বাউল
শ্রবণে, দর্শনে কিম্বা মননে বাউল শব্দটি আমাদের মনে করে দেয়, কোনো ঘরছাড়া উদাসী সাধকের কথা, কিম্বা কোনো এক বিশেষ দর্শনের কথা কিম্বা কোনো মরমী গানের কথা। মূলত বাউল হলো এসকল অর্থের বিচারে যে কোনো একটি, আবার একই সাথে সকল অর্থের সমাহার। আক্ষরিক অর্থের বিচারে যাই থাক, বাউলের ভিত্তি হলো বহুবিধ ধর্ম-দর্শনে সৃষ্ট একটি তত্ত্ব। এই তত্ত্বকে যিনি মান্য করে স্বতন্ত্র জীবপযাপনের পথ বেছে নেন, তিনি বাউল বা বাউল সাধক। এই তত্ত্বকে যখন বিশেষ সুরাঙ্গে গানে গানে প্রকাশ করা হয়, তখন তা হয়ে উঠে বাউল গান। তাই ব্যক্তি বাউল বা বাউল গানকে বুঝতে হলে- প্রথমে আসতে হয় বাউল তত্ত্বের পাঠশালায়।

বাউল তত্ত্ব
বাংলাদেশে বিকশিত এবং চর্চিত বিশেষ ধর্ম-দর্শনের নাম বাউলতত্ত্ব। দেশী-বিদেশী বহু ধর্মদর্শনের সংমিশ্রণে এই তত্ত্ব গড়ে উঠলেও, বাউলতত্ত্ব নিতান্তই বঙ্গদেশের। বাউলতত্ত্বের সাধকরা বেদ, বাইবেল বা কোরানের ম
তো মান্য করা যায়- এমন কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি। বাউলদের কাছে ধর্মগ্রন্থের চেয়ে গুরু বড়। বাউল সাধকরা কোনো অলৌকিক গল্পকথা দ্বারা নিজদের দর্শনকে মহিমান্বিত করার চেষ্টাও করেন নি। বাউল সাধকদের ভাবনা গ্রন্থাকারে প্রচারের পরিবর্তে সংক্রামিত হয়েছে শিষ্যদের কাছে, শিষ্যদের মাধ্যমে। সে কথাও আবার সবার জন্য হয়ে উঠে নি। কারণ গুরুর বারণ- 'বাউলের কথা বলিও না যথাতথা'। তাই বাউলতত্ত্ব পরিণত হয়েছে গুপ্তবিদ্যা। এ বিদ্যার পারিভাষিক শব্দাবলির গভীরে লুকিয়ে আছে তাত্ত্বিক রহস্যময়তা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বাউল গুরুরা নিজেরাই নিজেদের কথা রাখেন নি। কারণ তাঁরা তাঁদের গানে গানে সর্বজনের কাছে তত্ত্বের গোপন কথা প্রচার করেছেন। কিন্তু ভাবসন্ধানের বিচারে সে গান কি সকলের হয়ে উঠেছে? নিতান্তই শ্রোতা হিসেব যাঁরা সুরের মোহে বাউল গানে মুগ্ধ হন, ভাবসন্ধানে এসে তাঁরাই অসহায় বোধ করেন। গানের সুরে বাউল গান কাছে টানে, আর ভাবের সুরে বাউল মর্মের গভীর টেনে নিয়ে যায়।

আধুনিককালে আমরা তত্ত্বগত যা কিছু পাই, তার প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে আদিম মানুষের ক্রমবিবর্তনের তথ্যমালায়। তাই তত্ত্বের তথ্য পেতে হলে আমাদের কাঙালের মতো হাত পাততে হয়, আদিমকালের তথাকথিত অসভ্য মানুষের
কাছে। সে সব মানুষের ব্যবহার্য দ্রব্যাদি থেকে জীবনযাপনের হদিশ কিছুটা মেলে বটে, কিন্তু মনোদর্শন খোঁজাটা হয়ে যায় হাত বাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার মতো অলৌকিক। আদিম মানুষের অপরিসীম কল্পনার ভিতর দিয়ে জন্ম নিয়েছিল রূপকথা, ধর্ম বিশ্বাসের স্পর্শে এসে, তাই হয়ে হয়ে গেছে পৌরাণিক গল্পগাঁথা। তাই অন্যান্য তত্ত্বের উৎস সন্ধানে আমাদের কালস্রোতের ভাটি থেকে উজানের দিকে যেতে হবে। উজানের পথে ছড়িয়ে রয়েছে রাশি রাশি তথ্য-রত্ন। সে সব রত্নকে সযতনে পাঠ করে করে আরও সুদূর অতীতের ঠিকানা জেনে নিতে হবে। তাই যে কোনো তথ্যানুসন্ধান মাত্রেই অতীতের পানে যাত্রা। গবেষক বা ঐতিহাসিকরা হলেন যে যাত্রাপথের অভিযাত্রী মাত্র।

