বাংলা
গান
(১৪৫০-১৭০০ খ্রিষ্টাব্দ)
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পরে বাংলা সাহিত্যের, বিশেষ করে কাব্যসৃষ্টিতে বাংলার কবিরা সক্রিয় উঠেছিলেন। এই ধারায় অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্য বাংলা কাব্যজগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পরে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগের শেষে, কৃত্তিবাস ওঝা (১৩৯৯-১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলা সাহিত্যের নবতর ধারার সূচনা করেছিলেন, বাংলায় রামায়ণ অনুবাদের মধ্য দিয়ে। ১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা অস্থির হয়ে উঠছিল, রাজা গণেশ, মুসলমান দরবেশদের বিদ্রোহ, জালালউদ্দীন, মহেন্দ্রদেব, সামসুদ্দিন আহমেদে সিংহাসনের দ্বন্দ্বে। অনেকেই মনে করেন ১৪১৮-১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর কবি কৃত্তিবাস অনুবাদ করেছিলেন রামায়ণ। বর্তমানে এই গ্রন্থটি 'কৃত্তিবাসী রামায়ণ' নামে পরিচিত। তবে রচনাকাল নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে। ১৮০২-০৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই গ্রন্থটি শ্রীরামপুর থেকে প্রথম মুদ্রিত হয়। পরে ১৮৩০-৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে জয়গোপাল তর্কালঙ্কা দুই খণ্ডে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছিল। এরপরে অনুবাদ সাহিত্যে পাওয়া যায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দীকে। উভয়ই ছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ)-এর শাসনামলের কবি। কবীন্দ্র পরমেশ্বর বেদব্যাসের মহভারত অনুবাদ করেছেলেন সংক্ষিপ্তাকারে। আর শ্রীকর নন্দী অনুবাদ করেছিলেন জৈমিনি-সংহিতা অনুসরেণে মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব।
বাংলা নাগরিক গানের ক্রমবিকাশের ধারায় ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের কিছু আগে আমরা নাগরিক গান হিসেবে পাই বিদ্যাপতির পদাবলি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং নব্যধারার শ্রীচৈতন্য-প্রভাবিত কীর্তন গান। এই সময়ে বাংলা লোকগানের বিকাশ ঘটেছিল ভিন্নতর ধারায়। এই ধারায় বিশেষভাবে যুক্ত হয়েছিল প্রধান সুরাঙ্গ ধারার গান। এগুলো হলো- ঝুমুর, বাউল, ভাওইয়া, ভাটিয়ালি।
এই বিচারে বাউল দর্শন
এবং বাউল গানের বিকাশ ঘটেছিল ১৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দের আগেই।
১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলা বিভিন্ন অঞ্চলে বাউল আখড়া
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এসব আখড়ায় বাউলরা নিজেদের মতাদর্শ অনুসারে জীবনযাপন করতো।
এঁরা তাঁদের মতাদর্শকে গানে গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা শুরু করেছিল ব্যাপকভাবে।
এই ভাবে বাউল গান একটি স্বতন্ত্রধারার গান হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের
ভাটিয়ালি এবং পশ্চিমবঙ্গের (নদিয়া-শান্তিপুর) কীর্তনের সংমিশ্রণ গড়ে উঠেছিল
বাউলের সুর।
[সহায়ক পাঠ:
বাউল]
মঙ্গলগান
বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় মঙ্গলকাব্যকে। নানা কারণে
মঙ্গলকাব্য মধ্যযুগীয় বাংলাসাহিত্যকে একটি বিশিষ্ট অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এর বিস্তার ঘটেছিল খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর ভিতরে। মূলত লৌকিক
কল্যাণের জন্য পৌরাণিক ও লোক কাহিনির সমন্বয়ে এই কাব্যগুলো রচিত হয়েছিল। হিন্দু
পৌরাণিক বিশ্বাসের সাথে এ কাহিনির সম্পৃক্ততা রয়েছে অবলম্বন হিসেবে। কিন্তু
কাহিনিরই বিস্তার ঘটেছে লৌকিক জীবনযাপন ভিত্তিক উপাদনের সমন্বয়ে। এগুলো মূলত
মধ্যযুগীয় পাঁচালিরই কাব্যরূপ। মঙ্গলকাব্য রচনার সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে সেকালের
ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং কাব্যধর্মী
উপস্থাপনার প্রেরণা।
[সহায়ক পাঠ:
মঙ্গলকাব্য]
সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মুসলমান গীতি কবিদের মাধ্যমে জারি গানের সূচনা হয়।
যতদূর জানা যায়, কবি
মুহম্মদ খান ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মকতুল হোসেন শীর্ষক কারবালা-কেন্দ্রিক একখানি
শোকগাথা রচনা করেন। এই গ্রন্থটি আখ্যায়িকা কাব্য হিসেবে পরিচিত। এক সময় এই গ্রন্থটি
আশুরা উপলক্ষে সুর করে পাঠ করা হতো। সেই কারণে এই গ্রন্থটিকে জারি গানের আদি
নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
[সহায়ক পাঠ:
জারি]
সূত্র :
বাঙালির গান।
দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমি, এপ্রিল ২০০১।
বাঙালির রাগসঙ্গীত চর্চা। দীলিপকুমার মুখোপাধ্যায়।