চরিত্রে অভিনয়ে করেছিলেন- দীপক মুখোপাধ্যায়। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন- নীতিশ মুখোপাধ্যায়, জহর রায়, রবীন মজুমদার, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, শিশ্রা মিত্র, তপতী ঘোষ, গীতা সিং প্রমুখ। এই নাটকটি ব্যাপক জনসমাদর পেয়েছিল। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত একটানা উল্কার অভিনয় চলেছিল টানা ৫০০ রজনী। এরপর বিরতি দিয়ে দিয়ে আরও প্রায় নাটকটি প্রায় ১০০ রজনী অভিনীত হয়েছিল।

'উক্ষা'র অভূতপূর্ব সাফল্যের পরে অভিনীত হয়েছিল  মনোজ বসুর নামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি নাটক 'শেষলগ্ন'। নাটকটি পরিচালনা করলেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র্র। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ নভেম্বর। এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন-  রবীন মজুমদার (প্রশান্ত)। হরিধন মুখোপাধ্যায় (বনমালী) জীবেন বোস (নিখিল), জহর রায় (গোবিন্দ), সত্য বন্দ্যোপাধায় (শিবনাথ). অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় (সাতকড়ি), দীপক মুখোপাধ্যায় (নীরদ), প্রণতি ঘোষ (গৌরী), গীতা সিং (বিভা), কেতকী দত্ত (সুরবালা), ইরা চক্রবর্তী (কাদম্বিনী, পরে সাধনা রায়চৌধুরী), কানন দেবী (রজনী), মঞ্জুদেবী (কমলা)।  এই নাটকে সুরকার হিসেবে রাজেন সরকার কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাস পর্যন্ত একটানা এই নাটকটি অভিনীত হয়েছিল।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে অভিনেতা-পরিচালক-নাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্ত রঙমহলে যোগ দেন। এই বছরের উল্লেখ্যযোগ্য নাটকগুলো ছিল-

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের উল্লেখযোগ্য নাটক ছিল- নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস অবলম্বনে রচিত নাটক 'মায়ামৃগ'। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৪ এপ্রিল। পরিচালনায় ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মার্চ পর্যন্ত নাটকটি একটানা চলেছিল।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রঙমহলে যোগদেন নাট্যকার, অভিনেতা পারিচালক তরুণ রায় (ধনঞ্জয় বৈরাগী)। এই বছরে তরুণ রায়ের দুটি নাটক বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। নাটক দুটি হলো-

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে তরুণ রায় সদলবলে রঙমহল ত্যাগ করেন। এরপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়, সাহেব-বিবি-গোলাম'। বিমল মিত্রের রচিত উপান্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শচীন সেনগুপ্ত। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৮ সেপ্টেম্বর। এই নাটকের মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিশ্বজিৎ।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে দুটি উল্লেখযোগ্য নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাটক দুটি হলো-

১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে রঙমহল আবার সঙ্কটে পড়ে। এই সময় থিয়েটারের মালিক জীতেন বোস ও ভিটল ভাই মানসাটা ছিলেন দুটি সিনেমা হলের মালিক। এঁরা এই থিয়েটার হলটিকে সিনেমা হল রূপান্তরের উদ্যোগ নেন। তাঁর এ বিষয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করলে, থিয়েটারের কর্মীরা আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনে থিয়েটারের কর্মীদের সাথে যোগ দেন থিয়েটারের অপর দুই মালিক হেমন্ত ব্যানার্জি এবং নলিনী ব্যানার্জী। আন্দোলনের মুখে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেন প্রতাপ প্রতাপচন্দ্র চন্দ। সে সময় এর মধ্যস্থতায় সাড়া দিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। শেষ পর্যন্ত এই থিয়েটারের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের হাতে। সে সময়ে সমবায় পদ্ধতিতে ‌এই থিয়েটারের পরিচালনার দায়িত্ব নেন সরযূবালা এবং জহর রায়। এরপর রঙমহল থেকে বছরের প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয়, 'আদর্শ হিন্দু হোটেল'। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি।

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রঙমহলের মঞ্চস্থ করেছিল তিনটি উল্লেখযোগ্য নাটক। এগুলো হলো-

১৯৬৪-৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে রঙমহলের বেশকিছু নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। এগুলো হলো-


সূত্র: