বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী
১৮০৪- ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ
বাঙালি ধ্রুপদ শিল্পী, সুরকার এবং সঙ্গীত শিক্ষক।

পারাবারিক সূত্রে তিনি ছিলেন বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলার কায়েত পাড়ার অধিবাসী। পিতার নাম কালীপ্রসাদ চক্রবর্তী। তিনি এবং তাঁর অপর দুই ভাই কৃষ্ণপ্রসাদ ও দয়ানাথ  রাজা শ্রীশচন্দ্রের সভা গায়ক  হসনু খাঁ এবং তাঁর ভাই দেলওয়ার খাঁ ও কাওয়াল মিঞা মীরনের কাছে শিখেছিলেন ধ্রুপদ ও খেয়াল

১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে ২০ আগষ্ট তারিখে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে রাজা রামমোহন রায়, ব্রাহ্মসভা গঠন করেন।  ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে দয়াল নাথের মৃত্যর পর, কৃষ্ণপ্রসাদ ও বিষ্ণুচন্দ্র  ব্রাহ্মসমাজের গায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন।

এই সূত্রে তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'ছেলেবেলা' গ্রন্থে এই বিষয়ে লিখেছেন-
' এ দিকে বিষ্ণুর কাছে দিশি গান শুরু হয়েছে শিশুকাল থেকে। গানের এই পাঠশালায় আমাকেও ভর্তি হতে হল। বিষ্ণু যে গানে হাতেখড়ি দিলেন এখনকার কালের কোনা নামী বা বেনামী ওস্তাদ তাকে ছুঁতে ঘৃণা করবেন। সেগুলো পাড়াগেঁয়ে ছড়ার অত্যন্ত নীচের তলায়। দুই-একটা নমুনা দিই-

        এক যে ছিল বেদের মেয়ে
                        এল পাড়াতে
                সাধের উল্কি পরাতে।
        আবার উল্কি-পরা যেমন-তেমন
                লাগিয়ে দিল ভেল্কি
                        ঠাকুরঝি,
        উল্কির জ্বালাতে কত কেঁদেছি
                        ঠাকুরঝি!

আরো কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া লাইন মনে পড়ে, যেমন-
        চন্দ্র সূর্য হার মেনেছে, জোনাক জ্বালে বাতি।
                মোগল পাঠান হদ্দ হল,
                       ফার্সি পড়ে তাঁতি।
                          ...

গণেশের মা, কলাবউকে জ্বালা দিয়ো না,
    তার একটি মাচা ফললে পরে
        কত হবে ছানাপানা।

অতি পুরানা কালের ভুলে-যাওয়া খবরের আমেজ আসে এমন লাইনও পাওয়া যায়, যেমন-

এক যে ছিল কুকুর-চাটা
     শেয়ালকাঁটার বন
        কেটে করলে সিংহাসন।
বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীর গান শেখানোর ধরন ছিলে সেকালের ধরন থেকে আলাদা। এই প্রসঙ্গে তাঁর রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলাতে লিখেছেন-

বিষ্ণুচন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পুত্রদের অনেকের গানে তিনি সুরারোপ করেছিলেন। এঁরা তাঁর শেখানো হিন্দি গানের সুরের উপর কথা বসিয়ে নতুন গান্ রচনা করেছিলেন। এঁদের গানে সুরারোপের বিষয়ে জানা যায়- সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহমদ নগর থেকে গগনেন্দ্রনাথ ও দেবেন্দ্রনাথের কাছে লেখা চিঠি থেকে।  ২৪ জানুয়ারি ১৮৬৯ (রবিবার ১২ মাঘ ১২৭৫) সত্যেন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছিলেন- ইচ্ছা হয় সর্ব্ব ভুলে' মঙ্গলনিদান, বিঘ্নের কৃপাণ, মুক্তির সোপান', 'হে করুণাকর দীনসখা তুমি', দীন-দয়াময় ভুলো না অনাথে', 'কৃপাসাগর হে অখিল জগৎপাতা' গানগুলোকে বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীকে সুর করিয়ে নেওয়ার জন্য। এর পরে দেবেন্দ্রনাথকে তিনি দুটি গান পাঠিয়েছিলেন। গান দুটি ছিল- কৃপাসাগর হে অখিল জগৎপাতা' ও 'তুমি বিনা কে প্রভু শঙ্কট নিবারে'।

এই গানগুলোতে বিষ্ণুচন্দ্র সুরারোপ করেছিলেন। আদি ব্রাহ্মসমাজের চত্বারিংশ সাংবাৎসরিক উৎসবে- সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরে রচিত - 'তুমি বিনা কে প্রভু শঙ্কট নিবারে' 'হে করুণাকর দীনসখা তুমি', 'দরশন দেও হে কাতরে', 'কত যে করুণা তোমার ভুলিব না' পরিবেশিত হয়েছিল। অনুষ্ঠানে পরিবেশিত অপর গানটি ছিল-দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'কর তার নাম গান'। ২৪ জানুয়ারি ১৮৬৯-এর সত্যেন্দ্রনাথের লেখা চিঠি অনুসারে ধারণ করা যায়, এই গানগুলোর সুর করেছিলেন বিষ্ণুচন্দ্র ।  উল্লেখ্য স্বরলিপি-সহ গানগুলো প্রকাশিত হয়েছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা কার্তিক সংখ্যার ক্রোড়পত্র হিসেবে। স্বরলিপি করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর কিছুদিন পর তিনি ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম কেশবচন্দ্রের হাতে ন্যাস্ত করেন। পরে ধর্মীয় আদর্শের কারণে কেশবচন্দ্রের সাথে সংঘাত উপস্থিত হলে  ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হয়। কেশবচন্দ্রের অনুগামী সমাজের নাম হয় 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ', পক্ষান্তরে দেবেন্দ্রনাথের অনুগামী ধর্মের নাম হয়- 'আদি ব্রাহ্মসমাজ'।  এই সময় বিষ্ণু চক্রবর্তী ' আদি ব্রাহ্মসমাজ' সমাজের সাথেই থেকে যান।

১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি (২ ও ৩ ফাল্গুন ১২৭৬ বঙ্গাব্দ), হিন্দু মেলার চতুর্থ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে বিষ্ণুচন্দ্র জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। এই গানটি হলো সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত-
মিলে সবে ভারত সন্তান [তথ্য]

১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের গান শুনে মুগ্ধ হন। এই সূত্রে তিনি তিনি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষক হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্রকে পুরস্কৃত করেন।

১২৮৯ বঙ্গাব্দে (১৮৮২-১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) ব্রহ্মসমাজের গায়কের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর অবসরের বিষয়টি জানা যায় তত্ত্বোধিনী পত্রিকার ফাল্গুন ১৮৮৯ সংখ্যায় লিখিত বিবরণ থেকে।  বিবরণে বলা হয়-

'পঞ্চাশ বৎসর অতীত হইল মহাত্মা রামমোহন রায়ের সময় হইতে শ্রীযুক্ত বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী আদি ব্রাহ্মসমাজে অতি নিপুণতার সহিত সঙ্গীত করিয়া আসিয়াছেন। তিনি এক্ষণে বার্দ্ধক্য নিবন্ধন অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। অতঃপর ব্রাহ্মেরা এইরূপ মধুর কণ্ঠে ব্রহ্মসঙ্গীত আর শুনিতে পাইবেন কি না সন্দেহ। যাহারা শ্রদ্ধান্বিত হইয়া উপাসনায় যোগ দিয়া আসিয়েছেন, তাঁহাদের মধ্যে প্রায় এমন কেহই নাই বিষ্ণুর মধুর সঙ্গীতে যাঁহার অশ্রুপাত না হইয়াছে। বহু দিনের পর ব্রাহ্মসমাজে গায়কের একটী অভাব উপস্থিত হইল। পূরণ হইবে কি না ঈশ্বর জানেন।'

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যবরণ করেন।


সূত্র :