খ্রিষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি নাট্যমঞ্চ
কলকাতার ৬ নম্বর
বিটন স্ট্রটে মহেন্দ্রনাথের দাসের জমিতে এই মঞ্চটি তৈরি হয়েছিল।
মূল বাড়িটি তৈরি হয়েছিল কাঠ দিয়ে। মঞ্চটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভুবনমোহন নিয়োগী। শুরুতে ভুবনমোহন নিয়োগী
এই থিয়েটারের জন্য ইংরেজ
শিল্পী গ্যারিককে ড্রপসীন ও দৃশ্যপট অঙ্কনের দায়িত্ব দেন।
মূলত এই থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন
ন্যাশনাল থিয়েটারের
আদিপর্বের
কলাকুশলীরা ছিলেন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ৮ মার্চ রাত্রের
ন্যাশনাল থিয়েটারের
পরিবেশনা শেষে, নাট্যদলটি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এর একটি ছিল
গিরিশচন্দ্রের পরিচালিত
ন্যাশনাল থিয়েটারের
এবং অর্ধেন্দুশেখরের 'হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার।
বিভাজিত এই দুটি দলের ভিতের মিলে মিশে কাজ করার যে
উদ্যোম সৃষ্টি হয়েছিল, সেই প্রেরণা থেকে হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটারের
নগেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ন্যাশনাল থিয়েটারের ধর্মদাস সুর, নতুন একটি
নাট্যালয় তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর এই থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ
হল অমৃতলাল বসুর 'কাম্যকানন'। কিন্তু প্রথম অভিনয়ের সময় আগুন লেগে মঞ্চটি
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এই ঘটনার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে থিয়েটার বন্ধ হয়ে
গিয়েছিল। এরপর রাতভর কাজ করে এই
থিয়েটার বাড়িকে মেরামত করা হয় এবং পরের দিন অর্থাৎ ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার বেলভেডিয়ারে নীলদর্পণ মঞ্চস্থ করে।
এরপর বাড়িটি পুননির্মাণ করে
পুরোপুরিভাব অন্যান্য নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। এই বছরের
উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিলো-
-
বিধবাবিবাহ। নাট্যকার উমেশচন্দ্র মিত্র। (১০ জানুয়ারি)
- প্রণয় পরীক্ষা। নাট্যকার মনোমোহন(১৭ জানুয়ারি)
- কৃষ্ণকুমারী। নাট্যকার
মাইকেল
মধুসূদন দত্ত (২৪ জানুয়ারি)
- কপালকুণ্ডলা।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় -এর উপন্যাস অবলম্বনে রচিত
নাটক (৭ ও ১৪ ফেব্রুয়ার)
এরপর গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় -এর মৃণালিনী ও বিষবৃক্ষ
উপন্যাসকে মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেয়। এই উপন্যাস দুটির নাট্যরূপ দেওয়ার জন্য
গিরিশচন্দ্র ঘোষ-কে অনুরোধ করা হয়।
গিরিশচন্দ্র এই উপন্যাস দুটির নাট্যরূপ দেন এবং অভিনেতা
অভিনেত্রীদের প্রশিক্ষণ দেন। এই নাটক দুটির ভিতরে মৃণালিনীর অসম্ভব
সাফল্য লাভ করেছিল। ১৮৭৪ খ্রষ্টাব্দের ২১ ও ২৮
ফেব্রুয়ারি মৃণালিনী অভিনীত হয়। এতে অভিনয় করেছিলেন গিরিশচন্দ্র
(পশুপতি), অর্ধেন্দুশেখর (হ্ষিকেশ), নগেন্দ্রনাথ (হেমচন্দ্) অমৃতলাল বসু (দিগ্বিজয়), অমৃতলাল
মুখোপাধ্যায় (ব্যোমকেশ), মহেন্দ্রলাল বসু (বক্তিয়ার খিলজি), বসন্তকুমার ঘোষ (মৃণালিনী), আশুতোব বন্দ্যোপাধ্যায়
