ভারতীয় ধর্মভিত্তিক এক প্রকার গান।
শাক্ত শব্দের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হলো-
শক্তি+অ (অণ)। হিন্দু পৌরাণিক
কাহিনিতে দুর্গাকে আদ্যা শক্তি হিসেবে মান্য করা হয়। আর শাক্ত হলো শক্তিরূপিণী
দুর্গা এবং শৈবশক্তির উপাসক। এই বিচারে
শিব ও দুর্গার উদ্দেশ্যে রচিত ভক্তি পর্যায়ের
সঙ্গীতই হলো শাক্ত সঙ্গীত।
এই শিব-দুর্গার
উপাসকদের দ্বারা এই গানের উদ্ভব ঘটেছিল।
পৌরাণিক বহুবিধ কাহিনির সূত্রে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে দুর্গা বহু নামে
পরিচিত এবং বহু নামে পূজিতা হয়ে থাকেন। যেমন, দুর্গা, কালিকা, কালী, কমলা, শ্যামা
ইত্যাদি। এছাড়া এ সকল গানে সমার্থক নাম হিসেবে 'মা' নামে সম্বোধিত হয়েছন।
এর সূত্রপাত ঘটেছিল আর্যদের হাতে বৈদিক যুগে। বেদে নানা
সূক্তিতে (‘দেবীসূক্ত’
ও ‘রাত্রিসূক্তে’)
দৈবিক শক্তির মহিমা এবং শক্তির আরাধনার উদাহরণ রয়েছে। ঋগ্বেদের সূচনাই
হয়েছে অগ্নিদেবতার স্তূতি এবং আরাধনার মধ্য দিয়ে। বৈদিক যুগের দ্বাদশ দেব-দেবী
পৌরাণিক যুগে হয়েছে ৩৩ কোটি। এসব দেবদেবীর পরিচয় পাওয়া
যায় পুরাণ, উপপুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে।
বাংলা শক্তিতত্ত্বের উদ্ভব ও বিস্তার
ঘটেছিল
অষ্টাদশ
শতাব্দীর প্রথমার্ধে
তন্ত্রপুরাণের যুগে। এই তত্ত্বে শাক্তশক্তির
পরিচায়ক হয়ে উঠেছিল দুর্গা। শাক্তরা দেবীকে নানা বিশেষণে অভিহিত করেছেন। শাক্তসাধকরা
এই তন্ত্রে এনেছিলেন নানা সাধন পদ্ধতি। এঁরা সাধনার দ্বারা দৈব শক্তি লাভের সাধনা
করতেন। এই সাধনায় এসেছিল সাধনসঙ্গিনীর বিহারে বামাচার, নরবলির মতো ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া,
শব-সাধনা ইত্যাদি। এঁরা দুর্গার নাম দিয়েছিলেন- এলোকেশী, ভয়ঙ্করী, শবাসনা, শ্যামা
ইত্যাদি।
বাংলায় শক্তি সাধনার ইতিহাস প্রাচীন হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর একবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন
(১৭২০-১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)
শাক্তসঙ্গীতের
নবতর
ধারার শুভ সূচনা
করেন।
রামপ্রসাদ সেন
ছিলেন মূলত কালীসাধক। তিনি অধিকাংশ সময় কালী সাধনায় মগ্ন থাকতেন। কালীকে তিনি
যেভাবে উপলব্ধি করেছেন, তারই প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর গানে।
দৈবশক্তির কাছে নিজেকে সেবক রূপে নিবেদিত করার প্রথাগত ভক্তিবাদের সনাতন রীতিকে
ভেঙে দিয়ে, দেবী মাতৃরূপ কখনো কন্যারূপে উপস্থাপন করেছেন। তাই
তাঁর শাক্তসঙ্গীতে
ফুটে উঠেছে
মাতা-সন্তানের গভীর
ভালোবাসা। নদিয়ার মহারাজ
কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে
তাঁকে সভাকবির মর্যাদা দেন।
রামপ্রসাদ সেন
তাঁর গানকে একটি বিশেষ সুরের চলনে বেঁধেছিলেন। এই সুরটি পর্বর্তী
সময়ে ‘রামপ্রসাদী সুর’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। মূলত তিনি
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে লোক সুরের
সংমিশ্রণে এই রূপটি সৃষ্টি করেছিলেন।
বাণীর বিচারে তাঁর গানে ভাষা ছিল সহজ, সরল আবার একই সাথে ভাব গম্ভীর।
কালীকে অধ্যাত্মিক দর্শনে তাঁর গানে উপস্থাপন করলেও, অতি সাধারণ কথায়
বা উপমায় তা প্রকাশ করার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে আদৃত হয়েছিল। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগের সুরবিন্যসের সূত্রে রামপ্রসাদী
সুর ভিন্নতর সুরশশেলী তৈরি করেছিল। তাঁর গানে যে সকল রাগরূপ পাওয়া যায়, সেগুলো হল-
ইমনন,
ইমন কল্যাণ,
কালাংড়া,
খাম্বাজ,
গৌড় মল্লার,
ছায়ানট,
জয়জয়ন্তী,
ঝিঁঝিট,
পিলু,
বসন্তবাহার,
বাহার,
বিভাস,
বেহাগ,
ভৈরবী,
মালশ্রী,
মুলতান,
ললিত,
সোহিনী ইত্যাদি।
রামপ্রসাদ সেনেরর
পরে অনেকে শাক্তসঙ্গীত
রচনা করেছিলেন। এঁদের ভিতরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
(১৭৭২-১৮২১ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনিও ছিলেন কালীসাধক। এই
সাধনার পাশাপাশি তিনি বহু শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেন। তিনি
রামপ্রসাদী সুরের সাথে টপ্পার চলন
মিশিয়ে নতুন ধারার সুরের প্রবর্তন করেছিলেন।
দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত বাঙালির গান গ্রন্থে তাঁর
৭৯টি গানের নমুনা পাওয়া যায়।
[রামপ্রসাদ
সেনের গানের তালিকা]
রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের পরে শাক্তসঙ্গীত
রচনায় বিশেষ স্বাক্ষর রেখেছিলেন মহারাজ নন্দকুমার (১৭০৫-৭৫),
রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬), পাঁচালিকার
দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭
খ্রিষ্টাব্দ), রসিক
চন্দ্র রায় (১৮২০-৯৩), প্রমুখ
শাক্তসাধকবৃন্দ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রাহ্মধর্মের
প্রসার এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাবে বঙ্গদেশে সনাতন হিন্দু ধর্মের
দেবদেবী-ভিত্তিক ধর্মে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে।
১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ১১৩, সারকুলার
রোডস্থ ভবনে
রামমোহন রায়
প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্মের সূত্রপাত ঘটেছিল 'আত্মীয় সভা'র
মাধ্যমে।
রামমোহন রায়ের
পর, ব্রাহ্মধর্মের হাল ধরেন
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই ধর্মে
সেকালের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ আকৃষ্ট হয়েছিল। এই সূত্রে
বিকশিত হয়েছিল ব্রাহ্মসঙ্গীত।
এছাড়া ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রসার ঘটে
কোলকাতা কেন্দ্রিক সঙ্গীতাঙ্গনে। বিশেষ করে টপ্পা, ঠুমরি জাতীয় আধা শাস্ত্রীয়
সঙ্গীত, নব্য থিয়েটার-ভিত্তিক গান, কলের গান ইত্যাদির প্রভাবে শাক্তসঙ্গীত চর্চার
ক্ষেত্র সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কালী সাধক
রামকৃষ্ণ পরমহংসের
মাধ্যমে শাক্ত ধর্ম নব শক্তি লাভ করে। তাঁর শিষ্য স্বামী
বিবেকানন্দের দ্বারা
রামকৃষ্ণ পরমহংসের সর্বধর্মের সত্য উপস্থাপিত হলেও, রামকৃষ্ণ মিশনের মাধ্যমে
শাক্ত ধর্ম শক্তিশালী রূপে প্রচারিত হতে থাকে। এই সূত্রে সে সময়ের বহু গীতিকার
শাক্ত সঙ্গীত রচনা করতেন। এই ধারায় শাক্ত সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছিলেন
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।
নজরুল ইসলামের পরে তেমন উল্লেখযোগ্য শাক্ত সঙ্গীত রচয়িতার
আবির্ভাব ঘটে নি।
নজরুলে পরে বা সমসাময়িক সময়ে আরও কিছু গীতিকার শ্যামা
সঙ্গীত রচনা করলেও সাঙ্গীতিক মানের বিচারে নজরুলকে অতিক্রম করে যেতে পারে নি।
[নজরুলের
রচিত শাক্ত-সঙ্গীত]
লেটো গানের লোক-আঙ্গিকের অধ্যায় বাদ দিলে, পল্টন
ফেরত নজরুলের প্রায় ২২ বছরের সাহিত্য চর্চার ভিতরে একটি উল্লেযোগ্য অংশ
জুড়ে ছিল সঙ্গীতরচনার অধ্যায়। এই স্বল্প-পরিসরে তিনি রচনা করেছিলে তিন
সহস্রাধিক গান। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বহু মাত্রিক। এই সময়ের
তিনি ছিলেন গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত-পরিচালক, নাট্যকার, অভিনেতা ইত্যাদি।
তিনি নিজের নাটকের পাশাপাশি অন্যের নাটকে গান লিখেছেন, অন্যের রচিত গানে
সুরারোপ করেছেন। সঙ্গীতে নজরুলের এই বর্ণাঢ্য জীবনের একটি অন্যতম
অধ্যায় ভক্তিগীতি। এক্ষেত্রে তিনি সাধারণ, ইসলাম ও সনাতন ধর্মের আলোকে
যত গান রচনা করেছেন, তার মধ্য একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হলো-
শাক্তসঙ্গীত। তিনি প্রায় দুই শতাধিক সুর ও বাণীর বিচারে উচ্চতর মানের
শাক্ত-সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। এ সকল গানে ছিল, দেবীর প্রতি ভক্তি, প্রার্থনা,
আত্ননিবেদন। এর বাইরে তাঁর দেবী বন্দনার মধ্য দিয়ে দিয়ে ঘটেছিল দ্রোহের প্রকাশ।
যেখানে স্বদেশী ভাবনার প্রতিবাদমুখরতা। তাই সমগ্র নজরুল-রচনাবলীর মধ্যে
শাক্ত-সঙ্গীত অনন্য স্থান করে নিয়েছে।