উত্তর সঙ্গীত পদ্ধতিতে রাগাঙ্গ।
সাধারণভাবে বিলাবল অঙ্গের রাগের পরই কড়ি মধ্যমের মাধ্যমে এই অঙ্গের রাগের সূত্রপাত
ঘটে। সূর্যদয়ের সময় কড়ি মধ্যমের মাধ্যমে ললিত রাগ ভৈরব অঙ্গের পরিবেশ তৈরি হয়।
দিবসের দ্বিতীয় প্রহরে টোড়ি অঙ্গের সূচনা কড়ি মধ্যমের মাধ্যমে। টোড়ি অঙ্গের রাগের
ভিতরে সকালের রাগের প্রসন্নতা হ্রাস পায়। বেলা দ্বিতীয় প্রহরের শেষে এসে টোড়ি থেকে
আবার কড়ি মধ্যমের মাধ্যমে সূচিত সারং অঙ্গের। এই ধারায় প্রথম পাওয়া যায় শুদ্ধ সারং
ও গৌড় সারং। মূলত বেলা বাড়তে বাড়তে মধ্যাহ্নে যখন পৌঁছায় এবং তারপরে দিন সন্ধ্যার দিকে
চলতে থাকে।
প্রাচীন ভারতে
সারঙ্গ নামক একটি রাগের প্রচলন ছিল।
অহোবলের সঙ্গীত পারিজাত গ্রন্থে এই রাগের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হয়, এই
সারঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়েছিল সারঙ্গ অঙ্গের রাগসমূহ।
সারং
অঙ্গের রাগের আবশ্যকীয় সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ
-
ম গ
- মর প। মল্লারে এই
স্বরগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে র থেকে পা তে
দীর্ঘ
মীড়পাত হয়।
ম র মীড়পাত এই রাগের অন্যতম স্বরবিন্যাস।
সারং অঙ্গে
রপ রাগে ব্যাপ্তী কম
হয়।
প
র, প ম র, ণ প। এসকল স্বরে হ্রস্ব মীড়পাত হয়।
সকালের রাগগুলোর মতো
এই অঙ্গের রাগে
আরোহী বর্ণের প্রভাব বেশী
থাকে। কিন্ত প্রকৃতি রুক্ষভাবকে প্রশমিত করার জন্য অবরোহীর প্রাবল্য বৃদ্ধি করা হয়।
এই ভাবে সারং অঙ্গের রাগে দিবসের পূর্বভাগে এবং দিবসের শেষ ভাগের সমন্বিত রূপ পাওয়া
যায়। বিলাবলের অঙ্গের 'গমর' স্বর বিন্যাসের সাথে প্রবলভাবে যুক্ত হয় 'রমগ'
স্বরগুচ্ছ। এই প্রয়োগের ফলে বিলাবল অঙ্গ থেকে সারঙ্গ অঙ্গ একটি বিশেষ রূপ পায়। আবার
এই অঙ্গের যুক্ত করা হয়-
মর প স্বরগুচ্ছ। তবে মল্লারের চেয়ে সারং অঙ্গের রাগে ব্যাপ্তী কম
হয়।
গৌর সারংকে দুপুরের বেহাগ
বলা হয়। তাই গানে গৌড় সারংকে গ্রহণ করা হয়েছে অতিথির মতো। যার আগমনে প্রকৃতির
শ্রাবণের স্নিগ্ধ রূপ ফুটে উঠে। নূপুরনিক্কনের সুমধুর ধ্বনি যেনো আকস্মিকভাবে
মুখরিত করে তোলে। বন-কোকিলের মধুর ধ্বনির সাথে তমাল শাখায় যেন দোয়েল দোল খায়,
বনময়ূর সচকিত হয়ে যেন ডাকে কে-গো-কে।
গৌর সারং-এর আবির্ভাবে উত্তপ্ত হৃদয়ে যেন সজল মেঘের স্পর্শসুখ আবেশিত করে।
বকুল-কেয়া বন থেকে ছুটে আসে আনন্দ-চঞ্চল সমীরণ। অলস-দুপুরে যেন চন্দ্রালোকিত
রাত্রি আবেশ ছড়িয়ে পড়ে।
সারঙ্গ অঙ্গের রাগসমূহ
-
গৌড়সারং। এই রাগের অত্যাবশ্যকীয় স্বগুচ্ছ হলো- গ র স, গ র মগ, প হ্ম প। তবে এতে
সামান্য পরিমাণে গ ম র- এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য গ ম র হলো- বিলাবল
অঙ্গের স্বরগুচ্ছ। কিন্তু এই স্বরগুচ্ছের সাথে যখন ম র এবং প র মীড়পাতে
হয় তখন, সারং-এর একটি ভিন্নতর রূপ প্রকাশ পায়।
কাজী নজরুল ইসলাম, তাঁর
যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যমের গীতিআলেখ্যে গানের শুরুতে, যাম যোজনায় 'গৌড় সারং'
রাগের ভূমিকা এবং কড়ি মধ্যমের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এই
ব্যাখ্যটি নজরুল যুক্ত করেছিলেন এই গীতি আলেখ্যের আলোকে। নজরুলের পাণ্ডুলিপি
থেকে এ প্রসঙ্গে যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা হলো-
'টোড়ির পর যে সব সারং গীত হয় তার মধ্যে শুদ্ধ সারং ও গৌড় সারং ছাড়া অন্য
রাগে তীব্র মধ্যম নেই। গৌড় সারংকে দিনের বেহাগও বলা হয়। দুপুর বেলায় এই রাগ
গাওয়া হয়। এরও দুই মা। এর দুই মা'র উপরে সমান টান। এর চলন অত্যন্ত বাঁকা।
এর খেয়াল গান গাওয়া হচ্ছে শুন্লেই এর বাঁকা স্বভাবের পরিচয় পাবেন।
-
বড়হংস সারং
এই রাগের ম র মীড়পাত হয়। মধ্যম
মুক্ত এবং ন্যাস স্বর। ম র দিয়েই সারং-এর রূপ ধরে
রাখার চেষ্টা করা হয়। এর সরসঙ্গতিতে আরোহণে
শুদ্ধ নিষাদ এবং অবরোহণে কোমল নিষাদ ব্যবহার করা হয়। যেমন- স ন্ স্ র ণ্ স।
মর, ণ্ স সন্ স।
- বৃন্দাবনী সারং
এই রাগের ম র, ণ প, প র মীড়পাত হয়। সাধারণত সারং অঙ্গে র ম গ স্বরগুচ্ছ
ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বৃন্দাবনী সারং- গান্ধার ব্যবহৃত হয় না। তাই ম র দিয়েই
সারং-এর রূপ ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। এই রাগে দুই নিষাদ ব্যবহৃত হয়। এক
সময় বৃন্দাবনী সারং- শুধু শুদ্ধ নিষাদ ব্যবহৃত হতো। পণ্ডিত ভাতখণ্ডেজির
আয়োজনে অনুষ্ঠিত দিল্লী সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনীতে- সর্বসম্মতিতে উভয়
নিষাদের ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।
- মধুমাদ সারং
এই রাগের ম র, ণ প মীড়পাত হয়।
এছাড়া ফলে প র মীড়পাত বৃন্দাবনী সারং-এর চেয়ে বেশি
ব্যবহৃত হয়। এই রাগের চলন অনেকটা বৃন্দাবনী সারং-এর মতো। পার্থক্য হলো-
বৃন্দাবনী সারং-এ উভয় নিষাদ ব্যবহৃত হয়, কিন্তু মধুমাদ সারং-এ শুধই ণ ব্যবহৃত
হয়।
-
মিঞা কি সারং
এই রাগে আরোহণে শুদ্ধ নিষাদ এবং অবরোহণে কোমল নিষাদ ব্যবহৃত হয়। এর সাথে সারং
এর মিশ্রণে এই রাগের সৃষ্টি হয়েছে। এর পূর্বাঙ্গে সারং (পর, মর, ণপ) এবং
উত্তরাঙ্গে
মিঞা কি মল্লারর
-এর (ণ ধ ন র্স) প্রয়োগ হয়ে থাকে। উত্তরাঙ্গে মল্লার-এর রূপ ফুটে উঠে ণধনর্স এর মাধ্যমে। পক্ষান্তরে
পূর্বাঙ্গে ণপ মর সারং-এর রূপ ফুটে উঠে।
-
লঙ্কাদহন সারং
এই রাগে কোমল গান্ধার ব্যবহারের
ফলে, রাগরূপ সারঙ্গ অঙ্গের বাইরে চলে যায়। কোমল গান্ধার ব্যবহার করেও
কিন্তু কুশলতার সারঙ্গ অঙ্গকে প্রকাশ করা মধ্যেই রয়েছে- এই রাগ প্রকাশের মুন্সিয়ানা।
এই রাগে 'ণ ধপ' -এর পরিবর্তে 'ণ ধ ণ প' স্বরগুচ্ছ ব্যব্হার করা হয়।
- শুদ্ধ
সারং। প্রাচীন গ্রন্থাদিতে শুধু সারং নামটি পাওয়া যায়। এই রাগটি সারং
অঙ্গের আদি রাগ। বর্তমানে একে শুদ্ধ সারং নামে অভিহিত করা হয়। এর প্রধান
সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ- ম র, প ম র, প র, ণ প। এক্ষেত্রে প্রতিটি স্বরগুচ্ছে
হ্রস্ব মীড়পাত হয়। ম র, প ম র স্বরগুচ্ছ দ্বারা সারং অঙ্গের রাগ হিসেবে
প্রকাশিত হয়। এই রাগে কড়ি মা এবং শুদ্ধ মা-এর ব্যবহারের ফলে সারং অঙ্গের একটি
স্বতন্ত্র রাগ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এর আরোহণে মীড়পাত হয় না, তবে অবরোহণে মীড়পাত
আব্যশকীয় ক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- সামন্ত সারং
এই রাগে
দেশ
এবং
বৃন্দাবনী সারং -এর মিশ্রণ
লক্ষ্য করা যায়। এই রাগের ম র, ণ প মীড়পাত হয়। এ ছাড়া
ণ ধপ এবং ধ ণ প-এর ব্যবহারে এই রাগটি স্বতন্ত্র রূপ লাভ করে।
-
ধুরিয়া সারং
-
নুর সারং
-
ভীম সারং
-
রক্তহংস সারং
-
লুম সারং
-
শুক্ল সারং
-
সুর সারং
-
তথ্যসূত্র:
রাগ-রূপায়ণ। সুরেশচন্দ্র-চক্রবর্তী। ১৫ এপ্রিল ১৯৮৩।