(গিরিজায়া) এবং ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় (মনোরমা)।
উল্লেখ্যে এই সময় এই থিয়েটারে নারী চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয়
করতেন। এরপর এই থিয়েটার মঞ্চস্থ হয় নবাবের নবরত্ব সভা (৭ মার্চ), নবীন তপস্থিনী (১৮ মার্চ), হেমলতা (১৮ এপ্রিল)
ও কুলীনকন্যা বা কমলিনী (৩০ মে)।
দর্শকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে- নারী ভূমিকায় অভিনেত্রী গ্রহণের
সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে যাঁদেরকে নেওয়া হয়েছিল, এঁরা হলেন- কাদম্বিনী, ক্ষেত্রমণি,
যাদুমণি, হরিদাসী ও
রাজকুমারী। অভিনেত্রী সহযোগে মঞ্চস্থ হল সতী কি কলঙিকনী (১৮
সেপ্টেম্বর, ১৮৭৪)। নাট্যকার ছিলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
নানাবিধ কারণে
গিরিশচন্দ্র এই থিয়েটার ত্যাগ করেন। তাঁর জায়গায়
নগেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন দলের ম্যানেজার। ১৮৭৪-এর ৩
অক্টোবর ও ১০ অক্টোবর যথাক্রমে মঞ্জস্থ হয়
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুর পুরুবিক্রম, সতী কি কলঙ্কিনী
ও ভারতে যবন। শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ-এর বাংলা অনুবাদ রুদ্রপাল
(রূপান্তর হরলাল রায়) অভিনীত হয়
৩১ অক্টোবর।
এরপরে অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণচন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায়, মদনমোহন বর্মণম যাদুমণি, কাদম্বিনী দলত্যাগ করেন এরা প্রথমে একটি
দল গড়ার কথা ভেবেছিলেন। পরে
এঁরা সকলেই ১৮৭৫-এ
বেঙ্গল থিয়েটারে যোগ দেন।
এরপর আবার ধর্মদাস-সুর গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ম্যানেজার নিযুক্ত হন। ১৮৭৫
খ্রিষ্টাব্দ যে সকল উল্লেখযোগ্য নাটক
মঞ্চস্থ হয়েছিল- সেগুলো হলো-
- শত্রুসংহার (৬ ফেব্রুয়ারি)। নাটকটি ভট্টনারায়ণের বেণীসংহার অবলম্বনে হরলাল রায় রচনা করেন। এই নাটকে
বিনোদিনী দাসী
দ্রৌপদীর সখীর এক ছোট্ট ভূমিকায় অভিনয় করেন।
- শরৎ-সরোজিনী। রচয়িতা উপেন্দ্র দাস। এই নাটকে গোলাপ
সুন্দরী নামক এক অভিনেত্রী সুকুমারী চরিত্রে অভিনয় করে এতাটাই সুখ্যাতি
পেয়েছিলেন যে, পরে তাঁর নামই হয়ে যায় সুকুমারী।
- নগনলিনী। রচয়িতা প্রমথনাথ মিত্র
- যেমন কর্ম তেমন ফল।
দাসের শরৎ-সরোজিনী, প্রমথনাথ মিত্রের নগনলিশী, যেমন কর্ম তেমন ফল। এর মধ্যে শরৎ-সরোজিনী নাটক দারুণ
জনপ্রিয়তা পায়। এই নাটকে গোলাপসুন্দরী সুকুমারী চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য সুকুমারী নামেই পরিচিতি লাভ
করেন।
এরপর ধর্মদাস সুরের নেতৃত্বে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৭৫-এর মার্চে দিল্লি, আগ্রা, মিরাট,
লক্ষ্ণৌ, লাহোর
ইত্যাদি স্থানে অভিনয় করতে যায়। দলে ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর, ধর্মদাস, অবিনাশচন্দ্র কর, বিনোদিনী, ক্ষেত্রমণি প্রমুখ।
লক্ষ্ণৌ শহরে নীলদর্পণ অভিনয়ের সময় সাহেব দর্শকরা
উত্তেজিত হয়ে মঞ্চে এসে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের
আক্রমণ করেছিল।
এই সময় এদের একটি দল কলকতায় অভিনয় চালু রেখেছিল। এই দলের অভিনীত উল্লেখযোগ্য
নাটকগুলো ছিল-
