ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


শেষরক্ষা

 

 

শেষরক্ষা ১৯২৮ সালের জুলাই মাসে গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয়।
ইহা 'গোড়ায় গলদ' প্রহসনটির (রবীন্দ্র-রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড দ্রষ্টব্য) পুনর্লিখিত অভিনয়যোগ্য সংস্করণ। ১৩৩৪ সালে আষাঢ় মাসের 'মাসিক বসুমতী'তে প্রথম প্রকাশিত হয়।
                [রবীন্দ্ররচনাবলী ঊনবিংশ খণ্ড (বিশ্বভারতী, ফাল্গুন ১৩৮২)]


নাটকের পাত্রগণ

  চন্দ্রকান্ত             ক্ষান্তমণি   
বিনোদ              ইন্দু
গদাই                কমল
নিবারণ             বুড়ি
শিব                 ঠাকুরদাসী
ভৃত্য
নলিনাক্ষ
শ্রীপতি
ভূপতি
দরজি
ললিত
   
  প্রথম অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য | দ্বিতীয় দৃশ্য | তৃতীয় দৃশ্য |
দ্বিতীয় অঙ্ক :  প্রথম দৃশ্য
|
তৃতীয় অঙ্ক :  প্রথম দৃশ্য
| দ্বিতীয় দৃশ্য | তৃতীয় দৃশ্য |
চতুর্থ অঙ্ক :  প্রথম দৃশ্য | দ্বিতীয় দৃশ্য | তৃতীয় দৃশ্য
|

প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
নিবারণবাবুর বাসা
ক্ষান্তমণি ও ইন্দু
 

 

ক্ষান্তমণি । কী আর বলব আমি তোকে , আমার তো হাড় জ্বালাতন । আমার ঘরে যতগুলো লোক জোটে সবচেয়ে লক্ষ্মীছাড়া হচ্ছে ঐ বিনোদ ।
ইন্দু । সেইজন্যেই লক্ষ্মীদের মহলে সবচেয়ে তার পসর ভারী — লক্ষ্মী যে ছাড়ে লক্ষ্মী তারই পিছনে পিছনে ছোটে ।
ক্ষান্তমণি । কেন ভাই , তোর ওকে পছন্দ নাকি ?
ইন্দু । আরেকটু হলেই হতে পারত । কিন্তু সে ফাঁড়া কেটে গেছে ।
ক্ষান্তমণি । কী ক'রে কাটল ?
ইন্দু । দিদি আগেই তাকে পছন্দ করে বসে আছে । আমাকে আর সময় দিলে না ।
ক্ষান্তমণি । বলিস কী! কমল নাকি ? সে ওকে দেখলে কখন ?
ইন্দু । দেখে নি । সেইটেই তো বিপদ । শব্দভেদী বাণের কথা রামায়ণে শোন নি ?
ক্ষান্তমণি । শুনেছি ।
ইন্দু । সব চেয়ে শক্ত বাণ হল সেইটে । শব্দের রাস্তা বেয়ে কখন এসে বুকে বেঁধে , কেউ দেখতেই পায় না ।
ক্ষান্তমণি । একটু ভাই , বুঝিয়ে বল্‌ । তোদের মতো আমার অত পড়াশুনো নেই ।
ইন্দু । সেইটেতেই তোমার রক্ষে । নইলে কেবল পড়াশোনার জোরেই মরণ হতে পারত , দেখাশোনার দরকার হত না । তোমার বিনোদবাবু যে কবি তা জান না!
ক্ষান্তমণি । তা হোক-না কবি , হয়েছে কী ?
ইন্দু । কমলদিদি ওর বই লুকিয়ে পড়ে । সেইটেই খারাপ লক্ষণ । বিনোদবাবুর ‘ আঙুরলতা ' বইখানা ওর বালিশের নীচে থাকে । আর তার ‘ কাননকুসুমিকা ' রেখেছে ধোবার বাড়ির হিসেবের খাতার তলায় ।
ক্ষান্তমণি । কিন্তু ওর মুখে তো বিনোদবাবুর নামও শুনি নি ।
ইন্দু । নামটা বুকের মধ্যে বাসা করেছে , তাই মুখে বের হতে চায় না ।
ক্ষান্তমণি । কী যে বলিস , বুঝতে পারি নে — ওর লেখার এমন কী মন্ত্র আছে বল্‌ তো ! আমাকে একটু নমুনা দে দেখি।
ইন্দু । তবে শোনো —
                        রসনায় ভাষা নাই , থাকি চুপে চুপে ,
                                    অন্তরে জোগায় সে যে বাণী ।
                        সময় পায় না আঁখি মজিবারে রূপে ,
                                    গোপনে স্বপনে তারে জানি ।
 

ক্ষান্তমণি । হায় রে , কী শব্দভেদী বাণেরই নমুনা!
ইন্দু । কমলদিদি খাতায় লিখে রেখেছে , এই ওর জপের মন্ত্র । শব্দভেদী বাণের যে জোর কত তা প্রত্যক্ষ দেখতে চাও ?
ক্ষান্তমণি । চাই বৈকি , জেনে রাখা ভালো ।
ইন্দু । ( নেপথ্যে চাহিয়া) দিদি! দিদি!
সেলাই হাতে কমলের প্রবেশ
কমল । কেন ? হয়েছে কী ?
ইন্দু । এখনো বিশেষ কিছু হয় নি , কিন্তু হতে কতক্ষণ ? বিধাতা আমাদের চেয়েও পর্দানশীন , আড়ালে বসে বসে তোমার সাধের স্বপ্নকে মূর্তি দিচ্ছেন ।
কমল । সে খবর দেবার জন্যে তোমায় ডাকাডাকি করতে হবে না ।
ইন্দু । তা জানি ভাই , খবর পাকা হলে বিধাতা আপনিই দূত পাঠিয়ে দেবেন । আমি সেজন্যে ভাবিও নি । সখীপরিষদে আমাকে গান গাইতে ধরেছে । স্বরলিপি থেকে তুমি যে নতুন গানটি শিখেছ আমাকে শিখিয়ে দাও । ক্ষান্তদিদিও সেইজন্যে বসে আছেন — আমি জানি , তোমার গান উনি চন্দ্রবাবুর চটি জুতোর আওয়াজের প্রায় সমতুল্য বলেই জানেন ।
ক্ষান্তমণি । ইন্দুর কথা শোনো একবার! এ আবার আমি কবে বললুম!
ইন্দু । তা হলে সমতুল্য বলাটা ভুল হয়েছে , তার চেয়ে নাহয় কিছু নীরসই হল । সে তর্ক পরে হবে , তুমি গান গাও ।
কমল ।
                                        গান
                        ডাকিল মোরে জাগার সাথি ।
                                প্রাণের মাঝে বিভাস বাজে ,
                        প্রভাত হল আঁধার রাতি ।
                                বাজায় বাঁশি তন্দ্রাভাঙা ,
                                ছড়ায় তারি বসন রাঙা ,
                                ফুলের বাসে এই বাতাসে
                                    কী মায়াখানি দিয়েছে গাঁথি ।
                                গোপনতম অন্তরে কী
                        লেখনরেখা দিয়েছে লেখি!
                                মন তো তারি নাম জানে না ,
                                রূপ আজিও নয় যে চেনা ,
                                বেদনা মম বিছায়ে দিয়ে
                                    রেখেছি তারি আসন পাতি ।
ইন্দু । ক্ষান্তদিদি , ঐ চেয়ে দেখো , বাণ পৌঁচেছে!
ক্ষান্তমণি । কোথায় ?
ইন্দু । আমাদের এই গলির আকাশ পার হয়ে , ঠেকেছে গিয়ে তোমাদের বাড়ির ঐ দরজাতে ।
ক্ষান্তমণি । ইন্দু , তুই স্বপ্ন দেখছিস নাকি ?
ইন্দু । ঐ দেখো-না , তোমাদের বন্ধ দরজার খড়্‌খড়ে খুলে গেছে ।
ক্ষান্তমণি । তা তো দেখছি ।
ইন্দু । কমলদিদি , বুঝতে পেরেছ ?
কমল । আঃ , কী যে বকিস তার ঠিক নেই ।
ইন্দু । ঐ খোলা খড়্‌খড়ির ফাঁক দিয়ে কবিকুঞ্জবনের দীর্ঘনিশ্বাস উচ্ছ্বসিত । ঐ খড়্‌খড়ির পিছনে একটা ধড়্‌ফড়ানি দেখতে পাচ্ছ ?
কমল । কিসের ধড়্‌ফড়ানি ?
ইন্দু । সেই খবরটাই তো চোখের আড়ালে রয়ে গেল ।
                                    গান
                    হায় রে ,
                                    ওরে যায় না কি জানা!
                            নয়ন ওরে খুঁজে বেড়ায় ,
                                    পায় না ঠিকানা ।
                            অলখ পথেই যাওয়া-আসা ,
                            শুনি চরণধ্বনির ভাষা ,
                            গন্ধে শুধু হাওয়ায় হাওয়ায়
                                    রইল নিশানা ।
                            কেমন ক'রে জানাই তারে ,
                                    বসে আছি পথের ধারে ।
                            প্রাণে এল সন্ধ্যাবেলা
                            আলোয় ছায়ায় রঙিন খেলা ,
                            ঝ'রে-পড়া বকুলদলে
                                    বিছায় বিছানা ।

