বিপরীতার্থক শব্দ: ভাবার্থে: অসুর স্ত্রীলিঙ্গার্থে: দেবী
দেবতা-র ধারণার উৎপত্তি
মানুষ যখন ক্রমান্বয়ে ভাবনা-চিন্তা, জীবনযাত্রায় অন্যান্য প্রাণিকূল থেকে একটি
স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে বিকাশ লাভ করছিল। তারই একটি পর্যায় পর্যন্ত, এই প্রজাতি
নিজেদের নিরাপত্তার কথা নিজেরাই ভাবতো এবং তার সমাধানের পথ তৈরি করতো। যখন এই
প্রজাতির মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ শুরু হলো, তখন সে তার চারপাশের পরিবেশ এবং এর সাথে
তার নিরাপত্তাজনীত বিষয় ভাবা শুরু করলো। তার যখন দেখলো, ভয়ঙ্কর জীবজন্তুর হাত থেকে
রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা সফল হতে পারে, কিন্তু প্রাকৃতিক এমন কিছু বিষয় থাকে, যাকে
প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তাদের নেই। যেমন- প্রবল ঘূর্ণিঝড়, অগ্ন্যুৎপাত, সামুদ্রিক
জলোচ্ছ্বাস, অজ্ঞাত ব্যধি ইত্যাদি। তখন সমাজের কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি এগুলোর ব্যাখ্যা
দিতেন নিজেদের সীমীত জ্ঞানের আলোকে। যেখানে তারা কোনো ব্যাখ্যা দিতে অপারগ হতেন,
সেখানে তাঁরা নিজেদের ধারণা থেকে কোনো তথ্য দিতেন। এই অভ্যাস সাধারণ মানুষ থেকে
বিজ্ঞানীদের ভিতরও আছে। প্রাচীনকালের জ্ঞানী মানুষের কাছে একালের জ্ঞানী ব্যক্তিদের
মতো এতো তথ্য ছিল না। ফলে তাঁদের সিন্ধান্ত মূল সত্য থেকে বহুদূরে থাকতো। ফলে
সিদ্ধান্তের ভিতরে নানা ধরনের কল্পনাপ্রসূত বিষয় ঢুকে পড়তো। এই কল্পনাপ্রসূত ভাবনা
থেকে জন্ম নিয়েছিল 'দেবতা' নামক সত্তার।
ধরা যাক কোনো একটি বড় পাহাড়ের ভিতর অনেক দিন ধরে গুম গুম শব্দ হচ্ছে। এর নিকটবর্তী
জনগোষ্ঠীর জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে এর কোনো যথার্থ কারণ জানা ছিল না। তাঁর যথেষ্ঠ
গবেষণা করেও যখন কোনো সমাধান পেলেন না, তখন কোনো অশরীরী সত্তাকে এনে হাজির করলেন।
হয়তো সে সত্তা দেবতা, দানব, রাক্ষস ইত্যাদি কোনো সত্তার কথা ভাবলেন। এদের হুঙ্কার
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হয়তো একসময় ফলমূল, পশু ইত্যাদি উৎসর্গ করার বিধান দিয়ে
দিলেন। তারপর একদিন দেখা গেল, পাহাড়ের মাথা উড়ে গিয়ে আগুনের শিখা বের হচ্ছে,
লাভাস্রোতে আশপাশের এলাকা ভাসিয়ে দিচ্ছে। ব্যাপক ক্ষতির ভিতর দিয়ে সাধারণ মানুষ যে
অভিজ্ঞতা লাভ করলো বটে, কিন্তু এর কারণ তারা জানতো না। পুরোহিতরা ব্যাখ্যা দিলেন,
কোনো কারণে দেবতা ও দানব রুষ্ঠ হয়েছে। ফলে পূজার চর্চার বেড়ে গেলো। আগুনে পাহাড় হয়ে
গেলো দেবতার পাহাড়। আর সে পাহাড়ের অধিকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো কল্পনাপ্রসূত
দেবতা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের
মানুষের কাছে প্রাথমিকভাবে দেবতাকুলের জন্ম হয়েছিল প্রাকৃতিক শক্তির মানদণ্ডে। কিছু
সাধারণ দেবতা আছে, যা সকল পৌরাণিক কাহিনিতে পাওয়া যায়। যেমন বাতাসের দেবতা, আগুনের
দেবতা, বৃষ্টির দেবতা, আগুনের দেবতা। কিন্তু গ্রীষ্ম প্রধান দেশে বরফের দেবতা নেই,
আবার সমুদ্র থেকে বহুদূরে রয়েছে এমন অঞ্চলে সমুদ্র দেবতা নেই। বাংলার নদ-নদী বিধৌত
অঞ্চলে যে সর্পদেবী আছে, উত্তর ভারতে এই দেবী নেই।
হিন্দু দৈবসত্তা
হিন্দু দৈবসত্তা
(Hindu deity)
: হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে যে সকল দৈবসত্তাকে স্বীকার করা হয়।
আর্যদের ভারতবর্ষের আসার আগে
আদিবাসীদের ভিতর নানা ধরনের দেবদেবীর পূজা ছিল। যেগুলো পরবর্তী সময়ে আর্যদের
দেবদেবীর সাথে মিশ্রিত হয়ে গেছে। ভারতীয় আর্যরা পারশ্যের আর্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন
হয়ে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন বসবাস শুরু করে, তখন উভয় আর্যদের ভাষা এবং দেবদেবীর
বিশ্বাস একই ছিল। দীর্ঘদিন পর উভয় আর্যদের ভাষা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপক
পার্থক্য গড়ে উঠে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫oo থেকে ১২০০ অব্দের ভিতরে ভারতীয় আর্যদের নিজস্ব ভাষা এবং ধর্মীয় ভাবনা নতুন রূপ লাভ
করে। ভারতীয় আর্যরা তাদের ধর্ম এবং অন্যান্য জাগতিক বিষয়াদি নিয়ে যা ভাবতেন তা
শ্লোকাকারে শিষ্যদের শিখিয়ে দিতেন। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল বেদ। আর একই সূত্রে এই
ভাষার নাম দেওয়া হয়েছে বৈদিক ভাষা। বৈদিক ভাষা আর্যদের নিত্যদিনের ঘরোয়া ভাষা নয়।
বেদের ভাষা সাহিত্যধর্মী এবং কৃত্রিম।বেদের সূত্রে ভারতীয় সনাতন
ধর্মের দেবদেবীর আবির্ভাব। আদিবেদ হিসেবে স্বীকৃত ঋগ্বেদে কতগুলো দেবদেবীর উল্লেখ
পাওয়া যায়, তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। তার কতকগুলো বিশেষ কারণ আছে। ঋগ্বেদে দেবতা শব্দ
ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেবতা হিসেবে বিষয়বস্তুকে বুঝানো হয়েছে।
এই অর্থে প্রস্তরখণ্ড, ধনুক, ব্যাঙ ইত্যাদি দেবতা। কিছু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী
স্বর্গবাসী অমর কিছু সত্তাকেই দেবতা হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়। মূলত সনাতন ধর্মে
জীবধর্মী অলোকিক সত্তার অধিকারীদেরই দেবতা হিসেবে মান্য করা হয়। এই অর্থে সকল
দেবতার নাম পাওয়া নে গেলেও এদের সংখ্যা পাওয়া যায়। ঋগ্বদের তৃতীয়মণ্ডলের তৃতীয়
সূক্তের নবম শ্লোকে বলা হয়েছে-
ত্রীণি শতা ত্রী সংহস্রাণ্যগ্নিং ত্রংশশচ্চ দেবা নব চাসপর্যন্এই বিচারে দেবতার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩৩৯। ভাষ্যকার সায়ণের মতে- দেবতার সংখ্যা ৩৩ জন, ৩৩৩৯সংখ্যা হলো এই দেবতাদের মহিমামান। ঋগ্বেদের অষ্টমমণ্ডলের ২৮সংখ্যক সূক্তের প্রথম শ্লোকে অবশ্য ৩৩ দেবতার কথা বলা হয়েছে। নিরুক্তকার যাষ্কের মতে দেবতার সংখ্যা মাত্র ৩ জন। এঁরা হলেন পৃথিবীলোকে অগ্নি, অন্তরীক্ষে বায়ু বা ইন্দ্র আর দ্যুলোকে সূর্য। যাস্কের মতে দেবতার সংখ্যা ৩জন ধরলে, বহু উল্লেখযোগ্য দেবতা বাদ পড়ে যান। যাস্কের সংজ্ঞায় দেবতা হলো 'যিনি দান করেন তিনি দেব, যিনি দীপ্ত হন বা দ্যোতিত হন তিনি দেবতা, যিনি দ্যুস্থানে থাকেন তিনি দেবতা। এই বিচারে পৃথিবীলোকের অগ্নি, অন্তরীক্ষের বায়ু বা ইন্দ্র দেবতার পর্যায়ে পড়ে না। এই সব কারণে যাস্কের ব্যাখ্যা মান্য করা হয় না। ঋগ্বেদে একই দেবতাকে নানা নামে অভিহিত করা হয়েছে। মৌলিকভাবে দেবতাদের ধরলে, ঋগ্বেদে যে সকল দেবতার নাম পাওয়া যায়, তা হলো−অগ্নি, অপ্, অশ্বিযুগল, ইন্দ্র, ঊষা, দ্যু, পর্জন্য, পূষা, পৃথিবী, বরুণ, বিষ্ণু, বৃহস্পতি, যম, রাত্রি, রুদ্র, মিত্র, সবিতা, সূর্য, সোম। পৌরাণিক যুগে নানা ধরনের কাহিনির সূত্রে বহু দেবদেবী যুক্ত হয়েছে। পৌরাণিক যুগের প্রধান দেবতার সংখ্য ৩টি। এঁরা হলেন ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর। প্রথম থেকেই এঁরা অমর। কিন্তু বাকী দেবতারা অমর হয়েছেন−সমুদ্রমন্থনের সূত্রে প্রাপ্ত অমৃত পান করার কারণে। দেবতারা কার্যকারণ ভেদে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। যেমন−মহাদেবের বাসস্থান হিমালয়ের কৈলাস, বিষ্ণুর বাসস্থান গোলকধাম,বরুণের বাসস্থান সমুদ্রতল। দেবতাদের রাজধানীর নাম অমরাবতী। এই রাজ্যের রাজা ইন্দ্র। হিন্দু ধর্মমতে পৃথিবীর প্রাকৃতিক কারণ, মানুষের জীবনধারা, পার্থিব-অপার্থিব বিষয়াবলীসহ সকল বিষয় দেবতারা নিয়ন্ত্রণ করেন। বিষয়াবলী অনুসারে দেবতাদের নির্দিষ্ট ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন হিন্দু ধর্মমতের− সৃষ্টি করেন ব্রহ্মা, পালন করেন বিষ্ণু,ধ্বংস করেন মহাদেব। এছাড়া রয়েছেন− বৃষ্টি ও বজ্রের দেবতা ইন্দ্র, জলের দেবতা বরুণ, মৃত্যুর দেবতা যম ইত্যাদি। দেবতা শব্দটি ব্যাকরণগতভাবে স্ত্রীবাচক হলেও এঁরা জাতিতে পুরুষ। অধিকাংশ দেবতাদের স্ত্রী রয়েছে। দেবতার স্ত্রীরা দেবী নামে পরিচিতি। যেমন− মহাদেবের স্ত্রী দুর্গা (সতী, পার্বতী), বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী, ব্রহ্মার স্ত্রী সরস্বতী, ইন্দ্রের স্ত্রী শচী ইত্যাদি। এই সকল দেবীরাও বিভিন্ন বিষয়াবলী নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। যেমন- দুর্গা আদ্যাশক্তি, লক্ষ্মী সম্পদের দেবী, সরস্বতী বিদ্যাদেবী ইত্যাদি।
[তিন সহস্র তিনশতত্রিংশৎ ও নব সংখ্যক দেবগণ অগ্নিকে পূজা করছেন।]
হিন্দু ধর্মমতে যৌনাচারের দিক থেকে অধিকাংশ দেবতাই কমবেশি অশুদ্ধাচারী। দেবতার মধ্যে যৌনাচারে অসংযমী ছিলেন ইন্দ্র। ইনি পছন্দের নারীকে পাওয়ার জন্য ছলনার আশ্রয় ছাড়া ধর্ষণের মতো অপরাধও করেছেন। এছাড়াও ইনি বিভিন্ন অপ্সরাদের সাথে মিলিত হয়েছেন। এদিক থেকে ইন্দ্র গ্রিক পুরাণের
জিউস-এর সমতূল্য। যৌনসঙ্গী হিসাবে কোন কোন দেবতা অমিতযৌনাচারী না হয়েও কার্যকারণে মানব কন্যাদের সাথে মিলিত হয়েছেন বা মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন− পঞ্চপাণ্ডবের দুই মা- কুন্তী ও মাদ্রির সাথে দেবতারা মিলিত হয়েছেন।
টাইটানদের উপর সাতটি গ্রহ
নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। এরপর এই দেবী তৈরি করলেন সাতটি গ্রহনিয়ন্ত্রক
শক্তি। এই শক্তিগুলো যাঁদেরকে প্রদান করেছিলেন, তাঁরা হলেন।
থেইয়া
এবং
হাইপেরিয়ান সূর্যের
জন্য,
ফিবি
এবং
এ্যাটলাস
চাঁদের জন্য,
ডাইওনে এবং
ক্রিয়াস মঙ্গলের
জন্য,
মেটিস
এবং
কোয়েসাস
বুধের জন্য,
থেমিস
এবং
ইউরিমেডোন বৃহস্পতির জন্য,
টেথিস
এবং
ওসিনাস
শুক্রের জন্য,
রিয়া
ও
ক্রোনাস শনির জন্য।
গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীর শেষের দিকে
ব্যাপকভাবে আলোচিত চরিত্র হিসেবে পাওয়া যায়
জিউসকে।
দেখুন : [পৌরাণিক
কোষ [গ্রিক]