- সধবার একাদশী (২০ মার্চ)
- নয়শো রুপেয়া (১০ এপ্রিল),
- তিলোত্তমা সম্ভব (১৭ এপ্রিল)
- নন্দনকানন (৮ মে)।
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জুলাই মহেন্দ্রলাল বসুর পদ্মিনী নাটকের অভিনয়-এর মধ্য দিয়ে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার কলকাতায়
পূর্ণশক্তিতে অভিনয় শুরু করে। আগষ্ট মাসে প্রতিষ্ঠাতা ভুবনমোহন নিয়োগী
ধর্মদাস সুরকে সরিয়ে দলের কার্যভার
গ্রহণ করেন। ম্যানেজার হিসেবে থাকেন মহেন্দ্রলাল বসু।
পরে তিনি কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়কে
মঞ্চটি ইজারা দেন। কৃষ্ণধন গ্রেট
ন্যাশনাল থিয়েটারের নাম পরিবর্তন করেন, নাম দেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার।
এই ঘটনায় ধর্মদাস এই রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করে নতুন দল তৈরি করেন। এই
দলের নাম দিয়েছিলেন 'দি নিউ এরিয়ান'। এঁরা বেঙ্গল থিয়েটারে কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ
করেছিলে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য নাটক ছিল-
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার পদ্মিনী নাটক মঞ্চস্থ ।
১৪ আগষ্ট শরৎসরোজিনী, ২১ আগষ্ট নীলদর্পণ মঞ্চস্থ হয়। পরে
বেঙ্গল থিয়েটারের অমৃতলাল বসু এখানে যোগ দেন।
এরপর সুকুমারী
দত্তের লেখা নাটক অপূর্বসতী মঞ্চস্থ হয় ২৩ আগস্ট।
কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় তার নতুন থিয়েটার চালাতে গিয়ে
ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে ভূবনমোহন নিয়োগ
আবার নিজের হাতে থিয়েটারের ভার নিয়ে নেন। এরপর তিনি
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার নাম
পাল্টে আগের গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার নামে মঞ্চটি চালু
করেন। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর অমৃতলাল বসুর
'হীরকচূর্ণ' মঞ্চস্থ। ৩১ ডিসেম্বর অভিনীত হলো উপেন্দ্রনাথ দাসের সুরেন্দ্র-বিনোদিনী।
১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এই মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল প্রকৃত
বধু (ব্রজেন্দ্রকুমার রায়), সরোজিনী (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) ও বিদ্যসুন্দর নাটক।
এই সময় ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অফ ওয়েলস কলকাতায় এসে উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়-এর বাড়ির আতিথ্য
গ্রহণ করেন। এ নিয়ে কলকাতায় আলোড়ন তৈরি হয়। এই বিষয় নিয়ে উপেন্দ্রনাথ রচিত
'গজদানন্দ ও যুবরাজ'
নামক একটি প্রহসন মঞ্চস্থ করে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার। ১৯ ফেব্রুয়ারি,
'গজদানন্দ ও যুবরাজ' ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের
সরোজিনী মঞ্চস্থ হয়। আবার ২৩ ফেব্রুয়ারি সতী কি কলঙিকনী নাটকের সঙ্গে
'গজদানন্দ ও যুবরাজ অভিনীত' হয়। এই অভিনয়ের
পরে পুলিশ অভিনয় বন্ধ করে দেয়। ২৬ ফেব্রুয়ার উপেন্দ্রনাথ প্রহসনটির নাম পরিবর্তন করে
'হনুমান চরিত্র' নামে মঞ্চস্থ
করেন। পুলিশ এই হনুমান চরিত্র-এর অভিনয়ও বন্ধ করে দেয়। তখন পুলিশকে বিদ্রূপ করে উপেন্দ্রনাথ
দাস