ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্বিংশ খণ্ডের গ্রন্থপরিচয় অংশে লিখিত- এই গ্রন্থ সম্পর্কিত পাঠ।
দূরের গান কর্ণধার আসা-যাওয়া বিপ্লব জ্যোতির্বাষ্প জানালায় ক্ষণিক নতুন রঙ সানাই স্মৃতির ভূমিকা মানসী সার্থকতা মায়া অদেয় রূপকথায় অধীরা বাসাবদল শেষ কথা মুক্তপথে আধোজাগা যক্ষ পরিচয় নারী গানের স্মৃতি অবশেষে সম্পূর্ণ উদ্বৃত্ত অত্যুক্তি হঠাৎ মিলন দূরবর্তিনী বাণীহারা অনসূয়া শেষ অভিসার বিমুখতা অসময় অপঘাত মানসী |
প্রবাসী। চৈত্র ১৩৪৬।৮০১ 'লীলা' : প্রবাসী। অগ্রহায়ণ ১৩৪৬।১৬১ কবিতা। আষাঢ় ১৩৪৭।১ কবিতা। চৈত্র ১৩৪৬।১ দেশ। ২৮ বৈশাখ ১৩৪৭ প্রবাসী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭।১৪৬ কবিতা। আষাঢ় ১৩৪৭।২ 'গোধূলি' : জয়শ্রী। চৈত্র ১৩৪৬ প্রবাসী। ফাল্গুন ১৩৪৬।৫৭১ প্রবাসী। ভাদ্র ১৩৪৬।৫৯৯ 'ছিন্নপত্র' : পরিচয়। শ্রাবণ ১৩৪৬।১ প্রবাসী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭।১৪৫ প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৫।৪৬৫ প্রবাসী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬।১৫৭ 'গান' : বঙ্গলক্ষ্মী। পৌষ ১৩৪৬ বিচিত্রা। বৈশাখ ১৩৪৫।৪২৫ প্রবাসী। আশ্বিন ১৩৪৬।৭৪৩ পরিচয়। বৈশাখ ১৩৪৬ কবিতা। পৌষ ১৩৪৩।১ রূপ ও রীতি। বৈশাখ ১৩৪৭ প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৫।৪৬৩ প্রবাসী। কার্তিক ১৩৪৬।১ চতুরঙ্গ। আশ্বিন ১৩৪৫ 'তোমারে কি চিনিতাম আগে' বিচিত্রা। অগ্রহায়ণ ১৩৪৫ 'পালাশেষে' : জয়শ্রী। আষাঢ় ১৩৪৬ পরিচয়। চৈত্র ১৩৪৫ 'গান' : বৈজয়ন্তী। কার্তিক ১৩৪৬ পরিচয়। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬।৪৬৭ বিচিত্রা। শ্রাবণ ১৩৪৫।১ 'অলস মিলন' : কবিতা। আশ্বিন ১৩৪৪।১ 'গান' বঙ্গলক্ষ্মী। বৈশাখ ১৩৪৬ প্রবাসী। বৈশাখ ১৩৪৭।৬৩ সমসাময়িক। আষাঢ় ১৩৪৭ প্রবাসী। ভাদ্র ১৩৪৭।৫৫৭ সাহানা। জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৭।৪৭০ প্রবাসী। শ্রাবণ ১৩৪৭।৪২১ |
রবীন্দ্রসদনের পাণ্ডুলিপির সাহায্যে বর্তমান সংস্করণে অনেকগুলি
কবিতার রচনাস্থান ও তারিখের নির্দেশ সংযোজিত হইয়াছে।
'কর্ণধার; কবিতাটির প্রথম রচনা ও উহার ক্রমবিবর্তনের
পরিচয়-স্বরূপ 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের প্রাসঙ্গিক কিয়দংশ নিম্নে উদ্ধৃত হইল–
