দেবযানী
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা
{
হিন্দু পৌরাণিক সত্তা
|
ভারতীয় পৌরাণিক সত্তা |
পৌরাণিক সত্তা |
কাল্পনিক সত্তা |
কল্পনা |
সৃজনশীলতা |
কর্মক্ষমতা
|
জ্ঞান
দেবাসুরের মধ্যে যখন ত্রিলোকের ঐশ্বর্য নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ হয়
, তখন দেবতারা বৃহস্পতিকে এবং অসুরেরা শুক্রাচার্যকে পুরোহিত হিসাবে বরণ করেন। উল্লেখ্য শুক্রাচার্য অসুরদের রাজা বৃষপর্বার রাজ-পুরোহিত হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। দেখুন : শুক্রাচার্যদেবতা ও অসুরদের ভিতর যুদ্ধ শুরু হলে
, শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যার প্রভাবে নিহত অসুরদের জীবিত করতেন, কিন্তু এই মন্ত্র বৃহস্পতির জানা ছিল না বলে- দেবতাপক্ষের মৃত সৈনিকদের তিনি বাঁচতে পারতেন না। এই জন্য দেবতারা বৃহস্পতি-পুত্র কচকে এই মৃতসঞ্জবিনী বিদ্যা শিক্ষা করার জন্য শুক্রাচার্যের কাছে পাঠিয়ে দেন এবং নির্দেশ দেন যে, কচ যদি শুক্রাচার্যের প্রিয়কন্যা দেবযানীর প্রিয় হতে পারেন, তবেই তিনি এই মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শিক্ষা করতে সক্ষম হবেন। এরপর কচ নিজ গুণে শুক্রাচার্য ও দেবযানীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন এবং শেষ পর্যন্ত মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করতে সমর্থ হন। কচ দেবযানীর প্রণয়, কচের মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যালাভ ও কচ-দেবযানীর অভিশাপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, কচ চরিত্রের সাথে। দেখুন : কচদেবযানী ও শর্মিষ্ঠার বিবাদ : শর্মিষ্ঠা ছিলেন অসুর অধিপতি বৃষপর্বার কন্যা
। দুজন সমবয়সী হওয়ায় উভয়ের ভিতর বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও, দেবযানী বৃহস্পতির কন্যা হিসাবে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। এই শ্রেষ্ঠত্ববোধ থেকে দেবযানী ও শর্মিষ্ঠার বিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল। মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করে কচ স্বর্গে গেলে, দেবতারা ইন্দ্রকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। ইন্দ্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মর্তে নেমে এলেন। বৃষপর্বার রাজ্যের দিকে কিছুদূর আসার পর ইনি দেখলেন যে- একটি সরোবরের পারে, দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা তাঁদের সখীদের নিয়ে জলবিহার করছেন। ইন্দ্র আরও লক্ষ্য করলেন যে, এঁরা সবাই কাপড় খুলে রেখে নগ্ন অবস্থায় জলে নেমেছে। এরপর বাতাসের রূপ ধরে ইন্দ্র সকলের কাপড় একত্রিত করে দেন। স্নান শেষে সকলে পাড়ে উঠলে, শর্মিষ্ঠা ভুল করে দেবযানীর কাপড় গ্রহণ করেন। এতে দেবযানী অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে কটুবাক্য দ্বারা শর্মিষ্ঠাকে অপমান করেন। শর্মিষ্ঠাও সমভাবে এর উত্তর দেন। বিষয়টি ক্রমে ক্রমে তীব্র বিবাদে পরিণত হলে, শর্মিষ্ঠা ক্রোধে অধীর হয়ে দেবযানীকে এক কুপের মধ্যে নিক্ষেপ করে চলে যান। এই সময়ে রাজা যযাতি মৃগয়ায় এসেছিলেন। ইনি পিপাসিত হয়ে জলের খোঁজ করতে করতে, কূপে পতিত দেবযানীকে দেখতে পান। দেবযানীর কূপে পতিত হওয়ার কারণ অবগত হয়ে, যযাতি তাঁকে কূপ থেকে উদ্ধার করেন।এরপর দেবযানী তাঁর ঘূর্ণিকা নামক এক দাসীর দ্বারা শুক্রাচার্যের কাছে খবর পাঠান
। শুক্রাচার্য বনে এসে দেবযানীর কাছে সকল বিষয় জানতে পেরে, বৃষপর্বার দরবারে আসেন এবং বৃষপর্বার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। বৃষপর্বা সকল বিষয় শুনে দুঃখিত হয়ে শুক্রাচার্যের ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরপর শুক্রাচার্য বৃষপর্বাকে বলেন যে, তিনি দেবযানীকে কোনক্রমে সন্তুষ্ট করলেই তিনি ক্ষমা করবেন। বৃষপর্বা দেবযানীর নিকট উপস্থিত হলে দেবযানী বলেন, সহস্র কন্যার সহিত শর্মিষ্ঠা আমার দাসী হোক এবং আমার বিবাহ হলে তারা আমার সঙ্গে স্বামীগৃহে যাক। শুক্রাচার্যের ক্রোধ নিবারণের জন্যে এবং পিতার কল্যাণের জন্য, শর্মিষ্ঠা এই দাসীত্ব স্বীকার করে নেন।দেবযানী ও যযাতির বিবাহ : কিছুদিন পর দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা ভ্রমণ করার জন্য নিকটস্থ বনে যান
। এই সময় যযাতিও উক্ত বনে মৃগয়ায় আসেন। ইনি পিপাসার্ত হয়ে জল খুঁজতে খুঁজতে দেবযানীর দেখা পান। দেবযানীর সাথে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে, উভয়ে উভয়ের পরিচয় লাভ করেন। এই সময় দেবযানী জানতে পারেন যে, কূপ থেকে এই ব্যক্তিই তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন। পরে দেবযানী যযাতীকে স্বামী হিসাবে পাবার ইচ্ছা করলেও, যযাতি শুক্রাচার্যের অভিশাপের ভয়ে রাজী হলেন না। এরপর দেবযানী তাঁর দাসী ঘূর্ণিকে পাঠিয়ে শুক্রাচার্যকে উক্ত বনে আসার অনুরোধ করেন। শুক্রাচার্য উক্ত বনে এলে, দেবযানী যযাতির পরিচয় দিয়ে তাঁকে স্বামী হিসাবে পাবার কথা ব্যক্ত করেন। এরপর শুক্রাচার্য এই বিবাহে সম্মতি দেন। একই সাথে শর্মিষ্ঠাকে কখনো বিবাহ না করার নির্দেশ দেন। এরপর যযাতি দেবযানীকে বিবাহ করেন এবং শর্মিষ্ঠা ও তাঁর দুই সহস্র দাসী নিয়ে রাজধানীতে ফিরে আসেন।যযাতি ও দেবযানীর সন্তান লাভ : রাজধানীতে ফিরে
, দেবযানীকে অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন। পক্ষান্তরে শর্মিষ্ঠর জন্য একটি পৃথক বাড়ি তৈরি করে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এইভাবে এক হাজার বত্সর অতিবাহিত হয়। এই সময় যযাতির ঔরসে দেবযানী একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেন। এর নাম ছিল যদু।যযাতি-শর্মিষ্ঠার গুপ্তপ্রণয় ও সন্তান লাভ : ইতোমধ্যে যৌবনের কামনা পরিতৃপ্তি ও সন্তান লাভের আশায় শর্মিষ্ঠা অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন
। সেই কারণে একবার যযাতিকে একাকী পেয়ে তাঁর কাছে প্রেম নিবেদন করেন। যযাতি প্রথমাবস্থায় এই আবেদন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও, শেষ পর্যন্ত শর্মিষ্ঠার সাথে মিলিত হন। এই মিলনের ফলে শর্মিষ্ঠা দ্রুহ্য নামক একটি পুত্র লাভ করেন।দেবযানী শর্মিষ্ঠার সন্তান লাভের সংবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে
, শর্মিষ্ঠা একজন কল্পিত ঋষির সাথে মিলনের কথা বলে দেবযানীকে আশ্বস্ত করেন। এরপর দেবযানীর গর্ভে তুর্বসু নামে অপর একটি পুত্র জন্মলাভ করে। একই সময়ের ভিতর শর্মিষ্ঠা অনু ও পুরু নামক দুটি সন্তানের জন্ম দেন।একদিন দেবযানী শর্মিষ্ঠার পুত্রদের কাছে তাঁদের পিতার নাম জিজ্ঞাসা করায়
, পুত্ররা যযাতিকে পিতা হিসাবে দেখান। এরপর দেবযানী শর্মিষ্ঠার কাছ থেকে প্রকৃত বিষয় জেনে, কাঁদতে কাঁদতে শুক্রাচার্যের কাছে যান এবং সকল বিষয় খুলে বলেন। শুক্রাচার্য সকল বিষয় শুনে যযাতিকে অভিসক্পাত দেন- তুমি জরাগ্রস্ত হও। পরে এই শাপ প্রত্যাহারের জন্য যযাতি বহু অনুনয় করলে শুক্রাচার্য বলেন, তুমি ইচ্ছা করলে তোমার জরা অন্যকে দান করতে পারবে। যযাতি বলেন, আপনি অনুমতি দিন যে, যে পুত্র আমাকে তার যৌবন দেবে, সেই আমার রাজ্য পাবে। শুক্রচার্য বললেন, তাই হবে। এরপর দেবযানী ও শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত সকল পুত্রকে যযাতি তাঁর জরা গ্রহণ করে তার পরিবর্তে তাদের যৌবন দিতে বললেন, পুরু জরা গ্রহণ করে পিতাকে নিজের যৌবন ভোগ করতে দিলেন। অন্যান্য পুত্ররা এতে রাজী না হওয়ায়, যযাতি তাঁদের অভিশাপ দেন।যযাতির যৌবন লাভের পরবর্তী জীবন: যৌবন লাভ করে
, যযাতি ১০০০ বত্সর উভয় স্ত্রীর সাথে ইন্দ্রিয়সম্ভোগ করেন। এরপর কুবেরের চৈত্ররথ নামক উদ্যানে বিশ্বাচী নামক অপ্সরাকে দীর্ঘকাল ধরে ভোগ করেন। এরপরও তাঁর কামের উপশম না হলে, ইনি উপলব্ধি করলেন যে, পৃথিবীতে সমস্ত ধন ও সমস্ত রমণী উপভোগ করলেও তিনি তৃপ্ত হবেন না। তাই তিনি ভোগ-তৃষ্ণা ত্যাগ করে পুরুকে তাঁর যৌবন ফিরিয়ে দেন। এরপর ইনি পুরুকে রাজপদে অভিষিক্ত করে বানপ্রস্থ অবলম্বনপূর্বক কঠোর তপস্যা করেন। এই কারণে, মৃত্যুর পরে কিছুকাল তিনি স্বর্গসুখ ভোগ করেন। ইনি অহঙ্কারবশত নিজেকে শ্রেষ্ঠ ধার্মিক মনে করায় ইন্দ্রের অভিশাপে, স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে পতিত হতে থাকেন। পথের মধ্যে আকাশের যে স্থানে তাঁর দৌহিত্র অষ্টক, প্রতর্দন, বসুমনা ও শিবি বাস করছিলেন, সেখানে উপস্থিত হওয়ায় এঁরা যযাতির পরিচয় পেয়ে তাঁকে তাঁদের পুণ্যবলে আবার স্বর্গে প্রেরণ করেন।