বেঙ্গল  থিয়েটার
১৮৭৩-১৯০১
খ্রিষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে প্রতিষ্ঠিত একটি নাট্যমঞ্চ ও নাট্যদল।

১৮৭২-৭৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তৎকালীন  'ন্যাশনাল থিয়েটারের সাফল্যে ঊসাহিত হয়ে সাতুবাবুর (আশুতোষ দেব) দৌহিত্র  শরৎচন্দ্র ঘোষ একটি নাট্যমঞ্চ তৈরির কথা ভাবতে থাকেন। এই ভাবনা থেকে কলকাতার নম্বর বিডন স্ট্রিটে রামদুলাল সরকারের ঠাকুরবাড়ির বিপরীতে ফাঁকা মাঠে একটি নাট্যমঞ্চ তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। মধ্যস্থ পত্রিকার '২২-২-১৮৭৩' সংখ্যার বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, ১৮ অংশীদার প্রত্যেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে ১৮ হাজার টাকার একটি তহবিল গঠন করে এই নাট্যাশ্যালা তৈরির কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল। বেঙ্গল থিয়েটারই বাংলার প্রথম পেশাদার ‘থিয়েটার হল’ যা নির্মিত হয়েছিল জনসাধারণের শেয়ারের টাকায়। মঞ্চটি প্রথমে ছিল খোলার চাল ও মাটির দেওয়াল। পরে করোগেড টিনের ছাদ ও পরে পাকা দেওয়াল দেওয়া হয়েছিল।

এই নাট্যমঞ্চ পরিচালনা জন্য তিনি একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। এই কমিটিতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত, সত্যব্রত সাম্যধ্যায়ী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি। এছাড়া যাঁরা বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন, তাঁর হলেন- বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়, হরিদাস, দেবেন্দ্রনাথ মিত্র, অক্ষয়কুমার মজুমদার।

নাট্যমঞ্চ তৈরি প্রস্তুতি পর্বের মাঝপথে, ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন, ‘বেঙ্গল থিয়েটার’-এর অন্যতম উপদেষ্টা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মৃত্যবরণ করেন। তাই মধুসূদনের লেখা ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়েই নাট্যালয়ের সূচনা হবে বলে স্থির করা হয়। এবং টিকিট বিক্রির লভ্যাংশ মাইকেলের সহায়সম্বলহীন পুত্রকন্যাদের সাহায্যার্থে ব্যয় করা হবে - এমন সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছিল।

১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগষ্ট  ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগস্ট। এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন, শরৎচন্দ্র (যযাতি)। বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায় (শুক্রাচার্য), এলোকেশী (দেবযানী), জগত্তারিণী (দেবিকা)।

বেঙ্গল থিয়েটার শুরু থেকেই নারী চরিত্র রূপায়নে মঞ্চে অভিনেত্রী গ্রহণ করেছিল। প্রথমে চারজন অভিনেত্রী ছিলেন- শ্যামা, জগত্তারিণী, এলোকেশী ও গোলাপ। পরে আরো অভিনেত্রী নেওয়া হয়।

অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় তার ‌গিরিশচন্দ্র' গ্রন্থে জানিয়েছেন যে, শর্মিষ্ঠা নাটকের মহলায় সুকুমারী অংশগ্রহণ করলেও, প্রথম রাতের অভিনয়ে অংশ নেন নি। শঙ্কর ভট্ট্চার্য তার “বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাসের উপাদান' গ্রন্থে জানিয়েছেন, ২৩ আগস্ট, ১৮৭৩ দ্বিতীয় অভিনয়ের রাতে সুকুমারী প্রথম অবতীর্ণ হন। সে যুগে ভদ্র গৃহস্থ ঘরের মেয়েদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে পাওয়া সম্তব না ছিল না। তাই বেঙ্গল থিয়েটার নিষিদ্ধ পল্লী থেকে এই অভিনেত্রীদের জোগাড় করেছিল। নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করানোর জন্য
নানা বাকৃবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছিল। মধুসূদনের এই ব্যাপারে উৎসাহ ও সমর্থন ছিল। আর বিদ্যাসাগর এই কারণেই এদের কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।