এই অভিযাত্রার আদি বিন্দু হিসেবে যদি, মানবজাতির উন্মেষকাল যদি নির্বাচন করি, তাহলে সেটাই হবে আমাদের অভিযাত্রার আদ্যবিন্দু। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে, বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন-
প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগে প্রাইমেট বর্গের হোমিনিডি গোত্রের হোমো (Homo) গণের অন্তর্গত Homo sapiens এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ (Jebel Irhoud) -তে। কালক্রমে  মরোক্কো থেকেই ইথিওপিয়া অঞ্চল পর্যন্ত এদের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল।

আদিতে এরা ছিল শিকারী। বন্য পশুপাখির মাংসের পাশাপাশি বনজ ফলমূলও আহার করতো। এর মধ্য দিয়ে মানুষ হয়ে উঠেছিল সর্বভুক প্রজাতি। কালক্রমে পরিবেশ এবং পরিস্থিতির মধ্য এরা ধীরে ধীরে কৃষিজীবী হয়ে উঠেছিল।

কৃষির সূচনা হয়েছিল নারীদের দ্বারা। আপন সত্তার ভিতরে গভীরভাবে
তারা অনুভব করেছিল তাদের সাথে ভূমির একাত্মতা। তাদের চেতনায় বিকশিত হয়েছিল,  পুরুষরূপ হলকর্ষণের দ্বারা নারী-স্বরূপ ভূমি গর্ভাধান উন্মুক্ত হয়। এরপর বীজবপন করলে শষ্যরূপী সন্তানের জন্ম হয়। মানুষের সন্তান-উৎপাদনের সাথে তুলনা করেই ভূমিকে তারা মান্য করতো 'জননী বসুন্ধরা' হিসেবে। এই ভাবনা থেকে বিকশিত হয়েছিল মৈথুনতত্ত্ব।  খাঁটি মৈথুনতত্ত্ব হলো- আদি নাস্তিক মতবাদের সূতিকাগৃহ। কালক্রমে এই মতবাদের সাথে দৈবশক্তির ভাবনা যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছিল পৌরাণিক বিশ্বাস।

ভারতের মৈথুন তত্ত্বের ক্রমবিবর্তনের ধারা
ভারতের আদিম জনগোষ্ঠীসমূহের ভিতর অনার্য প্রোটো-অস্ট্রালয়েড
দের দ্বারা আদিম কৃষির উদ্ভব ঘটেছিল। উল্লেখ্য, আফ্রিকার ইথিওপিয়া অঞ্চল থেকে একটি দল খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫ হাজার বৎসরের দিকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই সব দেশান্তরী মানুষের দ্বিতীয় দলটিকে বিজ্ঞানীরা প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নামে চিহ্নিত করেছেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫ হাজার বৎসরের দিকে এরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর খ্রিষ্টপূর্ব ৪০ হাজার বৎসরের দিকে এরা, সাগর পাড়ি দিয়ে অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রবেশ করেছিল। এরাই হলো অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। এদেরকে সাধারণভাবে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বলা হয়। ভারতবর্ষের বেশকিছু আদিবাসীকে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধারণা করা হয়, ভারতে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর পূর্বে।

এর পরে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে
দ্রাবিড় নৃগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৩৫০০ বৎসরের ভিতরে বসতি স্থাপন করেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে যে সকল নমুনা এই অঞ্চলের হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়ো থেকে পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে এরদের সভ্যতাকে সামগ্রিকভাবে 'সিন্ধু সভ্যতা' নামে অভিহিত করা হয়।

এরা
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের কৃষিকে গ্রহণ করেছিল। ধর্মীয় তত্ত্বের বিচারে এই সমাজেও মৈথুনতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। কালক্রমে আর্যদেরকেও মৈথুনতত্ত্ব নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। অনেক পরে সকল আদিম জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে যে মিশ্র ভারতীয় জাতি সত্তার গড়ে উঠেছিল, তাতে অর্ধ-নারীশ্বরের ভাবনা আর মৈথুন তত্ত্ব মিলেমিশে মিশ্র মতাদর্শের সৃষ্টি করেছিল। তবে বাঙালির কাছে আর্য দর্শনের চেয়ে অনার্যদের প্রভাবটা বেশি পড়েছিল। অনার্যদের ভাবনা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল সাংখ্যতত্ত্ব, তন্ত্রবিদ্যা (তন্ত্র মত), যোগশাস্ত্র। এই তিনটি তত্ত্ব এবং আদিম মৈথুনতত্ত্ব ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল আদি শৈব-শাক্ততন্ত্র এবং বৌদ্ধতন্ত্রে।

আদি শৈব-তান্ত্রিক ভাবনা ও সাংখ্যদর্শন
আদি শৈব-তান্ত্রিক শাক্ত ধর্মের নারীকে আদ্যাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলো। সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতি আর নারী সমার্থক হয়ে গেছে। অন্যদিকে শক্তিমান শিব হলো পুরুষ সত্তা। এই মতে নারীশক্তিতেই পুরুষ হয়ে উঠে শক্তিমান। মৈথুনতত্ত্বের নারী সত্তার সাথে পুরুষ সত্তার মৈথুনে সৃষ্টি হয়, নতুন সত্তা। আদি শৈব-তান্ত্রিক শাক্ত ধর্মের যোনি-প্রতিম পদ্ম হয়েছে পূজার উপাদান। এই পূজায় যুক্ত হয়েছে বীজমন্ত্র, যোগক্রিয়া, মুদ্রা ইত্যাদি। এসব সাধনার অঙ্গ নিয়ে তৈরি হয়েছে সাধনার গুহ্য পদ্ধতি।


এই পদ্ধতিতে পঞ্চমকার হিসেবে মাংস, মৎস্য, মদ্য, মুদ্র ও মৈথুন হয়েছে সাধনার অন্যতম উপায়। শাক্ত তান্ত্রিক মতে পরনারীর সাথে মৈথুনকর্মকে একটি প্রকৃষ্ট পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এদের চার প্রকার গুরু শিবের অংশ। এই চার গুরু হলেন- গুরু, পরমগুরু, পরমেষ্টি গুরু ও পরৎপরা গুরু। এই তন্ত্রের বলা হয়, মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে ছয়টি চক্র রয়েছে ।  এই ছয়টি চক্র হলো-মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুরি, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা চক্রএর সন্নিহিত পদ্ম (যোনি) এবং ইড়া, পিঙ্গলা এবং সুষুম্না নারীর প্রতীক। এই ষটচক্রের  নিচে রয়েছে চক্রাধার চক্র। এতে সৃষ্টিরূপা কুণ্ডলিনী ঘুমিয়ে আছে। আর উপরে রয়েছে শিব। যৌগক্রিয়া  সৃষ্টিরূপা কুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে পরম শিবের সাথে মিলন ঘটাতে পারলে ত্রিগুণাতীত শিবের উপলব্ধি অনুভব করা যায়। তাই এই সাধনায় নারীর প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বেশ্যা, নটী, রজকী ও ব্রাহ্মণীকে প্রকৃত যোগ্য সাধন সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বৌদ্ধতন্ত্রে সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতি ও পুরুষকে প্রজ্ঞা ও উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হিন্দুতন্ত্রের পদ্মচক্র বা ঘটচক্রকে বলা হয় পদ্ম বা চারচক্র। এই চক্রটি কায় নামে অভিহিত করা হয়। নাভির নিচের প্রথম চক্রটিকে বলা হয় 'নির্মাণকায়'। হৃদয়ে রয়েছে ধর্মকায় নামক দ্বিতীয় চক্র। কণ্ঠদেশে অবস্থিত তৃতীয় চক্র হলো সম্ভোগকায় আর চতুর্থ চক্রটি হলো সহজকায়। এর অবস্থান ব্রহ্মতালুতে। এদের সাথে যুক্ত করা হয়েছে সেবা, উপসেবা, সাধনা ও মহাসাধনা নামক চারটি সাধনাঙ্গ।  দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিবৃত্তি এবং দুঃখ নিবৃত্তির উপায় নামক চারটি আর্য সত্যও রয়েছে এর সাথে। বৌদ্ধতন্ত্রে ইড়া নামক নাড়ীকে বলা হয় ললনা, আলি, ধমন, চন্দ্র ইত্যাদি। পিঙ্গলার নাম রসনা, কালি, চমন, সূর্য ইত্যাদি। সষুম্না নাড়ীর নাম অবধূতী, দেবী, প্রজ্ঞা, নৈরাত্মা, যোগিনী, সহজ সুন্দরী ইত্যাদি। এই মতে ললনাকে প্রজ্ঞা বা চন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পক্ষান্তরে রসনাকে উপায় বা সূর্য বলা হয়। এই দুই নারীর মিলন হয় অবধূতীতে। এই মতে উপযুক্ত সাধনসঙ্গী হলো- ডোমিনী, চণ্ডালিনী ও ব্রাহ্মণী।

গৌতম বুদ্ধ গভীর ধর্মদর্শনে অজ্ঞ শিষ্যদের জন্য সাধনার উপায় হিসেবে কিছু আচার, মন্ত্র, মুদ্রা তৈরি করেছিলেন। পরে এই আচারই তান্ত্রিক বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। বুদ্ধের মৃত্যুর পর বিভিন্ন ধর্মগুরুদের দ্বারা বহু মন্ত্র তৈরি হয়। এই সূত্রে আদি শৈব-শাক্ততন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্র মিলে সৃষ্টি হয়েছিল যোগতন্ত্র-ভিত্তিক বৌদ্ধ মহাযান মত। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে ক্ষান্তি-পারমিতা, দান-পারমিতা নামক দেবীর উৎপত্তি ঘটে।  এই সময় বীজমন্ত্রেরও উদ্ভব হয়। মন্ত্রনির্ভর এই পূজা ও ধ্যান পরবর্তী সময়ে মন্ত্রযান পদ্ধতির সৃষ্টি করে। ধর্মীয় আচরণে ধীরে ধীরে নানা মতের সৃষ্টি হতে থাকে। পালবংশীয় রাজত্বকাল(৭৫০-১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ) বৌদ্ধ ধর্ম তিনটি মতে বিভক্ত হয়ে যায়। এই ভাগ তিনটি হলো- বজ্রযান, কালচক্রযান এবং সহজযান।

সহজিয়া বৌদ্ধ মতাদর্শ এবং শৈব তান্ত্রিক ভাবনা সংমিশ্রণে আদি বাউল ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। গোড়ার দিকে এই ধর্মে ছিল পরমাত্মা ও জীবাত্মার বিশ্বাস। ধ্যানের ভিতর দিয়ে পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়ার যোগাচারের সাথে যুক্ত হয়েছিল বামাচারী সাধনা।

১২০০ খ্রিষ্টাব্দের পরে বঙ্গদেশে মুসলমান সুফি সাধকদের সংস্পর্শে আসে বাউলরা। এই সব সুফিবাদীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে সুফিবাদ বাংলার বাউলদের প্রভাবিত করেছিল।

বাউলের আত্মপ্রকাশ
বহু ধর্ম-দর্শনের সমন্বয়ে খ্রিষ্টীয় ১৫শতকের ভিতরে একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে বাউলদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। সেকালের রক্ষণশীল সনাতন হিন্দু ধর্ম, শরিয়তী ইসলাম ধরম এবং রক্ষণশীল বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের কাছে এরা হয়ে উঠেছিল ধর্মবিচ্যুত অনাচারী মানুষ। গৃহীদের কাছে ছিল বাউলরা 'ছন্নছাড়া খ্যাপা পাগল'। এই ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই ১৪-১৫ শতকের বাংলার কবিদের বর্ণনায়।

বাউল শব্দটি উন্মত্ত বা পাগল অর্থে ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যে। যতদূর জানা যায়, সুলতান
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ  রাজত্বকালে (১৩৯৩-১৪০৯ খ্রিষ্টাব্দ), শাহ মুহম্মদ সগীর ইউসুফ-জোলেখা কাব্য রচনা করেন। এই কাব্যে তিনি বাউর, বাউল, আউল শব্দ ব্যবহার করেন। যেমন

                    বিরহে তাপিত কম্পিত হৃদয়
                    উরত লোরএ কেশ।
                    এলিন বয়ান কাতর নয়ান
                    আউল বাউল বেশ
শাহ মুহম্মদ সগীরের সময়, বাউলদেরকে (বাউর) অস্বাভাবিক, জাতকুলহীন নিচুস্তরের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সমাজের চোখে হীন এবং স্বভাবে উন্মাদ এমন ব্যক্তিকে বাউল নামে অভিহিত করা হতো। ইউসুফ-জোলেখা -এর একটি অংশে এমনভাবেই শাহ মুহম্মদ সগীর বাউলকে উপস্থাপন করেছেন।
                    সর্বক্ষণ উতরোল চিত্ত আসোয়াস্ত।
                    নিশি ন পোহা এ তার দিন ন জা এ অস্ত
                    জদি রাত্রি বিরাম উদয় ভেল ভানু
                    তার তাপে তাপিত কম্পিত সর্ব তনু
                    হেন গতি মদি জদি নৃপতি দেখিল।
                    বাউর চরিত্র হেন ভূপতি জানিল
                    লোকাচার জাতিকুল কিছু নাহি ভিত
                    সদয় উদাস বাস চিত্ত বিচলিত।

 আরও পরে
মালাধর বসু (গুণরাজ খান) তাঁর শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যে (রচনাকাল ১৪৭৩ থেকে ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দ) বাউল শব্দটি উলঙ্গ, উন্মত্ত বা পাগল অর্থে ব্যবহার করেছেন উপমা হিসেবে। যেমন
            মুকুল মাথার চুল            নাংটা যেন বাউল
                    রাক্ষসে রাক্ষসে বুলে রণ।

এসব উদাহরণ থেকে অনুমান করা যায়, বাউর, আউল, বাউল এই নামে কিছু লোকের অস্তিত্ব ছিল। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা ভাষায় বাউল শব্দের দ্বারা বুঝানো হয়েছে বাহ্যজ্ঞানহীন, উন্মাদ, স্বাভাবিক চেতনাশূন্য, খ্যাপা ইত্যাদি অর্থে। এই নামগুলো দিয়েছিলেন, যাঁরা বাউল
ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, যাঁরা প্রথাগত ধর্মমতের বাইরে এসে ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে পারেন নি। এরূপ ধারণার পিছনে বাউলদের জীবনযাত্রা ধরনও কম দায়ী নয়। অন্তত কয়েকটি কারণে বৈষয়িক মানুষ এবং মোল্লা-পুরুতরা বাউলদেরকে ভিন্ন জাতের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। যেমন

এই সময় হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মানুসারীদের কিছু মানুষ 'বাউল' মতবাদকে ধর্মের মতো মান্য করতে থাকে। উভয় ধর্ম থেকে আগত সাধকরা নিজ নিজ ধর্মের অনুসান থেকে বেরিয়ে এলেও বাউল-সাধনায় বৈষ্ণবমত, তন্ত্রমত, সহজিয়া বৌদ্ধমত, সুফিমতকে্রাধান্য দিয়েছিল এসকল মতাদর্শের সূত্রে সাধনার অঙ্গ হিসেবে বাউলরা গুরুভজনা এবং সাধনসঙ্গী প্রথা গ্রহণ করেছিল

খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাউলতত্ত্বের একটি বিশেষ ধারার উদ্ভব হয় আউল চাঁদ ফকিরের মাধ্যমে। তাঁর এই পথ বর্তমানে
কর্তাভজা নামে পরিচিত। 

বৈষ্ণবমত আর্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সনাতন হিন্দু ধর্মের বিবর্তিত মত। বাউল তেমন নয়। বাউল শুধুই বাংলার নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র মত।
বাউল দর্শনে সুফি, বৈষ্ণব মতের প্রভাব থাকলেও, এই ধর্মমত গড়ে উঠেছে স্থানীয় লোকাচার, স্থানীয় মানুষের সামাজিক এবং মানসিক মূলবোধের উপর ভিত্তি করে। এই কারণেই বাউলধর্ম কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মত নয়। যতদূর জানা যায়- খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাউল দর্শন গোপনীয় সাধন পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এই পর্যায়ে মাধব বিবি নামক জনৈকা মুসলমান রমণীর নাম পাওয়া যায়। এই মাধব বিবির শিষ্য ছিলেন বীরভদ্র (১৪৭৩-১৫৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)।  মূলত বীরভদ্রের মাধ্যমে বাউলদর্শন ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এই কারণে অনেকে বীরভদ্রকে আদি বাউল বলে থাকেন। বীরভদ্রের মাধ্যমে গুরু-শিষ্য পরম্পরা প্রতিষ্ঠাও পেয়েছে।

মাধব বিবির সমসাময়িক পরিমণ্ডলে আউল চাঁদ নামক আরও একজন সাধকের নাম পাওয়া যায়। নেকে আউল চাঁদকে বাউলমতের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। তবে এটাও অনুমান মাত্র। মাধববিবি ও আউলচাঁদের আগের কোনো গুরুর নাম পাওয়া যায় না বলেই, তাঁরাই এই মতের আদি প্রবর্তক এটাও মানা যায় না।

১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আউল চাঁদের সাথে রামশরণ পাল নামক অপর একজন সাধকের সখ্য গড়ে উঠে। কথিত আছে আউল চাঁদ রামশরণ পালকে 'কর্তাবাবা' অভিহিত করেছিলেন। আউল চাঁদের নেতৃত্বে রামশরণ এবং তাঁর স্ত্রী সরস্বতী 'কর্তাভজা' নামক বাউল মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করেন। রামশরণের মৃ্ত্যুর পর, তাঁর শিষ্যরা তাঁর পুত্র দুলাল চাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং কর্তাভজা মতকে প্রচার করেন। দুলাল চাঁদ 'কর্তাভজা' দল পরিচালনার পাশাপাশি গান রচনা করতেন। ১৩১৯ থেকে ১৩৮৪ বঙ্গাব্দের ভিতরে প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থে প্রায় ৬০০ গান পাওয়া যায়।
 

খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে, বাংলার তৎকালীন সমাজব্যবস্থা এবং ধর্মীয় প্রভাবে এবং সমন্বয়ে বাউলতত্ত্বের বিকাশ ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে। এই মতবাদের একটি প্রবল ধাক্কা লেগেছিল পদ্মার দুই পাড়ের কুষ্টিয়া ও পাবনা অঞ্চলে। সিরাজ সাঁই এবং লালন ফকিরের কল্যাণে বাউল গান একটি ভিন্নতর উৎকর্ষতায় পৌঁছেছিল। লালনের শিষ্যরা তাঁকে বয়ে চলেছেন আজও। যদিও নাগরিক সভ্যতার ছোঁয়ায় বর্তমানে বাউলধর্ম অনেকটা বিশৃঙ্খলদশায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু বিভিন্ন বাউল-আখড়ায় তার কমবেশি এখনো চর্চিত হয়ে থাকে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে বাউল গানের পরিবেশনার ধরনে।  

বাউল দর্শন ও গান
বাউলের এই দর্শন গড়ে উঠছিল একধরনের প্রতিবাদী সত্তা হিসেবে। তৎকালীন হিন্দু সমাজের বর্ণবৈষম্য, হিন্দু-মুসলামানের প্রথাগত ধর্মীয় অনুশাসন-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ এঁরা ভিন্ন আদর্শে নিজেদেরকে তৈরি করে নিয়েছিলেন। এদের মতবাদের অন্যতম প্রচার-উপকরণ হলো গান। এই গানে এঁরা প্রথাগত রাগরীতিকে অনুসরণ করেন নি। শাস্ত্রীয় বা নাগরিক গানের তালের পরিবর্তে, তাঁরা ভাবের দোলায় আপন ছন্দে গান বেঁধেছেন। এঁদের গানের ভাষা, চর্চাপদের মতই সন্ধ্যাভাষা। এ ভাষায় বাইরে এক কথা বলে, ভিতরে অন্য কথা থাকে। এ গানের বাইরে রূপ প্রতীকী। ভিতরের কথাটাই আসল। লালন যখন বলেন, 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়।' তখন আক্ষরিক অর্থে 'খাঁচা' এবং 'পাখি' মূল তত্ত্বকে প্রকাশ করে না। কিন্তু প্রতীকী 'খাঁচা' শব্দের মূল অর্থ যখন হয় 'দেহ' আর 'পাখি'র অর্থ হয় 'প্রাণ' বা 'মন' হয়, তখন ভাবের ঘরে নতুন চৈতন্যের উদয় । বহুদিন ধরে অজস্র বাউল গানের ভিতর দিয়ে বাউল দর্শন বর্ণিত হয়েছে। এ দর্শন এমনি প্রতীকী মোড়কে আবদ্ধ। গুরুর কাছে বসে শিষ্যর বাউলতত্ত্বের গোপন আয়ত্ত্ব করেন সযত্নে। তাঁদের কাছে এ সকল গানের ভাবের বিচার হয়, আরও গভীর তত্ত্ব কথায়। বাউল গানের সুরের ঢং রেখে গান বাঁধলেও বাউল গান হয় না। তার ভিতরে বাউল দর্শনও থাকা আবশ্যক।

বাউলগানে মৌলিক দর্শন যা পাওয়া যায়, তা হলো

বাউল গান ও সুর
বাউল গানে নিতান্তই প্রেম বা প্রকৃতির গান নেই। এদের গানের একমাত্র বিষয় বাউল ভাবনা কেন্দ্রিক তত্ত্বকথা। এদের গানে নানা ধরনের রূপক শব্দ পাওয়া যায়। যা ভাব প্রকাশের সহায়ক হলেও এর বাণী সাধারণ মানুষের কাছে সহজে ধরা দেয় না। বাউল গানের বাণী চর্যাপদের মতই সন্ধ্যা ভাষা। যেখানে বাইরে এক কথা থাকে কিন্তু ভিতরে অন্য ভাব থাকে।
গানের বাণীতে পাওয়া যায় প্রশান্ত ভাব, যা আধ্যাত্মিক দর্শনকে প্রকাশ করার জন্য অত্যন্ত উপযোগী।

বাউলের সুর লোকজ।
বাংলা লোকগানের প্রধান চারটি ধারার সুরের ভিতরে, বাউল সুর একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তবে সুরের কাঠামোগত রূপের ভিতরে পাওয়া যায় পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি এবং পশ্চিমবঙ্গের কীর্তনের প্রভাব।
উদ্দীপনামূলক গানে রয়েছে চঞ্চল গতি। আনন্দ প্রকাশের অঙ্গ হিসেবে গানের সাথে এরা নাচে। এদের নাচে ধরা-বাঁধা ছকে আবদ্ধ নয়। এ নাচে বন্ধনের আড়ষ্ঠতা নেই, আছে মুক্তির আনন্দ। বাউল নিজে নাচে যত, শ্রোতাকে নাচায় বেশি। বাউল ভাবের ঘোরে নাচে, আর শ্রোতা সে নাচে উদ্বেলিত হয়। বাউলের গানে তাল নেই, আছে ছন্দ। তালটা যান্ত্রিক বলে, তাতে আনন্দ কম। ছন্দ হলো নান্দনিক, তাই ছন্দ আনন্দময়। একালে তালে বেঁধে যে বাউল গান উপস্থান করা হয়, তাতে তালের শুদ্ধতা থাকে, কিন্তু অনেক সময় বাউল
গানের ছন্দটাই হারিয়ে যায়।


সূত্র: