বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
৮-১৫ মার্চ, ১৯৭১
পূরব-পাঠ:
১-৭ মার্চ
- ৮ মার্চ (সোমবার, ২৩ ফাল্গুন
১৩৭৭ বঙ্গাব্দ)
- আগের দিনের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, সকাল সাড়ে
আটটায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করে। এই ভাষণ রিলে করে প্রদেশের অন্যান্য
বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রচার করা হয়। এর ফলে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন নতুন
উদ্যমে শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম
কমিটিও গঠন করা হয়। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের
সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়।
- যদিও সেনাবাহিনীর সদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে- সরকারের পক্ষ থেকে
বলা হয়, কিন্তু তখনো শহরে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত সেনা টহল ছিল।
- ৭ই মার্চের সরকারি প্রেসনোটে প্রকাশিত '১৭২ জন নিহত
ও ৩৫৮ জন আহত হয়েছে' সংবাদের প্রতিবাদ করে- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
তাজউদ্দীন আহমদ- একে মিথ্যাচার বলে অভিহিত করেন।
ঢাকা হাইকোর্টের সব বিচারপতি
নবনিযুক্ত গভর্নর
টিক্কা
খান-এর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানান।
ছাত্রলীগের সভাপতি
নূরে-আলম-সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক
শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি আ. স. ম. আব্দুর রব ও
সাধারণ সম্পাদক
আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, বাংলার বর্তমান
মুক্তি আন্দোলনকে 'স্বাধীনতার আন্দোলন' ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় যে প্রত্যক্ষ
কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন আমরা তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে
ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহবান জানাচ্ছি।'
রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষিত নির্দেশের ব্যাখা
প্রদান করেন।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের একটি সভা
অনুষ্ঠিত হয়, ৪২ বলাকা ভবনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। ওই সভায় 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ' নাম
পরিবর্তন করে শুধু 'ছাত্রলীগ' রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়া সভায় 'স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র
সংগ্রাম পরিষদ' গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। জেলা শহর থেকে শুরু করে একদম তৃণমূল
পর্যন্ত ছাত্রলীগের সকল শাখায়র সভাপতিকে আহবায়ক ও সাধারণ সম্পাদককে সম্পাদক করে এবং
৯ জন সদস্য (মোট ১১ জন) নিয়ে এই পরিষদ গঠন করা হয়। এই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে,
পূর্ব পাকিস্তানের সকল প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত, পাকিস্তানি পতাকা
প্রদর্শন এবং উর্দু সিনেমা দেখানো বন্ধ থাকবে।
[দ্রষ্টব্য: পূর্ব পাকিস্তান
ছাত্রলীগের প্রস্তাবাবলী]
ইংরেজি ভাষায় গেরিলা যুদ্ধের নিয়মকানুন লিপিবদ্ধ করা একটি
বেনামী প্রচারপত্র বিলি করা হয়।
[দ্রষ্টব্য:
গেরিলা
যুদ্ধের নিয়মকানুন]
ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক স্বাধীন
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারপত্র প্রকাশ করে। প্রচার পত্রে স্বাধীনতা
বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান করা হয়। এটি প্রকাশিত ও
প্রচারিত হয়েছিল ফরোয়ার্ড স্টুডেন্স ব্লকের সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ এহসানুল
হক সেলিম নামে।
[দ্রষ্টব্য:
ফরোয়ার্ড স্টুডেন্স ব্লকের প্রচারপত্র]
এদিন রাতে গণ-ঐক্য আন্দোলনের প্রধান
এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান. , বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পীরা ১০ মার্চ
মুক্তিযুদ্ধের অনুকুলে অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে তা
জানান।
সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত
সংস্থার কর্মচারী সমিতি ও ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
আন্দোলনের স্বার্থে তাঁর অফিস বর্জন করার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানান। এছাড়া এঁরা
আন্দোলনে আহত ও নিহত জনের পরিবারের সাহায্যের জন্য ১ দিনের বেতন সাহায্য তহবিলে দান
করেন।
৮ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্য
আজিজুর রহমান মল্লিকের সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল।
ব্রিটেনে প্রবাসী প্রায় ১০ হাজার
বাঙালি, লন্ডনস্থ পাকিস্তানি হাই কমিশনের সামনে স্বাধীন বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ
প্রদর্শন করেন।
ব্রিটিশ ও পশ্চিম জার্মানীর ১৭৮ জন নাগরিক
ঢাকা ত্যাগ করেন।
ইসলামাবাদে পিপলস পার্টির চেয়াম্যান
জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের
ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দেয়া শর্ত সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করতে
অস্বীকৃতি জানান।
জেনারেল টিক্কা খানের কাছে সাহেবজাদা ইয়াকুব সমস্ত দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।
ইয়াহিয়া খান ব্রিগেডিয়ার জিলানীর মাধ্যমে প্রেরিত এক লিখিত বার্তায় বঙ্গবন্ধুকে
জানান যে, 'আপনি যা দাবি করেছেন, তার চাইতে বেশি কিছু দিতেও আমার আপত্তি নেই। আমি
অচিরেই ঢাকায় আসছি।'
৯ মার্চ (মঙ্গলবার, ২৪ ফাল্গুন ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ)
- আগের মতই অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতে কিছু অফিস খোলা
থাকে। জনসাধারণের সুবিধার জন্য বাস, ট্যাক্সি, রিকশা ও অন্যান্য যানবাহন চলাচল করে।
রেল চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও, অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল বন্ধ থাকে।
- এই দিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ক্যান্টিনে
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় গত ২ মার্চে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত 'স্বাধীন
বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'-এ ছাত্র জনসভায় গৃহীত হয়। এক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুকে
বাংলাদেশের জাতীয় সরকার গঠনে জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা
আন্দোলনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
- আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি তাজউদ্দিন আহমেদ, আওয়ামী লীগের পক্ষ
থেকে সরকারী ও আধা-সরকারি সংস্থাসমূহের প্রতি নির্দেশনামা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ব্যাংকসমূহ সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা
থাকবে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ভেতরে নগদ জমা, বেতন ও মজুরী প্রদান, এক হাজার
টাকা পর্যন্ত প্রদান এবং আন্তঃব্যাংক ক্লিয়ারেন্স ও নগদ লেনদেন করতে পারবে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং প্রয়োজনীয় বিভাগগুলো খোলা থাকবে। সার সরবরাহ ও পাওয়ার
পাম্পের ডিজেল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। পোস্ট অফিস সেভিংস ব্যাংক খোলা থাকবে।
পানি ও গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ
পৃথক আরেকটি বিবৃতিতে সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত প্রেসনোটের প্রতিবাদ
জানিয়ে বলেন, প্রেসনোটে হতাহতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে বলা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ
ও লুটপাটের ক্ষেত্রেই গুলিবর্ষণ করা হয়েছে বলে কথিত বক্তব্য সত্যের অপলাপ।
নিজেদের অধিকারের স্বপক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরত নিরস্ত্র বেসামরিক
অধিবাসীদের ওপরই নিশ্চিতভাবে গুলি চালানো হয়েছে। পুলিশ ও ইপিআর গুলিবর্ষণ করেছে
বলে যে প্রচারণা করা হয়েছে তা বাঙালিদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই
করা হয়েছে।
[দ্রষ্টব্য:
সরকারী ও আধা-সরকারি সংস্থাসমূহের প্রতি তাজউদ্দিনের নির্দেশ]
- বঙ্গবন্ধু ও ভাসানীর ভিতরে সর্বশেষ প্রায় আড়াই ঘণ্টার বৈঠক হয়।
- বিকেলে পল্টন ময়দানে ন্যাপের জনসভায় মওলানা ভাসানী
ভাষণ দেন। জনসমাবেশে ন্যাপ প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ভাষণ দেন । তিনি
বলেন-
- 'শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশমতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোনো
কিছু না করা হলে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো
তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করব । তিনি উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন,
কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে শেখ মুজিবুর রহমান আপস করতে পারে ।
খামোখা, কেউ মুজিবকে অবিশ্বাস করবেন না । শেখ মুজিবকে আমি খুব ভালো
করে চিনি। তাকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছি । আমার রাজনৈতিক
জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ৩১ জন জেনারেল সেক্রেটারির সাথে
কাজ করেছি । তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানই ছিল শ্রেষ্ঠ সেক্রেটারি।'
তিনি ইয়াহিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে। পাকিস্তান অখণ্ড
থাকবে না । অখণ্ড রাখবও না । তিনি আরো বলেন, যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভালো
চাও তাহলে কালই বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও । একই মঞ্চে বাংলা জাতীয়
লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা । আপনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘোষণা করুন । পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে
নেয়ার জন্য প্রতি আহ্বান জানান। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৪ দফার
ভিত্তিতে একটি কর্মসূচী পেশ করেন।
[দ্রষ্টব্য:
মওলানা ভাসানীর ১৪ দফা কর্মসূচী ঘোষণা]
এই সাথে ভাসানী মুক্তি-সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য জনগণে আহবান করে একটি
প্রচার পত্র বিলি করার ব্যবস্থা করেন।
[দ্রষ্টব্য:
মওলানা ভাসানীর
প্রচারপত্র]
- রাজশাহী শহরে রাত ৯টা থেকে ৮ ঘণ্টার জন্য কার্ফিউ জারি করে।
- পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি'র (মার্কসনাদী-লেলিনবাদী) ঢাকা
শাখা'র পক্ষে অসহযোগ আন্দোলন
ত্যাগ করে, গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার আহবান জানায়।
[দ্রষ্টব্য: পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির বিবৃতি]
এ ছাড়াও স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য
পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে পৃথক প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়।
[দ্রষ্টব্য:
পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির
প্রচারপত্র]
- জাতিসংঘের মহাসচিভ উ থান্ট, জাতিসংঘের কর্মাচারীদের প্রয়োজনে ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন।
- জাপানের পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশে অবস্থিত তাদের দেশের নাগরিকদের প্রত্যাহারের
সিদ্ধান্ত নেন।
- পশ্চিম জার্মানী তাদের দেশের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ বিমান
পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
১০ মার্চ। বুধবার ২৫
ফাল্গুন ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ।
- বুধবার রাত্রি তৃতীয় প্রহরে (১২টার পরে) ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে টিক্কা
খানকে খ অঞ্চলর সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যা ৭ই মার্চ থেকে
কার্যকর হবে বলে জানানো হয়। উল্লেখ্য, তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর পদে
ছিলেন
সাহেবজাদা ইয়াকুব খান।
ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে তাঁকে অপসারণ করে
টিক্কা
খানকে গভর্নর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। একই সাথে তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের
কমান্ডার এবং সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পান। কিন্তু ৭ই মার্চ
টিক্কা
খান ঢাকায় পৌঁছার পর, হাইকোর্টের বিচারপতি তাঁকে শপথ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন।
ফলে একটি অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থা নিরসনের জন্য পূর্বের আদেশ বাতিল করে
টিক্কা
খানকে 'খ' অঞ্চলের সামারিক প্রশাসক পদ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে তৎকালীন 'ইত্তেফাক'
পত্রিকার ১০ মার্চ সংখ্যায় একটি খবর প্রকাশিত হয়।
[দ্রষ্টব্য:
ইত্তেফাকের প্রতিবেদন]
- এই দিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো সরকারি আধা-সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের
কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকে। প্রত্যেক সরকারি ও
আধাসরকারি ভবন, ব্যসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, থানা ও
হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। এছাড়া সকল
ধরনের যানবাহন, পুলিশের গাড়িতে কালো পতাকা লাগিয়ে চলাচল করে।
- নিউইয়র্কে বাঙালি ছাত্র-জনতা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন
করে এবং জাতিসংঘ মহাসচিবকে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।
- সকালে
বঙ্গবন্ধু
বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি
পূর্ব-বাংলার মানুষ যে স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছেছে, তা
বাক্যবিনিময়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন।
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক ছাত্রাবাসের প্রাঙ্গনে কেন্দ্রীয়
ছাত্রলীগের উদ্যোগে একটি জনসভা হয়। এই সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি
নূরে-আলম-সিদ্দিকী। সভায় প্রায় সকল ছাত্রলীগ নেতা স্বাধীনতার স্বপক্ষে বক্তব্য
রাখেন। সভা শেষে ডাকসু ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরিত স্বাধীন বাংলাদেশ
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও
পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি উপনেবেশবাদী সরকারের সাথে সহযোগিতা না
করার আবেদন করা হয়। এছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামে সকল মানুষকে সহযোগিতার হাত
বাড়ানোর কথা বলা হয়।
- অভিনেতা গোলাম মোস্তফা ও খান আতার নেতৃত্বের 'বিক্ষু্ব্ধ শিল্পী সমাজ'-এর
ব্যানারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। এদিন 'লেখক শিল্পী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ'-এর
ব্যানারে লেখক ও শিল্পীরা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
- শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে বিকেল বেলায় ওয়ালীপন্থী ন্যাপের উদ্যোগে এক
পথসভা অনুষ্ঠিত হয়।
- ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল
বের করে।
- সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য
ঘোষণা করে।
- সকালে নারায়ণগঞ্জের জেলখানা ভেঙে ৪০ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। এই সময়
কারারক্ষীদের গুলিতে ২৭ জন আহত হয়।
- চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নং জেটিতে ভোর বেলায় এম এন সোয়াত নামে একটি
অস্ত্রবাহী জাহাজ নোঙর করে। বন্দর শ্রমিকরা সেই জাহাজ থেকে সমরান্ত্র খালাস করতে
রাজি না হওয়ায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা তা খালাসের ব্যবস্থা করা হয়।
এরপর অস্ত্রগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌছানোর জন্য প্রস্তুতকৃত রেল
ওয়াগনে ওঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের
উদ্দেশে ৩২ হাজার টন গম চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। 'ভিনটেজ হরাইজন'
নামক ওই গমবাহী জাহাজটির গতিপথ পরিবর্তন করে করাচি বন্দরে পাঠানো হয়।
- লাহোরে সাবেক পিডিএম প্রধান নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের আহবানে পশ্চিম
পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক সভায় মিলিত হয়। সভায় বঙ্গবন্ধু জাতীয়
পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য যে সকল শর্ত দিয়েছেন তা মেনে নেওয়ার দাবি জানানো
হয়।
- এ সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে পূর্ব-পাকিস্তান সরকার ১১৪ নম্বর সামরিক বিধি ঘোষণা
করে। এই বিধিতে বলা হয়:
“যে কেহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিসাধনের কাজ বা
সশস্ত্র বাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি বা রাস্তা, জলপথ বা নৌযান
ব্যবহার, বিদ্যুৎ বা পানি সরবরাহে বাধা প্রদান যাহা দ্বারা সশস্ত্র বাহিনীর
রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাহত হইতে পারে- এই ধরনের কার্যকলাপ আক্রমণাত্মক কাজের
সামিল যাহা সংশ্লিষ্ট সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী
শাস্তিযোগ্য।”
মার্চ ১১।
২৬ ফাল্গুন
১৩৭৭ বঙ্গাব্দ। বৃহস্পতিবার
- এই দিন পূর্ব পাকিস্তানের
সচিবালায়, মুখ্য সচিবের বাসভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবন-সহ বিভিন্ন সরকারি,
আধাসরাকরি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি বাসভবনে কালো
পতাকা উত্তোলন করা হয়। সারা পূর্বপাকিস্তানে সেনানিবাসগুলো ছাড়া অন্য কোথাও
পাকাস্তিন পতাকা উত্তোলিত হয় নি।
- হাইকোর্টের বিচারপতি এবং সচিবালয়ের সকল সকল কর্মচারী এবং সকল সরাকরি, আধা সরকারি অফিসের কর্মচারীরা
অফিস বর্জন করে। তবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, তফসিলী ব্যাংক ও
সরকারি ট্রেজারিতে স্বাভাবিক লেনদেন হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সকল দোকানপাট
খোলা থাকে। অভ্যন্তরীণ বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও সড়ক, রেল এবং জলপথের যানাবাহন
সচল থাকে।
- অর্থনীতি সচল রাখার জন্য, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাজউদ্দীনের একটি বিবৃতি
প্রকাশিত হয়।
[দ্রষ্টব্য:
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্য তাজউদ্দিনের নির্দেশ]
- স্বাধীন পূর্ব-বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্র ইউনিয়নের একটি প্রচারপত্র
প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিল- শোষণমুক্ত স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের সংগ্রাম
আরও দুর্বার করিয়া তুলুন।
[দ্রষ্টব্য:
ছাত্র ইউনিয়নের একটি প্রচারপত্র]
- স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা
এদিন দুটি বিবৃতি প্রদান করে। ছাত্র
সংগ্রাম পরিষদের নেতারা অপর এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত যাবতীয় খেতাব
ও পদক বর্জনের
জন্য বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
- সকল প্রেক্ষাগৃহে বাংলা ছবি প্রদর্শিত হয়। ছবি শুরুর আগে পাকিস্তানি জাতীয়
সঙ্গীতের পরিবর্তে 'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানটি বাজানো হয়।
- সিএসপি এবং ইপিসিএস সমিতির পদস্থ বাঙালি কর্মচারীরা তাঁদের একদিনের বেতন আওয়ামী
লীগ তহবিলে প্রদান করেন।
- কুমিল্লা ও বরিশালে জেল ভেঙে কয়েদিদের একাংশ পালিয়ে যায়। এই সময় কারগার
রক্ষীদের গুলিতে কুমিল্লায় ৩জন এবং বরিশালে ২জন নিহত হয়।
- মওলানা ভাসানী এদিন টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী হাইস্কুলের মাঠে জনসভায় বক্তৃতা
করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সকলের
প্রতি আহ্বান জানান।
- ঢাকাস্থ জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক
প্রতিনিধি মি. উলফ বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং পূর্ব-পাকিস্তানের
চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
- মানুষের মানবিক অধিকার আদায়ের সপক্ষে সমর্থন দান করার
জন্য বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উথান্টের কাছে আহ্বান জানান।
মার্চ ১২।
২৭ ফাল্গুন
১৩৭৭ বঙ্গাব্দ। শুক্রবার
বঙ্গবন্ধুর সাথে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আজগর খান, করাচিতে বলেন যে,
'শেখ মুজিব হচ্ছেন পূর্ব আর পশ্চিমের ক্ষীয়মান সম্পর্কের শেষ সংলাপ। তিনি ঢাকায়
কোনো পাকিস্তানের পতাকা দেখেননি বলে জানান।'
- মার্চ ১৩।
২৮ ফাল্গুন
১৩৭৭ বঙ্গাব্দ। শনিবার
মওলানা ভাসানী রাজবন্দীদের মুক্ত করার জন্য 'জেল ভাঙ্গা' নামে এক
আন্দোলনের ডাক দেন। ইয়াহিয়া লাহোরে সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করেন। বঙ্গবন্ধু এই
বৈঠক বর্জন করেন। কিন্তু বলেন যে, ঢাকায় বৈঠক হলে তাতে যোগ দেবেন।
- মার্চ ১৪।
২৯ ফাল্গুন
১৩৭৭ বঙ্গাব্দ। রবিবার
সামরিক আইন লংঘন করে আন্দোলনকারীরার মিছিল ও সভা পরিচালনা করে। এই দিন
অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রে বেসামরিক প্রশাসন পশ্চিম পাকিস্তানি নীতি অনুযায়ী কাজ করা
থেকে বিরত থাকে।
- মার্চ ১৫
।
১
চৈত্র ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ। সোমবার
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবিতে বাংলাদেশের শাসন নিজ
হাতে নেয়ার ঘোষণা দেন এবং কাজ-কর্ম পরিচালনার জন্য ৩৫টি বিধি জারি করেন।
[দ্রষ্টব্য:
শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক আন্দোলনের নতুন
কর্মসূচী ঘোষণা]
মাত্র
দুটি ব্যাংকে সরকারকে কর প্রদানের নির্দেশ দেন। এই দিন প্রেসিডেন্ট
ইয়াহিয়া খান
ঢাকায় আসেন। তিনি ২৩শে মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন বলে ঘোষণা দেন।
সূত্র:
- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র:
১-১৫ খণ্ড
- মুক্তিযুদ্ধ কোষ। প্রথম খণ্ড। মুনতাসির মামুন সম্পাদিত। সময়, ঢাকা।
ফেব্রুয়ারি ২০১৩।
- প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ
- বিভিন্ন পত্রপত্রিকা