বেঙ্গল থিয়েটারের অভিনয় শর্মিষ্ঠা নাটক দিয়ে শুরু করার পর এখানে রামনারায়ণের স্বপ্নধন (অক্টোবর, ১৮৭৩), বিদ্যাসুন্দর ও যেমন কর্ম তেমনি ফল অভিনীত হয়। তারপর মধুসূদনের “মায়াকানন' এখানে অভিনীত হয়। অভিনেত্রী প্রসঙ্গ আলোড়ন তুললেও নাট্যাভিনয় দর্শক আনুকূল্য লাভ করতে পারে নি।

এই সময়
হুগলী জেলার তারকেশ্বর মন্দিরের মন্দিরের পুরোহিতের অনাচারের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে (১২৮০ বঙ্গাব্দ) মোহান্তের নামে প্রথম নারীঘটিত অভিযোগ উঠেছিল। তখন থেকেই মোহান্তদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ-সহ নানা ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল। দীর্ঘদিন পর ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ (১৩৩১ ৩১ বঙ্গাব্দ) দিকে তৎকালীন মোহান্ত সতীশচন্দ্র গিরির নামে নারীঘটিত এবং অর্থ আত্মসাতের মতো অভিযোগ ওঠে। এই সময় স্থানীয় মানুষ এর প্রতিবাদ শুরু করে। এরই সূত্রে ধরে ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২৭শে জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গালবার ১০ জুন ১৯২৪) থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ 
তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেন। সে সময় তারেকেশ্বরের মোহান্ত ও এলোকেশী নিয়ে অনেকগুলো নাটক লেখা হয়েছিল। এমনি একটি নাটক রচনমা করেছিলেন- লক্ষ্মীনারায়ণ দাস। নাটকের নাম ছিল- 'মোহান্তের এই কি কাজ'।  ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। এই নাটকের পর থেকে বেঙ্গল থিয়েটারের আর্থিক দুর্বস্থা কেটে গিয়েছিল।

এরপর এই মঞ্চে অভিনীত হয় চক্ষুদান (রামনারায়ণ), রত্নাধলী (অনুবাদ--রামনারায়ণ), কৃষ্ণকুমারী মঞ্চস্থ হয়। বেঙ্গলের নাটক দেখে অভিনয় দেখে বর্ধমানের মহারাজা মুগ্ধ হন এবং ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক হন। এই উপলক্ষে ১২ ডিসেম্বর বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনীর নাট্যরূপ অভিনীত হয়। এটি খুবই সাফল্য লাভ করেছিল। অভিনয়ে ছিলেন জগৎসিংহ-শরৎচন্দ্র। ওসমান-হরিবৈষ্ণব, তিলোত্তমা-জগত্তারিণী, আয়েযা- গোলাপ। জগৎসিংহের ভূমিকায় শরৎচন্দ্র ঘোড়ার পিঠে চড়ে মঞ্চে প্রবেশ করতেন। এই ঘটনা তৎকালীন দর্শকদের কাছে বিস্ময়কর ও কৌতৃহলপ্রদ হয়েছিল।

