বাংলা ধর্ম সঙ্গীত
বাংলা ভাষায় রচিত ধর্ম বিষয়ক সঙ্গীতকে সাধারণভাবে বলা হয় বাংলা ধর্মসঙ্গীত।

ধর্মের বিচারে বাংলাভাষাভাষীরা বহুধর্মীয় আদর্শে বিভাজিত। উল্লেখযোগ্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে- ইসলাম ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম. খ্রিষ্টান ধর্ম সনাতন ধর্ম। এই বাইরে রয়েছে শিখ ধর্ম, ব্রাহ্মধর্ম, প্রকৃতি পূজারী আদিবাসীদের ধর্ম। এ সকল ধর্মাবলম্বীদের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় সঙ্গীত।

চর্যাগীতি (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)
নমুনা প্রাপ্তির বিচারে- বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মমতাদর্শের রচিত
চর্যাগীতি এবং সমতূল্য নাথগীতিকাকে বাংলা ভাষার রচিত আদি ধর্মসঙ্গীতে হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধর্মের বিচারে সাধারণভাবে বলা হয় বৌদ্ধ সঙ্গীত

১২০৪-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ [বাংলা গানের অন্ধকারযুগ]
এই যুগে বাংলা গানের কোন নমুনা পাওয়া যায় নি।

বৈষ্ণবসঙ্গীত (১৩৫০-১৭০০ খ্রিষ্টাব্দ)
কালানুক্রমের বিচারে
চর্যাগীতির পর পাওয়া যায় সনাতন ধর্মের গানের সূচনা হয়েছিল কীর্তন গানের মধ্য দিয়ে। সংস্কৃত কীর্তন [কীর্ত্তি (বর্ণনা করা) +অন (ল্যুট), ভাববাচ্য] শব্দের একাধিক অর্থের ভিতরে বিশেষ কয়েকটি অর্থ হলো- গুণকথন, গুণগানকরণ, স্তবন। এই বিচারে যে কোনো বিষয়ের গুণকথনই কীর্তন বলা যায়। বাস্তবে কীর্তন বলতে রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গানকেই কীর্তন বলা হয়।

বাণীর বিচারে কীর্তনকে বিশেষভাবে শনাক্ত করতে গেলে কিছুটা অপূর্ণতা থেকে যায়।
সাঙ্গীতিক পরিভাষায় কীর্তন যে কোনো বিষয়ের গুণকীর্তন নয়। কারণ, কীর্তন বানীর পাশাপাশি সূর-শৈলীও। বিশেষভাবে বলতে গেলে- মূলত সুরাঙ্গই কীর্তনকে বিশেষধারার গান হিসেবে সঙ্গীতজগতে স্থান করে দিয়েছে। কারণ বিষয় রাধা-কৃষ্ণ হলেও সুর-শৈলী যদি কীর্তনের মতো না হয়, তা হলে তা কীর্তন বলা যায় না।

ভাবের বিচারে কীর্তন গান হলো- সুর-তাল সহযোগে কৃষ্ণের মধ্য দিয়ে বিষ্ণুর দশম অবতারের গুণকথন বা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব লীলার ভিতর দিয়ে ঈশ্বর লীলা অনুধাবনের চেষ্টা। যদিও বৈদিক যুগের শেষের দিকে রচিত বৈদিক সাহিত্যে বিষ্ণুর উল্লেখ থাকলেও ততটা একান্ত বিষ্ণুর অনুগত ভাবনার বিকাশ ঘটে নি। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দের ভিতরে রচিত রামায়ণের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিষ্ণুর অবতার রাম। কিন্তু এই কাব্যের রামভক্তের বিকাশ ঘটলেও, ক্ষত্রিয় রামের ভিতরে অহিংস বৈষ্ণব দর্শন পাওয়া যায় না। ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে রচিত মহাভারতে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেও, কৃষ্ণকে ক্ষত্রিয় হিসেবেই দেখানো হয়েছে। মহভারতোত্তর পৌরাণিক যুগে, অরথাৎ ৩০০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত বিষ্ণু অন্যতম দেবতা হয়ে উঠেছিল প্রজা-রক্ষাকারী দেবতা। এই সময়ের ভিতরে বিষ্ণুর ক্ষত্রিয়-রূপটি বিশেষভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো পুরাণে রাধাকৃষ্ণের লীলা-ভিত্তিক কাহিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পুরাণের বাইরে এই জাতীয় রচনায় উৎকৃষ্ট নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যায়, কবি জয়দেবের রচিত 'গীতগোবিন্দম্'। যতদূর জানা যায়, জয়দেবব ছিলেন বাংলা রাজা লক্ষণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ) রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম। উল্লেখ্য অপর চারজন রত্ন ছিলেন− গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ীউমাপতি ধর। কারও কারও মতে তিনি কিছুকাল উৎকলরাজেরও সভাপণ্ডিত ছিলেন।

১২০৪-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে সংঘটিত '
বাংলা গানের অন্ধকারযুগ'-এই কাব্যের খ্যাতি বঙ্গদেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ধারায় মৈথিলী-বাংলার কবি
বিদ্যাপতি পদাবলী রচনা করেছিলেন। মূলত বাংলা বৈষ্ণব সঙ্গীতের পদাবলীর ধারার সূত্রপাত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ধারায়, বিদ্যাপতি'র পরবর্তী কবি হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাসকে ধরা হয়। আনুমানিক ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়, তাঁর আসল নাম ছিল অনন্ত এবং কৌলিক উপাধি বড়ু, গুরুপ্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাস নামে একাধিক কবির নাম পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও চণ্ডীদাস। তবে বিভিন্ন গবেষকদের মতে বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণচরিতের রচয়িতা।

১৩৫০-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে লীলাকীর্তন দুটি ধারায় বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল। এই ধারা দুটি হলো- বিভিন্ন পদকর্তাদের দ্বারা রচিত বিচ্ছিন্নভাবে রচিত পদাবলী এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আদলে রচিত অভিনয়যোগ্য পালাকীর্তন। মূলত পদাবলী কীর্তন এবং পালাকীর্তন ছিল  শৃঙ্গারধর্মী গান। এই ধারাকে ভক্তি রসে সিক্ত করেছিলেন শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬ -১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি ভক্তিকে নামজপের সূত্রে প্রণয়ন করেছিলেন নামকীর্তন।

শ্রীচৈতন্যের মৃত্যুর পর, বহু পদকর্তা বাংলা পদাবলী কীর্তনকে সমৃদ্ধ করেছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- জ্ঞানদাস (১৫২০/৩৫-?),
নরোত্তম দাস (১৫৩১-১৬১১). গোবিন্দ দাস (
১৫৩৪/৩৭-১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দ) প্রমুখ।

বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর সূত্রে বঙ্গদেশের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিরা সৃষ্টি করেছিলেন রাধাকৃষ্ণের লীলাভিত্তিক এক ধরনের গান। কালক্রমে এই গানের সাধারণ নাম হয়ে ছিল কীর্তন। এই গানের চর্চা বৈষ্ণবদের অদ্বৈতাচার্য, যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিতদের প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব গোষ্ঠীর ভিতরে প্রচলিত ছিল। সে সময় বৈষ্ণবগোষ্ঠী ক্ষুদ্রাকার একটি গোষ্ঠী হিসেবে নদীয়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এঁরা মূলত রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক কীর্তন গান করতেন।

ক্রমশ...