ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
প্রকৃতির
প্রতিশোধ
গ্রন্থপরিচিত
জীবনের প্রথম বয়স কেটেছে বদ্ধঘরে নিঃসঙ্গ নির্জনে। সন্ধ্যাসংগীত এবং
প্রভাতসংগীতের অনেকটা সেই অবরুদ্ধ আলোকের কবিতা। নিজের মনের ভাবনা নিজের
মনের প্রাচীরের মধ্যে প্রতিহত হয়ে আলোড়িত।
তার পরের অবস্থায় মনের মধ্যে মানুষের স্পর্শ লাগল, বাইরের হাওয়ায় জানলা গেল
খুলে, উৎসুক মনের কাছে পৃথিবীর দৃশ্য খণ্ড খণ্ড চলচ্ছবির মতো দেখা দিতে
লাগল। গুহাচরের মন তখন ঝুঁকল লোকালয়ের দিকে। তখনও বাইরের জগৎ সম্পূর্ণ
মুক্ত হতে পারে নি আবেগের বাষ্পপুঞ্জ থেকে। তবু দুঃস্বপ্নের মতো আপনার
বাঁধন-জাল ছাড়াবার জন্যে জেগে উঠল বালকের আগ্রহ। এই সময়কার রচনা 'ছবি ও গান'।
লেখনীর সেই নূতন বহির্মুখী প্রবৃত্তি তখন কেবল ভাবুকতার অস্পষ্টতার মধ্যে
বন্ধন স্বীকার করলে না। বেদনার ভিতর দিয়ে ভাবপ্রকাশের প্রয়াসে সে শ্রান্ত,
কল্পনার পথে সৃষ্টি করবার দিকে পড়েছে তার ঝোঁক। এই পথে তার দ্বার প্রথম
খুলেছিল 'বাল্মীকি-প্রতিভা'য়। যদিও তার উপকরণ গান নিয়ে কিন্তু তার প্রকৃতিই
নাট্যীয়। তাকে গীতিকাব্য বলা চলে না। কিছুকাল পরে, তখন আমার বয়স বোধ হয়
তেইশ কিংবা চব্বিশ হবে, কারোয়ার থেকে জাহাজে আসতে আসতে হঠাৎ যে গান
সমুদ্রের উপর প্রভাতসূর্যালোকে সম্পূর্ণ হয়ে দেখা দিল তাকে নাট্যীয় বলা যেতে
পারে, অর্থাৎ সে আত্মগত নয় সে কল্পনায় রূপায়িত। 'হেদে গো নন্দরানী' গানটি
একটি ছবি, যার রস নাট্যরস। রাখাল বালকেরা নন্দরানীর কাছে এসেছে আবদার করতে,
তারা শ্যামকে নিয়ে গোষ্ঠে যাবে এই তাদের পণ। এই গানটি প্রকৃতির প্রতিশোধে
ভুক্ত করেছি। এই আমার হাতের প্রথম নাটক যা গানের ছাঁচে ঢালা নয়। এই বইটি
কাব্যে এবং নাট্যে মিলিত। সন্ন্যাসীর যা অন্তরের কথা তা প্রকাশ হয়েছে
কবিতায়। সে তার একলার কথা। এই আত্মকেন্দ্রিত বৈরাগীকে ঘিরে প্রাত্যহিক
সংসার নানা রূপে নানা কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠেছে। এই কলরবের বিশেষত্বই হচ্ছে
তার অকিঞ্চিৎকরতা। এই বৈপরীত্যকে নাট্যিক বলা যেতে পারে। এরই মাঝে মাঝে
গানের রস এসে অনির্বচনীয়তার আভাস দিয়েছে। শেষ কথাটা এই দাঁড়াল শূন্যতার
মধ্যে নির্বিশেষের সন্ধান ব্যর্থ, বিশেষের মধ্যেই সেই অসীম প্রতিক্ষণে হয়েছে
রূপ নিয়ে সার্থক, সেইখানেই যে তাকে পায় সেই যথার্থ পায়।
উৎসর্গ
তোমাকে দিলাম
গ্রন্থপরিচিতি
বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী প্রথম খণ্ডের (আশ্বিন ১৩৯০) গ্রন্থ পরিচয় অংশে লিখিত এই গ্রন্থ সম্পর্কিত পাঠ।
প্রকৃতির
প্রতিশোধ ১২৯১ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
প্রকৃতির প্রতিশোধের পরবর্তী সংস্করণ (ভাদ্র ১৩৩৫) প্রথম
সংস্করণের চতুর্দশ দৃশ্যটি নাই। ইহা ছাড়াও অনেক অংশ পরিবর্জিত ও পরিমার্জিত হইয়াছে।
রচনাবলীতে পূর্বোক্ত সংস্করণ (১৩৩৫) অনুসৃত। প্রকৃতির প্রতিশোধের সমসাময়িক 'আলোচনা'
গ্রন্থে কবি প্রকৃতির প্রতিশোধের অন্তর্নিহিত ভাবটির ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আলোচনা
গ্রন্থ এখন অপ্রচলিত। জীবনস্মৃতিতে এ-সম্বন্ধে কবি লিখিয়াছেন–
'আলোচনা নাম দিয়া যে ছোটো ছোটো গদ্য প্রবন্ধ বাহির করিয়াছিলাম
তাহার গোড়ার দিকেই প্রকৃতির প্রতিশোধের ভিতরকার ভাবটির একটি তত্ত্বব্যাখ্যা লিখিতে
চেষ্টা করিয়াছিলাম। সীমা যে সীমাবদ্ধ নহে, তাহা যে অতলস্পর্শ গভীরতাকে এক কণার
মধ্যে সংহত করিয়া দেখাইতেছে, ইহা লইয়া আলোচনা করা হইয়াছে। তত্ত্বহিসাবে সে
ব্যাখ্যার কোনো মূল্য আছে কি না এবং কাব্যহিসাবে 'প্রকৃতির প্রতিশোধ'এর স্থান
কী তাহা জানি না, কিন্তু আজ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, এই একটিমাত্র আইডিয়া অলক্ষ্যভাবে
নানা বেশে আজ পর্যন্ত আমার সমস্ত রচনাকে অধিকার করিয়া আসিয়াছে।'
'বঙ্গভাষার লেখক' (১৯১১) গ্রন্থে 'প্রকৃতির প্রতিশোধ'
সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন–
'আমি বালকবয়্সে প্রকৃতির
প্রতিশোধ লিখিয়াছিলাম... তাহাতে এই কথা ছিল যে, এই বিশ্বকে গ্রহণ করিয়া, এই সংসারকে
বিশ্বাস করিয়া, এই প্রত্যক্ষকে শ্রদ্ধা করিয়া, আমরা যথার্থ অনন্তকে উপলব্ধি করিতে
পারি। যে জাহাজে অনন্তকোটি লোক যাত্রা করিয়া বাহির হইয়াছে তাহা হইতে লাফ দিয়া পড়িয়া
সাঁতারের জোরে সমুদ্র পার হইবার চেষ্টা সফল হইবার নহে'।
প্রকৃতির
প্রতিশোধ |