১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মঞ্চস্থ হয়েছিল পদ্মাবতী (মধুসূদন), পুরুবিক্রম (জ্যোতিরিন্দরনাথ), বঙ্গের সুখাবসান (হরলাল রায়), মণিমালিনী (হরিমোহন মুখোপাধ্যায়), বিদ্যাসুন্দর, যেমন কর্ম তেমনি ফল, একেই কি বলে বাঙালি সাহেব, প্রভাবতী প্রভৃতি। এর মধ্যে পুরুবিক্রম, যেমন কর্ম তেমনি ফল, বিদ্যাসুন্দর জনপ্রিয় হয়েছিল।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসেন অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মদনমোহন বর্মণম যাদুমণি, কাদম্বিনী দলত্যাগ করেন। এরা প্রথমে একটি দল গড়ার কথা ভেবেছিলেন। পরে এঁরা সকলেই ১৮৭৫-এ বেঙ্গল থিয়েটারে যোগ দেন।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি,
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসা নাট্যশিল্পী এবং বেঙ্গল থিয়েটারের নিজস্ব নাট্যশিল্পীদের নিয়ে অভিনীত হয়েছিল নগেন্দ্রনাথের লেখা 'সতী কি কলঙ্কিনী' গীতিনাট্য। এদের সম্মিলিত অভিনীত  নাটকগুলো ছিল- মেঘনাদবধ কাব্যের নাট্যরূপ। উল্লেখ্য রামকৃষ্ণ রায়ের অনুপ্রেরণায়, গিরিশচন্দ্র এই নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। এই নাটকে প্রথম গিরিশচন্দ্র ভাঙা আমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করেন। তিনি রাজকৃষ্ণ রায়ের 'হরধনুভঙ্গ' নাটকের ভাঙা অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রভাবে এই ছন্দ তৈরি করেছিলেন। তিনি এই ছন্দকে উন্নত ও ত্রটিমুক্ত করে নাটকের সংলাপে ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমানে একে গৈরিশ ছন্দ নামে অভিহিত করা হয়।  এই নাটকে মেঘনাদের চরিত্রে কিরণচন্দ্র এবং লক্ষ্মণ চরিত্রে হরিবৈষ্ণব, মহাদেব চরিত্রে বিহারীলাল গৈরিশ ছন্দের সংলাপ উচ্চারণে পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন।  সম্মিলিত অভিনয়ের ধারায় মঞ্চস্থ হয়েছিল কপালকুণ্ডলার নাট্যরূপ, ভীমসিংহ প্রভৃতি।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দ  গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার শিল্পীরা চলে যায়। এরপর বেঙ্গল থিয়েটার নিজেদের প্রযোজনায় আবার নাটক মঞ্চস্থ করা শুরু করে। এগুলোর ভিতরে ছিল- উপেন্দ্রনাথ দাসের সুরেন্দ্র-বিনোদিনী (১৪ আগস্ট, ১৮৭৫), বীরনারী (৪ সেপ্টেম্বর), বঙ্গবিজেতা, পলাশীর যুদ্ধ ইত্যাদি। এই সময় বরোদা রাজ্যের মহারাজ ব্রিটিশ রেসিডেন্টকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিলেন। এই কারণে বরোদা মহারাজের বিচার প্রক্রিয়া চলছিল। এই বিষয় নিয়ে নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুরেন্দ্রনাথ মিত্র সম্মিলিতভাবে রচনা করেছিলেন ']গুইকোয়ার নাটক। বেঙ্গল থিয়েটার এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিল।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জুলাই মহেন্দ্রলাল বসুর পদ্মিনী নাটকের অভিনয়-এর মধ্য দিয়ে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার কলকাতায় পূর্ণশক্তিতে অভিনয় শুরু করে। আগষ্ট মাসে প্রতিষ্ঠাতা ভুবনমোহন নিয়োগী ধর্মদাস সুরকে সরিয়ে দলের কার্যভার গ্রহণ করেন। ম্যানেজার হিসেবে থাকেন মহেন্দ্রলাল বসু। পরে তিনি কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়কে মঞ্চটি ইজারা দেন। কৃষ্ণধন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের নাম পরিবর্তন করেন, নাম দেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার। এই ঘটনায় ধর্মদাস এই রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করে নতুন দল তৈরি করেন। এই দলের নাম দিয়েছিলেন 'দি নিউ এরিয়ান'। এঁরা বেঙ্গল থিয়েটারে কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলে।

১৮৭ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে বেঙ্গল থিয়েটার নতুন বাড়ি নির্মাণে হাত দেয়। ফলে কিছুদিন এদের প্রদর্শন বন্ধ থাকে। প্রায় তিন মাস পর নতুন নাট্যমঞ্চে এরা নাটক পরিবেশন শুরু করে। এই বছরের ডিসেম্বর মাসে কুখ্যাত 'অভিনয় নিয়ন্ত্রণ' চালু হয়। এর ফলে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই ধারায় বেঙ্গল থিয়েটার প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়ে যায়। এই আইনের জন্য, ঐতিহাসিক ও দেশপ্রেম-ভিত্তিক নাটকের অভিনয় বেঙ্গল বন্ধ রাখে। এই সময় এরা শুধু পৌরাণিক নাটক, ব্রিটিশ-বিরিধী নয় এমন গীতিনাট্য, অপেরা, সামাজিক প্রহসন দিয়ে থিয়েটারের কার্যক্রম চালু রেখেছিল। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে
বিনোদিনী দাসী-সহ বেশকিছু নাট্যকর্মী বেঙ্গল থিয়েটারে যোগদান করেন। বিনোদিনীর 'আমার কথা' গ্রন্থ থেকে জনা যায়- বিনোদিনী-কে মাসিক ২৫ টাকা বেতনে আনা হয়েছিল। এই সময় বেঙ্গল থিয়েটার ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে শুধু মহিলাদের জন্য এক রাত্রি অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিল।

