রাধা
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা
{
পৌরাণিক সত্তা
|
কাল্পনিকসত্তা
|
কল্পনা
|
সৃজনশীলতা
|
দক্ষতা
|
জ্ঞান |
মনস্তাত্ত্বিক বিষয়
|
বিমূর্তন
|
বিমূর্ত-সত্তা
|
সত্তা
|}
হিন্দু
পৌরাণিক কাহিনিতে
এই নামে একাধিক
চরিত্র পাওয়া যায়। যেমন−
১. মহাভারতের মতে, অধিরথ নামক সুতারের স্ত্রী। কুন্তির প্রথম পুত্র কর্ণের জন্মের পর, কুন্তি তাকে জলে ভাসিয়ে দেয়। এই পুত্রকে উদ্ধার করে রাধা প্রতিপালন করেন। এই কারণে কর্ণের অপর নাম রাধাসুত।
২. শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়িনী। বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থে রাধার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা হলো−
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে, গোলকধামের রাসমণ্ডলে বিষ্ণুর অবস্থানকালে রম্যবনে প্রবেশ করেন। এই সময় তাঁর রমণ ইচ্ছা জাগ্রত হলে, তাঁর ডান অংশ থেকে কৃষ্ণমূর্তি ও বাম অংশ থেকে রাধা মূর্তি প্রকাশ পায়। রাধা কৃষ্ণকে কামাতুর দেখে তাঁর দিকে অগ্রসর হন। রা অর্থ লাভ এবং ধা অর্থ ধাবমান। ইনি অগ্রসর হয়ে কৃষ্ণকে লাভ করেছিলেন বলে- এঁর নাম হয়েছিল রাধা।
রাধার উদ্ভবকালে ষোড়শ বৎসর বয়স্কা, নৌবযৌবনা ছিলেন এবং সৌন্দর্যবতী ছিলেন। তিনি জন্মের পর পরই কৃষ্ণের প্রণয়িনীরূপে কৃষ্ণের বাম পাশে সিংহাসনে বসেন। এই সময় তাঁর প্রতিটি লোমকূপ হতে রাধার অনুরূপ অসংখ্য গোপাঙ্গনার জন্ম হয়। এই রাধাই পরবর্তী সময়ে বৃন্দাবনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
পদ্মপুরাণ ও ভাগবতের মতে- গোলকধামে কৃষ্ণের বামপাশ হতে রাধার উৎপত্তি হয়েছিল। জন্মের পর পরই ইনি কৃষ্ণের আরাধনা শুরু করেন। ইনি উৎপত্তিকালে ১৬ বৎসরের নব-যৌবনারূপে কৃষ্ণের সিংহাসনের বামপাশে অবস্থান নেন। এই সময় রাধার লোমকূপ হতে লক্ষকোটি গোপিকা ও কৃষ্ণের লোমকূপ থেকে লক্ষকোটি গোপের জন্ম হয়।
বৃন্দাবনে রাধার অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বিবৃত হয়েছে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে। এই পুরাণ মতে− একবার ভগবতী মহাদেবকে রাধিকার উৎপত্তির সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, মহাদেব ভগবতীকে জানান যে, গোলকধামের রাসমণ্ডলে বিষ্ণুর অবস্থানকালে রম্যবনে প্রবেশ করেন। এই সময় তাঁর রমণ ইচ্ছা জাগ্রত হলে, তাঁর ডান অংশ থেকে কৃষ্ণমূর্তি ও বাম অংশ থেকে রাধা মূর্তি প্রকাশ পায়। এরপর দীর্ঘদিন ধরে, কৃষ্ণ রাধার সাথে সেই রম্যবনে বিহার করেন।
একবার কৃষ্ণ রাধার অজ্ঞাতে বিরজা নামক এক গোপীর সাথে মিলিত হন। দূতীদের মুখে রাধা এই সংবাদ পেয়ে অনুসন্ধানের জন্য অগ্রসর হলে, সুদামা কৃষ্ণকে উক্ত সংবাদ দিয়ে সতর্ক করে দেন। কৃষ্ণ এই সংবাদ পেয়ে বিরজাকে ত্যাগ করে অন্তর্হিত হন। বিরজা এই দুখে প্রাণত্যাগ করে নদীরূপে প্রবাহিত হন। রাধা অকুস্থলে এসে কাউকে না দেখে ফিরে আসেন। পরে কৃষ্ণ তাঁর অষ্টসখাসহ রাধা কাছে আসেন। এই সময় রাধা কৃষ্ণকে তিরস্কার করতে থাকলে, সুদামা তা সহ্য করতে না পেরে-রাধাকে তিরস্কার করেন। রাধা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সুদামাকে অসুর হয়ে জন্মনোর অভিশাপ দেন। সুদামাও ক্ষুব্ধ হয়ে রাধাকে গোপী হয়ে পৃথিবীতে জন্মানোর অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, শত বৎসর কৃষ্ণবিরহ যন্ত্রণা ভোগ করার পর তিনি পৃথিবীতে কৃষ্ণের সাথে মিলিত হবেন। রাধার অভিশাপ, সুদাম অসুর হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। পৃথিবীতে সুদামের নাম ছিল শঙ্খচূড়।
অন্যদিকে সুদামের অভিশাপে রাধা বরাহকল্পে গোকুল নগরের বৃষভানুর কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। বৃষভানুর স্ত্রী কলাবতী বায়ুকে গর্ভে ধারণ করেন। কলাবতী বয়ু প্রসব কালে রাধার জন্ম হয়। রাধার বার বৎসর বয়স হলে, বৃষভানু রায়ান নামক এক গোপের সাথে রাধার বিবাহের ব্যবস্থা করেন। এই সময় রাধা নিজ ছায়া দিয়ে কৃত্রিম রাধা তৈরি করে অন্তর্হিতা হন। এই ছায়া-রাধার সাথে রায়ানের বিবাহ হয়। রাধার ১৪ বৎসর বয়সের সময়, কংসের হত্যার জন্য কৃষ্ণের জন্ম হয়।কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত
বসুদেব-এর ঔরসে দেবকীর অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। কংস নামক এক অত্যাচারী রাজার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে, ব্রহ্মা সকল দেবতাদের নিয়ে সমুদ্রের ধারে বসে বিষ্ণুর আরাধনা শুরু করেন। বিষ্ণু সে আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সাদা ও কালো রঙের দুটি চুল দিয়ে বললেন যে, বসুদেবের ঔরসে দেবকীর সন্তান হিসাবে কৃষ্ণ হয়ে জন্মাবেন। কৃষ্ণের প্রতীক হলো কালো চুল। তাঁর সহযোগী হবে বলরাম, এর প্রতীক সাদা চুল। এই জন্মে তিনি কংসাসুরকে হত্যা করবেন। উল্লেখ্য বসুদেবের অপর স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে বলরাম জন্মেছিলেন।
দেবকীর পিতা দেবক ও কংসের পিতা উগ্রসেন আপন দুই ভাই ছিলেন। সেই সূত্রে কংস ছিলেন দেবকীর কাকাতো ভাই অর্থাৎ কংস ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের মামা। দেবর্ষি নারদ এসে কংসকে কৃষ্ণ-বলরাম-এর জন্মের কারণ বর্ণনা করে যান। এই সংবাদ পেয়ে কংস দেবকীর গর্ভজাত সকল সন্তানকে জন্মের পরপরই হত্যা করতে থাকলেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয় দ্বাপর যুগের শেষে ভাদ্র-রোহিণী নক্ষত্রে, এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রিতে। জন্মের পরপরই বসুদেব কংসের ভয়ে এই শিশুটিকে ব্রজধামে নন্দের বাড়িতে রেখে আসেন এবং তাঁর সদ্যজাতা কন্যাকে আনেন। ব্রহ্ম-বৈবর্ত্ত পুরাণের মতে এই কন্যা ছিলেন দুর্গা। এই পুরাণে এই সদ্যজাতা কন্যাকে অংশা নামে অভিহিত করা হয়েছে। বিষ্ণুর অনুরোধে তিনি যশোদার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।রায়ান ছিলেন যশোদার ভাই, আর যশোদার পুত্র হিসেবে কৃষ্ণ ছিলেন রায়ানের ভাগ্নে। সেই সূত্রে রাধা ছিলেন কৃষ্ণের মামী। বৃন্দাবনে রাধার সাথে কিছুদিন শ্রীকৃষ্ণ প্রণয় করেন। পরে সুদামার অভিশাপে রাধা কৃষ্ণের বিচ্ছেদ ঘটে। উল্লেখ্য, বৃন্দাবনে কৃষ্ণের সাথে রাধা সহ অন্যান্য গোপিনীদের সম্পর্ক গড়ে উঠে। গোপীরা কৃষ্ণকে স্বামী হিসাবে পাবার জন্য একমাসের কাত্যায়ন ব্রত করেন। এই এক মাস গোপীরা দলবদ্ধভাবে যমুনা নদীতে এসে এক সাথে স্নান করতো। এই সময় গোপীরা সকল বস্ত্র নদীর পারে রেখে উলঙ্গ অবস্থায় নদীতে স্নান করতে নামতো। কৃষ্ণ এই ব্রতের শেষ দিনে গোপীদের অনুসরণ করে নদীর পারে আসেন। গোপীরা বস্ত্র ত্যাগ করে নদীতে নামলে কৃষ্ণ পরিত্যাক্ত বস্ত্রগুলি অপহরণ করেন। এরপর কৃষ্ণের কাছে গোপীরা নিজেদের সমর্পণ করে বস্ত্র সংগ্রহ করলেন। এরপর গোপীরা গৃহত্যাগ করে কৃষ্ণের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য কুঞ্জবনে আসে। এবং সেখানে গোপীরা ঈশ্বর জ্ঞানে তাঁর সাথে মিলিত হয়। কথিত আছে কৃষ্ণ নিজেকে গোপীদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। ফলে প্রতি গোপীই একই সময়ে কৃষ্ণের সান্নিধ্য পান। কংসবধের জন্য কৃষ্ণ বৃন্দাবন পরিত্যাগ করেন।
হিন্দু শাস্ত্রমতে রাধা ও কৃষ্ণের একত্রে উচ্চারণকালে রাধার নাম আগে নিতে হয়। সেই কারণে রাধাকৃষ্ণ উচ্চারণ শাস্ত্রসম্মত। কৃষ্ণরাধা উচ্চারণ করলে ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়। কার্তিকী পূর্ণিমার পূজা করে রাসোৎসব উপলক্ষে গোলকমণ্ডলের রাসমণ্ডলে বিষ্ণু রাসেশ্বরী পূজা করেন। এই পূজায় বিষ্ণু রাধাকবচ কণ্ঠে ও বাহুদেশে ধারণ করেন। এই সময় রাধা বিষ্ণুর পূজা করেন এবং বিষ্ণু রাধার পূজা করেন। [ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতি খণ্ড, ৪৮-৫০ খণ্ড]
রাধা বিভিন্ন নামে অভিহিতা হয়ে থাকেন। এর ভিতরে ১৬টি নাম পাপনাশক। এই নামগুলো হলো−
রাসেশ্বরী: শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় রাসেশ্বর। কৃষ্ণের পত্নী অর্থে রাধাকে বলা হয় রাসেশ্বরী।
রাসবাসিনী: রাসমণ্ডলে বাস করেন, তাই তিনি রাসবাসিনী।
রসিকেশ্বরী: সকল রসিকাদেবীগণের ঈশ্বরী, এই অর্থে রসিকেশ্বরী।
কৃষ্ণপ্রাণাধিকা: শ্রীকৃষ্ণের প্রাণাধিকা প্রেয়সী, এই অর্থে কৃষ্ণপ্রাণাধিকা।
কৃষ্ণপ্রিয়া: শ্রীকৃষ্ণের অতিশয় প্রিয় নারী, এই অর্থে কৃষ্ণপ্রিয়া। এর সমার্থক শব্দ বিষ্ণুপ্রিয়া।
কৃষ্ণস্বরূপিণী: অবলীলাক্রমে কৃষ্ণের বিধান সম্পন্ন করতে পারেন বলে, তিনি কৃষ্ণস্বরূপিণী।
বামাংশসম্ভূতা: বিষ্ণুর বামপার্শ্ব থেকে উৎপন্ন হন, এই অর্থে বামাংশসম্ভূতা।
পরমানন্দরূপিণী: রাধা স্বয়ং মূর্তিমতী পরমানন্দরাশি, এবং পরমানন্দরূপে বিরাজ করেন, এই অর্থে পরমানন্দরূপিণী।
কৃষ্ণা: কৃষ্ শব্দের অর্থ মোক্ষ (মুক্তি), এর সাথের ণ-এর অর্থ উৎকৃষ্ট। এর সাথে দানবোধক আ ধ্বনি যুক্ত হয়ে কৃষ্ণা শব্দের সৃষ্টি। সব মিলিয়ে কৃষ্ণা শব্দের অর্থ দাঁড়ায়, যিনি উৎকৃষ্টতর মুক্তি প্রদান করেন।
বৃন্দাবনী: বৃন্দাবনে সম্পূর্ণরূপে বিরাজিতা, এই অর্থে বৃন্দাবনী।
বৃন্দা: বৃন্দ শব্দের অর্থ সখী, আছে অর্থে আ মিলে তৈরি হয় বৃন্দা শব্দ। বৃন্দাবনে তাঁর লোমকূপ থেকে উৎপন্ন সকল সখীসহ বিরাজিতা ছিলেন, তাই তাঁর নাম বৃন্দা।
বৃন্দাবনবিনোদিনী: বৃন্দাবনে বিনোদ (আনন্দ) রূপে বিরাজ করেন, এই অর্থ বৃন্দাবনবিনোদিনী।
চন্দ্রাবলী: রাধার মুখমণ্ডল ও নখ চাঁদের মতো, তাই তিনি চন্দ্রাবলী।
চন্দ্রাকান্তা: রাধার মুখমণ্ডল সবসময় চাঁদের তূল্য, তাই তিনি চন্দ্রকান্তা।
শতচন্দ্রনিভাবননা: তাঁর মুখমণ্ডল সর্বদা শতচন্দ্রে প্রভা বিদ্যমান থাকে, তাই তিনি শতচন্দ্রনিভাবনা।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বৈষ্ণবরা নানাভাবে রাধাকৃষ্ণের পূজা করে থাকেন। দেবীভাগবতে রাধিকাপূজার মন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়।