ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সানাই

গ্রন্থপরিচয়
দূরের গান
 | কর্ণধার | আসা-যাওয়া |  বিপ্লব | জ্যোতির্বাষ্প | জানালায় | ক্ষণিক | অনাবৃষ্টি | নতুন রঙ | গানের খেয়া | অধরা | ব্যথিতা | বিদায় | যাবার আগ | সানাই | পূর্ণা | কৃপণা | ছায়াছবি | স্মৃতির ভূমিকা | মানসী | দেওয়া-নেওয়া | সার্থকতা | মায় | অদেয় |  রূপকথায় | আহ্বান | অধীর | বাসাবদল | শেষ কথা | মুক্তপথে | দ্বিধা | আধোজাগা | যক্ষ | পরিচয় | নারী | গানের স্মৃতি | অবশেষে | সম্পূর্ণ |  দ্‌বৃত্ত | ভাঙন | অত্যুক্তি | হঠাৎ মিলন |  গানের জাল | মরিয়া | দূরবর্তিনী | গান | বাণীহারা | অনসূয়া | শেষ অভিসার |  নামকরণ | বিমুখতা | আত্মছলনা | অসময় | অপঘাত | মানসী | অসম্ভব ছবি | অসম্ভব | গানের মন্ত্র | স্বল্প | অবসান


বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্বিংশ খণ্ডের গ্রন্থপরিচয় অংশে লিখিত- এই গ্রন্থ সম্পর্কিত পাঠ।


  
'সানাই' ১৩৪৭ সালের শ্রাবণ মাসে [গ্রন্থে প্রথম প্রকাশের কাল 'আষাঢ়' মুদ্রিত হইয়াছিল; ঐ মাসেই গ্রন্থটি প্রকাশিত হইবার কথা ছিল, কিন্তু পরে নবরচিত আর কয়েকটি কবিতা কবি যোগ করেন। গ্রন্থাশেষে মুদ্রিত শ্রাবণ মাসে লেখা কবিতা-কয়টি দ্রষ্টব্য] প্রথম প্রকাশিত হয়। অধিকাংশ কবিতা সাময়িক পত্রে প্রকাশিত। নিম্নে প্রকাশসূচী সম্ভাব্যস্থলে পৃষ্ঠাঙ্ক মুদ্রিত হইল

দূরের গান
কর্ণধার
আসা-যাওয়া
বিপ্লব
জ্যোতির্বাষ্প
জানালায়
ক্ষণিক
নতুন রঙ
সানাই
স্মৃতির ভূমিকা
মানসী
সার্থকতা
মায়া
অদেয়
রূপকথায়
অধীরা
বাসাবদল
শেষ কথা
মুক্তপথে
আধোজাগা
যক্ষ
পরিচয়
নারী
গানের স্মৃতি
অবশেষে
সম্পূর্ণ
উদ্‌বৃত্ত
অত্যুক্তি
হঠাৎ মিলন
দূরবর্তিনী
বাণীহারা
অনসূয়া
শেষ অভিসার
বিমুখতা
অসময়
অপঘাত
মানসী
প্রবাসী। চৈত্র ১৩৪৬।৮০১
'লীলা' : প্রবাসী। অগ্রহায়ণ ১৩৪৬।১৬১
কবিতা। আষাঢ় ১৩৪৭।‌১
কবিতা। চৈত্র ১৩৪৬।‌১
দেশ। ২৮ বৈশাখ ১৩৪৭
প্রবাসী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭।১৪৬
কবিতা। আষাঢ় ১৩৪৭।‌২
'গোধূলি' : জয়শ্রী। চৈত্র ১৩৪৬
প্রবাসী। ফাল্গুন ১৩৪৬।৫৭১
প্রবাসী। ভাদ্র ১৩৪৬।৫৯৯
'ছিন্নপত্র' : পরিচয়। শ্রাবণ ১৩৪৬।১
প্রবাসী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭।১৪৫
প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৫।৪৬৫
প্রবাসী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬।১৫৭
'গান' : বঙ্গলক্ষ্মী। পৌষ ১৩৪৬
বিচিত্রা। বৈশাখ ১৩৪৫।৪২৫
প্রবাসী। আশ্বিন ১৩৪৬।৭৪৩
পরিচয়। বৈশাখ ১৩৪৬
কবিতা। পৌষ ১৩৪৩।১
রূপ ও রীতি। বৈশাখ ১৩৪৭
প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৫।৪৬৩
প্রবাসী। কার্তিক ১৩৪৬।১
চতুরঙ্গ। আশ্বিন ১৩৪৫
'তোমারে কি চিনিতাম আগে' বিচিত্রা। অগ্রহায়ণ ১৩৪৫
'পালাশেষে' : জয়শ্রী। আষাঢ় ১৩৪৬
পরিচয়। চৈত্র ১৩৪৫
'গান' : বৈজয়ন্তী। কার্তিক ১৩৪৬
পরিচয়। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬।৪৬৭
বিচিত্রা। শ্রাবণ ১৩৪৫।১
'অলস মিলন' : কবিতা। আশ্বিন ১৩৪৪।১
'গান' বঙ্গলক্ষ্মী। বৈশাখ ১৩৪৬
প্রবাসী। বৈশাখ ১৩৪৭।৬৩
সমসাময়িক। আষাঢ় ১৩৪৭
প্রবাসী। ভাদ্র ১৩৪৭।৫৫৭
সাহানা। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭
প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৭।৪৭০
প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৭।৪২১


    রবীন্দ্রসদনের পাণ্ডুলিপির সাহায্যে বর্তমান সংস্করণে অনেকগুলি কবিতার রচনাস্থান ও তারিখের নির্দেশ সংযোজিত হইয়াছে।
    'কর্ণধার; কবিতাটির প্রথম রচনা ও উহার ক্রমবিবর্তনের পরিচয়-স্বরূপ 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের প্রাসঙ্গিক কিয়দংশ নিম্নে উদ্‌ধৃত হইল

        একদিন সুন্দর রোদ উঠেছে, আকাশে অল্প অল্প শরৎকালের [?] মেঘ, মংপুর পক্ষে দিনটা ঈষৎ গরম বলা যেতে পারে। এখানকার কুয়াসার বন্ধন মোচন ক'রে যেদিন রোদ উঠত উনি [রবীন্দ্রনাথ] খুব খুশি হয়ে উঠতেন। যথারীতি বারান্দার বড় চৌকিটাতে বসে আছেন। আমরা খাবার ঘর থেকে গুন্ গুন্ গান শুনতে পাচ্ছি। খাওয়াদাওয়া শেষ ক'রে বারান্দায় এলাম আমরা।
    "আজ চমৎকার দিনটি হয়েছে। কেবল কুঁড়েমি করতে ইচ্ছে করছে, তাই এই চৌকিতে হেলান দিয়ে বসেই আছি, বসেই আছি।'" গান গেয়ে যেতে লাগলেন,
"হে তরুণী তুমি আমার ছুটির কর্ণধার। আজ সমস্ত দিনটা যেন ছুটিতে পাওয়া। কাজের দিন নয় এ, তাই বসে বসে গাইছি হে তরুণী, তুমিই আমার ছুটির কর্ণধার, অলস হাওয়ায় দিচ্ছ পাড়ি নিয়ে যাবে কর্মনদীর পার। হে তরুণী " সে সুর মনে আছে। ইসারায় বল্লেন কলমটা দাও। প্যাড আর কলম এগিয়ে দিলুম। গান গেয়ে লিখে চল্লেন  

                                হে তরুণী তুমিই আমার ছুটির কর্ণধার
                                অলস হাওয়ায় বাইচো স্বপনতরী
                                            নিয়ে যাবে কর্মনদীর পার।

    প্যাডটা নিয়ে গুন গুন করে গেয়ে চললেন। বিকেল বেলা যখন ফিরে এলুম, দেখি লেখাটা প্রায় সবই বদল হয়ে গেছে এবং বিচিত্রিত ভাবে আগেকার লেখাটিকে কালির আচ্ছাদনে মণ্ডিত ক'রে আঁকা হয়েছে সুন্দর একটি ছবি, তাঁর ফাঁকে ফাঁকে নূতন যে লেখাটা পড়া যাচ্ছে
 

 

কে অদৃশ্য ছুটির কর্ণধার
অলস হাওয়ায় দিচ্ছ পাড়ি
      কর্মনদীর পার।
দিগন্তরের কুঞ্জবনে
অশ্রুত কোন্ গুঞ্জরণে
বাতাসেতে জাল বুনে দেয়
      মদির তন্দ্রার।
নীল নয়নের মৌনখানি
সেই সে দূরের আকাশবাণী
দিনগুলি মোর ওরি ডাকে
যায় ভেসে যায় বাঁকে বাঁকে
      উদ্দেশহীন অকর্মণ্যতার।

মংপু   [কবিতাটির এই পাঠের রচনার স্থানকালনির্দেশ মূল পাণ্ডলিপি হইতে উদ্‌ধৃত হইল।]
২৩।৫।৩

    প্যাডটা ফেলে দিলেন "লও, কপি কর খাতায়।" তার পরদিন সকালবেলায় খাতাটা দিয়ে বল্লেন "হে তরণী, আর একবার কপি করতে হচ্ছে।" তখন দেখি কবিতাটা আরো অনেক বদলে গেছে, তার প্রথম লাইনটা হয়েছে "কে অসীমের লীলার কর্ণধার।" এমনি ক'রে পরিবর্তিত পারবর্ধিত হতে হতে বেশ কয়েকদিন পরে সে এক সম্পূর্ণ অন্য কবিতা হয়ে দাঁড়াল
 

  ছুটির কর্ণধার
দখিন হাওয়ায় দিচ্ছ পাড়ি,
            কর্মনদী পার।
নীল আকাশের মৌনখানি
আনে দূরের দৈববাণী
মন্থর দিন তারি ডাকে
যায় ভেসে যায় বাঁকে বাঁকে
ভাঁটার স্রোতে উদ্দেশহীন
          কর্মহীনতার
তুমি তখন ছুটির কর্ণধার
শিরায় শিরায় বাজিয়ে তোলো
         নীরব ঝংকার
ইত্যাদি।

কয়েক মাস পরে যে তার সংস্করণ 'সানাই'-তে প্রকাশ হ'ল তাকে আর চেনবার জো নেই।
                                                             
মংপুতে রবীন্দ্রনাথ। পৃ ১৭৭-৭৯

    সানাই প্রকাশের পূর্বে ১৩৪৬ অগ্রহায়ণের প্রবাসীতে 'লীলা' নামে উক্ত কবিতাটির আর-একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পাঠ মুদ্রিত হইয়াছিল

 

            লীলা

      ওগো কর্ণধার
সৃষ্টি তোমার ভাসান খেলায়
      লীলার পারাবার।

আলোক-ছায়া চমকিছে
ক্ষণেক আগে, ক্ষণেক পিছে,
পূর্ণিমারে ফুটিয়ে তোলে
      অমার অন্ধকার।
ছুটির খেলা খেলাও কর্ণধার,
     ডাইনে বাঁয়ে দ্বন্দ্ব লাগে
           সত্যের মিথ্যার।

      লীলার কর্ণধার
জীবন নিয়ে মৃত্যুভাঁটায়
      চলেছ কোন্ পার।
   নীল আকাশের মৌনখানি
   আনে দূরের দৈববাণী,
   গান করে দিন উদ্দেশহীন
      অকূল শূন্যতার।
   তুমি ওগো লীলার কর্ণধার
      রক্তে বাজাও রহস্যময়
           মন্ত্রের ঝংকার।

অলস ক্ষেতের পোড়ো ভূমে
আগাম ফসল মগন ঘুমে।
      অগোচরে মাটির নীচে
      সোনার স্বপন অঙ্কুরিছে,
      আলোর পানে কান্না ওঠে
            খবর না পাই তার।
      তুমি করো লীলার কর্ণধার
           শ্যামল ঢেউয়ের তাল-সাধনা
                 দিগন্ত-দোলার।

তাকিয়ে থাকে নিমেষহারা
দিনশেষের প্রথম তারা।
      ছায়াঘন কুঞ্জবনে
      মন্দমৃদু গুঞ্জরণে
      বাতাসেতে জাল বুনে দেয়
               মদির তন্দ্রার।
      তুমি তখন লীলার কর্ণধার
           গোধুলিতে পাল তুলে দাও
                 ধূসরচ্ছন্দার।

অস্তরবির ছায়ার সাথে
লুকিয়ে আঁধার আসন পাতে।
      ঝিল্লিরবে গগন কাঁপে,
      দিগঙ্গনা কী জপ জাপে,
      হাওয়ায় লাগে মোহপরশ
                রজনীগন্ধার।
      তুমি তখন লীলার কর্ণধার
              নীরব সুরে বেহাগ বাজাও
                    বিধুর সন্ধ্যার।

রাতের শঙ্খকুহর ব্যেপে
ওঙ্কাররব ওঠে কেঁপে।
      বিশ্বকেন্দ্রগুহা হতে
      প্রতিধ্বনি অলখ স্রোতে
           শূন্যে করে নিঃশবদের
                 তরঙ্গ বিস্তার।
      তুমি তখন লীলার কর্ণধার
           তারার ফেনা ফেনিয়ে তোলো
                 আকাশগঙ্গার।

   মংপু
১৪।১০।৩৯

আলোচ্য কবিতার সানাইয়ে মুদ্রিত পাঠের অস্তিম স্তবকটি সর্বশেষে সংযোজিত হয়। তৎপূর্বে 'উদীচী ২৫।১।৪০' তারিখের রচনা অনুযায়ী (পাণ্ডুলিপি) কবিতাটি প্রথম পাঁচ স্তবকে সমাপ্ত ছিল।
      'আসা-যাওয়া' কবিতার সহিত তুলনীয় সমকালীন একটি রচনা কৌতুহলী পাঠকদের জন্য পাণ্ডুলিপি হইতে উদ্‌ধৃত হইল। ইহাকে আলোচ্য কবিতার পূর্বপাঠ বলা সমীচীন না হইলেও ভাবের বিচারে পূর্বাভাস বলা চলে

 

নির্জন রাতে নিঃশব্দ চরণপাতে কেন এলে,
দুয়ারে মম স্বপ্নের ধন সম এ যে দেখি
      তব কণ্ঠের মালা এ কী গেছ ফেলে,
            জাগালে না শিয়রে দীপ জ্বেলে
এলে ধীরে ধীরে নিদ্রার তীরে তীরে
      চামেলির ইঙ্গিত আসে
            যে বাতাসে লজ্জিত গন্ধ মেলে।
বিদায়ের যাত্রাকালে পুষ্প-ঝরা বকুলের ডালে
      দক্ষিণ পবনের প্রাণে
রেখে গেলে বল নি যে কথা কানে কানে,
      বিরহবারতা
অরুণ আভার আভাসে রাঙায়ে গেলে।

    উদয়ন
চৈত্র ১৩৪৬


    নিম্নোদ্‌ধৃত গানটিও [ ইহা দ্বিতীয়সংস্করণ গীতবিতানের প্রথম বা দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হয় নাই; পরবর্তী এবং প্রচলিত গীতবিতানের তৃতীয় খণ্ডে বা অখণ্ড গীতবিতানে সংকলিত এবং তৎপূর্বে সঙ্গীত-বিজ্ঞান-প্রবেশিকার ১৩৫০ কার্তিক-সংখ্যার ১৭২ পৃষ্ঠায় স্বরলিপিসহ মুদ্রিত হয়। উক্ত পত্রিকায় গানের পঞ্চম ছত্রে 'নিল যবে' স্থলে 'দিনু যারে' এবং সপ্তম ছত্রে 'তখন' স্থলে 'তখনো' মুদ্রিত হইয়াছে।] এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য

 

প্রেম এসেছিল
      নিঃশব্দ চরণে
তাই    স্বপ্ন মনে হল তারে
         দিই নি তাহারে আসন।
বিদায় নিল যবে শব্দ পেয়ে
                  গেনু ধেয়ে

সে তখন স্বপ্ন কায়াবিহীন
    নিশীথতিমিরে বিলীন,
          দূর পথে দীপশিখা
             রক্তিম মরীচিকা।

    উদয়ন
২৮ চৈত্র ১৩৪৬


 'বিপ্লব' কবিতার সংক্ষিপ্ত একটি পূর্বপাঠ পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া গিয়াছে। নিম্নে তাহা মুদ্রিত হইল

 

                  নির্দয়া

ডমরুতে নটরাজ বাজালেন যে নাচের তাল
                   হে নটিনী
সে কি ছিন্ন করে নাই ঐ তব ঝংকৃত কিঙ্কিণী।
                তোমার কুন্তলজাল
          বেণীর বন্ধনমুক্ত উদ্দাম উচ্ছ্বাসে
      উচ্ছৃঙ্খল উড়ে নি কি খঞ্ঝার বাতাসে।
বিদ্যুৎ-আঘাতে দীর্ণ হল ঐ তমিস্রাযামিনী
         তোমার দিগন্তে হে নটিনী।
   নিষ্ঠুর চরণপাতে মুগ্ধদের গাঁথা ফুলমালা
বিস্রন্ত দলিত দলে বিতীর্ণ করেছ রঙ্গশালা।
         মোহমদিরায় পূর্ণ কানায় কানায়
                 যে পাত্রখানায়
            উচ্ছলি পড়িত রসধারা
        আজ তার পালা হল সারা।
      বাজে ডঙ্কা, শঙ্কা লাগে মনে
হে নির্দয়া, কী সংকেত স্ফুরে তব কঙ্কণে কঙ্কণে।

    উদীচী। শান্তিনিকেতন
       ১৬।১।৪০

'মানসী' (পৃ ৮৭) কবিতা রচনার ইতিহাস নবজাতক গ্রন্থের 'সাড়ে নটা' (পৃ ৪১) কবিতার সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই প্রসঙ্গে 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের নিম্নোদ্‌ধৃত বিবরণ প্রণিধানযোগ্য

      সকাল সাড়ে নটা দশটার সময় খাওয়া হয়ে গেলে বসবার ঘরে এসে বসতেন একটা চৌকিতে, হাতে থাকত একটা বই বা কোনো মাসিক পত্র রেডিওতে বাজত সুশ্রাব্য অশ্রাব্য মেশানো প্রোগ্রাম, কিছু শুনতেন, কিছু শুনতেন না। 'ইয়োরোপের সংগীত শুনছিলুম গো আর্যে, কী আশ্চর্য এই যন্ত্রটা। কোন্ সুদূর থেকে কত রাজ্য পার হয়ে ভেসে আসছে এই সুরধ্বনি। সে দেশে এখন কত কাণ্ডই চলেছে, মারামারি হানাহানি, সব পার হয়ে আসছে একখানি সুর, তার মধ্যে একটুও ছায়া পড়ে নি সেখানকার জীবনের। যেখানে এই গান গাওয়া হচ্ছে সেখানেও তো নানা রকম ব্যাপার চলেছে, নানা রকম ঘটনাপ্রবাহ। কত লোক আসছে যাচ্ছে যে গান গাইছে তারও একটা অস্তিত্ব আছে, কিন্তু সে সমস্তকে বাদ দিয়ে একটি সকল সম্পর্ক-রহিত নিরাসক্ত সুরের ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে। মনে পড়ে যখন বোটে বসে লিখতুম, চারিদিকে জল বয়ে চলেছে মৃদু কলধ্বনিতে, দূরে দেখা যায় বালির চর ধূ-ধু করছে, আমি লিখেই চলেছি লিখেই চলেছি "মানসী" (মানসসুন্দরী)। যখন শুরু করেছিলাম তখন ঝাঁ ঝাঁ করে রোদ্‌দুর, তার পরে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এল আলো, আকাশ রঙীন ক'রে অস্ত গেল সূর্য। একটি চাকর বোটে থাকত আমার নীরব সঙ্গী, সে কখন নীরবে মিট্‌মিটে প্রদীপ রেখে চলে গেল। আমি লিখেই চলেছি মানসী। আজ কোনো কাজ নয়, সব ফেলে দিয়ে ছন্দ-বন্ধ-গ্রন্থ-গীত এসো তুমি প্রিয়ে! কোথায় গেল সেই দিন। সেই পদ্মার চর, ধূ ধূ করে সোনালী বালি সেই মিট্‌মিটে শিখার ম্লান আলো, সব চিহ্ন ধুয়ে মুছে গেছে, শুধু আছে মানসী, তার যে পরিবেশ ছিল সে তো লুপ্ত হয়ে গেল্য এমন কি তার থেকে সম্পূর্ণ বাদ পড়ে গেছে তার কবিও। চারিদিকের সমস্ত সুত্র তার ছিন্ন, সে শুধু একখানি সুত্রছিন্ন বাণী।... তোমার এই রেডিওর গান শুনছি আর এই সব ভাবছি।"
      সেই দিন একটা প্রকাণ্ড কবিতা লিখেছিলেন এ বিষয় নিয়ে। তারপর পরিবর্তন করতে করতে একটা কবিতা থেকে দুটো কবিতা হয়। তার একটি 'সাড়ে নটা' নামে নবজাতকে, আর একটি 'মানসী' নামে সানাইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
                                                              
মংপুতে রবীন্দ্রনাথ। পৃ ৯১-৯৩

      'সার্থকতা' কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে প্রেরিত শ্রীমতী মৈত্রেয়ীদেবীর একটি কবিতার উত্তরে প্রথম লিখিত হইয়াছিল, 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' (পৃ ৬৩-৬৫) গ্রন্থে এইরূপ লেখা হইয়াছে।
      'রূপকথায়' ১৩৪৬ সালে শান্তিনিকেতনে 'ডাকঘর' অভিনয়ের অসমাপ্ত এক আয়োজন উপলক্ষে গান রূপে প্রথম রচিত হয়। নাটকটির তৃতীয় দৃশ্যে "ফকিরবেশী ঠাকুরদা"র ভূমিকায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ইহা গাহিবার কথা ছিল।
      'বাসাবদল' কবিতার একটি পূর্ববর্তী পাঠে পাণ্ডুলিপিতে সূচনাংশ নিম্নমূদ্রিত আকারে পাওয়া যায়

 

       এল এবার জিনিস প্যাকের দিন।
বালিগঞ্জে বাসা ছেড়ে যাব ব্যারাকপুরে।
      অবিনাশের আনুকূল্য এই দশাতেই জোটে
              চাইতে না চাইতেই,
      কাজ পেলে সে ভাগ্য বলেই মানে,
             খাটে মূটের মতো।
আর সবারে বোঝা তো নয় সহজ ব্যাপার,
কেবল জানি এই অবিনাশ নিতান্ত নিশ্চিত
                 সময় অসময়ে।
           বিমুখা বান্ধবা যান্তি
      শুনি নাকি ধর্ম কেবল থাকে
               আর এই অবিনাশ।
           জিনিসপত্র ছড়াছড়ি,
      লালন ক'ষে আস্তিন গুটিয়ে।
ওডিকলোন মুড়ে নিল পুরোনো এক আনন্দবাজারে
                                                            ইত্যাদি।

    তৎপূর্বের অন্য একটি পাণ্ডুলিপিতে 'বাসাবদল' (পৃ ৯৬) ও 'পরিচয়' (পৃ ১০৫) এই উভয় কবিতা'র গদ্যছন্দে-লিখিত একটি অবিচ্ছিন্ন আদিপাঠ পাওয়া গিয়াছে। অপ্রকাশিতপূর্ব এই রচনাটির নাটকীয় সুসম্পূর্ণতা কবিতা দুইটির রসগ্রহণে পাঠকদের সবিশেষ সাহায্য করিবে বলিয়া মনে হয়
    নমস্কার কবি। চিনতুম না তোমাকে, চেয়েছিলুম চিনতে, চেনা হয়ে গেছে, আর বেশি সইত না, দাঁড়ি পড়েছে ঠিক জায়গায়।
    বাঙালীর মেয়ে, অত্যন্ত করে জানি ঘরের লোকদের। লোভ ছিল অজানা জগতের পরিচয়ে। বয়স ছিল কাঁচা, সদ্য বেরিয়েছি কলেজের মধ্যপথ থেকে। আমার বিশ্ববৃত্তান্তে সব চেয়ে অজানা রহস্য কবি।
    তখনো চোখে দেখি নি, অনিলবাবু, তোমাকে। পড়েছি তোমার লেখা, ছবি এসেছে মনে, স্বপ্নের ঘোড়ায় চড়ে তুমি খুঁজতে বেরিয়েছ তোমার মানসীকে। রূপকথার রাজপুত্তুর তুমি
  জগতে একটিমাত্র আছে রাজকন্যা, বিদেশী সমুদ্রের ওপারে, সে আছে তোমারই জন্যে।
      তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে এমন কথা যদি মনে করে থাকি যেন আমিই সেই রাজকন্যা তবে হেসো না। দেখা হবার আগেই ছুঁইয়েছিলে রুপোর কাঠি, জাগিয়েছিলে সুপ্ত প্রাণকে। ঐ বয়সে অনেক মেয়ে মনে করেছিল ঐ একই কথা। তারা চিঠি লিখেছিল, ঠিকানা দেয় নি।
      খেয়াল, মাঝ বসন্তের খেয়াল। ওরই আড়ালে কতদিন আবছা হয়ে গেছে দুপুরবেলাকার পরীক্ষার পড়া, বুকের মধ্যে হঠাৎ উছলে উঠেছে একটা যৌবনের ঢেউ।
      একেই বলে রোম্যান্‌স্, নবীন বয়সে আপনা-ভোলানোর শিল্পকলা। মনের দেহলিতে এঁকেছি আলপনা, কার পা ফেলবার পথে। আরো কিছুদিন যেত, বয়েস পেরিয়ে যেত বিশেষ কোঠা, গোটাকতক মডার্ন নভেল পড়া হত শেষ, চোখের ঘোর যেত কেটে, হাসতুম নিজের কচিমেয়েপনায়। তার দৃষ্টান্ত দেখেছি কত।
      সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ের দল আছে আই.এ.ক্লাসের শেষ সীমানায়, চশমা চোখে পড়ছে কীট্‌সের কবিতা, না-দেখা- নাইটেঙ্গলের না-শোনা সুরে ব্যথিয়েছে তাদের বুকের পাঁজর, হৃদয়বাতায়নের ঝরোকা খুলে গেছে ফেনায়িত সমুদ্রের জনশূন্যতায় উজাড় কোন্ পরীস্থান। অনিলবাবু, তোমার সঙ্গে শুভদৃষ্টির লগ্ন ছিল সেই আলো-আঁধারের ঝিকিমিকিতে। তখন কত দিন দুলেছে কত ঘরের কোণে তোমার কলামূর্তি তরুণীর আর্তচিত্তের রহস্যদোলায়।
      তার পরে দেখি, দেখতে দেখতে সেই মেয়েদের সময় বয়ে যায়। এসে পড়ে যুগান্তর, ছেঁড়া মোজা সেলাইয়ের, নতুন বাজারে সওদা করতে পাঠাবার ফর্দ লেখার, চায়ের সভার হাঁটুজল বন্ধুত্বের।
      আমার ভাগ্যে রোম্যান্‌সের ঘনসজল আষাঢ়ে দিন তখনো ফুরোয় নি
  সেই রসাভিষিক্ত বাদল-বেলায় আলাপ হল তোমার সঙ্গে। অচেনাকে চেনা হল শুরু রোমাঞ্চিত মনে।

      চেনার প্রথম অধ্যায়েই ধরা পড়ল তুমি একেবারেই দুর্লভ নও। মায়ার টান তো দেখি আমাদেরই দিকে। লক্ষ্যসন্ধানের আগেই ধরা পড়বার মতো তোমার ভাব। এত সহজ মৃগয়ায় পরীক্ষাই হয় না ব্যাধের গুণপনার।
      উলটে গেল পালা। পথ চেয়ে বসেছিলুম ধরা দেব বলে, ধরবার খেলা হল শুরু। দুঃখ এই তুমি দুর্লভ নও। হায় আমার রাজপুত্র, একটু স্পর্শ লাগতেই তোমার মুকুট পড়ল খসে ধুলোয় আমার পায়ের কাছে, সংকোচে, চাইলুম পা সরিয়ে নিতে
  তুমি বললে, থাক্ থাক্।
      সেদিন আমার ফাঁদ পাতা ছিল বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে
  কলকণ্ঠের কাকলিতে, মানঅভিমানের ছলনায়, অকারণ হাসির কল্লোলে। রসে রঙে এ ঘরের বেড়াজাল ছিল ঠাসবুনুনি করা। তুমি তোমার দিগ্বিজয়ী চালের মন্থর ভঙ্গীতে পা ফেললে ঠিক তার মাঝখানটাতে। বারে বারে চেয়ে দেখলুম কটাক্ষে, মনে মনে হাসলুম তোমার দুই চক্ষুর বিহ্বলতায়।
      কোন্ ফাঁকে এসে পড়ল আর
-
এক মায়াবিনী রণিতা। আমরা এক ব্যবসায়ের ব্যবসায়িনী। দেখলুম তার ফাঁসটাতে অল্প-একটু টান দিতেই বন্দী তখনি এক দিক থেকে আর-এক দিকে পড়ল হেলে। ভোজের বাহুল্যে ওর ক্ষুধা হয়েছিল অলস, সেই শিথিল অবস্থায় পথ্য ছিল তড়িদ্‌বেগে এক চুমুকের সুধারস। সেটা বুঝে নিয়েছিল যাদুকরী।
      বোধ হয় জান না মেয়েতে মেয়েতে বাজি রাখা পণ আছে ভিতরে ভিতরে। রণিতা এল আমার দরজায়। আমার মুখে সে চাইলে, আমি চাইলুম তার মুখে। পাশা ফেলল তার হাতের এক ঘুরুনিতেই, এক দানেই হল জিত। তুমি গেলে চলে, মনেও পড়ল না একটা সামান্য রকম অছিলা করে যেতে।
      হাসতে চেষ্টা করি সঙ্গিনীরা যখন শুধায় হল কী। রণিতাকেও একদিন জবাব দিতে হবে ঐ প্রশ্নরই শুকনো হাসি দিয়ে। বেশি দেরি নেই।

      পালা ফুরল, এবার প্যাক করতে হবে। অনাহূত সাহায্য করতে এল রমেশ
  ঐটুকুই তার লাভ। লেগে গেল আস্তিন গুটিয়ে। কাঁচের শিশি মুড়তে লাগল খবরের কাগজে, কিছু বা জড়িয়ে দিল ছেঁড়া মোজায়। চামড়ার বাক্সোয় সাবধানে সাজিয়ে দিলে হাত-আয়না, রুপোর বাঁধানো চিরুনি, নখ-কাটা কাঁচি, চুলের তেল, ওটেনের মলম, পাউডারের কৌটো, সাবানের বাটি। অবসাদের ভারে অচল ছিল আমার মন, গা লাগছিল না কিছুতে হাত লাগাতে, কেবল বসে বসে ছিঁড়ছিলুম কুটিকুটি ক'রে পুরনো চিঠিগুলো। ব্যবহার-করা শাড়িগুলো নানা নিমন্ত্রণদিনের ফিকে গন্ধ মিলিয়ে দিল ঘরের হাওয়ায়। সেগুলো বিছিয়ে বিছিয়ে দুই হাতে চেপে চেপে পাট করে দিতে অসম্ভব সময় নিচ্ছিল রমেশ। আমার জরির-কাজ-করা স্লিপারের এক-একটা পাটি নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুছে দিচ্ছিল কোঁচার কাপড়ে, কোনো আবশ্যক ছিল না। চৌকির উপর দাঁড়িয়ে দেয়াল থেকে সে খসিয়ে নিল ছবিগুলো। মোটা কার্পেটটা গুটিয়ে-সুটিয়ে দিলে সরিয়ে ঘরের এক ধারে। মেঝের উপর ছড়িয়ে রইল ছেঁড়া চিঠির টুকরো। এল কুলির দল, আসবাবগুলো তুলে দিল মালগাড়িতে।
      শূন্য হয়ে গেল ঘর, কোথায় মিলিয়ে গেল তার স্বপ্নরূপ, তার রঙিন মায়া। যে কেউ কোথাও নেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে ফ্যাকাসে দেয়াল অবুঝের মতো।
      আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দেবার জন্যে শেষ পর্যন্ত রইল রমেশ। বললে, চিঠি লিখো কেমন থাক।
      আমার রোম্যান্‌সটুকু স্বপ্ন মাপের পেয়ালায়। এখনো তলায় কিছু রস আছে বাকি, আর কিছু আছে ব্যথা। আর দেরি হলে হাসির লেশও থাকত না, চোখের জলও যেত শুকিয়ে।
      ভাবছি মনে এসব কী বকচি। ভারতচন্দ্রে আছে 'সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর'।
      এতক্ষণ বিস্তর কথা বলা হল শেষকালে দাঁড়াল সব তার মিছে। কী করে বললুম, তোমাকে চিনেছি। তোমাকে ভোলাতে বসলুম, আপনাকে ভোলালুম, এই কি চেনবার রাস্তা। যে বিস্ময়দৃষ্টি দিয়ে তুমি দেখেছ এই জগৎকে সেই দৃষ্টি দিয়ে যদি আমি চাইতুম তোমার দিকে তা হলেই দেখতুম তোমার সত্যকে। ঢাকা দিলুম তোমাকে মায়া দিয়ে, তোমার বিশ্বনিখিল থেকে সরিয়ে এনে কেটে ছেঁটে ছোটো করে তোমাকে ধরাতে চাইলুম আমার এই আড়াইশো-টাকা-ভাড়া ফ্ল্যাট্‌টাতে। আজ আমার চেয়ে তোমাকে দেখাচ্ছে ছোটো, আর বলছি তোমাকে চিনেছি।
                                                         -রবীন্দ্রসদনস্থ পাণ্ডুলিপি

    উপরের রচনাটির প্রথমার্ধ অনেক সংশোধন ও সম্মার্জন করিয়া রবীন্দ্রনাথ উহা পরে প্রতিমা দেবীকে আলমোড়ায় পাঠাইয়াছিলেন। কৌতূহলী পাঠক প্রতিমা দেবীর 'চিত্রলেখা' গ্রন্থের ভূমিকা ও 'মন্দিরার উক্তি' লেখাটি এই প্রসঙ্গে দেখিতে পারেন। সেখানে 'অনিলবাবু'কে বদলাইয়া 'নরেশবাবু' করা হইয়াছে।
      'নারী' (পৃ ১১০) কবিতার সাময়িক পত্রে প্রকাশিত পাঠে কিছু কিছু পাঠান্তর পাওয়া যায়। প্রথম দিকে 'সেই আদি.......সংগোপনে' পাঠ সাময়িক পত্রে এইরূপ ছিল

 

তাহারি সংকল্পচ্ছবি বিধাতার মনে
     আছে তাঁর তপস্যার সংগোপনে।
         সেই আদি ধ্যানমূর্তিটিরে
              সন্ধান করিছে ফিরে ফিরে
                                  রূপকার।

    অন্যান্য পাঠান্তর  'রক্তিম হিল্লোল' স্থলে 'মদির হিল্লোল'। 'শাস্ত্রবচনের ঘের' স্থলে 'বচনের ঘের'। 'সকলি ফেলিয়া দূরে' স্থলে 'সকলি করিয়া দূর'। পরের ছত্রে 'সুরে' স্থলে 'সুর'। 'ভুবনমোহিনী' স্থলে 'ভুবনমোহন'। 'মর্তের মদিরা-মাঝে' স্থলে 'মর্ত্যের রূপের মাঝে'।

      শেষ অংশের ('আদিস্বর্গলোক...সহচরী') পাঠ এইরূপ ছিল

 

যেন সর্ব পুরুষের নির্বাসিত মন
      রূপ আর অরূপের ঘটায় মিলন।
মনে পড়ে যেন কবে ছিল অন্যলোকে
             অপূর্ব আলোকে।
      তারি ছবি আনে ধ্যানে ধরি
সেথায় যে ছিল তার চিরসহচরী।

 

'নামকরণ' (পৃ ১২৭) কবিতার একটি পূর্বতন পাঠ পাণ্ডুলিপি হইতে নিম্নে মুদ্রিত হইল

 

            নামকরণ
পাড়ার সবাই তারে ডাকে
      আদরের নামে সুনয়নী,
বানান বদল ক'রে দিয়ে
      আমি তারে ডাকি শুনায়নী।
বাদল-বেলায় গৃহকোণে
রেশমে পশমে জামা বোনে,
নীরবে আমার লেখা শোনে
      তাই সে আমার শোনা-মনি।
কাব্য বোঝে কি নাই বোঝে,
      শোনে, তাই ডাকি শুনায়নী।
প্রচলিত ডাক নয় এ যে
দরদীর মুখে ওঠে বেজে,
পণ্ডিতে দেয় নাই মেজে,
      অশুদ্ধ ভাষা এর খনি
ভদ্ররীতির অভিধানে
      মেলে না কোনোই এর মানে,
বর্বর ঠেকে তার কানে
      ভাষায় যে কড়া সনাতনী।
নূতন চোখে যে ওরে দেখি,
সাধুভাষা সে দেখাতে ঠেকি
আদরের টানে গেছে বেঁকি
      নিয়েছে নূতনতরো ধ্বনি।
সেও জানে আর জানি আমি
এ মোর নেহাত পাগলামি,
এ ডাকে চকিত তার দেহে
      কঙ্কণ উঠে কনকনি।
সে হাসে আমিও তাই হাসি
      জবাবে ঘটে না কোনো বাধা

ব্যাকরণ-বর্জিত ব'লে
      মানে আমাদের কাছে সাদা।
কেহ নাহি জানে কোন্ খনে
      কবিতার ছন্দের সাথে
পশমের শিল্প তোমার
      মিলে যায় সুকুমার হাতে
              শুনায়নী, ওগো সুনয়নী।

'বিমুখতা'র (পৃ ১২৮) অন্য দুইটি পাঠ পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়

 

           বিমুখ

হঠাৎপ্লাবনী যে মন নদীর প্রায়
অভাবিত পথে সহসা বাঁকিয়া যায়।
      সে তার সহজ গতি,
এ বিমুখতায় যার হোক যত ক্ষতি।
বাঁধা পথে তারে বাঁধিয়া রাখিবে যদি
বর্ষা নামিবে যবে, অবাধ্য নদী
বারে বারে ফিরে ভাঙিয়া ফেলিবে কূল,
সে ভাঙন সাথে ভাঙিবে তোমার ভুল।
      স্বেচ্ছাপ্রবাহবেগে
দুর্দাম তার ফেনিল হাস্য
      উচ্ছ্বসি উঠে জেগে।
প্রাণের প্রচুর পণ্য আহরি
ভাসাইয়া দিলে ভঙ্গুর তরী,
উচ্ছ্বাসে তারে পাষাণে আছড়ি
      করিবে সে পরিহাস,
খেলার ছলেতে ঘটাবে সর্বনাশ।
এ খেলারে যদি খেলা বলে মান,
এ হাসিতে যদি হাসিবারে জান,
      তবেই তোমার জয়।
সহজের স্রোতে সহজ মনেই
      ভাসিয়া চকিতে হয়।
মূল্য যাহার আছে একটুও
সাবধান হয়ে দূরে তারে থুয়ো,
এ স্রোতের সাথে বাঁধা পড়িয়ো না
      পণ্যের ব্যবহারে।
ঘাটে ফিরে এসে তবে হাঁফ ছেড়ো
      শান-বাঁধা তার ধারে।
যদি পার তবে কাটিয়ো সাঁতার,
সাধ করিয়ো না তলিয়ে যাবার,
নিজেরে ভাসায়ে রাখিতে না জান
      বসে থেকো দূর পারে। 

      বিমুখতা

যে মন হঠাৎ-প্লাবনী নদীর প্রায়
অভাবিত পথে কখন বাঁকিয়া যায়
      সে তার সহজ গতি,
এ বিমুখতায় হোক-না যতই ক্ষতি।
বাঁধা পথে তারে বাঁধিয়া রাখিবে যদি
বর্ষা নামিলে খরপ্রবাহিণী নদী
      ফিরে ফিরে তার ভাঙিয়া ফেলিবে কূল,
                ভাঙিবে তোমার ভুল।
স্বৈরপ্রবাহবেগে
      দুর্দাম তার ফেনিল হাস্য
              উচ্ছ্বসি উঠে জেগে।
প্রাণের প্রচুর পণ্য আহরি
ভাসাইয়া দিলে ভঙ্গুর তরী,
উচ্ছ্বাসে তারে পাষাণে আছাড়ি
      করিবে সে পরিহাস।
খেলার ছলেতে ঘটাবে সর্বনাশ।
এ খেলারে যদি খেলা বলি মান,
হাসিতে হাস্য মিলাইতে জান,
      তবেই তোমার জয়।
সহজের স্রোতে সহজ মনেই
      ভাসিয়া চলিতে হয়।
পেয়েছি বলিয়া যদি জাগে অহমিকা
তা হলে কপালে বিদ্রূপ আছে লিখা।
আলগা লীলায় নেই দেওয়া নেই পাওয়া
সহাস নয়নে শুধু দূর থেকে চাওয়া,
      মানবমনের রহস্য কিছু শিখা।
মূল্য যাহার আছে কোনো একটুও
সাবধান হয়ে তারে দূরে দূরে থুয়ো,
সাঁতার কাটিয়া যদি সেটা জানা থাকে,
তলিয়ে যেয়ো না আওড়ের কোনো পাকে,
      নিজেরে ভাসায়ে রাখিতে না জান
              ভরসা ডাঙার পারে,
ঘাটে ফিরে এসে তবে হাঁফ ছেড়ো
      শান-বাঁধা তার ধারে।

২৯।৫।৪০

'সানাই' গ্রন্থের অনেকগুলি ছোটো ছোটো কবিতার স্বতন্ত্র সংগীতরূপ প্রচলিত আছে। কোথাও বা গান আগে রচিত হইয়াছে, কোথাও বা কবিতা। তুলনামূলক পাঠের উদ্দেশে কবিতাগুলির দ্বিতীয়সংস্করণ-গীতবিতানে-মুদ্রিত সংগীতরূপ যথাক্রমে নির্দেশ করা হইল-

 

কবিতা   গীতিরূপান্তরের প্রথম ছত্র    রচনাকাল
আসা-যাওয়া  প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে  
অনাবৃষ্টি  মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন  
নতুন রঙ   ধূসর জীবনের গোধুলিতে ক্লান্ত মলিন সেই স্মৃতি  
                  এবং  ধূসর জীবনের গোধুলিতে ক্লান্ত আলোয় ম্লানস্মৃতি  
গানের খেয়া আমি যে গান গাই জানি নে সে কার উদ্দেশে  
অধরা   অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে  
ব্যথিতা   ওরে জাগায়ো না, ও যে বিরাম মাগে  
বিদায় বসন্ত সে যায় তো হেসে, যাবার কালে  
যাবার আগে  এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে  
পূর্ণা

ওগো তুমি পঞ্চদশী

 
কৃপণা এসেছিনু দ্বারে তব শ্রাবণরাতে  
ছায়াছবি  আমার প্রিয়ার ছায়া     ২৫।৮।১৯৩৮
দেওয়া-নেওয়া   বাদলদিনের প্রথম কদমফুল পুনশ্চ। ৩০।৭।১৯৩৯
আহ্বান  এসো গো, জ্বেলে দিয়ে যাও ১।৮।১৯৩৯
দ্বিধা  এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে  
আধোজাগা    স্বপ্নে আমার মনে হল  
উদ্‌বৃত্ত  যদি হায়, জীবনপূরণ নাই হল  
ভাঙন  তুমি কোন্‌ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে  
গানের জাল  দৈবে তুমি কখন নেশায় পেয়ে  
মরিয়া

আজি মেঘ কেটে গেছে সকালবেলায়

 
গান যে ছিল আমার স্বপনচারিণী  ৮।১২।১৯৩৮
বাণীহারা

বাণী মোর নাহি

 
আত্মছলনা    দোষী করিব না, করিব না তোমারে