হে তরুণী তুমিই আমার ছুটির কর্ণধার
অলস হাওয়ায় বাইচো স্বপনতরী
নিয়ে যাবে কর্মনদীর পার।
প্যাডটা নিয়ে গুন গুন
করে গেয়ে চললেন। বিকেল বেলা যখন ফিরে এলুম, দেখি লেখাটা প্রায় সবই বদল হয়ে গেছে এবং
বিচিত্রিত ভাবে আগেকার লেখাটিকে কালির আচ্ছাদনে মণ্ডিত ক'রে আঁকা হয়েছে সুন্দর একটি
ছবি, তাঁর ফাঁকে ফাঁকে নূতন যে লেখাটা পড়া যাচ্ছে–
কে
অদৃশ্য ছুটির কর্ণধার
মংপু
[কবিতাটির এই পাঠের রচনার স্থানকালনির্দেশ মূল পাণ্ডলিপি হইতে উদ্ধৃত
হইল।] |
প্যাডটা ফেলে দিলেন–
"লও, কপি কর খাতায়।" তার পরদিন সকালবেলায় খাতাটা দিয়ে বল্লেন–
"হে তরণী, আর একবার কপি করতে হচ্ছে।" তখন দেখি কবিতাটা আরো অনেক বদলে গেছে, তার
প্রথম লাইনটা হয়েছে–
"কে অসীমের লীলার কর্ণধার।" এমনি ক'রে পরিবর্তিত পারবর্ধিত হতে হতে বেশ কয়েকদিন পরে
সে এক সম্পূর্ণ অন্য কবিতা হয়ে দাঁড়াল–
ছুটির কর্ণধার দখিন হাওয়ায় দিচ্ছ পাড়ি, কর্মনদী পার। নীল আকাশের মৌনখানি আনে দূরের দৈববাণী মন্থর দিন তারি ডাকে যায় ভেসে যায় বাঁকে বাঁকে ভাঁটার স্রোতে উদ্দেশহীন কর্মহীনতার তুমি তখন ছুটির কর্ণধার শিরায় শিরায় বাজিয়ে তোলো নীরব ঝংকার –ইত্যাদি। |
কয়েক মাস
পরে যে তার সংস্করণ 'সানাই'-তে প্রকাশ হ'ল তাকে আর চেনবার জো নেই।
–মংপুতে
রবীন্দ্রনাথ। পৃ ১৭৭-৭৯
সানাই প্রকাশের পূর্বে ১৩৪৬ অগ্রহায়ণের প্রবাসীতে 'লীলা' নামে
উক্ত কবিতাটির আর-একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পাঠ মুদ্রিত হইয়াছিল–
লীলা
ওগো কর্ণধার
অলস
ক্ষেতের পোড়ো ভূমে
তাকিয়ে থাকে নিমেষহারা
অস্তরবির ছায়ার সাথে
রাতের শঙ্খকুহর ব্যেপে
মংপু |
আলোচ্য
কবিতার সানাইয়ে মুদ্রিত পাঠের অস্তিম স্তবকটি সর্বশেষে সংযোজিত হয়। তৎপূর্বে
'উদীচী ২৫।১।৪০' তারিখের রচনা অনুযায়ী (পাণ্ডুলিপি) কবিতাটি প্রথম পাঁচ স্তবকে
সমাপ্ত ছিল।
'আসা-যাওয়া' কবিতার সহিত তুলনীয় সমকালীন একটি রচনা কৌতুহলী পাঠকদের জন্য
পাণ্ডুলিপি হইতে উদ্ধৃত হইল। ইহাকে আলোচ্য কবিতার পূর্বপাঠ বলা সমীচীন না
হইলেও ভাবের বিচারে পূর্বাভাস বলা চলে–
নির্জন রাতে নিঃশব্দ চরণপাতে কেন এলে, |
নিম্নোদ্ধৃত গানটিও [ ইহা দ্বিতীয়সংস্করণ গীতবিতানের প্রথম বা দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হয় নাই; পরবর্তী এবং প্রচলিত গীতবিতানের তৃতীয় খণ্ডে বা অখণ্ড গীতবিতানে সংকলিত এবং তৎপূর্বে সঙ্গীত-বিজ্ঞান-প্রবেশিকার ১৩৫০ কার্তিক-সংখ্যার ১৭২ পৃষ্ঠায় স্বরলিপিসহ মুদ্রিত হয়। উক্ত পত্রিকায় গানের পঞ্চম ছত্রে 'নিল যবে' স্থলে 'দিনু যারে' এবং সপ্তম ছত্রে 'তখন' স্থলে 'তখনো' মুদ্রিত হইয়াছে।] এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য–
প্রেম এসেছিল
সে
তখন স্বপ্ন কায়াবিহীন
উদয়ন |
'বিপ্লব' কবিতার সংক্ষিপ্ত একটি পূর্বপাঠ পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া গিয়াছে। নিম্নে তাহা মুদ্রিত হইল–
নির্দয়া
ডমরুতে নটরাজ বাজালেন যে নাচের তাল
উদীচী। শান্তিনিকেতন |
'মানসী' (পৃ ৮৭) কবিতা রচনার ইতিহাস নবজাতক গ্রন্থের 'সাড়ে নটা' (পৃ ৪১) কবিতার সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই প্রসঙ্গে 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের নিম্নোদ্ধৃত বিবরণ প্রণিধানযোগ্য–
সকাল
সাড়ে নটা দশটার সময় খাওয়া হয়ে গেলে বসবার ঘরে এসে বসতেন একটা চৌকিতে, হাতে থাকত
একটা বই বা কোনো মাসিক পত্র–
রেডিওতে বাজত সুশ্রাব্য অশ্রাব্য মেশানো প্রোগ্রাম, কিছু শুনতেন, কিছু শুনতেন
না। 'ইয়োরোপের সংগীত শুনছিলুম গো আর্যে, কী আশ্চর্য এই যন্ত্রটা। কোন্ সুদূর
থেকে কত রাজ্য পার হয়ে ভেসে আসছে এই সুরধ্বনি। সে দেশে এখন কত কাণ্ডই চলেছে,
মারামারি হানাহানি, সব পার হয়ে আসছে একখানি সুর, তার মধ্যে একটুও ছায়া পড়ে নি
সেখানকার জীবনের। যেখানে এই গান গাওয়া হচ্ছে সেখানেও তো নানা রকম ব্যাপার
চলেছে, নানা রকম ঘটনাপ্রবাহ। কত লোক আসছে যাচ্ছে–
যে গান গাইছে তারও একটা অস্তিত্ব আছে, কিন্তু সে সমস্তকে বাদ দিয়ে একটি সকল
সম্পর্ক-রহিত নিরাসক্ত সুরের ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে। মনে পড়ে যখন বোটে বসে
লিখতুম, চারিদিকে জল বয়ে চলেছে মৃদু কলধ্বনিতে, দূরে দেখা যায় বালির চর ধূ-ধু
করছে, আমি লিখেই চলেছি লিখেই চলেছি "মানসী" (মানসসুন্দরী)। যখন শুরু করেছিলাম
তখন ঝাঁ ঝাঁ করে রোদ্দুর, তার পরে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এল আলো, আকাশ রঙীন ক'রে
অস্ত গেল সূর্য। একটি চাকর বোটে থাকত আমার নীরব সঙ্গী, সে কখন নীরবে মিট্মিটে
প্রদীপ রেখে চলে গেল। আমি লিখেই চলেছি–
মানসী। আজ কোনো কাজ নয়, সব ফেলে দিয়ে ছন্দ-বন্ধ-গ্রন্থ-গীত এসো তুমি প্রিয়ে!
কোথায় গেল সেই দিন। সেই পদ্মার চর, ধূ ধূ করে সোনালী বালি সেই মিট্মিটে শিখার
ম্লান আলো, সব চিহ্ন ধুয়ে মুছে গেছে, শুধু আছে মানসী, তার যে পরিবেশ ছিল সে তো
লুপ্ত হয়ে গেল্য–
এমন কি তার থেকে সম্পূর্ণ বাদ পড়ে গেছে তার কবিও। চারিদিকের সমস্ত সুত্র তার
ছিন্ন, সে শুধু একখানি সুত্রছিন্ন বাণী।... তোমার এই রেডিওর গান শুনছি আর এই সব
ভাবছি।"
সেই দিন একটা প্রকাণ্ড কবিতা লিখেছিলেন এ বিষয় নিয়ে। তারপর পরিবর্তন করতে
করতে একটা কবিতা থেকে দুটো কবিতা হয়। তার একটি 'সাড়ে নটা' নামে নবজাতকে, আর
একটি 'মানসী' নামে সানাইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
–
মংপুতে রবীন্দ্রনাথ। পৃ ৯১-৯৩
'সার্থকতা' কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে প্রেরিত শ্রীমতী মৈত্রেয়ীদেবীর একটি কবিতার
উত্তরে প্রথম লিখিত হইয়াছিল, 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' (পৃ ৬৩-৬৫) গ্রন্থে এইরূপ
লেখা হইয়াছে।
'রূপকথায়' ১৩৪৬ সালে শান্তিনিকেতনে 'ডাকঘর' অভিনয়ের অসমাপ্ত এক আয়োজন
উপলক্ষে গান রূপে প্রথম রচিত হয়। নাটকটির তৃতীয় দৃশ্যে "ফকিরবেশী ঠাকুরদা"র
ভূমিকায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ইহা গাহিবার কথা ছিল।
'বাসাবদল' কবিতার একটি পূর্ববর্তী পাঠে পাণ্ডুলিপিতে সূচনাংশ
নিম্নমূদ্রিত আকারে পাওয়া যায়–
এল এবার জিনিস প্যাকের দিন। |
তৎপূর্বের অন্য একটি পাণ্ডুলিপিতে 'বাসাবদল' (পৃ ৯৬) ও 'পরিচয়' (পৃ ১০৫) এই উভয়
কবিতা'র গদ্যছন্দে-লিখিত একটি অবিচ্ছিন্ন আদিপাঠ পাওয়া গিয়াছে। অপ্রকাশিতপূর্ব
এই রচনাটির নাটকীয় সুসম্পূর্ণতা কবিতা দুইটির রসগ্রহণে পাঠকদের সবিশেষ সাহায্য
করিবে বলিয়া মনে হয়–
নমস্কার কবি। চিনতুম না তোমাকে, চেয়েছিলুম চিনতে, চেনা হয়ে গেছে, আর বেশি
সইত না, দাঁড়ি পড়েছে ঠিক জায়গায়।
বাঙালীর মেয়ে, অত্যন্ত করে জানি ঘরের লোকদের। লোভ ছিল অজানা
জগতের পরিচয়ে। বয়স ছিল কাঁচা, সদ্য বেরিয়েছি কলেজের মধ্যপথ থেকে। আমার
বিশ্ববৃত্তান্তে সব চেয়ে অজানা রহস্য কবি।
তখনো চোখে দেখি নি, অনিলবাবু, তোমাকে। পড়েছি তোমার লেখা, ছবি এসেছে মনে,
স্বপ্নের ঘোড়ায় চড়ে তুমি খুঁজতে বেরিয়েছ তোমার মানসীকে। রূপকথার রাজপুত্তুর
তুমি–
জগতে একটিমাত্র আছে রাজকন্যা, বিদেশী সমুদ্রের ওপারে, সে আছে তোমারই জন্যে।
তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে এমন কথা যদি মনে করে থাকি যেন
আমিই সেই রাজকন্যা তবে হেসো না। দেখা হবার আগেই ছুঁইয়েছিলে রুপোর কাঠি,
জাগিয়েছিলে সুপ্ত প্রাণকে। ঐ বয়সে অনেক মেয়ে মনে করেছিল ঐ একই কথা। তারা চিঠি
লিখেছিল, ঠিকানা দেয় নি।
খেয়াল, মাঝ বসন্তের খেয়াল। ওরই আড়ালে কতদিন আবছা হয়ে গেছে দুপুরবেলাকার
পরীক্ষার পড়া, বুকের মধ্যে হঠাৎ উছলে উঠেছে একটা যৌবনের ঢেউ।
একেই বলে রোম্যান্স্, নবীন বয়সে আপনা-ভোলানোর শিল্পকলা। মনের দেহলিতে
এঁকেছি আলপনা, কার পা ফেলবার পথে। আরো কিছুদিন যেত, বয়েস পেরিয়ে যেত বিশেষ
কোঠা, গোটাকতক মডার্ন নভেল পড়া হত শেষ, চোখের ঘোর যেত কেটে, হাসতুম নিজের
কচিমেয়েপনায়। তার দৃষ্টান্ত দেখেছি কত।
সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ের দল আছে আই.এ.ক্লাসের শেষ সীমানায়, চশমা চোখে
পড়ছে কীট্সের কবিতা, না-দেখা- নাইটেঙ্গলের না-শোনা সুরে ব্যথিয়েছে তাদের বুকের
পাঁজর, হৃদয়বাতায়নের ঝরোকা খুলে গেছে ফেনায়িত সমুদ্রের জনশূন্যতায় উজাড় কোন্
পরীস্থান। অনিলবাবু, তোমার সঙ্গে শুভদৃষ্টির লগ্ন ছিল সেই আলো-আঁধারের
ঝিকিমিকিতে। তখন কত দিন দুলেছে কত ঘরের কোণে তোমার কলামূর্তি তরুণীর
আর্তচিত্তের রহস্যদোলায়।
তার পরে দেখি, দেখতে দেখতে সেই মেয়েদের সময় বয়ে যায়। এসে পড়ে যুগান্তর,
ছেঁড়া মোজা সেলাইয়ের, নতুন বাজারে সওদা করতে পাঠাবার ফর্দ লেখার, চায়ের সভার
হাঁটুজল বন্ধুত্বের।
আমার ভাগ্যে রোম্যান্সের ঘনসজল আষাঢ়ে দিন তখনো ফুরোয় নি–
সেই রসাভিষিক্ত বাদল-বেলায় আলাপ হল তোমার সঙ্গে। অচেনাকে চেনা হল শুরু
রোমাঞ্চিত মনে।
চেনার
প্রথম অধ্যায়েই ধরা পড়ল তুমি একেবারেই দুর্লভ নও। মায়ার টান তো দেখি আমাদেরই
দিকে। লক্ষ্যসন্ধানের আগেই ধরা পড়বার মতো তোমার ভাব। এত সহজ মৃগয়ায় পরীক্ষাই হয়
না ব্যাধের গুণপনার।
উলটে গেল পালা। পথ চেয়ে বসেছিলুম ধরা দেব বলে, ধরবার খেলা হল শুরু। দুঃখ
এই তুমি দুর্লভ নও। হায় আমার রাজপুত্র, একটু স্পর্শ লাগতেই তোমার মুকুট পড়ল খসে
ধুলোয় আমার পায়ের কাছে, সংকোচে, চাইলুম পা সরিয়ে নিতে–
তুমি বললে, থাক্ থাক্।
সেদিন আমার ফাঁদ পাতা ছিল বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে–
কলকণ্ঠের কাকলিতে, মানঅভিমানের ছলনায়, অকারণ হাসির কল্লোলে। রসে রঙে এ ঘরের
বেড়াজাল ছিল ঠাসবুনুনি করা। তুমি তোমার দিগ্বিজয়ী চালের মন্থর ভঙ্গীতে পা ফেললে
ঠিক তার মাঝখানটাতে। বারে বারে চেয়ে দেখলুম কটাক্ষে, মনে মনে হাসলুম তোমার দুই
চক্ষুর বিহ্বলতায়।
কোন্ ফাঁকে এসে পড়ল আর-এক
মায়াবিনী–
রণিতা। আমরা এক ব্যবসায়ের ব্যবসায়িনী। দেখলুম তার ফাঁসটাতে অল্প-একটু টান দিতেই
বন্দী তখনি এক দিক থেকে আর-এক দিকে পড়ল হেলে। ভোজের বাহুল্যে ওর ক্ষুধা হয়েছিল
অলস, সেই শিথিল অবস্থায় পথ্য ছিল তড়িদ্বেগে এক চুমুকের সুধারস। সেটা বুঝে
নিয়েছিল যাদুকরী।
বোধ হয় জান না মেয়েতে মেয়েতে বাজি রাখা পণ আছে ভিতরে ভিতরে। রণিতা এল
আমার দরজায়। আমার মুখে সে চাইলে, আমি চাইলুম তার মুখে। পাশা ফেলল তার হাতের এক
ঘুরুনিতেই, এক দানেই হল জিত। তুমি গেলে চলে, মনেও পড়ল না একটা সামান্য রকম
অছিলা করে যেতে।
হাসতে চেষ্টা করি সঙ্গিনীরা যখন শুধায় হল কী। রণিতাকেও একদিন জবাব দিতে
হবে ঐ প্রশ্নরই শুকনো হাসি দিয়ে। বেশি দেরি নেই।
পালা ফুরল, এবার প্যাক করতে হবে। অনাহূত সাহায্য করতে এল রমেশ–
ঐটুকুই তার লাভ। লেগে গেল আস্তিন গুটিয়ে। কাঁচের শিশি মুড়তে লাগল খবরের কাগজে,
কিছু বা জড়িয়ে দিল ছেঁড়া মোজায়। চামড়ার বাক্সোয় সাবধানে সাজিয়ে দিলে হাত-আয়না,
রুপোর বাঁধানো চিরুনি, নখ-কাটা কাঁচি, চুলের তেল, ওটেনের মলম, পাউডারের কৌটো,
সাবানের বাটি। অবসাদের ভারে অচল ছিল আমার মন, গা লাগছিল না কিছুতে হাত লাগাতে,
কেবল বসে বসে ছিঁড়ছিলুম কুটিকুটি ক'রে পুরনো চিঠিগুলো। ব্যবহার-করা শাড়িগুলো
নানা নিমন্ত্রণদিনের ফিকে গন্ধ মিলিয়ে দিল ঘরের হাওয়ায়। সেগুলো বিছিয়ে বিছিয়ে
দুই হাতে চেপে চেপে পাট করে দিতে অসম্ভব সময় নিচ্ছিল রমেশ। আমার জরির-কাজ-করা
স্লিপারের এক-একটা পাটি নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুছে দিচ্ছিল কোঁচার কাপড়ে, কোনো
আবশ্যক ছিল না। চৌকির উপর দাঁড়িয়ে দেয়াল থেকে সে খসিয়ে নিল ছবিগুলো। মোটা
কার্পেটটা গুটিয়ে-সুটিয়ে দিলে সরিয়ে ঘরের এক ধারে। মেঝের উপর ছড়িয়ে রইল ছেঁড়া
চিঠির টুকরো। এল কুলির দল, আসবাবগুলো তুলে দিল মালগাড়িতে।
শূন্য হয়ে গেল ঘর, কোথায় মিলিয়ে গেল তার স্বপ্নরূপ, তার রঙিন মায়া। যে
কেউ কোথাও নেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে ফ্যাকাসে দেয়াল অবুঝের মতো।
আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দেবার জন্যে শেষ পর্যন্ত রইল রমেশ। বললে, চিঠি
লিখো কেমন থাক।
আমার রোম্যান্সটুকু স্বপ্ন মাপের পেয়ালায়। এখনো তলায় কিছু রস আছে বাকি,
আর কিছু আছে ব্যথা। আর দেরি হলে হাসির লেশও থাকত না, চোখের জলও যেত শুকিয়ে।
ভাবছি মনে এসব কী বকচি। ভারতচন্দ্রে আছে 'সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে
বিস্তর'।
এতক্ষণ বিস্তর কথা বলা হল শেষকালে দাঁড়াল সব তার মিছে। কী করে বললুম,
তোমাকে চিনেছি। তোমাকে ভোলাতে বসলুম, আপনাকে ভোলালুম, এই কি চেনবার রাস্তা। যে
বিস্ময়দৃষ্টি দিয়ে তুমি দেখেছ এই জগৎকে সেই দৃষ্টি দিয়ে যদি আমি চাইতুম তোমার
দিকে তা হলেই দেখতুম তোমার সত্যকে। ঢাকা দিলুম তোমাকে মায়া দিয়ে, তোমার
বিশ্বনিখিল থেকে সরিয়ে এনে কেটে ছেঁটে ছোটো করে তোমাকে ধরাতে চাইলুম আমার এই
আড়াইশো-টাকা-ভাড়া ফ্ল্যাট্টাতে। আজ আমার চেয়ে তোমাকে দেখাচ্ছে ছোটো, আর বলছি
তোমাকে চিনেছি।
-রবীন্দ্রসদনস্থ পাণ্ডুলিপি
উপরের রচনাটির প্রথমার্ধ অনেক সংশোধন ও সম্মার্জন করিয়া রবীন্দ্রনাথ উহা পরে
প্রতিমা দেবীকে আলমোড়ায় পাঠাইয়াছিলেন। কৌতূহলী পাঠক প্রতিমা দেবীর 'চিত্রলেখা'
গ্রন্থের ভূমিকা ও 'মন্দিরার উক্তি' লেখাটি এই প্রসঙ্গে দেখিতে পারেন। সেখানে
'অনিলবাবু'কে বদলাইয়া 'নরেশবাবু' করা হইয়াছে।
'নারী' (পৃ ১১০) কবিতার সাময়িক পত্রে প্রকাশিত পাঠে কিছু কিছু পাঠান্তর
পাওয়া যায়। প্রথম দিকে 'সেই আদি.......সংগোপনে' পাঠ সাময়িক পত্রে এইরূপ ছিল–
তাহারি সংকল্পচ্ছবি বিধাতার মনে |
অন্যান্য পাঠান্তর– 'রক্তিম হিল্লোল' স্থলে 'মদির হিল্লোল'। 'শাস্ত্রবচনের ঘের' স্থলে 'বচনের ঘের'। 'সকলি ফেলিয়া দূরে' স্থলে 'সকলি করিয়া দূর'। পরের ছত্রে 'সুরে' স্থলে 'সুর'। 'ভুবনমোহিনী' স্থলে 'ভুবনমোহন'। 'মর্তের মদিরা-মাঝে' স্থলে 'মর্ত্যের রূপের মাঝে'।
শেষ অংশের ('আদিস্বর্গলোক...সহচরী') পাঠ এইরূপ ছিল–
যেন
সর্ব পুরুষের নির্বাসিত মন
|
'নামকরণ' (পৃ ১২৭) কবিতার একটি পূর্বতন পাঠ পাণ্ডুলিপি হইতে নিম্নে মুদ্রিত হইল–
নামকরণ |
'বিমুখতা'র (পৃ ১২৮) অন্য দুইটি পাঠ পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়–
বিমুখ
হঠাৎপ্লাবনী যে মন নদীর প্রায় বিমুখতা
যে
মন হঠাৎ-প্লাবনী নদীর প্রায় ২৯।৫।৪০ |
'সানাই' গ্রন্থের অনেকগুলি ছোটো ছোটো কবিতার স্বতন্ত্র সংগীতরূপ প্রচলিত আছে। কোথাও বা গান আগে রচিত হইয়াছে, কোথাও বা কবিতা। তুলনামূলক পাঠের উদ্দেশে কবিতাগুলির দ্বিতীয়সংস্করণ-গীতবিতানে-মুদ্রিত সংগীতরূপ যথাক্রমে নির্দেশ করা হইল-
কবিতা | গীতিরূপান্তরের প্রথম ছত্র | রচনাকাল |
আসা-যাওয়া | প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে | |
অনাবৃষ্টি | মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন | |
নতুন রঙ | ধূসর জীবনের গোধুলিতে ক্লান্ত মলিন সেই স্মৃতি | |
এবং | ধূসর জীবনের গোধুলিতে ক্লান্ত আলোয় ম্লানস্মৃতি | |
গানের খেয়া | আমি যে গান গাই জানি নে সে কার উদ্দেশে | |
অধরা | অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে | |
ব্যথিতা | ওরে জাগায়ো না, ও যে বিরাম মাগে | |
বিদায় | বসন্ত সে যায় তো হেসে, যাবার কালে | |
যাবার আগে | এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে | |
পূর্ণা |
ওগো তুমি পঞ্চদশী |
|
কৃপণা | এসেছিনু দ্বারে তব শ্রাবণরাতে | |
ছায়াছবি | আমার প্রিয়ার ছায়া | ২৫।৮।১৯৩৮ |
দেওয়া-নেওয়া | বাদলদিনের প্রথম কদমফুল পুনশ্চ। | ৩০।৭।১৯৩৯ |
আহ্বান | এসো গো, জ্বেলে দিয়ে যাও | ১।৮।১৯৩৯ |
দ্বিধা | এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে | |
আধোজাগা | স্বপ্নে আমার মনে হল | |
উদ্বৃত্ত | যদি হায়, জীবনপূরণ নাই হল | |
ভাঙন | তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে | |
গানের জাল | দৈবে তুমি কখন নেশায় পেয়ে | |
মরিয়া |
আজি মেঘ কেটে গেছে সকালবেলায় |
|
গান | যে ছিল আমার স্বপনচারিণী | ৮।১২।১৯৩৮ |
বাণীহারা |
বাণী মোর নাহি |
|
আত্মছলনা | দোষী করিব না, করিব না তোমারে |