ক্ষান্তমণি । ওলো ইন্দু , দেখ্‌ দেখ্‌ খড়্‌খড়ে আরো ফাঁক হয়ে উঠল যে!
ইন্দু । এবার তুমি যদি গান ধর তা হলে দেয়ালসুদ্ধ ফাঁক হয়ে যাবে!
ক্ষান্তমণি । আর ঠাট্টা করতে হবে না , যাঃ । তোর কথা শুনে ভেবেছিলুম , একা কমলই বুঝি শব্দভেদী বাণের তীরন্দাজ । বিধাতা কি তোদের সকলেরই গলায় বাণ বোঝাই করেছেন! হাতের কাছে এত বিপদ জমা আছে , এ তো জানতুম না ।
ইন্দু । সৃষ্টিকর্তা সংকল্প করেছেন পুরুষমেধ যজ্ঞ করতে — তারই সহায়তায় নারীদের ডাক পড়েছে । সবাই ছুটে আসছে , কেউ কণ্ঠ নিয়ে , কেউ কটাক্ষ নিয়ে ; কারও বা কুটিল হাস্য , কারো বা কুঞ্চিত কেশকলাপ ; কারো বা সর্ষের তেল ও লঙ্কার বাটনাযোগে বুক-জ্বালানি রান্না ।
ক্ষান্তমণি । কিন্তু তোদের সব বাণই কি একটা খড়্‌খড়ে দিয়ে গলবে নাকি ?

ইন্দু । কবির হৃদয়টা দরাজ , বড়ো বোনের পাকা হাত আর ছোটো বোনের কাঁচা হাত কারও লক্ষ্যই ফসকায় না ।
ক্ষান্তমণি । তা যেন হল , তার পরে অংশ নিয়ে তোদের মামলা বাধবে না ?
ইন্দু । তাই তো বলে রেখেছি , আমি দাবি করব না ।
কমল । এত নিঃস্বার্থ হবার দরকার কী ?
ইন্দু । কমলদিদি , জীবনের অঙ্কশাস্ত্রে পুরুষরা আছে গুণের কোঠায় , মেয়েরা ভাগের কোঠায় । ওদের বেলায় দুইয়ের দ্বারা হয় দ্বিগুণ , আমাদের বেলায় দুইয়ের দ্বারা হয় দুভাগ । তাই তোমাকে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছি — নইলে দুই বোনে মিলে ঐ খড়্‌খড়েটার কব্‌জা এতদিনে ঝর্‌ঝরে করে দিতুম ।
কমল । কেন , রাস্তা কি আমি ছাড়তে জানি নে ?
ইন্দু । আমি ওর কবিতাবিছানো রাস্তায় এক পা চলতে পারব না । মানেই বুঝতে পারি নে — হুঁচট খেয়ে মরব ।
ক্ষান্তমণি । তোরা দুজনে মিলে রফানিষ্পত্তি করে নে , আমার কাজ আছে , যাই ।
ইন্দু । বেলা গিয়েছে , এখন আবার তোমার কাজ ?
ক্ষান্তমণি । যত বেকারের দল , কখন কী খেয়াল যায় তার ঠিক নেই । হয়তো হঠাৎ হুকুম হবে , তপ্‌সি মাছ ভাজা চাই ; নয়তো কড়াইশুটির কচুরি , নয়তো হাঁসের ডিমের বড়া ।
ইন্দু । একটু দাঁড়াও , আমরাও যাচ্ছি । তোমার সঙ্গে কর্মবিভাগ করে নেব । আমরা লাগব চেখে দেখবার কঠিন কাজে । কমলদিদি , ঐ দেখো , খড়্‌খড়েটা লুব্ধ চকোরের চঞ্চুর মতো এখনো হাঁ করে রয়েছে । দেখে দুঃখ হচ্ছে ।
কমল । এত দয়া যদি তো সুধা তুমিই ঢালো-না । আমি চললুম ।
ইন্দু । না , দিদি ।
                                গান
                যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে ,
                কোন্‌খানে যে মন লুকানো দাও বলে ।
                        চপল লীলা ছলনাভরে
                        বেদনখানি আড়াল করে ,
                যে বাণী তব হয় নি বলা নাও বলে ।

