| 
				
				
				নীলিমা 
				
				রৌদ্র-ঝিলমিল 
				
				উষার আকাশ, মধ্যনিশিথের নীল, 
				
				অপার ঐশ্বর্যবেশে দ্যাখা তুমি দাও বারে-বারে 
				
				নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে। 
				
				উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী, 
				
				উগ্র চুল্লীবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি, 
				
				আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা, 
				
				মরীচিকা-ঢাকা। 
				
				অগণন যাত্রিকের প্রাণ 
				
				খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান: 
				
				চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল; 
				
				হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধি-বিধানের এই কারাতল 
				
				তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙেছো মায়াবী! 
				
				জনতার কোলাহলে একা ব’সে 
				ভাবি 
				
				কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি 
				
				বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী; 
				
				স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা 
				
				মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা! 
				
				চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধিরলিপিকা, 
				
				জ্ব’লে 
				ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা! 
				
				বসুধার অশ্রুপাংশু আতপ্ত সৈকত, 
				
				ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ, 
				
				লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার, 
				
				এই ধূলি—ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার 
				
				ডুবে যায় নীলিমায়— স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে, 
				
				শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে নক্ষত্রের রাতে; 
				
				ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক 
				
				তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক! 
				  
				
				             
				নব নবীনের লাগি 
				
				             —নব নবীনের লাগি 
				
				প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমরা রয়েছি জাগি! 
				
				ব্যর্থ পঙ্গু খর্ব প্রাণের বিকল শাসন ভেঙ্গে, 
				
				নব আকাঙ্ক্ষা আশার স্বপনে হৃদয় মোদের রেঙে, 
				
				দেবতার দ্বারে নবীন বিধান— নতুন ভিক্ষা মেগে 
				
				দাঁড়ায়েছি মোরা তরুণ প্রাণের অরুণের অনুরাগী! 
				  
				
				            ঝড়ের বাতাস চাই! 
				
				— চারিদিক ঘিরে শীতের কুহেলি, শ্মশানপথের ছাই, 
				
				ছড়ায়ে রয়েছি পাহাড়প্রমাণ মৃতের অস্থি খুলি, 
				
				কে সাজাব ঘর-দেউলের ’পর 
				কঙ্কাল তুলি-তুলি? 
				
				সূর্যচন্দ্র নিভায়ে কে নেবে জরার চোখের ঠুলি! 
				
				—মরার ধরায় জ্যান্ত কখনো মাগিতে যাবে কি ঠাঁই! 
				  
				
				            —ঘুমায়ে কে আছে ঘরে! 
				
				মৃতশিশু-বুকে কল্যাণী পুরকামিনী কি আজ মরে! 
				
				কে আছে বসিয়া হতাশ উদাস অলস অন্যমনা? 
				
				দোদুল আকাশে দুলিয়া উঠিছে রাঙা অশনির ফণা, 
				
				বাজে বাদলের রঙ্গমল্লী, ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝনা! 
				
				ফিরিছে বালক ঘর-পলাতক ঝরা পালকের ঝড়ে! 
				  
				
				            আমরা অশ্বারোহী!— 
				
				যাযাবর যুবা, বন্দিনীদের ব্যথা মোরা বুকে বহি, 
				
				মানবের মাঝে যে দেবতা আছে আমরা তাহারে বরি, 
				
				মোদের প্রাণের পূজার দেউলে তাহার প্রতিমা গড়ি, 
				
				চুয়া-চন্দন-গন্ধ বিলায়ে আমরা ঝরিয়া পড়ি, 
				
				সুবাস ছড়াই উশীরের মতো,
				
				— ধূপের মতন দহি! 
				  
				
				            গাহি মানবের জয়! 
				
				—কোটি-কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়! 
				
				সবার প্রাণের অশ্রু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে, 
				
				কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছে,
				
				—কোটি-কোটি শিখা জাগে, 
				
				প্রদীপ নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে, 
				
				আমার তাদের শস্ত্র, শাসন, আসন করিব ক্ষয়! 
				
				            -জয় মানবের জয়! 
				  
				
				        কিশোরের প্রতি 
				
				যৌবনের সুরাপাত্র গরল-মদির 
				
				ঢালোনি অধরে তব, ধরা-মোহিনীর 
				
				            ঊর্ধ্বফণা মায়া-ভুজঙ্গিনী 
				
				আসেনি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি, 
				
				চুমিয়া-চুমিয়া তব হৃদয়ের মধু 
				
				বিষবহ্নি ঢালেনিকো বাসনার বধূ 
				
				            অন্তরের পানপাত্র তব; 
				
				অম্লান আনন্দ তব, আপ্লুত উৎসব, 
				
				            অশ্রুহীন হাসি, 
				
				কামনার পিছে ঘুরে সাজোনি উদাসী। 
				
				ধবল কাশের দলে, আশ্বিনের গগনের তলে 
				
				তোর তরে রে কিশোর, মৃগতৃষ্ণা কভু নাহি জ্বলে! 
				
				নয়নে ফোটে না তব মিথ্যা মরূদ্যান। 
				
				অপরূপ রূপ-পরীস্থান 
				
				                        দিগন্তের আগে 
				
				তোমার নির্মেঘ চক্ষে কভু নাহি জাগে! 
				
				আকাশকুসুমবীথি দিয়া 
				
				মাল্য তুমি আনো না রচিয়া, 
				
				                        উধাও হও না তুমি আলেয়ার 
				পিছে 
				
				            ছলাময় গগনের নিচে! 
				
				—রূপ-পিপাসায় জ্বলি মৃত্যুর পাথারে 
				
				স্পন্দহীন প্রেতপুরদ্বারে 
				
				            করোনিকো করাঘাত তুমি 
				
				সুধার সন্ধানে লক্ষ বিষপাত্র চুমি 
				
				            সাজোনিকো নীলকণ্ঠ ব্যাকুল বাউল! 
				
				অধরে নাহিকো তৃষ্ণা, চক্ষে নাহি ভুল, 
				
				রক্তে তব অলক্ত যে পরে নাই আজো রানী, 
				
				রুধির নিঙাড়ি তব আজো দেবী মাগে নাই রক্তিম চন্দন! 
				
				কারাগার নাহি তব, নাহিকো বন্ধন; 
				
				            দীঘল পতাকা, বর্শাতন্দ্রাহারা প্রহরীর 
				লওনি তুলিয়া, 
				
				—সুকুমার কিশোরের হিয়া! 
				
				—জীবন-সৈকতে তব দুলে যায় লীলায়িত লঘুনৃত্য নদী, 
				
				            বক্ষে তব নাচেনিকো যৌবনের দূরন্ত জলধি; 
				
				            শূল-তোলা শম্ভুর মতন 
				
				            আস্ফালিয়া ওঠে নাই মন 
				
				মিথ্যা বাধা-বিধানের ধ্বংসের উল্লাসে! 
				
				            তোমার আকাশে 
				
				দ্বাদশ সূর্যের বহ্নি ওঠেনিকো জ্বলি 
				
				কক্ষচ্যুত উল্কাসম পড়েনিকো স্খলি, 
				
				            কুজ্ঝটিকা-আবর্তের মাঝে 
				
				            অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গের সাজে! 
				
				            সব বিঘ্ন সকল আগল 
				
				            ভাঙিয়া জাগোনি তুমি স্পন্দন-পাগল 
				
				            অনাগত স্বপ্নের সন্ধানে 
				
				            দুরন্ত দুরাশা তুমি জাগাওনি প্রাণে! 
				
				            নিঃস্ব দুটি অঞ্জলির আকিঞ্চন মাগী 
				
				সাজোনিকো দিক্ভোলা দিওয়ানা বৈরাগী! 
				
				            পথে-পথে ভিক্ষা মেগে কাম্য কল্পতরু 
				
				            বাজাওনি শ্মশান-ডমরু! 
				
				জ্যোৎস্নাময়ী নিশি তব, জীবনের অমানিশা ঘোর 
				
				            চক্ষে তব জাগেনি কিশোর! 
				
				            আঁধারের নির্বিকল্প রূপ, 
				
				            স্পন্দহীন বেদনার কূপ 
				
				            রুদ্ধ তব বুকে; 
				
				            তোমার সম্মুখে 
				
				ধরিত্রী জাগিছে ফুল্ল সুন্দরীর বেশে; 
				
				            নিত্য বেলাশেষে 
				
				                        যেই পুষ্প ঝরে 
				
				যে-বিরহ জাগে চরাচরে 
				
				            গোধূলির অবসানে শ্লোক-ম্লান সাঁঝে, 
				
				তাহার বেদনা তব বক্ষে নাহি বাজে; 
				
				আকাঙ্ক্ষার অগ্নি দিয়া জ্বালো নাই চিতা, 
				
				            ব্যাথার সংহিতা 
				
				            গাহো নাই তুমি! 
				
				দরিয়ার তীর ছাড়ি দেখ নাই দাব-মরুভূমি 
				
				            জ্বলন্ত নিষ্ঠুর! 
				
				নগরীর ক্ষুব্ধ বক্ষে জাগে যেই মৃত্যুপ্রেতপুর, 
				
				            ডাকিনীর রুক্ষ অট্টহাসি 
				
				ছন্দ তার মর্মে তব ওঠে না প্রকাশি! 
				
				            সভ্যতার বীভৎস ভৈরবী 
				
				            মলিন করেনি তব মানসের ছবি, 
				
				ফেনিল করেনি তব নভোনীল, প্রভাতের আলো, 
				
				এ উদভ্রান্ত যুবকের বক্ষে তার রশ্মি আজো ঢালো, 
				বন্ধু, ঢালো! |