ইসলামি গান
বঙ্গদেশে মুসলমানদের মধ্যে চর্চিত সঙ্গীত।

চর্যাগীতির পরে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে একটি বড় ধরনে ধাক্কা লাগে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজির বাংলা-অভিযানের মধ্য দিয়ে। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকের বখতিয়ার খিলজির গৌড় দখলের পর, শুরু হয় বাংলার আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা ছিল অনুমানিক ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়ে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা গানের কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। এই সূত্রে এই সময়কে বাংলা গানের অন্ধকারযুগ বলা হলেও, এই সময়ে বাংলার লোকসমাজে গানের চর্চা একেবারই ছিল না, এ কথা মানা যায় না।

তুঘলক বংশের শাসনামলকে -কে সাধারণভাবে অরাজকতার কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে তুঘলকী শাসনের শেষের দিকে লক্ষ্মণাবতীর সুলতান আউউদ্দিন-আলি-শাহকে পরাজিত করে, সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে বসেন।
১৩৫৭ খ্রিষ্টাব্দে
ইলিয়াস শাহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। ১৩৫৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতান ফিরোজ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করে পরাজিত হয়ে, সিকান্দার শাহকে বাংলার শাসক হিসেবে মেনে নেন। ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র আজম শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। আজম শাহ  সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। তিনি পারস্যের কবি হাফিজকে বাংলায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন। কবি এর প্রত্যুত্তরে একটি গজল রচনা করে, আজমশাহকে পাঠান।

জারি, মর্সিয়া কাব্য ও গান
বাংলা ভাষায় ইসলামু গানের সূচনা হয়েছিল মর্সিয়া কাব্যের মাধ্যমে। এর প্রেক্ষাপট ছিল কারবালা প্রান্তরে করুণ কাহিনি। ইসলামী ইতিহাস অনুসারে, হিজরী ৬১ সনের ১০ই মহরম (‌১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ) তারিখে, হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন কারবালা প্রান্তরে শহিদ হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ভিতর শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। উল্লেখ্য মুহম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর যে চারজন খলিফা পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন, এঁদের ভিতর চতুর্থ খলিফা ছিলেন, নবীর জামাতা হযরত আলীকে (রা.)। কিন্তু শিয়া মতাবলম্বীরা মনে করেন,  হযরত আলী(রা.)-ই প্রকৃতপক্ষে প্রথম খলিফা মানে। কিন্তু নবীর মৃত্যুর পর হযরত আলী (রা.) খলিফা নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হন। পরপর তিনজন খলিফার শাসনকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর, ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এ পদে নির্বাচিত হন। সে সময় তৃতীয় খলিফা উসমানের (রা.) আত্মীয় মুয়াবিয়া (রা.) এর তীব্র বিরোধিতা করেন। হযরত আলী (রা.) ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে শাহাদত বরণ করলে, তাঁর পুত্র হযরত হাসান (রা.) খলিফা হন। কিন্তু তিনি মুয়াবিয়ার (রা.) কাছে খেলাফত ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এর কিছুপরে পরেই বিষ প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হয়। মুয়াবিয়ার (রা.) মৃত্যুর পর হযরত হাসানের (রা.) ভাই হযরত হুসেইনকে (রা.) খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হবেন বলে অনেকে আশা করেছিলেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার (রা.) পুত্র ইয়াজিদ খলিফা হন। এই সূত্রে হযরত হোসেন (রা.) এবং ইয়াজিদের ভিতরে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত হিজরী ৬১ সনের ১০ই মহরম (‌১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ) ইয়াজিদের বাহিনীর কাছে কারবালা প্রান্তরে হযরত হোসেন (রা.) পরাজিত ও নিহত হন। হযরত আলী (রা.) ও তাঁর পুত্রদের সমর্থকরা একে এজিদের একটি ধর্মবিরোধী কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই ভাবনা ধীরে ধীরে শিয়া মতবাদের জন্ম দেয়।

১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমান কবিদের দ্বারা সূচিত হয়েছিল- মর্সিয়া কাব্য। শোক গাঁথামূলক কাব্যকে সাধারণ ভাবে মর্সিয়া কাব্য বলা হয়। আরবী মর্সিয়া শব্দের অর্থ হলো- শোক প্রকাশ করা। আরবী সাহিত্যে মর্সিয়া শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে নানা ধরনের শোকাবহ ঘটনাকে প্রকাশ করার অর্থে। পরবর্তী সময়ে কারবালা প্রান্তরে শহিদ ইমাম হোসেন ও অন্য শহিদদেরকে উপজীব্য করে লেখা সাহিত্য মর্সিয়া নামে আখ্যায়িত হওয়া শুরু হয়েছে। আরবীয় মুসলমানদের দ্বারা পারশ্যে ইসলাম ধর্মের বিকাশ ঘটলে, ফারসি ভাষা- সাহিত্য-সঙ্গীতে, আরবি মর্সিয়া শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। মুসলমানরা ভারত উপমহাদেশে রাজত্ব কায়েম করলে, ইসলামী অনুশাসনের সূত্রে সরকারি ভাষা ফার্সি হয়েছিল। এই সময় মর্সিয়া ভারতীয় ভাষাগুলোতে বিদেশী শব্দ হিসেবে প্রচলিত হয়। এই কাহিনি অবলম্বনে প্রথম মর্সিয়া কাব্য রচনা করেছিলেন শেখ ফয়জুল্লা। ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রচিত এই গ্রন্থটির নাম 'জয়নবের চৌতিশা'। এরপর আরও অনেকে এই বিষয়ের উপর কাব্য রচনা করেছিলেন।

কালক্রমে মর্সিয়া নামক দীর্ঘ কাব্যগাঁথার পরিবর্তে. স্থানীয় কবিয়ালরা অনেকে ছোটো ছোটো করে গান বাঁধা শুরু করেন। এঁদের দ্বারা সাধারণ কৃষিজীবী মুসলমানদের ভিতরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল মর্সিয়া-ভিত্তিক গান এবং যা বাংলা লোকগানের অংশ হয়ে যায়। পরে আরব-পারস্য অঞ্চলের বহু আখ্যান কাব্য বাংলাকাব্যজগতে ঢুকে পরে। ধীরে ধীরে এই ধারায় যুক্ত হয় জহরনামা, সাদ্দাদের জারি, শাহজালালের জারি, সোহরাব-রোস্তমের জারি ইত্যাদি আখ্যানকাব্য। আরও পরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে- সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ব্যঙ্গরসাত্মক বিষয়, পরিবার-পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ক জারি গান।

কবিয়ালরা যখন এই জাতীয় গান ছোট ছোট আকারে শোকের গান হিসেবে প্রকাশ করে করুণা প্রকাশ করেন, তখন তাকে বলা হয় মর্সিয়া। এই জাতীয় গানকে উৎকৃষ্ট পর্যায় নিয়ে গিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যদিকে কবিয়ালরা যখন বিস্তৃতভাবে নানাসুর বৈচিত্রের মাধ্যমে পরিবেশন করেন, তখন তাকে বলে  জারি গান। অনেক সময় মূল কবিয়ালের সাথে কিছু সহযোগী শিল্পী ধুয়া ধরেন। তখন তা হয়ে যায় ধুয়া গান। মূলত মুহররম উপলক্ষে এ তিনটি ধারায়ই গীত পরিবেশিত হয় গান।

সুফিবাদী গান
ইসলাম ধর্মের সুফিবাদী দর্শনে অনুসরণে রচিত গানকে সাধারণভাবে সুফিবাদী গান বলা হয়। বাংলাতে প্রধানত চার ধরনের সুফিবাদী গানের বিকাশ ঘটেছিল সুফিবাদি লোকশিল্পীদের দ্বারা। এগুলো হলো- নজরুল ইসলামের ইসলামি সঙ্গীত
বাংলা ইসলামি গানের অন্যতম দিকপাল হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ইসলামি গানের উল্লেখিত চারটি ধারার বাইরে নতুন আঙ্গিকে গান রচনা করেছিলেন। সব মিলিয়ে নজরুলের গানে যে সকল ধারার ইসলামি গান পাওয়া যায়, তা হলো-