১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুধুমাত্র শনিবারে অভিনয়ের দিনকে বাড়িয়ে সপ্তাহে তিন দিন করা হয়েছিল। এই তিন দিন ছিল রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার। মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার টিকিটের মূল্য ছিল অর্ধেক। এই বছরে এদের উল্লেখযোগ্য উল্লেখযোগ্য অভিনীত নাটকগুলো ছিল - কুলীনকন্যা/কমলিনী, আলিবাবা, অপূর্বসতী, রত্নাবলী, মেঘনাদবধ. কপালকুগুলা, মৃণালিনী, দুর্গেশনন্দিনী‌ উপন্যাসের নাট্যরূপ,  পঞ্চপাণ্ডবের বনগমন, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, সুভদ্রাহরণ, সতী কি কলঙ্কিনী ইত্যাদি।

১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে পুরনো নাটকগুলির সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নতুন দু একটি নাট্যরূপ অভিনীত হয়েছিল। এর ভিতরে শকুন্তলা নাটকের অভিনয়ে বড়লাট লিটন ও তার স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। অভিনয়নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের পর এই প্রথম ব্রিটিশ সরকারের কোন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি বাংলা মঞ্চে নাটক দেখার জন্য হাজির হয়েছিলেন।

১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ন্যাশনাল থিয়েটার নিলামে ওঠে এবং প্রতাপ জহুরি নিলামে ২৫ হাজার টাকায় এই থিয়েটার কিনে নেন। এই সময় তিনি গিরিশচন্দ্রকে এই থিয়েটারের ম্যানেজার পদে নিয়োগ দেন। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে গিরিশচন্দ্র এই থিয়েটারের জন্য নতুন নাট্যদল গঠনের উদ্যোগ নেন। তিনি তাঁর পরিচিত এবং যোগ্য নাট্যকর্মীদের একটি দল গঠন করেন। এই সময় বিনোদিনী-সহ অনেকেই গিরিশচন্দ্রের দলে যোগ দিয়েছিলেন।

১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ঘোষের মৃত্যু হয়। এই থিয়েটারের জন্য এটা ছিল অপূরণীয় ক্ষতি। এরপর এই নাটাশালার সব দায়িত্ব গ্রহণ করলেন বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়। উল্লেখ্য, তিনি এই থিয়েটারের প্রথম প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বঙ্কিমচন্দ্র ও রমেশচন্দ্রের উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ ও পলাশীর যুদ্ধের অভিনয়ের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তিনি রচনা করেছিলেন - সুভদ্রাহরণ, রাবণবধ, পাণ্ডবনির্বাসন, শ্রীবৎসচিন্তা, প্রভাসমিলন, নন্দবিদায়, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি পৌরাণিক নাটক। মোট কথা ১৮৮০ থেকে তিনি ছিলেন- বেঙ্গলের অভিনেতা  নাট্যকার, অভিনয় শিক্ষক, মঞ্চাধ্যক্ষ। ‌এই বছরের শুরুতে জ্যোতিরিন্রনাথ ঠাকুরের 'অশ্রুমতী' নাটক দেখবার জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঙ্গল থিয়েটারের সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থা করেন। যাতে সেদিন শুধু ঠাকুর বাড়ির সদস্যরাই এই নাটক দেখতে পারেন।

১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে অমৃতলাল বসু এই থিয়েটারে যোগ দেন। তাঁর রচিত প্রহসন 'ডিসমিস' এবং নাটক 'হরিশচন্দ্র‌' জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

১৮৮৩-তে তার ব্রজলীলা মঞ্চস্থ হয়। এই সময়ে নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায়ের হরধনুভঙ্গ (১৮৮৩), প্রহ্লাদ চরিত (১৮৮৪), ভীম্মের শরশয্যা (১৮৮৬), দুর্বাসার পারণ (১৮৮৫) অভিনীত হয়েছিল। এই বছরে প্রতাপচাঁদ মিত্রের
ন্যাশনাল থিয়েটার থেকে গিরিশচন্দ্র সদলবলে বেরিয়ে এসে ক্যালকাটা স্টার কোম্পানী'  নামে একটি দল তৈরি করেছিলেন। এই দল মাঝে মাঝে বেঙল থিয়েটারের মঞ্চ ভাড়া করে- নাটক পরিবেশন করেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের এই দলে ছিলেন-  অমৃত মিত্র, অঘোরনাথ পাঠক, উপেন্দ্র মিত্র,  বিনোদিনী, কাদম্বিনী, ক্ষেত্রমণি, নীলমাধব চক্রবর্তী প্রমুখ।

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বিহারীলালের রচিত শ্রীবৎসচিস্তা, পাণ্ডব নির্বাসন, রুক্মিণীহরণ, প্রভাসমিলন অভিনীত হয়।
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বিহারীলালের নন্দবিদায়, ব্রহ্মশাপ ছিল সফল মঞ্চসফল নাটক অভিনীত হয়।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে দে বিহারীলালের শৈলজা, জন্মাষ্টমী এবং শকুস্তলা মঞ্চস্থ হয়েছিল।
১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ যুবরাজের কলকাতায় আসেন। তাঁকে গড়ের মাঠে তার সম্বর্ধনার সময় লর্ড লিটনের অনুরোধে বেঙ্গল থিয়েটার শকুন্তলা মঞ্চস্থ করে। ৭ জানুয়ারি সরকার থেকে বেঙ্গল থিয়েটার 'রয়াল' উপাধি লাভ করে।  এই বছরের উল্লেখযোগ্য অভিনীত নাটকগুলো ছিল সীতা স্বয়ম্বর এবং নাট্যবিচার নামে একটি প্রহসন। ১১ জানুয়ারি থেকে বেঙ্গলের নাম হয় 'রয়াল বেঙ্গল থিয়েটার'।

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে গোবরগণেশ, বাণযুদ্ধ, বসন্তমেলা অভিনীত হয়।
১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে পুরনো নাটকের পুনরাভিনয়ের সাথে নতুন নাটক মোহশেল, শ্রীরামনবনী মঞ্চস্থ হয়।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাসকাশী ও খণ্ড প্রলয় উল্লেখযোগ্য। অপর প্রযোজনা 'মুই-হাদু' প্রহসনটির অভিনয় জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। 

১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মহেন্দ্রলাল বসু, কুসুমকুমারী, প্রমদাসুন্দরী প্রভৃতি কয়েকজন প্রখ্যাত নট- নটী বেঙ্গলে যোগ দেন। এদের সহযোগে অভিনীত হয় বঙ্কিমের মৃণালিনী ও বিষধৃক্ষ উপন্যাসের নাটারূপ। দুটিরই নাটারূপ দেন বিহারীলাল।

১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্কিমের রজনী উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন বিহারীলাল। এবং তা বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনীত হয়। এছাড় দানলীলা, সীতারাম, রন্ডগঙ্গা অভিনয়ে প্রশংসা পায়। এই বছরে মহেন্দ্রলাল বসু এই সময়ে বেঙ্গল ত্যাগ করেন।

১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পুরনো নাটকের পুনরভিনয় চলে। নতুন নটক ছিল বিহারীলালের ধ্রুব ও নরোত্তম ঠাকুর।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে উল্লেখযোগা অভিনীত নাটক ছিল বঙ্কিমের দেবী চৌধুরানী ও কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসের নাট্যরূপ।

১৮৯৮-১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অভিনীত হয়েছে বভ্রূবাহন, দফরখাঁ, প্রমোদরঞ্জন, সুকন্যা, যমুনা, দাওয়াই, নীহার প্রভৃতি।

১৯০১-এর ২০ এপ্রিল বেঙ্গলের দ্বিতীয় প্রাণপুরুষ বিহারীলালের মৃত্যু হয়। ২১ এপ্রিল নীহার ও দাওয়াই অভিনীত হয়। এরপর বেঙ্গল থিয়েটার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। বেঙ্গল থিয়েটারের সেই বাড়িতে এখন বিডন স্ট্রিট ডাকঘর প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বার বার পরিবর্তিত হলেও ডাকঘরের বিশাল হলটির ছাদের কড়ি-বরগা, স্কাই-লাইট কিংবা বাইরের ঢালাই লোহার জাফরি কাজ করা গেট এখনও পুরনো স্থাপত্যের চিহ্ন বহন করে চলেছে।
 


সূত্র: