ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদকর্তাদের অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের রচিত পদাবলীই ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে খ্যাত।

অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্রের সংকলিত প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ পাঠ করে
রবীন্দ্রনাথের মৈথিলীমিশ্রিত ভাষার প্রতি যে আগ্রহ সৃষ্ট হয়, সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ এই পদাবলী রচনা করেছিলেন। পরে তিনি এর কিছু পদে সুরারোপ করেছিলেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে এই পদাবলীর রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে যে বিরবরণ দিয়েছে, তা নিতান্তই প্রাসঙ্গিক বলে, এখানে উল্লেখ করা হলো-
"... শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র মহাশয়-কর্তৃক সংকলিত প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ আমি বিশেষ আগ্রহের সহিত পড়িতাম। তাহার মৈথিলীমিশ্রিত ভাষা আমার পক্ষে দুর্বোধ ছিল। কিন্তু সেইজন্যই এত অধ্যবসায়ের সঙ্গে আমি তাহার মধ্যে প্রবেশচেষ্টা করিয়াছিলাম। গাছের বীজের মধ্যে যে-অঙ্কুর প্রচ্ছন্ন ও মাটির নীচে যে-রহস্য অনাবিষ্কৃত, তাহার প্রতি যেমন একটি একান্ত কৌতূহল বোধ করিতাম, প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা সম্বন্ধেও আমার ঠিক সেই ভাবটা ছিল। আবরণ মোচন করিতে করিতে একটি অপরিচিত ভাণ্ডার হইতে একটি-আধটি কাব্যরত্ন চোখে পড়িতে থাকিবে, এই আশাতেই আমাকে উৎসহিত করিয়া তুলিয়াছিল। এই রহস্যের মধ্যে তলাইয়া দুর্গম অন্ধকার হইতে রত্ন তুলিয়া আনিবার চেষ্টায় যখন আছি তখন নিজেকেও একবার রহস্য-আবরণে আবৃত করিয়া প্রকাশ করিবার একটা ইচ্ছা আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল। 
[সূত্র : জীবনস্মৃতিরবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ (১৭) খণ্ড, (বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩)। পৃষ্ঠা :৩৪৬।]
রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব সাহিত্য পড়েছিলেন ভাষাগত দুর্বোধ্যতা জয় করে রস আস্বাদনের জন্য। কিন্তু এই জয়ের আনন্দকে সৃষ্টির আনন্দে রূপান্তরিত করেছিলেন অন্য একটি তাড়না থেকে। তাঁর এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সৃষ্টির ইচ্ছাকে বালকোচিত উৎসাহ বলা যেতে পারে, কিন্তু এরই মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল
রবীন্দ্রসাহিত্য এবং সঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র দিক।

রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ বালককবি চ্যাটার্টনের
(Thomas Chatterton (1752-70) কথা শুনেছিলেন অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছে। চ্যাটার্টন প্রাচীন ইংরেজ কবিদের অনুকরণ করে এমন চমৎকার কবিতা রচনা করেছিলেন যে, সেগুলো পড়ে অনেকে বুঝতেই পারেন নি, ওগুলো চ্যাটার্টনের রচনা।এই বালক কবি ষোল বৎসর বয়সে আত্মহত্যা করেন। পনর-ষোল বৎসরের বয়সের বালক কবি রবীন্দ্রনাথও দ্বিতীয় চ্যাটার্টন হওয়ার চেষ্টা করলেন, আত্মহত্যার অনাবশ্যক অংশ বাদ দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'-তে এই বিষয়ে লিখেছেন
"..ইতিপূর্বে অক্ষয়বাবুর কাছে ইংরেজ বালককবি চ্যাটার্টনের (Thomas Chatterton (1752-70 )বিবরণ শুনিয়াছিলাম। তাঁহার কাব্য যে কিরূপ তাহা জানিতাম না— বোধ করি অক্ষয়বাবুও বিশেষ কিছু জানিতেন না, এবং জানিলে বোধ হয় রসভঙ্গ হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল কিন্তু তাঁহার গল্পটার মধ্যে যে একটা নাটকিয়ানা ছিল সে আমার কল্পনাকে খুব সরগরম করিয়া তুলিয়াছিল (দ্র‘ চ্যাটার্টন বালককবি’, ভারতী, আষাঢ় ১২৮৬ )। চ্যার্টাটন প্রাচীন কবিদের এমন নকল করিয়া কবিতা (Rowley poems, Thomas Rowley, an imaginary 15th-cent, Bristol poet and monk ) লিখিয়াছিলেন যে অনেকেই তাহা ধরিতে পারে নাই। অবশেষে ষোলোবছর বয়সে এই হতভাগ্য বালককবি আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছিলেন। আপাতত ঐ আত্মহত্যার অনাবশ্যক অংশটুকু হাতে রাখিয়া, কোমর বাঁধিয়া দ্বিতীয় চ্যাটার্টন হইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলাম।.."
[সূত্র : জীবনস্মৃতিরবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ (১৭) খণ্ড, (বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩)। পৃষ্ঠা : ৩৪৬-৩৪৭।]

বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ এবং  দ্বিতীয় চ্যাটার্টন হওয়ার চেষ্টার ভিতর দিয়ে জন্ম হলো ভানুসিংহ ঠাকুরের। কাগজে কলমে রচনার সূত্রপাত ঘটেছিল কোন তারিখে, তা জানা যায় না। কোন এক মেঘলা দুপুরে কবির মনের ভাবনা মুক্তি পেয়েছিল শ্লেটের উপর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি-তে এ বিষয়ে লিখেছেন
"...একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘলাদিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম‘ গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে’। লিখিয়া ভারি খুশি হইলামতখনই এমন লোককে পড়িয়া শুনাইলাম বুঝিতে পারিবার আশঙ্কামাত্র যাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। সুতরাং সে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া কহিল, "বেশ তো, এ তো বেশ হইয়াছে।..."
 [সূত্র :জীবনস্মৃতি রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ (১৭) খণ্ড, (বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩)। পৃষ্ঠা :৩৪৭।]
নিজের রচনায় নিজে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু তাও তো কাউকে দেখাতে হয়। সঙ্কোচের প্রথম ধাক্কায় তা হয়ে উঠলো না। পরে তাঁর এক পুরানো বন্ধুর কাছে প্রকাশ করলেন। বন্ধু সে রচনা দেখে প্রথমে যতটা আগ্রহ দেখালেন, রচনাটি রবীন্দ্রনাথের জেনে ততটাই নিরাসক্ত হয়ে পড়লেন। জীবনস্মৃতিতে এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন
"...পূর্বলিখিত আমার বন্ধুটিকে একদিন বলিলাম, "সমাজের লাইব্রেরি খুঁজিতে খুঁজিতে বহুকালের একটি জীর্ণ পুঁথি পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে ভানুসিংহ নামক কোনো প্রাচীন কবির পদ কাপি করিয়া আনিয়াছি।" এই বলিয়া তাঁহাকে কবিতাগুলি শুনাইলাম। শুনিয়া তিনি বিষম বিচলিত হইয়া উঠিলেন। কহিলেন, " এ পুঁথি আমার নিতান্তই চাই। এমন কবিতা বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের হাত দিয়াও বাহির হইতে পারিত না। আমি প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ ছাপিবার জন্য ইহা অক্ষয়বাবুকে দিব।" তখন আমার খাতা দেখাইয়া স্পষ্ট প্রমাণ করিয়া দিলাম, এ লেখা বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের হাত দিয়া নিশ্চয় বাহির হইতে পারে না, কারণ এ আমার লেখা। বন্ধু গম্ভীর হইয়া কহিলেন,নিতান্ত মন্দ হয় নাই।" ..."
    [সূত্র : জীবনস্মৃতিরবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ (১৭) খণ্ড, (বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩)। পৃষ্ঠা :৩৪৭।]
ভানুসিংহ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ
পদরচয়িতা হিসাবে নিজের প্রকৃত নামের পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ ছদ্মনাম হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন 'ভানুসিংহ ঠাকুর'। রবীন্দ্রসাহত্যে সঙ্কলিত এই পদগুলোর নাম হলো- 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’। কি বিবেচনা করে রবীন্দ্রনাথ এই নাম নির্বাচন করেছিলেন, তার কোন প্রত্যক্ষ তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন- 'ভানুসিংহ' বা 'ভানু' নামটি রবীন্দ্রনাথের বৌদি কাদম্বরী দেবীর (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী) দেওয়া। গ্রন্থাকারে 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' প্রকাশের আগে- এর পদগুলো 'ভানুসিংহের কবিতা' নামে ভারতী পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। এই পদগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় (১২৯১ বঙ্গাব্দ) এর নামকরণ করা হয়- 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'।

নাম যেভাবেই করা হোক না কেন, তার সাথে 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' -এর বেশ মিল পাওয়া যায়। যেমন—

রবীন্দ্রনাথ শব্দটি ভাঙলে পাওয়া যায়-রবি +ইন্দ্র (দেবরাজ)+নাথ
ভানুসিংহ শব্দটি ভাঙলে পাওয়া যায়- ভানু +সিংহ (পশুরাজ, রাজশক্তির প্রতীক)। প্রথম শব্দ হলো- রবি। এর সাধারণ অর্থ হলো- সূর্য। সূর্যের অপর একটি শব্দ ভানু।
               
দ্বিতীয় শব্দ -ইন্দ্র।  হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে ইন্দ্র হলেন দেবতাদের রাজা। রাজশক্তি বা অধিপতির ঐতিহ্যের বিচারে ইন্দ্র শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে 'ভানুসিংহ' শব্দের 'সিংহ' হলো- পশুদের রাজা। যা দৈবত্বের বিচারে ইন্দ্রতুল্য না হলেও অধিপতির ঐতিহ্যের বিচারে ইন্দ্রের তুল্য। নাথ শব্দটিকে বাদ দিলে রবীন্দ্র-এর প্রতীকী নাম 'ভানুসিংহ' প্রায় সমার্থক হয়ে উঠে। বলাই বাহুল্য পদবী হিসাবে 'ঠাকুর'-উভয় নামের ক্ষেত্রে সমান অর্থ বহন করে।

ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'র পদগুলোর প্রকাশকাল
রবীন্দ্রনাথের 'জীবনস্মৃতি ' অনুসারে 'গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝ' প্রথম পদ। কিন্তু প্রকাশের বিচারে প্রথম পদ বা কবিতা হলো —

' সজনি গো'
    অঁধার রজনী ঘোর ঘন ঘটা।
    চমকত দামিনী রে।'
কুঞ্জপথে সখি, কয়্‌সে যাওব
    অবলা কামিনী রে॥ ধুয়া॥
'ভানুসিংহের কবিতা' নামে এই পদটি প্রকাশিত হয়েছিল 'ভারতী' পত্রিকা। (আশ্বিন ১২৮৪ সংখ্যা)। এই পদগুলোর প্রায় নিয়মিতভাবে এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ১২৯০ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত এই পত্রিকা মোট ১৩টি পদ প্রকাশিত হয়েছিল। এই পদগুলো হলো-
১. শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা। ভারতী (আশ্বিন ১২৮৪ সংখ্যা)।শিরোনাম : ভানুসিংহের কবিতা। রাগ- মল্লার। পৃষ্ঠা : ১৩৫।
২. গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে। ভারতী (কার্তিক  ১২৮৪ সংখ্যা)। রাগ : বিহগড়া। পৃষ্ঠা : ২০৬-২০৭।
৩.বজাও রে মোহন বাঁশি। ভারতী (পৌষ ১২৮৪ সংখ্যা)। ভানুসিংহের কবিতা। পৃষ্ঠা: ২৮৮।
৪. হম সখি দারিদ নারী। ভারতী (মাঘ ১২৮৪ সংখ্যা)। ভানুসিংহের কবিতা। ভৈরবী। পৃষ্ঠা: ৩৩৬।
৫. সতিমির রজনী, সচকিত সজনী। ভারতী (ফাল্গুন ১২৮৪ সংখ্যা)। ফাল্গুন ১২৮৪ বঙ্গাব্দ। পৃষ্ঠা : ৩৮১।
৬. সখি রে পিরীত বুঝাবে কে। ভারতী (ফাল্গুন ১২৮৪ সংখ্যা)। ভানুসিংহের কবিতা। পৃষ্ঠা : ৩৮১-৩৮২।
৭. বাদর বরখন, নীরদ গরজন। ভারতী (চৈত্র ১২৮৪ সংখ্যা)। ভানুসিংহের কবিতা। রাগিণী মল্লার।  পৃষ্ঠা: ৩৮০-৩৮১।
৮. বার বার সখি বারণ করণু । ভারতী (বৈশাখ ১২৮৫ সংখ্যা)। ভানুসিংহের কবিতা। পৃষ্ঠা: ২১
৯. মাধব না কহ আদরবাণী। ভারতী (বৈশাখ ১২৮৬ সংখ্যা)। ভানুসিংহের কবিতা। পৃষ্ঠা: ৩৪-৩৫
১০. দেখলো স্বজনী, চাঁদনী রজনী। ভারতী (বৈশাখ ১২৮৭ সংখ্যা)। ভানুসিংহের কবিতা। পৃষ্ঠা: ১
১১. সখিলো, সখি লো, নিকরুণ মাধব। ভারতী (অগ্রহায়ণ ১২৮৭ সংখ্যা)। ভানুসিংহের কবিতা। পৃষ্ঠা: ৩৮৪-৩৮৫
১২. মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান। ভারতী (শ্রাবণ ১২৮৮ সংখ্যা)। পৃষ্ঠা: ১৯৪।
১৩. আজু, সখি, মুহু মুহু। ভারতী (জ্যৈষ্ঠ ১২৯০ সংখ্যা)। ভানুসিংহের কবিতা। পৃষ্ঠা: ৮৮
১২৯১ বঙ্গাব্দের স্ব-উদ্যোগে 'ভানুসিংহের কবিতা'গুলোকে একত্রিত করে, গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলেন। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল 'আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে। মুদ্রাকর ছিলেন শ্রীকালিদাস চক্রবর্তী। অনেক বেদনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই গ্রন্থের উৎসর্গ-পত্রে (কাদম্বরী দেবীর উদ্দেশ্যে) লিখেছিলেন—
'ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।'
গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে প্রকাশক লিখেছিলেন
'ভানুসিংহের পদাবলী শৈশব সঙ্গীতের আনষঙ্গিক স্বরূপে প্রকাশিত হইল। ইহার অধিকাংশই পুরাতন কালের খাতা হইতে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছি।'
এই গ্রন্থে মোট ২১টি পদ স্থান পেয়েছিল। ১২৮৪ থেকে ১২৯০ বঙ্গাব্দের ভিতরে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত ১৩টি পদ ছাড়া, ৮টি নতুন পদ যুক্ত হয়েছিল। এই নতুন পদগুলো হলো-

১. বসন্ত আওল রে। বাহার। পৃষ্ঠা: ১-৩
২. শুনলো শুনলো বালিকা। ভৈরবী। পৃষ্ঠা: ৪-৫
৩. হৃদয়ক সাধ মিশাওল। ললিত। পৃষ্ঠা: ৬-৮।
৪. শ্যামরে, নিপট কঠিন মন তোর। বেহাগড়া। পৃষ্ঠা: ৯-১১
৫. সজনি সজনি রাধিকালো। শঙ্করা। পৃষ্ঠা: ১২-১৩
৬. বঁধুয়া, হিয়া পর আওয়ে। ভৈরবী। পৃষ্ঠা: ১৪-১৫
৭. শুন সখি বাজত বাঁশি। বেহাগ। পৃষ্ঠা: ১৬-১৭
৮. গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে। ঝিঁঝিট। পৃষ্ঠা: ১৮-১৯
৯.  সতিমির রজনী, সচকিত সজনী। মিশ্র জয়জয়ন্তী। পৃষ্ঠা: ২০-২১
১০. বজাও রে মোহন বাঁশী। মূলতান। পৃষ্ঠা: ২২-২৪
১১. আজু সখি মুহু মুহু। মিশ্র বেহাগ। পৃষ্ঠা: ২৫-২৭
১২. গহীর নীদমে ববিশ শ্যাম মম। খাম্বাজ। পৃষ্ঠা: পৃষ্ঠা:  ২৮-৩০
১৩. সজিন গো, শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা। মল্লার। ৩১-৩৩
১৪. বাদর বরখন, নীরদ গরজন। মল্লার। পৃষ্ঠা: ৩৪-৩৬
১৫. সখিরে পিরীত বুঝাবে কে?। টোড়ি। পৃষ্ঠা: ৩৭-৩৮
১৬. হম সখি দারিদ নারী। ভৈরবী। পৃষ্ঠা: ৩৯-৪১
১৭. মাধব! না কহ আদর বাণী। বাহার। পৃষ্ঠা: ৪২-৪৪
১৮. সখিলো, সখিলো, নিকরুণ মাধব। দেশ। পৃষ্ঠা: ৪৫-৪৯
১৯. বার বার সখি বারণ করনু। ইমন কল্যাণ। পৃষ্ঠা: ৫০-৫৩
২০. দেখলো সজনী চাঁদনি রজনী। বেহাগ। ৫৪- ৫৭
২১. মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান। পূরবী। ৫৮-৬০
এর ভিতরের দুটি কবিতা 'আজু সখি মুহু মুহু' ও 'মরণ রে তুহু মম শ্যামসমান' পূর্বে 'ছবি ও গান'-এর প্রথম সংস্করণে ছিল। পরে এই গ্রন্থ থেকে বাদ দিয়ে  'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' -তে গ্রহণ করা হয়। এছাড়া 'কো তুঁহু বোলবি মোয়' কবিতাটি  'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' -র প্রথম সংস্করণে ছিল না। এই কবিতটি প্রথমে 'কড়ি ও কোমল' গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে সংকলিত হয়েছিল। পর 'কড়ি ও কোমল'-থেকে বাদ দিয়ে  'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'-তে যুক্ত করা হয়েছে। 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'-র প্রথম সংস্করণের ১৫-সংখ্যক কবিতা 'সখি রে পিরীত বুঝাবে কে' ও ১৬ সংখ্যক কবিতা 'হম সখি দারিদ নারী', পরবর্তী সংস্করণ থেকে বাদ দেওয়া হয়।

গীতবিতানে 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' নামে যে সংকলনটি গৃহীত হয়েছে, তার গান সংখ্যা ২০, তবে তাতে  'মরণ রে তুহু মম শ্যামসমান' নেই, এই গানটি পাওয়া যায় 'প্রেম পর্যায়'-এর ১৮১ সংখ্যক গান হিসাবে। প্রকাশকালের বিচারে প্রথম গান 'শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা' গানটিও গীতবিতানের  'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' অংশে পাওয়া যায় না। এই গানটি পাওয়া যায়, প্রকৃতি পর্যায়ের ৩১ সংখ্যক গান হিসাবে।

রবীন্দ্ররচনাবলী
দ্বিতীয় (২) খণ্ডের 'কবিতা ও গান' অংশের ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'  এবং গীতবিতানের  'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী', প্রেম ১৮১ এবং প্রকৃতি ৩১ মিলিয়ে- ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'র পদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টি। এর ভিতর ১৩টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ভারতী পত্রিকায়। গানের সংকলন হিসাবে 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'-র প্রথম সংস্করণে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ৮টি পদ।  একটি গান প্রকাশিত হয়েছিল হয়েছিল প্রচার পত্রিকায়।

ভানুসিংহের কবিতা ও গান
মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবিদের অনুকরণে যে- কবিতা লিখা শুরু করেছিলেন, ভারতী পত্রিকায় তার নাম ছিল 'ভানুসিংহের কবিতা'। তিনি এই কবিতাগুলোতে সুরারোপ করে, কবে গানে রূপান্তর করা শুরু করেছিলেন তা জানা যায় না। একথাও জানা যায় না যে তিনি সব কবিতাকেই গানে পরিণত করেছিলেন কি না। বর্তমানে স্বরবিতান একবিংশ খণ্ডের সূত্রে আমরা ৯টি গানের স্বরলিপি পাই। এর ভিতরে একটি গান 'সুন্দরি রাধে আওয়ে বনি' গোবিন্দদাসের। উল্লেখ্য এই পদটিতে রবীন্দ্রনাথ সুরারোপ করেছিলেন। এ ছাড়া বিদ্যাপতির একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ সুরারোপ করেছিলেন। গানটি হলো- 'এ ভরা বাদর মাহ ভাদর' । এই গানটি স্বরবিতান একাদশ খণ্ডে (১১, কেতকী) মুদ্রিত হয়েছে।

স্বরবিতান একবিংশ খণ্ডের (২১, ভানুসিংহের পদাবলী ফাল্গুন ১৩৭৯) ৪৯ পৃষ্ঠা থেকে জানতে পারি যে- '...প্রত্যেকটি রচনার সুর 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'তে প্রথমাবধি উল্লিখিত থাকিলেও, অনেকগুলি গানের সুর হারাইয়া গিয়াছে মনে হয়। পূর্বে যেগুলির স্বরলিপি প্রকাশিত ছিল এবং ইন্দিরাদেবী যেগুলির সুর স্মৃতি হইতে উদ্ধার করিয়া স্বরলিপি করিয়া দিয়াছেন তাহাই এই গ্রন্থে প্রকাশিত (আশ্বিন ১৩৫৮) হয়।'

স্বরবিতান একবিংশ খণ্ডে গৃহীত এই নয়টি গানের বর্ণানুক্রমিক সূচি নিচে দেওয়া হলো-
১. আজু, সখি, মুহু মুহু [তথ্য]
২. গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে  [তথ্য]
৩. বজাও রে মোহন বাঁশি গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে [তথ্য]
৪. মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান [তথ্য]
৫. শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা। [তথ্য]
৬. শুন লো শুন লো বালিকা [তথ্য]
৭. সজনি সজনি রাধিকা লো [তথ্য]
৮. সতিমির রজনী, সচকিত সজনী [তথ্য]
৯. হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয় [তথ্য]

রবীন্দ্রনাথের সুরারোপিত বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের পদ
১. সুন্দরী রাধে আওয়ে বনি। রচয়িতা গোবিন্দদাস। [স্বর-২১]
২. ভরা বাদর, মাহ ভাদর। বিদ্যাপতি। [কেতকী, স্বর-১১]

ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর উচ্চারণ
'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'' ভাষা হলো- ব্রজভাষা বা ব্রজবুলি'র অনুকরণীয় ভাষা। মূলত ব্রজভাষা হলো ভারতের একটি আঞ্চলিক রূপ, যার সাথে হিন্দি এবং বাংলার বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ড: গ্রীয়ার্সন তাঁর Linguistic Survey of India নামক গ্রন্থে ব্রজভাষাকে উল্লেখ করেছেন-  'অন্তর্বেদী' ভাষারূপে, অর্থাৎ এই ভাষা গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অববাহিকা অঞ্চলের প্রচলিত ভাষা। এই ভাষার বিশুদ্ধ রূপ মথুরা, আগ্রা, আলীগড় তথা ধৌলপুর অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। এই কারণে এক সময় দিল্লী ও আগ্রা জেলার মধ্যবর্তী সমগ্র প্রদেশকে ব্রজভূমি বা ব্রজরাজ্য বলা হতো। ক্রমে ক্রমে, আধুনিক হিন্দি ভাষা এই ভাষাকে অনেকাংশেই গ্রাস করে ফেলেছে।

ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর গানগুলির উচ্চারণের বিষয়ে- রবীন্দ্রনাথের যেরূপ নির্দেশনা একটি নির্দেশনা পাওয়া যা। ভারতী পত্রিকায় (আশ্বিন ১২৮৪। পৃষ্ঠা: ১৩৫) ্রকাশিত, 'জনি গো- আঁধার রজনী োর ঘনঘটা'- এর পাদটীকায় মুদ্রিত নির্দেশনাটি ছিল-
'এই ব্রজ-গাথাগুলি হিন্দুস্থানী উচ্চারণে ও দীর্ঘ হ্রস্ব রক্ষা করিয়া সংস্কৃত ছন্দের নিয়মানুসারে না পড়িলে শ্রুতি-মধু হয় না-প্রত্যুত হাস্যজনক হইয়া পড়ে।'

এই নির্দেশনা থেকে এই পদের উচ্চারণসহ পাঠের যে বিধিটি পাওয়া যায়। এখানে মূলত দুটি বিধিই উল্লেখ করা হয়েছে।

১. শব্দের উচ্চারণ হবে হিন্দুস্থানী বা হিন্দি উচ্চারণের মতো।  হিন্দির সাথে বাংলা উচ্চারণের যে প্রভেদ রয়েছে, তা হলো-

ক. সকল অ ধ্বনি হিন্দিতে তীর্যক হবে। আন্তর্জাতিক লিপিমালায় ə= তীর্যক অ হিসেবে ধরা। বাংলাতে জগত- উচ্চারণ হবে জ.গো.তো। হিন্দিতে হবে ɟ ə.gə..t̪ə
খ. কতিপয় বর্ণের উচ্চারণে বিশেষ বিধি

১. সকল 'স'-এর উচ্চারণ কোমল শ-ধ্বনির মতো। এর উচ্চারণ 'ছ'-এর মতো তালব্য-প্রধান হবে না।

আন্তর্জাতিক লিপিমালায়
sh=
s=

এই বিচারে- কুসুম হবে-
kusum, বিসরি bisori হবে।

বিধি মোতাবেক বংশি হবে=bo
ŋ.ʃi
        ভিন্ন মত- বংশি==boŋ.si
        হিন্দিতে বংশী উচ্চারণ হয় বনশি   (banshee)


 


ব্রজভাষা ও ভানুসিংহ ঠাকুরের ভাষা

শুরুতেই বলেছি, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদকর্তাদের অনুকরণে— রবীন্দ্রনাথের রচিত পদাবলীই 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' নামে খ্যাত। মধ্যযুগীয় পদাবলীর ভাষাকে অনেকক্ষেত্রেই ব্রজভাষা বা ব্রজবুলি নামে উল্লেখ করা হয়। মূলত ব্রজভাষা হলো ভারতের একটি আঞ্চলিক রূপ, যার সাথে হিন্দি এবং বাংলার বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ড: গ্রীয়ার্সন তাঁর Linguistic Survey of India নাম গ্রন্থে ব্রজভাষাকে উল্লেখ করেছেন-  'অন্তর্বেদী' ভাষারূপে, অর্থাৎ এই ভাষা গঙ্গা-যমুনা বিধৌত অববাহিকা অঞ্চলের প্রচলিত ভাষা। এই ভাষার বিশুদ্ধ রূপ মথুরা, আগ্রা, আলীগড় তথা ধৌলপুর অঞ্চলে প্রচলিত ছিল এই কারণে এক সময় দিল্লী ও আগ্রা জেলার মধ্যবর্তী সমগ্র প্রদেশকে ব্রজভূমি বা ব্রজরাজ্য বলা হতো। ক্রমে ক্রমে, আধুনিক হিন্দি ভাষা এই ভাষাকে অনেকাংশেই গ্রাস করে ফেলেছে

১৩শ শতকের উত্তরার্ধে এই ব্রজভাষায় রচিত গ্রন্থাবলি সমগ্র উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধারণা করা হয়, গোরখনাথ (আনুমানিক ১১৫০ খ্রিষ্টাব্দ) নাথ তবাদের প্রবর্তক ছিলেনএই মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন ারানসীর  নির্গুণমার্গী সন্ত কবীর (১৩৯৯-১৫১৮ খ্রি) ধারণা করা হয় ব্রজভাষার প্রথম সার্থক লেখক ছিলেন কথিত আছে, জনৈকা বিধবা ব্রাহ্মণীর পুত্র ছিলেন কবীর। শৈশবে তিনি কবীরকে ত্যাগ করেছিল। জনৈক মুসলিম তন্তু ব্যবসায়ী (জোলা) তাকে প্রতিপালন করেন। এই সূত্রে তিনি ইসলাম ধর্মের আচারানুষ্ঠান সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। রপরে তিনি বৈষ্ণবাচার্য রামানন্দের (১৪০০-১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দ) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই সূত্রে তিনি বৈষ্ণব ধর্মের আচার জানতে পেরেছিলেন। পরে তিনি তাঁর অধ্যাত্মদর্শনে নাথ, সুফী ও বৈষ্ণব ধর্মের সমন্ব াঁর নিজস্ব অধ্যাত্মদর্শনকে তাঁর গানে প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম দিকে তিনি তাঁর মাতৃভাষা ভোজপুরীতে বেশ কিছু দোহা রচনা করেন। পরে তিনি তাঁর দোঁহাগুলো 'সাধুক্কড় বোলী'-তে (এক ধরনের মিশ্র ভাষা) র করেন। মূলত এই ভাষাকেই বলা হয় সরস ব্রজভাষা তবে এর সাথে 'দিল্লী বোলী' অব্রধীর মিশ্রণ আছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরবি-ফারসি ব্দ

তুলসীদাস  (১৫৩২-১৬২৩ খ্রি) অব্রধী ভাষার কবি হলেও কৃষ্ণবিষয়ক কাব্য রচনা করেছিলেন ব্রজভাষা। ব্রজভাষায় কৃষ্ণলীলার অগ্রণী কবিরা 'অষ্টছাপ' নামে পরিচিত। অষ্টছাপভুক্ত আটজন কবি হলেন- সূরদাস (১৪৮৪/১৫০৩-১৫৬৩ খ্রি), নন্দদাস, কৃষ্ণদাস, পরমানন্দদাস, কুম্ভনদাস, চতুর্ভুজদাস (১৫১৬), ছীত স্বামী ও গোবিন্দ স্বামী। অপর একজন পদকর্তা বল্লভাচার্য (১৪৭৯-১৫৩১ খ্রি) কৃষ্ণবিষয়ক পদরচয়িতা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এঁদের অনুগামীরা এঁদের রচিত পদ বৃন্দাবনের গোবিন্দ মন্দিরে পরিবেশন করতেন। এঁদের মধ্যে বল্লভার্চার্যের শিষ্য সুরদাসকে বলা এই ধারার শ্রেষ্ঠ কবি। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা ও গোপীপ্রেমের ওপর তাঁর কয়েক হাজার পদ আছে। বল্লভাচার্যের পুত্র বিঠ্‌ঠল নাথের শিষ্য ছিলেন নন্দদাস। তাঁর রচিত প্রাপ্ত ১৬টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাসপঞ্চাধ্যায়ী এবং ভন্‌ৱর-গীত। এছাড়া উল্লেখযোগ্য ব্রজভাষার পদকর্তা ছিলেন- পরমানন্দ দাস ( রচনা -ধ্রুবচরিত, দানলীলা), কৃষ্ণদাস (রচনা- ভ্রমর-গীত, প্রেমতত্ত্ব নিরূপণ) এবং চতুর্ভুজ দাস (রচনা- দ্বাদশ যশ, ভক্তি প্রতাপ, হিতু কো মঙ্গল), গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রধান গদাধর ভট্ট এবং ষড়্‌ গোস্বামীর অন্যতম গোপাল ভট্ট হিত হরিবংশ (জন্ম ১৫০৩ খ্রি)।

যে সকল সাধক-কবিরা মাতৃভাষার পরিবর্তে এই ব্রজভাষাকেই তাঁদের ভাবপ্রকাশের বাহন করে নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- রাজস্থানের মীরাবাই (১৪৯৮/১৫০৩-১৫৪৬)তিনি ছিলেন মেবারের রানী ও রাজপুত প্রধানের কন্যা তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব জীব গোস্বামীর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তাঁর রচনা ব্রজভাষা পাঠই সর্বাধিক প্রচলিত।

সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি) আমলে ব্রজভাষা বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছিল সম্রাটের উৎসাহ ও আনুকূল্যে বহু কবি ও গায়ক ব্রজভাষা চর্চা করেছেন। আকবরের রাজসভার ‘নবরত্ন’ সভার কবি আব্দুর রহীম খান্‌-খানান্ (১৫৫৬-১৬২৭ খ্রি), নরহরি, বীরবল, টোডরমল, অলম, গঙ্গ (১৫৭৮-১৬১৭), মনোহর কবি, বলভদ্র মিশ্র, কেশবদাস (১৫৬৫-১৬১৭ খ্রি) ব্রজবুলিতে কাব্য রচনা করেছিলেন এর ভিতরে কেশবদাস  আলংকারিক কাব্যরীতির প্রবর্তক হিসেবে বিশেষভাবে স্মরণীয়।

অম্বররাজ জয়সিংহের সভাকবি ছিলেন বিহারীলাল (১৬০৩-৬৩ খ্রি)। তাঁর 'সতসঈ' (সাতশত শ্লোকসংগ্রহ) ব্রজভাষায় রচিত। অপর একজন কবি ভূষণ (১৬৩১-১৭১২ খ্রি) শিবাজীর আদর্শ ও স্বদেশপ্রেমে উদ্বদ্ধ হয়ে ব্রজভাষায় রচনা করেছিলেন শিবা-বানী নামক একটি কাব্যগ্রন্থ। এই সময়ের কয়েকজন ব্রজভাষার কবির নাম বিশেষভাবে জানা যায়। এঁরা হলেন- ঘনানন্দ (১৬৯৯-১৭৪০ খ্রি)। সুন্দরদাস (১৫৯৭-১৬৮৯ খ্রি), মলূকদাস (৫৭৪-১৬৮২ খ্রি), পদ্মাকর (১৭৫৩-১৮৩৩ খ্রি)।

ব্রজভাষায় গদ্যরচনায় সূত্রপাত হয়েছে ১৬শ শতকেই, বিশেষত চুরাশি বৈষ্ণবের জীবনী রচনায় ('চৌরাশি বৈষ্ণবোঁ কী বার্তা') অথবা বৈষ্ণব ভক্তের কাহিনীতে ('দো সৌ বাত্তন বৈষ্ণবোঁ কী বার্তা')। তবে উনিশ শতক থেকেই ব্রজভাষার ধারা শীর্ণ হয়ে যায় আর তার স্থান দখল করে খড়ীবোলী হিন্দুস্থানী।

বাংলা ভাষায় যেসব কাব্যগুলোকে ব্রজবুলিতে লিখিত বলে দাবি করা হয়, সেগুলো হলো- আদ্য বাংলা ও অবহট্ঠের মিশ্রিত রূপ। এই ভাষাটি কৃত্রিম এবং কাব্যের। মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যধারায় ব্রজবুলি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বিশেষ করে- মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি মৈথিলি এবং ব্রজবুলি নামক মিশ্রিত ভাষাতে অনেক পদ রচনা করেছিলেন। এর ভিতরে ব্রজবুলিতে রচিত পদগুলোকে বাংলা ভাষার বিশিষ্ট রূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ- বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস প্রমুখ পদকর্তাদের অনুকরণে ব্রজবুলিতে যেসকল পদ রচনা করেছিলেন, তাতে ব্রজবুলি ছাড়াও ব্রজবুলির শব্দের মতো করে রবীন্দ্র-সৃষ্ট শব্দ পাওয়া যায়।

ব্রজভাষার ভাষাগত বৈশিষ্ট্য
ব্রজভাষার স্বরধ্বনিগুলির মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হলো হ্রস্ব ও দীর্ঘ্ এ্যা এবং অ’ ধ্বনি রয়েছে যা আদর্শ হিন্দীর মতো নয়। হিন্দিতে যেমন ড, ঢ স্থানে র উচ্চারণ দোষণীয় নয়। তেমনি ব্রজভাষায় এরূপ কিছু পরিবর্তন দোষণীয় নয়। নিচে এই জাতীয় কিছু ধ্বনি পরিবর্তন এবং সেই সাথে বানান পরিবর্তনের উদাহরণ দেওয়া হলো। 
    ল>র    জালো, আরো
    ড়>র    ঘড়া>ঘরা
    য>জ    যমুন>জমুনা
    শ>স    শঙ্খ>সঙ্খ, শিশু>সিসু
    ক্ষ>চ্ছ   অক্ষর>অচ্ছর
    ক্ষ>ছ    লক্ষমী>লছমী
    ম>ব    গাঁম>গাঁব, নাঁম>নাঁব।
    ভ>ব    কভু>কবু কভী>কবী
    গ>ঘ    পগা>পঘা
    ত>থ    ভরত>ভরথ, রথ>রত

ব্রজভাষার সর্বনাম
উত্তম পুরুষ: হৌঁ, মৈঁ, হম, মোঁ, মোয়, হমেঁ, মেরৌ, হমারৌ।
মধ্যম পুরুষ: তূঁ, তৈঁ, তুম, তো, তোয়, তুম্‌হেঁ, তেরৌ, তুম্‌হারৌ।

হিন্দি আকারান্ত ও ওকারান্ত পদগুলো ব্রজভাষায় ঔ-কারন্ত হয়ে যায়। এই বিষয়টি সর্বনামে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।

হিন্দি        ব্রজ              বাংলা
মেরা        মেরৌ            আমার
তেরা        তেরৌ           তোমার  
তুমকো     তকৌ           তোমাকে
উস্‌কো     বা-তাকৌ       তাকে, উহাকে
ইস্‌কা      যাকৌ            ইহার
তিস্‌কা    তাকৌ            উহার      

লিঙ্গবিচার
লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্রজ ও হিন্দী অভিন্ন। উভয় ভাষার ক্ষেত্রেই পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সাধারণত স্ত্রীপ্রত্যয় হিসাবে ব্যবহৃত হয় : নী,-ন,-ইয়া,-ঈ (আ)ঈ।

বচনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নাম শব্দের তির্যক বহুবচনের অন্তে-(অ) ন এবং মূল  বহুবচন স্ত্রীলিঙ্গ রূপের অন্তে-এঁ অথবা আনুনাসিকতা এবং পুংলিঙ্গ অন্তে-এ যুক্ত হয়, যথা-লরিকন, গইয়ন (তির্যক বহুবচন), লট-লটেঁ, ঘুড়িয়া- ঘুড়িয়াঁ, কান্টৌ কান্টে (মূল বহুবচন)।

 

                  ক্রিয়াগঠনের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, বর্তমান কাল ব্রজভাষায় মৌলিক বা প্রাত্যয়িক (Flectional) নয় তা কৃদন্ত (Participial)। স্মরণীয়, বাঙলা ইত্যাদি অন্যান্য আধুনিক পূর্বী আর্য ভাষায় এই বর্তমান কাল প্রাত্যয়িক। ফলে ব্রজভাষার বর্তমান কালে লিঙ্গ ও বচনভেদ থাকলেও পুরুষ ভেদ নেই, যথা-খেলত শ্যাম অপনে রঙ্গ, হৌঁ খেলত ইত্যাদি। হিন্দীর মতো এখানে অবশ্য অস্ত্যর্থক ক্রিয়া অনিবার্য নয় (তু. হিন্দী খেলতা হৈ)।

                  অতীতকাল অবশ্য কৃদন্ত অর্থাৎ ক্রিয়ার লিঙ্গ ও বচনভেদ আছে, কিন্তু পুরুষভেদ নেই, যথা-পুংলিঙ্গ একবচন গয়ৌ (হি. গয়া), বহুবচন গয়ে (=গএ)। স্ত্রীলিঙ্গ একবচন গঈ (গঈ), বহুবচন গঈঁ (গঈঁ)। অনুরূপ ক্রমে ভয়ো, ভয়ে, ভঈ, গঈঁ (=হিন্দী হুআ, হুএ, হুঈ, হুঈঁ)।

                   ভবিষ্যৎ কাল দু’ভাবে গঠিত হয়। প্রথম প্রকার যৌগিক পদগঠনে হিন্দীসুলভ-গো-গী,-গে (=হিন্দী-গা,-গী,-গে) যুক্ত হয়। যথা-হৌঁ জাঊ গো (=হি, মৈঁ জাঊঁঙ্গা)। দ্বিতীয় প্রকার ভবিষ্যৎ হলো প্রাত্যয়িক। এইজাতীয় ভবিষ্যৎ পদের প্রত্যয় হচ্ছে –হ-(<সং-স্য-), কাজেই তা তিঙন্তমূলক। প্রথম পদ্ধতিতে লিঙ্গ ও চবন ভেদ আছে কিন্তু পুরুষ ভেদ নেই, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বচনভেদ আছে কিন্তু লিঙ্গভেদ নেই, যথা-হৌঁ জৈহোঁ, খৈহোঁ ইত্যাদি (=হিন্দী মৈঁ জাঊঙ্গা, খাঊঙ্গা), জৈহৈ, খৈহৈ (=হিন্দী ৱহ্ জাএগা, খাএগা) ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, প্রথম প্রকার পদগঠন অর্বাচীন এবং হিন্দী প্রভাবজাত।

মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদকর্তাদের রচিত পদগুলোর সাধারণ নাম বৈষ্ণব সাহিত্য। এই সহিত্য আধুনিক বাংলা ভাষার মতো নয়। এর প্রকৃতি জানতে গেলে বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারাকে অনুসরণ করতে হবে।

আর্যরা যখন বৈদিক ভাষায় বেদ রচনা করছিলেন, সে সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন অনার্যরা নিজ নিজ ভাষায় কথা বলতেন। অনার্যদের এই ভাষার  সাধারণ নাম দেওয়া হয়েছে- প্রাকৃত। ভারতবর্ষের পূর্ব-প্রান্তে যেখানে বর্তমানে আমরা বসবাস করি, সে অঞ্চলের অনার্যদেরও ভাষা ছিল। কালক্রমে আর্যদের বৈদিক এবং পরের সংস্কৃত ভাষার সংস্পর্শে এসে সেকালের প্রাকৃত ভাষার শব্দভাণ্ডারে নতুন শব্দ যুক্ত হতে লাগলো। অজস্র সংস্কৃত, সংস্কৃত ভাঙা বা বিকৃত সংস্কৃত শব্দের প্রাবল্যে ক্রমে ক্রমে অধিকাংশ প্রাকৃত ভাষার শব্দ হারিয়ে যায়। প্রাকৃত ভাষার বাক্য গঠনের প্রকৃতির ভিতরেই এই প্রক্রিয়া সচল থাকায়- দেশী শব্দের সাথে বিজাতীয় শব্দের  মিশ্রণে একটি নতুন ভাষারীতির সৃষ্টি হতে থাকলো। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে এই প্রাকৃত ভাষাগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে বিকশিত হয়ে উঠলো। বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায় আদি যে নমুনা পাই তা 'চর্যাপদ' নামে বিশেষভাবে পরিচিত। প্রাচীন বাংলার এই নমুনাগুলোকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উদ্ধার করেছিলেন নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্ষাপদ রচনার কাল নির্ধরাণ করেছিলেন ৬৫০-১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময় [দ্রষ্টব্য : বাংলা সাহিত্যের কথা প্রথম খণ্ড, মাওলা সংস্করণ মার্চ ২০০০]। অবশ্য এই সময় নিয়ে মতভেদ আছে।