মিজোরাম
ভারত প্রজাতন্ত্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি একটি প্রদেশ। রাজ্যটির রাজধানী আইজল।

ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক : ২১°৫৮-২৪° উত্তর ৯২°′১৫-৯৩°′২৯পূর্ব।

মিজোরামের
সীমানা ও আয়তন
এই রাজ্যের উত্তরে আসাম, মণিপুরি, পূর্বে মায়ানমার,  দক্ষিণে মায়ানমার, পশ্চিমে বাংলাদেশ  এবং পূর্বে
ভারতের ত্রিপুরা। এটি একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য। এর মোট আয়তন ২১,০৮৭ বর্গ কিলোমিটার। সীমানার বিচারে আসামের সাথে ১২৩ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সাথে ২৭৭ কিলোমিটার, মণিপুরি-এর সাথে ৯৫ কিলোমিটার, মায়ানমারের সাথে ৪০৪ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ-এর সাথে ৩১৮ কিলোমিটার। 

জনসংখ্যা : ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুসারে এই রাজ্যের লোকসংখ্যা ১০,৯১,০১৪ জন।
শিক্ষার হার : ৯১.৮৫% সাক্ষর।
ধর্ম : খ্রিষ্টান।

তাপমাত্রা : শীতকাল ১১-২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রীষ্মকালে ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

প্রশানিক বিভাজন
মিজোরাম মোট ২৬টি ব্লক, ৮টি জেলায় ২৩টি মহকুমায় বিভাজিত। জেলাগুলোর নাম হলো
মামিত, কোলাশিব, আইজল, চম্ফাই, সেরাছিপ, লুঙ্গলেই, লাওঙ্‌টলাই এবং সাহা।

ইতিহাস : কুকি, লুসাই ও মিজো
মিজোরাম একসময় দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হিসেবেই বিবেচিত হতো। এই অঞ্চলের মোঙ্গোলীয় মহাজাতি সত্তার আদিবাসী 'মিজো' থেকে এই অঞ্চলের নাম হয়েছে মিজোরাম। ধারণা করা হয়, চীনের ইয়ালোঙ (
Yalung) নদীর তীরবর্তী শিনলুঙ বা ছিনকুঙসেন অঞ্চলে ভারতীয় মোঙ্গোলীয়দের আদিপুরুষেরা বসবাস করতো। চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরততা এবং সেই সূত্রে সৃষ্ট অরাজকতার কারণে, খ্রিষ্টপূর্ব ২১০ অব্দের এই অঞ্চল থেকে বহু মানুষ মায়ানমার ও তিব্বতের দিকে চলে আসে। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে এদের একটি দল চীন-মায়ানমার সীমান্তের শান অঞ্চলে (বর্তমানে শান মায়ানমারের একটি প্রদেশ) এসে বসতি স্থাপন করেছিল। শান অঞ্চলের আদিবাসীরা এই নবাগতদের খুব ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের কারণে এদেরকে উৎখাতও করতে পারে নি। শান অঞ্চলে এরা প্রায় ৩০০ বৎসর বসবাস করে।

খ্রিষ্টাপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে পরে এদের একটি শাখা ভারতের মণিপুর এবং মায়ানমার সীমান্তের নিকটবর্তী কাবাও উপত্যাকায় চলে আসে এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে। এই সময় মায়ানমারের আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত বার্মিজদের সাথে সম্প্রীতি গড়ে উঠে এবং উভয় জাতির ভাষা এবং সংস্কৃতি উভয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

এরপর এদের একটি শাখা মায়ানমারের স্যাগায়িং প্রদেশের খ্যাম্পাট অঞ্চলে প্রবেশ করে। খ্রিষ্টীয় ১৪শ শতকের মধ্যভাগে এরা মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ের ভারত সীমান্ত বরাবর বসতিস্থাপন করে।  খ্রিষ্টীয় ১৬শ শতকের দিকে বর্তমান ভারত প্রজাতন্ত্রের মায়ানমার সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি ধাপে প্রবেশ করে।

ভারতবর্ষে প্রথম যে মিজোরা প্রথম প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে কুকি বলা হয়। ভারতে প্রবেশকারী এই জাতি গোষ্ঠীর দ্বিতীয় দলকে নব্য কুকি নামে অভিহিত করা হয়। আর এই জাতি সত্তার সর্বশেষ যে দলটি ভারতে প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে অভিহিত করা হয় লুসাই নামে। কুকি, নব্য কুকি এবং লুসাইদের সম্মিলিত নাম হলো মিজো।

মিজোদের বসতিস্থানের নামানুসারে একটি পাহাড়কে মিজো পাহাড় নামে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে এই পাহাড়কে ব্রিটিশ সরকার ভারতের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ পর্বতেকে পার্বত্য লুসাই জেলার অংশ হিসেবে গৃহীত হয়। এই সময় এই অঞ্চলের প্রশাসনিক সদর করা হয় আইজল-কে। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চলেকে আসামের সাথে যুক্ত করা হয়। 

ব্রিটিশ ভারতে খ্রিষ্টান মিশনারীদের তৎপরতায় মিজোদের অধিকাংশই খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। এই সময় এদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়তে থাকে। ব্রিটিশভারতের শেষার্ধে মিজোরা নিজেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠে।  ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল Mizo Common People's Union নামে দল গঠিত হয়। পরে এই দলটি Mizo Union নাম গ্রহণ করে। এরা ক্রমে ক্রমে স্বায়ত্ত শাসনের দাবী তুলতে থাকে। এই সূত্র এরপর লুসাই পাহাড় এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের নিয়ে একটি দল গঠিত হয়। এর নামকরণ করা হয় United Mizo Freedom (UMFO)। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ভারত বিভাজনের সময় এই অঞ্চল ভারতের অংশ হিসেবে যুক্ত করা হয়।

সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য একটি উপকমিটি গঠন করা। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন গোপীনাথ বরোডোলি। মিজো ইউনিয়ন এই কমিটির কাছে লুসাই পাহাড়ের সকল অধিবাসীদের একত্রিভূত করে একটি অখণ্ড অঞ্চলের দাবি রাখে। গোপীনাথের এই কমিটির একটি সীমিত স্বায়ত্ব শাসনের প্রস্তাব রাখে। নানা রকমের টানপোড়নের মধ্য দিয়ে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হয়। এই দলটির নাম রাখা হয় Eastern India Union (EITU)। এই সময় মিজো ইউনিয়ন বিভাজিত হয়ে যায় এবং এর একটি অংশ EITU-এর সাথে যুক্ত হয়। অন্যদিকে UMFO-ও এই নতুন দলের সাথে যুক্ত হয়। ফলে EITU মিজোরামের অন্যতম শক্তিশালী দলে পরিণত হয়।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড়ি বাঁশগুলো ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল। এই ফুল খেয়ে পাহাড়ি ইঁদুর সংখ্যা অত্যাধিক বেড়ে গিয়েছিল। এই বর্ধিত ইঁদুরের দল পরে গ্রামের ফসল, ঘরবাড়ি কেটেকুটে তছনছ করে ফেলে। একসময় এই অঞ্চলে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে প্রচুর মিজো মারা যায়। যারা প্লেগ থেকে বেঁচে গিয়েছিল তাদের একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছিল অনাহারে।

প্রাগ্ সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবার
পরিবার :
সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবার
উপ-পরিবার :
তিব্বত-বর্মীয় ভাষা-উপ-পরিবার
শাখা :
সাল
উপ-শাখা :
কুকি-চীন-নাগা
গোষ্ঠী : কুকি-চীন
উপগোষ্ঠী :
কুকি-চীন-মধ্যাঞ্চলীয়
আন্তর্জাতিক ভাষা সঙ্কেত
 
ISO 639-2 lus
ISO 639-3 lus

মিজোরামের ভাষা
মিজোরামের প্রদেশিক ভাষার নাম মিজো। মিজোরামের অধিকাংশ এই ভাষায় কথা বলে। এই ভাষার দুহলিয়ান আঞ্চলিক ভাষা লুসেই নামে পরিচিত। এই আঞ্চলিক ভাষাটিই মূলত মিজো নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই ভাষার সাথে হমার, মারা, লাই, পাইতে, গ্যাঙ্‌টে ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এই ভাষার কোনো বর্ণমালা ছিল না। মিজো ভাষা
সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবার-এর অন্তর্গত। ভাষা শ্রেণিবিভাজনে এর শ্রেণিস্তর বেশ দীর্ঘ। পাশের ছকে এর শ্রেণিস্তর দেখানো হলো।

এই ভাষার মানুষ মিজোরাম ছাড়াও মায়ানমার এবং বাংলাদেশে রয়েছে।

খ্রিষ্টান মিশনারিরার মিজো বর্ণমালার উন্নয় ঘটিয়েছে। এর মূল বর্ণগুলো রোমান বর্ণমালা থেকে গৃহিত হয়েছে। এই ভাষায় ব্যবহৃত বর্ণমালায় মোট ২৫টি বর্ণ রয়েছে। এই বর্ণগুলো হলো- A, AW, B, CH, D, E, F, G, NG, H, I, J, K, L, M, N, O, P, R, S, T, Ṭ, U, V, Z.। বাংলাদেশের মিজোভাষার মানুষ বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে।

মিজোরামে মিজো ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা, প্রশাসনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া রয়েছে হিন্দি এবং নেপালি ভাষা।

 


সূত্র :
http://mizoram.nic.in/about/history.htm
http://www.ethnologue.com/language/lus