                হাসির বাণে হেনেছ কত শ্লেষকথা ,
                নয়নজলে ভরো গো আজি শেষকথা
                       হায় রে অভিমানিনী নারী ,
                       বিরহ হল দ্বিগুণ ভারী
                দানের ডালি ফিরায়ে নিতে চাও বলে ।

আচ্ছা ভাই , ক্ষান্তদিদি , ঐ খড়্‌খড়ের পিছনে কোন্‌ মানুষটি বসে আছে আন্দাজ করো দেখি । চন্দরবাবু ?
ক্ষান্তমণি । না , ভাই , তার আর যাই দোষ থাক তোদের শব্দভেদী বাণ তাকে পৌঁছয় না , সে আমি খুব দেখে নিয়েছি ।
ইন্দু । অর্থাৎ , আমাদের চন্দ্রের যা কলঙ্ক সেটা কেবল মুখের উপরে , তার জ্যোৎস্নায় কোনো দাগ পড়ে না । তোমাদের লক্ষ্মীছাড়া দলে আর কে আছে নাম করো দেখি ।
ক্ষান্তমণি । আর-একজন আছে , তার নাম গদাই ।
ইন্দু । আরে , ছি ছি , ছি ছি! অমন নাম যার তার খড়্‌খড়ে চিরদিন যেন বোজা থাকে ।
ক্ষান্তমণি । নাম শুনেই যে তোর —
ইন্দু । নামের দাম কম নয় দিদি । ভেবে দেখো তো , দৈবদুর্যোগে গদাই যদি ‘ কাননকুসুমিকা ' র কবি হত তা হলে কবির নাম জপ করবার সময় দিদি কী মুশকিলেই পড়ত । ভক্তি হত না , সুতরাং মুক্তিও পেত না ।
কমল । দিদির মুক্তির জন্যে তোমাকে অত ভাবতে হবে না । এখন নিজের কথা চিন্তা করবার সময় হয়েছে ।
ইন্দু । সেইজন্যেই তো নাম বাছাই করতে লেগে গেছি । সময় নষ্ট করতে চাই নে । আমার স্বয়ম্বর সভার নিমন্ত্রণের ফর্দ থেকে গদাই নামটা কাটা পড়ল ।
কমল । তা হলে এইবেলা তোমার পছন্দসই নামের একটা ফর্দ করা যাক । কুমুদ কিরকম ?
ইন্দু । চলে যায় ।
কমল । নিকুঞ্জ ?
ইন্দু । চলতেও পারে , কিন্তু উপবাসের মুখে , অর্থাৎ দ্বাদশী তিথিতে ।
কমল । পরিমল ?
ইন্দু । মালাবদলের সময় নাম-বদল করতে হবে , সে হবে ইন্দু আমি হব পরিমল । যা হোক এগুলো চলতেও পারে — কিন্তু গদাই ? নৈব নৈব চ ।
ক্ষান্ত । কী যে পাগলামি করছিস ইন্দু! চল্‌ , আমার কাজ আছে ।


 

                                      এই গ্রন্থে গৃহীত গানগুলির তালিকা

প্রথম অঙ্ক :প্রথম দৃশ্য

কমল : ডাকিল মোরে জাগার সাথি

ইন্দু : হায় রে, ওরে যায় না কি জানা !

ইন্দু : যাবার বেলায় শেষ কথাটি

প্রথম অঙ্ক :দ্বিতীয় দৃশ্য

নেপথ্যে গান : কাছে যবে ছিল

চতুর্থ অঙ্ক :দ্বিতীয় দৃশ্য

ইন্দুর গান : এবার মিলন-হাওয়ায়

ইন্দুর গান : লুকালে বলেই খূজে বাহির-করা

নেপথ্যের গান : মুখ-পানে চেয়ে দেখি

চ্রকান্ত : জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না

চতুর্থ অঙ্ক :তৃতীয় দৃশ্য

ন্দ্রকান্ত ও অন্যান্য : যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে