ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
শেষরক্ষা ১৯২৮ সালের জুলাই মাসে গ্রন্থাগারে
প্রকাশিত হয়। |
নাটকের পাত্রগণ
চন্দ্রকান্ত
ক্ষান্তমণি বিনোদ ইন্দু গদাই কমল নিবারণ বুড়ি শিব ঠাকুরদাসী ভৃত্য নলিনাক্ষ শ্রীপতি ভূপতি দরজি ললিত |
|
প্রথম অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য
|
দ্বিতীয় দৃশ্য
|
তৃতীয় দৃশ্য
| দ্বিতীয় অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য | তৃতীয় অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য | দ্বিতীয় দৃশ্য | তৃতীয় দৃশ্য | চতুর্থ অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য | দ্বিতীয় দৃশ্য | তৃতীয় দৃশ্য | |
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
নিবারণবাবুর বাসা
ক্ষান্তমণি ও ইন্দু
ক্ষান্তমণি । কী আর বলব আমি তোকে , আমার তো হাড়
জ্বালাতন । আমার ঘরে যতগুলো লোক জোটে সবচেয়ে লক্ষ্মীছাড়া হচ্ছে ঐ বিনোদ ।
ইন্দু । সেইজন্যেই লক্ষ্মীদের মহলে সবচেয়ে তার পসর ভারী — লক্ষ্মী যে ছাড়ে লক্ষ্মী
তারই পিছনে পিছনে ছোটে ।
ক্ষান্তমণি । কেন ভাই , তোর ওকে পছন্দ নাকি ?
ইন্দু । আরেকটু হলেই হতে পারত । কিন্তু সে ফাঁড়া কেটে গেছে ।
ক্ষান্তমণি । কী ক'রে কাটল ?
ইন্দু । দিদি আগেই তাকে পছন্দ করে বসে আছে । আমাকে আর সময় দিলে না ।
ক্ষান্তমণি । বলিস কী! কমল নাকি ? সে ওকে দেখলে কখন ?
ইন্দু । দেখে নি । সেইটেই তো বিপদ । শব্দভেদী বাণের কথা রামায়ণে শোন নি ?
ক্ষান্তমণি । শুনেছি ।
ইন্দু । সব চেয়ে শক্ত বাণ হল সেইটে । শব্দের রাস্তা বেয়ে কখন এসে বুকে বেঁধে , কেউ
দেখতেই পায় না ।
ক্ষান্তমণি । একটু ভাই , বুঝিয়ে বল্ । তোদের মতো আমার অত পড়াশুনো নেই ।
ইন্দু । সেইটেতেই তোমার রক্ষে । নইলে কেবল পড়াশোনার জোরেই মরণ হতে পারত , দেখাশোনার
দরকার হত না । তোমার বিনোদবাবু যে কবি তা জান না!
ক্ষান্তমণি । তা হোক-না কবি , হয়েছে কী ?
ইন্দু । কমলদিদি ওর বই লুকিয়ে পড়ে । সেইটেই খারাপ লক্ষণ । বিনোদবাবুর ‘ আঙুরলতা '
বইখানা ওর বালিশের নীচে থাকে । আর তার ‘ কাননকুসুমিকা ' রেখেছে ধোবার বাড়ির হিসেবের
খাতার তলায় ।
ক্ষান্তমণি । কিন্তু ওর মুখে তো বিনোদবাবুর নামও শুনি নি ।
ইন্দু । নামটা বুকের মধ্যে বাসা করেছে , তাই মুখে বের হতে চায় না ।
ক্ষান্তমণি । কী যে বলিস , বুঝতে পারি নে — ওর লেখার এমন কী মন্ত্র আছে বল্ তো !
আমাকে একটু নমুনা দে দেখি।
ইন্দু । তবে শোনো —
রসনায় ভাষা নাই , থাকি চুপে চুপে ,
অন্তরে জোগায় সে যে বাণী ।
সময় পায় না আঁখি মজিবারে রূপে ,
গোপনে স্বপনে তারে জানি ।
ক্ষান্তমণি । হায় রে , কী শব্দভেদী বাণেরই
নমুনা!
ইন্দু । কমলদিদি খাতায় লিখে রেখেছে , এই ওর জপের মন্ত্র । শব্দভেদী বাণের যে জোর কত
তা প্রত্যক্ষ দেখতে চাও ?
ক্ষান্তমণি । চাই বৈকি , জেনে রাখা ভালো ।
ইন্দু । ( নেপথ্যে চাহিয়া) দিদি! দিদি!
সেলাই হাতে কমলের প্রবেশ
কমল । কেন ? হয়েছে কী ?
ইন্দু । এখনো বিশেষ কিছু হয় নি , কিন্তু হতে কতক্ষণ ? বিধাতা আমাদের চেয়েও
পর্দানশীন , আড়ালে বসে বসে তোমার সাধের স্বপ্নকে মূর্তি দিচ্ছেন ।
কমল । সে খবর দেবার জন্যে তোমায় ডাকাডাকি করতে হবে না ।
ইন্দু । তা জানি ভাই , খবর পাকা হলে বিধাতা আপনিই দূত পাঠিয়ে দেবেন । আমি সেজন্যে
ভাবিও নি । সখীপরিষদে আমাকে গান গাইতে ধরেছে । স্বরলিপি থেকে তুমি যে নতুন গানটি
শিখেছ আমাকে শিখিয়ে দাও । ক্ষান্তদিদিও সেইজন্যে বসে আছেন — আমি জানি , তোমার গান
উনি চন্দ্রবাবুর চটি জুতোর আওয়াজের প্রায় সমতুল্য বলেই জানেন ।
ক্ষান্তমণি । ইন্দুর কথা শোনো একবার! এ আবার আমি কবে বললুম!
ইন্দু । তা হলে সমতুল্য বলাটা ভুল হয়েছে , তার চেয়ে নাহয় কিছু নীরসই হল । সে তর্ক
পরে হবে , তুমি গান গাও ।
কমল ।
গান
ডাকিল মোরে জাগার সাথি ।
প্রাণের মাঝে বিভাস বাজে ,
প্রভাত হল আঁধার রাতি ।
বাজায় বাঁশি তন্দ্রাভাঙা ,
ছড়ায় তারি বসন রাঙা ,
ফুলের বাসে এই বাতাসে
কী মায়াখানি দিয়েছে গাঁথি ।
গোপনতম অন্তরে কী
লেখনরেখা দিয়েছে লেখি!
মন তো তারি নাম জানে না ,
রূপ আজিও নয় যে চেনা ,
বেদনা মম বিছায়ে দিয়ে
রেখেছি তারি আসন পাতি ।
ইন্দু । ক্ষান্তদিদি , ঐ চেয়ে দেখো , বাণ পৌঁচেছে!
ক্ষান্তমণি । কোথায় ?
ইন্দু । আমাদের এই গলির আকাশ পার হয়ে , ঠেকেছে গিয়ে তোমাদের বাড়ির ঐ দরজাতে ।
ক্ষান্তমণি । ইন্দু , তুই স্বপ্ন দেখছিস নাকি ?
ইন্দু । ঐ দেখো-না , তোমাদের বন্ধ দরজার খড়্খড়ে খুলে গেছে ।
ক্ষান্তমণি । তা তো দেখছি ।
ইন্দু । কমলদিদি , বুঝতে পেরেছ ?
কমল । আঃ , কী যে বকিস তার ঠিক নেই ।
ইন্দু । ঐ খোলা খড়্খড়ির ফাঁক দিয়ে কবিকুঞ্জবনের দীর্ঘনিশ্বাস উচ্ছ্বসিত । ঐ
খড়্খড়ির পিছনে একটা ধড়্ফড়ানি দেখতে পাচ্ছ ?
কমল । কিসের ধড়্ফড়ানি ?
ইন্দু । সেই খবরটাই তো চোখের আড়ালে রয়ে গেল ।
গান
হায় রে ,
ওরে যায় না কি জানা!
নয়ন ওরে খুঁজে বেড়ায় ,
পায় না ঠিকানা ।
অলখ পথেই যাওয়া-আসা ,
শুনি চরণধ্বনির ভাষা ,
গন্ধে শুধু হাওয়ায় হাওয়ায়
রইল নিশানা ।
কেমন ক'রে জানাই তারে ,
বসে আছি পথের ধারে ।
প্রাণে এল সন্ধ্যাবেলা
আলোয় ছায়ায় রঙিন খেলা ,
ঝ'রে-পড়া বকুলদলে
বিছায় বিছানা ।
ক্ষান্তমণি । ওলো ইন্দু , দেখ্ দেখ্ খড়্খড়ে আরো ফাঁক হয়ে উঠল যে!
ইন্দু । এবার তুমি যদি গান ধর তা হলে দেয়ালসুদ্ধ ফাঁক হয়ে যাবে!
ক্ষান্তমণি । আর ঠাট্টা করতে হবে না , যাঃ । তোর কথা শুনে ভেবেছিলুম , একা কমলই
বুঝি শব্দভেদী বাণের তীরন্দাজ । বিধাতা কি তোদের সকলেরই গলায় বাণ বোঝাই করেছেন!
হাতের কাছে এত বিপদ জমা আছে , এ তো জানতুম না ।
ইন্দু । সৃষ্টিকর্তা সংকল্প করেছেন পুরুষমেধ যজ্ঞ করতে — তারই সহায়তায় নারীদের ডাক
পড়েছে । সবাই ছুটে আসছে , কেউ কণ্ঠ নিয়ে , কেউ কটাক্ষ নিয়ে ; কারও বা কুটিল হাস্য ,
কারো বা কুঞ্চিত কেশকলাপ ; কারো বা সর্ষের তেল ও লঙ্কার বাটনাযোগে বুক-জ্বালানি
রান্না ।
ক্ষান্তমণি । কিন্তু তোদের সব বাণই কি একটা খড়্খড়ে দিয়ে গলবে নাকি ?
ইন্দু । কবির হৃদয়টা দরাজ , বড়ো বোনের পাকা হাত
আর ছোটো বোনের কাঁচা হাত কারও লক্ষ্যই ফসকায় না ।
ক্ষান্তমণি । তা যেন হল , তার পরে অংশ নিয়ে তোদের মামলা বাধবে না ?
ইন্দু । তাই তো বলে রেখেছি , আমি দাবি করব না ।
কমল । এত নিঃস্বার্থ হবার দরকার কী ?
ইন্দু । কমলদিদি , জীবনের অঙ্কশাস্ত্রে পুরুষরা আছে গুণের কোঠায় , মেয়েরা ভাগের
কোঠায় । ওদের বেলায় দুইয়ের দ্বারা হয় দ্বিগুণ , আমাদের বেলায় দুইয়ের দ্বারা হয়
দুভাগ । তাই তোমাকে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছি — নইলে দুই বোনে মিলে ঐ খড়্খড়েটার কব্জা
এতদিনে ঝর্ঝরে করে দিতুম ।
কমল । কেন , রাস্তা কি আমি ছাড়তে জানি নে ?
ইন্দু । আমি ওর কবিতাবিছানো রাস্তায় এক পা চলতে পারব না । মানেই বুঝতে পারি নে —
হুঁচট খেয়ে মরব ।
ক্ষান্তমণি । তোরা দুজনে মিলে রফানিষ্পত্তি করে নে , আমার কাজ আছে , যাই ।
ইন্দু । বেলা গিয়েছে , এখন আবার তোমার কাজ ?
ক্ষান্তমণি । যত বেকারের দল , কখন কী খেয়াল যায় তার ঠিক নেই । হয়তো হঠাৎ হুকুম হবে
, তপ্সি মাছ ভাজা চাই ; নয়তো কড়াইশুটির কচুরি , নয়তো হাঁসের ডিমের বড়া ।
ইন্দু । একটু দাঁড়াও , আমরাও যাচ্ছি । তোমার সঙ্গে কর্মবিভাগ করে নেব । আমরা লাগব
চেখে দেখবার কঠিন কাজে । কমলদিদি , ঐ দেখো , খড়্খড়েটা লুব্ধ চকোরের চঞ্চুর মতো
এখনো হাঁ করে রয়েছে । দেখে দুঃখ হচ্ছে ।
কমল । এত দয়া যদি তো সুধা তুমিই ঢালো-না । আমি চললুম ।
ইন্দু । না , দিদি ।
গান
যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে ,
কোন্খানে যে মন লুকানো দাও বলে ।
চপল লীলা ছলনাভরে
বেদনখানি আড়াল করে ,
যে বাণী তব হয় নি বলা নাও বলে ।
হাসির বাণে হেনেছ কত শ্লেষকথা ,
নয়নজলে ভরো গো আজি শেষকথা
হায় রে অভিমানিনী নারী ,
বিরহ হল দ্বিগুণ ভারী
দানের ডালি ফিরায়ে নিতে চাও বলে ।
আচ্ছা ভাই , ক্ষান্তদিদি , ঐ খড়্খড়ের পিছনে কোন্ মানুষটি বসে আছে আন্দাজ করো দেখি
। চন্দরবাবু ?
ক্ষান্তমণি । না , ভাই , তার আর যাই দোষ থাক তোদের শব্দভেদী বাণ তাকে পৌঁছয় না , সে
আমি খুব দেখে নিয়েছি ।
ইন্দু । অর্থাৎ , আমাদের চন্দ্রের যা কলঙ্ক সেটা কেবল মুখের উপরে , তার জ্যোৎস্নায়
কোনো দাগ পড়ে না । তোমাদের লক্ষ্মীছাড়া দলে আর কে আছে নাম করো দেখি ।
ক্ষান্তমণি । আর-একজন আছে , তার নাম গদাই ।
ইন্দু । আরে , ছি ছি , ছি ছি! অমন নাম যার তার খড়্খড়ে চিরদিন যেন বোজা থাকে ।
ক্ষান্তমণি । নাম শুনেই যে তোর —
ইন্দু । নামের দাম কম নয় দিদি । ভেবে দেখো তো , দৈবদুর্যোগে গদাই যদি ‘
কাননকুসুমিকা ' র কবি হত তা হলে কবির নাম জপ করবার সময় দিদি কী মুশকিলেই পড়ত ।
ভক্তি হত না , সুতরাং মুক্তিও পেত না ।
কমল । দিদির মুক্তির জন্যে তোমাকে অত ভাবতে হবে না । এখন নিজের কথা চিন্তা করবার
সময় হয়েছে ।
ইন্দু । সেইজন্যেই তো নাম বাছাই করতে লেগে গেছি । সময় নষ্ট করতে চাই নে । আমার
স্বয়ম্বর সভার নিমন্ত্রণের ফর্দ থেকে গদাই নামটা কাটা পড়ল ।
কমল । তা হলে এইবেলা তোমার পছন্দসই নামের একটা ফর্দ করা যাক । কুমুদ কিরকম ?
ইন্দু । চলে যায় ।
কমল । নিকুঞ্জ ?
ইন্দু । চলতেও পারে , কিন্তু উপবাসের মুখে , অর্থাৎ দ্বাদশী তিথিতে ।
কমল । পরিমল ?
ইন্দু । মালাবদলের সময় নাম-বদল করতে হবে , সে হবে ইন্দু আমি হব পরিমল । যা হোক
এগুলো চলতেও পারে — কিন্তু গদাই ? নৈব নৈব চ ।
ক্ষান্ত । কী যে পাগলামি করছিস ইন্দু! চল্ , আমার কাজ আছে ।
এই গ্রন্থে গৃহীত গানগুলির তালিকা
প্রথম অঙ্ক :প্রথম দৃশ্য কমল : ডাকিল মোরে জাগার সাথি ইন্দু : হায় রে, ওরে যায় না কি জানা ! ইন্দু : যাবার বেলায় শেষ কথাটি প্রথম অঙ্ক :দ্বিতীয় দৃশ্য নেপথ্যে গান : কাছে যবে ছিল |
চতুর্থ অঙ্ক :দ্বিতীয় দৃশ্য ইন্দুর গান : এবার মিলন-হাওয়ায় ইন্দুর গান : লুকালে বলেই খূজে বাহির-করা নেপথ্যের গান : মুখ-পানে চেয়ে দেখি চ্রকান্ত : জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না চতুর্থ অঙ্ক :তৃতীয় দৃশ্য চন্দ্রকান্ত ও অন্যান্য : যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে |