বিভাস
ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে একটি রাগ বিশেষ। এই রাগটি চারটি ঠাটে পাওয়া যায়। এই ঠাট ৪টি হলো– পূরবী, বিলাবল, ভৈরবমারবা

১. বিভাস (পূরবী)
পণ্ডিত অহোবলের রচিত 'সঙ্গীত পারিজাত' [ভাষ্যকার শচীন্দ্রনাথ মিত্র, পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৪] গ্রন্থে এই রাগের উল্লেখ আছে। শ্রুতিভিত্তিক প্রাচীন স্বর বিন্যাস অনুসারে এই রাগটিকে আধুনিক বিন্যাসে পূরবী ঠাটে ফেলা যায়। যেমন এই রাগের মধ্যকে বলা হয়েছে তীব্রতর। আধুনিক স্বরস্থানের বিচারে একে বলা হয় কড়ি মধ্যম। মধ্যমগ্রামের 'হরিণাশ্বা' মূর্চ্ছনা থেকে এই রাগের উৎপত্তি। তাই এর গ্রহস্বর গান্ধার। আবার গান্ধারকে অংশ স্বর তথা বাদী হিসেবে মানা হয়েছে। সঙ্গীত পারিজাতের মতে এই রাগের আরোহ- অবরোহ দাঁড়ায়

আরোহণ:  স ম গ ঋ  র্স      
অবরোহণ: র্স প দ প জ্ঞ র স
জাতি: ষাড়ব-সম্পূর্ণ
ঠাট: পূরবী
বাদীস্বর: গান্ধার (মতান্তরে পঞ্চম)
সমবাদী স্বর: পঞ্চম (ষড়্‌জ)

. বিভাস (ভৈরব)
 ভৈরব ঠাটের বিভাসে মধ্যম ও নিষাদ বর্জিত ব্যবহৃত হয় না। সম্ভবত এই কারণে ভৈরব ঠাটের এই রাগকেও আগে পূরবী ঠাটের বিভাস বলা হতো। কিন্তু ভৈরব ঠাটের বিভাসে ভৈরবের অনুরূপ আস্বাদন পাওয়া যায় বলে- একে এখন ভৈরব ঠাটের বিভাসই বলা হয়। এই রাগে গান্ধার ও নিষাদ বর্জিত। রাগটি সমস্বারিক। ফলে এই রাগের যে কোনো স্বরকে আশ্রয় করে বিস্তার করা যায়।  এই রাগে স দ, গ ঋ, প দ মীড়যুক্ত হয়।

আরোহণ:  স ঋ গ প দ  র্স      
অবরোহণ: র্স দ প গ ঋ স
ঠাট: ভৈরব
জাতি: ঔড়ব-ঔড়ব
বাদীস্বর: ধৈবত
সমবাদী স্বর: ঋষভ
সময়: রাত্রি চতুর্থ প্রহর।
চলন: দ প গ প গ ঋ স গপ দ প র্স দ প
৩. বিভাস (মারবা)
মারবা ঠাটের বিভাসে কোমল ঋষভ ও কড়ি মধ্যম ব্যবহৃত হয়। রাগটি সম্পূর্ণ জাতির এই রাগে গ ঋ, গ  প  মীড়যুক্ত হয়।
আরোহণ: স ঋ গ প হ্ম ধ র্স   
অবরোহণ: র্স ন ধ প হ্ম- প গা ঋ স
ঠাট: মারবা
জাতি: সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ
বাদীস্বর: ধৈবত
সমবাদী স্বর: ঋষভ
সময়: প্রাতঃকাল।
চলন: স ঋ গ ঋ, স ন্ ধ্ , স ঋ গ ঋ স। স ঋ গ হ্ম, গ প হ্ম গ প ধ, ধ প, প গ ঋ, স

নজরুল সঙ্গীতে মারবা ঠাটের বিভাস
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের [২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ (বৃহস্পতিবার ১২ পৌষ ১৩৪৬) কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুলের রচিত ঠাট-ভিত্তিক 'মেল-মেলন' নামক গীতি-আল্লেখ্য প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানে মারবা ঠাটের বিভাসে রচিত একটি গান প্রচারিত হয়েছিল। গানটি হলো-
মরালী গমনশ্রী মদ অলস চরণে [তথ্য]

এই রাগ প্রসঙ্গে নজরুলের পাণ্ডুলিপিতে যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা হলো-

মারওয়া ঠাট

প্রাচীন সঙ্গীতশান্ত্রে ইহার নাম 'গমন শ্রম' মেল। গমন শ্রম কি 'গাওন শ্রম" - এর অপভ্রংশ? এ ঠাটের রাগ-রাগিণী গাওয়া বা আয়ত্তাধীন করা যেরূপ শ্রম সাধ্য ব্যাপার- তাহাতে এ নামের সার্থকতা কতকটা উপলব্ধি হয় বটে। পূরবী ঠাটের সঙ্গে ইহার এইমাত্র প্রভেদ যে, ইহার ধৈবত তীব্র ও পূরবীর ধৈবত কোমল। ইহাতে এই সুর লাগে ষড়জ, কোমল রেখাব, তীব্র গান্ধার, তীব্র বা কড়ি মধ্যম, পঞ্চম, তীব্র ধৈবত, তীব্র নিখাদ। ইহার রাগ-রাগিণীতে 'মারওয়া' রাগিণীর অঙ্গ প্রধান, বলিয়া আজকাল ইহাকে মারওয়া ঠাট' নামে অভিহিত করা হইয়া থাকে।

বর্তমানে মারওয়া ঠাটে পণ্ডিতগণ যে বারটি রাগিণীর (পূরিয়া কল্যাণ বাদ দিয়া) নাম উল্লেখ করিয়াছেন, তাহার ছ'টি রাগিণী সন্ধ্যার ও ছয়টি সকালের । পুরিয়া, মারওয়া, জয়ত, গৌরী, সাজগিরি ও বরারী সন্ধ্যার রাগিণী এবং ললিত, পঞ্চম, ভাটিয়ার, বিভাস, ভঙ্কার ও সোহিনী দিনের বা শেষ প্রহর রাত্রির রাগিণী। সঙ্গীত-শাস্ত্রে  দিন বলিতে রাত্রি বারোটার পর হইতে দিন বারোটা পর্যন্ত বুঝায় এবং রাত্রি বলিতে দিন বারোটার পর রাত্রি বারোটা পর্যন্ত বুঝায়।

উপরে সন্ধ্যার যে ছয় রাগিণীর উল্লেখ করা হইয়াছে তাহার কতক গৌরী-অঙ্গ ও কতক পুরিয়া-অঙ্গ করিয়া গাওয়া হয়। উল্লিখিত সকালের ছয়টি রাগিণীর মধ্যে কতক ললিত -অঙ্গ ও কতক সোহিনী -অঙ্গ করিয়া গাওয়া হয়।

সন্ধ্যার রাগ- রাগিণীতে পূর্বাঙ্গ প্রবল থাকে অর্থাৎ সা হইতে পঞ্চম পর্যন্ত (মুদারা গ্রামের) বেশী লাগে । সকালের রাগ-রাগিণীতে উত্তরাঙ্গ অর্থাৎ পঞ্চম হইতে তারা স্থানের সা পর্যন্ত প্রবল থাকে।

এইগুলি স্মরণ রাখিলে রাগ- রাগিণী বিশুদ্ধ করিয়া গাওয়ায় অনেকটা সাহায্য করিবে।'
   [মূল পাণ্ডুলিপি]

৪. বিভাস (বিলাবল)
বিলাবল ঠাটের বিভাস বঙ্গদেশে অধিক প্রচলিত। বাংলার বাইরে এই রাগ প্রচলিত নেই। অখণ্ড বাংলায় এক সময় এই রাগ ধ্রুপদে ব্যবহার হতো। অনেকে মনে করেন এই রাগের ভিতর বাংলা লোকসঙ্গীতের সৌরভ পাওয়া যায়। এই কারণে বাংলাদেশে এই রাগ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিলাবল ঠাটের দেশকার রাগের সাথে এই রাগের বেশ মিল আছে। মূলত দেশকার রাগের অবরোহে নিষাদ প্রয়োগ করলে বিলাবল ঠাটের বিভাস পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রচলিত এই রাগটি মূলত বিষ্ণুপুর ঘরানার রাগ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ এই রাগে যে কয়টি গানে ব্যবহার করেছেন তার অধিকাংশই বাউল ও কীর্তনাঙ্গের। ধ্রুপদাঙ্গের গান রয়েছে মাত্র দুটি। গান দুটো হলো- 'ওঠো ওঠো রে' এবং জাগ্রত বিশ্বকোলাহল মাঝে।
আরোহণ: স র গ প ধ র্স
অবরোহণ: র্স ন ধ প গ র স
ঠাট: বিলাবল
জাতি: ঔড়ব-ষাড়ব
বাদীস্বর: ধৈবত
সমবাদী স্বর:ঋষভ
সময়: প্রাতঃকাল।
চলন: স ঋ গ ঋ, স ন্ ধ্ , স ঋ গ ঋ স। স ঋ গ হ্ম, গ প হ্ম গ প ধ, ধ প, প গ ঋ, স

তথ্য সূত্র :