এলাহাবাদ স্তম্ভশিলালিপি
ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজ তথা আল্লাহাবাদ-এ নির্মিত স্তম্ভ শিলালিপি।

এই শিলাস্তম্ভটি প্রথম তৈরি হয়েছিল সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৮-২৩২ অব্দ )। তখন এর নাম ছিল অশোক স্তম্ভ। অশোকের সময় এই স্থানের নাম ছিল প্রয়াগ। এই স্থানটি ছিল গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থল। লিপিটির সংস্কৃত নাম 'প্রয়াগ প্রশস্তি'। এই স্তম্ভের লিপির বিষয় ছিল রাষ্ট্রীয় অনুশাসন। 

এর রাণী অনুশাসন অংশে অশোকের দ্বিতীয় পত্নী কারুভাকীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এঁদের পত্রের নাম ছিল  তীবর। এই লিপিতে রাণী কারুভাকীর বিভিন্ন দানশীল এবং জনহিতকর কাজের প্রশংসা করা হয়েছে। অশোক নির্দেশ দেন যে রাণী কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত দানের রেকর্ড যেন রাখা হয়। এর লিপি ছিল- অশোকের শিলালিপিগুলিতে স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রাকৃত ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া কিছু পাঠ আছে ব্রাহ্মীলিপি -তে।

গুপ্তরাজবংশের চতুর্থ রাজা সমুদ্রগুপ্ত (৩২৫-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দ) এর উপর তাঁর নিজের বিজয়লিপি উৎকীর্ণ করান। দাক্ষিণাত্যের ১২ জন রাজাকে পরাজিত করা পর, তাঁদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। তবে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে কর প্রদানে বাধ্য করেন। এঁরা হলেন-

১. মহেন্দ্র  কোশল (দক্ষিণ কোশল - আধুনিক ছত্তিশগড়)
২. ব্যাঘ্ররাজ মহাকান্তার (মধ্য ভারত/উড়িষ্যার জঙ্গল এলাকা)
৩ মন্তরাজ  কৌরলক (আধুনিক উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলা)
৪ মহেন্দ্রগিরি  পিষ্টপুর (আধুনিক অন্ধ্রপ্রদেশের পিঠাপুরম)
৫ স্বামিদত্ত  কোট্টুর (আধুনিক উড়িষ্যার কোট্টুর)
৬ দমন এরণ্ডপল্ল (আধুনিক অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম)
৭ বিষ্ণুগোপ  কাঞ্চি (দক্ষিণের অন্যতম প্রধান পল্লব রাজ্যের রাজধানী) নীলরাজ 
৮ হস্তি বর্মণ  বেঙ্গি (কৃষ্ণ-গোদাবরী দোয়াব অঞ্চল)
১০ উগ্রসেন  পালক্ক (আধুনিক অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরের কাছে)
১১ কুবের  দেবরাষ্ট্র (আধুনিক অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমের কাছে)
১২ ধনঞ্জয়  কুস্থলপুর (আধুনিক উড়িষ্যার জয়পুর এলাকা)

এছাড়া  ৫টি রাজ্যেকে কর ও রাজস্ব প্রদান করে আনুগত্য স্বীকার করা। এই পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে কামরূপের উল্লেখ রয়েছে)। কামরূপ, সমতট (পূর্ব বাংলা), বরাক (মধ্য আসাম).কর্তৃপুর এবং নেপালের মতো সীমান্ত রাজ্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যারা কর দিয়ে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত।

উত্তর ভারতের ৯ জন রাজাকে পরাজিত করে তাদের রাজ্য সরাসরি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা। এঁরা হলেন-

১. রুদ্রদেব সম্ভবত উত্তর ভারতের কোনো স্থানের শাসক।
২. মতিল মথুরার শাসক হতে পারেন।
৩. নাগদত্ত সম্ভবত মথুরার নাগবংশের শাসক।
৪. চন্দ্রবর্মণ সম্ভবত বাংলা বা উত্তর ভারতের কোনো স্থানের শাসক।
৫ গণপতিনাগ সম্ভবত নাগবংশের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ শাসক।
৬ নাগসেন  মথুরা বা মধ্য ভারতের পদ্মাবতীর নাগবংশের শাসক।
৭ অচ্যুত  সম্ভবত অহিক্ষত্র বা উত্তর ভারতের অন্য কোনো স্থানের শাসক।
৮ নন্দিন  উত্তর ভারতের কোনো স্থানের শাসক।
৯ বলবর্মণ  উত্তর ভারতের কোনো স্থানের শাসক।
এর লিপি ছিল দেবনাগরী এবং ব্রাহ্মীলিপি ।   মূল পাঠ রচনা করেছিলেন- হরিসেন। তিনি সমুদ্রগুপ্তকে একজন আদর্শ রাজা (যার কোনো শত্রু ছিল না), মহান কবি (কবিরাজ), বিদ্বান, সঙ্গীতজ্ঞ এবং শিল্পকলা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাট আকবরের পুত্র সম্রাট সম্রাট জাহাঙ্গীর, লিপিও এই স্তম্ভে খোদাই করা হয়।  এই লিপিতে জাহাঙ্গীরের বংশতালিকা এবং তাঁর পূর্বর্তীতের (যেমন আকবর, হুমায়ুন, বাবর) নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এতে জাহাঙ্গীরের সিংহাসনে আরোহণের তারিখ এবং আনুক্রমিক বছরের উল্লেখ রয়েছে। এই লিপিটি উৎকীর্ণ করার সময় জাহাঙ্গীরের প্রয়াগ (এলাহাবাদ) দুর্গে অবস্থানের স্মৃতি ধরে রাখে। মুঘল ঐতিহ্য অনুসারে, এই বাণীতেও সম্রাটের মহিমা, ক্ষমতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুণগান করা হয়েছে। এর লিপি ছিল ফারসি এবং নাস্তালিক
 
১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে আকবর এই স্তম্ভটি আল্লাহাবাদ দুর্গের প্রবেশদ্বারের সামনে সরিয়ে আনেন। পালিশ করা পাথরের তৈরি এই স্তম্ভটির উচ্চতা ১০.৭ মিটার এবং এতে অশোকের একটি শিলালিপি খোদাই করা আছে।  এছাড়া মুঘল সম্রাট আকবরের সভাসদ রাজা বীরবলের একটি লিপিও এই স্তম্ভে উৎকীর্ণ আছে।