ঝুমুর

বাংলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ রাঢ়, ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের একটি প্রকরণ হলো। মূলত ঝুমুর হলো- গান, নাচ, তাল ও গায়নশৈলী নিয়ে একটি সাধারণ লোকসঙ্গীতের ধারা।

ঝুমুরের নামকরণ: ঝুমুর নামটি নিয়ে মতভেদ আছে। সুকুমার সেনের মতে-

'...নাট্য গীতের একটি ধারা ঝুমুর নামে পরিচিত ছিল। এই নাট্য গীত পালায় কোন গদ্য সংলাপ থাকত না। পুরো পালাটাই ছিল গানের। সংস্কৃতে ঝুমুরকে বলা হত জম্ভলিকা। জম্ভলিকা নাচ হইতে আসিয়াছে রাজস্থানী ঝামাল গান। বাংলায় ইহা একদিকে ধামানীতে ও অপরদিকে ঝুমুর-এ পরিণত।’

সুকুমার সেনের মত গ্রহণ করলে, বলা যায় যে, হয়তো সাঁওতালি বা বাংলা ঝুমুর নাচ ও গানকে সংস্কৃতভাষীরা জম্ভলিকা বলতো। কেউ কেউ বলেন ঝুমুর (নূপুর) শব্দের সাথে ঝুমুর গানের সম্পর্ক আছে। আবার অনেক বলে থাকেন ঝুমরি রাগের বা সুরে পরিবেশিত গানগুলোই ঝুমুর গান নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।

বাঙালিদের ভিতরে এই গান ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের শুরুর আগে থেকেই। তবে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য যে অঞ্চল জুড়ে বিকশিত হয়েছিল, ঝুমুর অঞ্চল তার বাইরে ছিল। সে কারণে, ঝুমুর পূর্ববঙ্গ, দক্ষিণ-মধ্য বঙ্গ, উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ অংশে মধ্যযুগীয় সাহিত্যের প্রথমদিকে ততটা প্রভাব ফেলে নি। সম্ভবত সে কারণে বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ঝুমুর বা ঝুমরি নামে কোনো গান বা রাগের উল্লেখ নেই। প্রখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাসের মাতামহ দামোদর সেনের 'সঙ্গীত দামোদর' গ্রন্থে প্রথম 'ঝুমুর' শব্দ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত সঙ্গীত দামোদরে উল্লেখ আছে-

প্রায়ঃ শৃঙ্গারবহুলা মধ্বীক মধুরামৃদু।
একৈব ঝুমুরীলৌকে বর্ণদিনিয়মোজ্‌ঝিতা

[প্রায়সই শৃঙ্গারবহুল মধুর মৃদু সুরার (মাধ্বীক) মতো। ঝুমুরে বর্ণাদি (বর্ণালঙ্কার ও ছন্দ) নিবদ্ধ নয়।]

ঝুমুর সম্পর্কে সঙ্গীত দামোদর-এর এই উক্তি অনুসারে জানা যায়, ঝুমুর গান শৃঙ্গার রসের এবং তাতে মধুর ব্যঞ্জনা আছে। অশ্লীল বলে এই গান দোষণীয় নয়। এই গানের কোনো বাঁধা-ধরা ছন্দও ছিল না।

মধ্যযুগের পদকল্পতরু নামক গ্রন্থের একটি পদে লেখা রয়েছে, 'যুবতী যুথ শত গায়ত ঝুমরী'। মধ্যযুগের আদি কবি, বিদ্যাপতি তাঁর পদাবলীতে লিখেছেন, 'গওই সহি লোরি ঝুমরি সঅন - আরাধনে যাঞা'। তাঁর পরবর্তী সময়ে রচিত গোবিন্দদাসের পদে পাওয়া যায়- 'মদনমোহন হরি মাতল মনসিজ যুবতী যুথ গাওত ঝুমরী'। এ সকল নমুনা থেকে মনে হয়, বাংলা সাহিত্যের বা সঙ্গীতের মধ্যযুগের পূর্বে ঝুমুরের উপস্থিতি ছিল।

ঝুমুরের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ধারা:
ঝুমুরের বিকাশ ঘটেছিল প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীর সঙ্গীতচর্চার মধ্য দিয়ে। প্রায় ৭৫-৬০ হাজার বৎসর আগে ভারতে আগত প্রথম জনগোষ্ঠী ছিল নেগ্রিটো। এদের পর প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর আগে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। এরা বেছে নিয়েছিল উত্তর ভারতের অরণ্যাঞ্চল। শুরুর দিকে এরা ছিল অরণ্যচারী শিকারী। কালক্রমে এরাই ভারতবর্ষে প্রথম কৃষির পত্তন ঘটেয়েছিল। এরা ছিল যাযাবর। ফলে এদের দ্বারা কোনো বিশেষ স্থানে স্থায়ী নগর গড়ে ওঠে নি। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৭ হাজার অব্দের দিকে ভারতবর্ষের প্রবেশ করেছিল দ্রাবিড় নামক জনগোষ্ঠী। এরা সিন্ধু নদের তীরে নগর সভ্যতার (সিন্ধু সভ্যতা) পত্তন ঘটিয়েছিল। এদের সাথে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বড় ধরনের সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল কিনা তা বিশেষভাবে জানা যায় না। তবে এদের সাথে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণে ভারতবর্ষে মিশ্র জাতির সূচনা ঘটেছিল। এই মিশ্রজাতির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল নবতর ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির। কালক্রমে এই মিশ্র ভাষা-সংস্কৃতির থেকে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাকৃত-সংস্কৃতি। এই মিশ্র জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল এবং এই সূত্রে ভাষাও নতুন রূপ লাভ করেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দের দিকে
আর্য ভাষাভাষীরা ভারতে প্রবেশের পূর্বে ভারতবর্ষের ভাষার বিকাশ ঘটেছিল দ্রাবিড় প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের  ভাষার সংমিশ্রণে। এই ধারা তিনটি হলো-

১. খাঁটি দ্রাবিড়য়ান ভাষা। এর ভিতরে বঙ্গের কাছাকাছি ভাষা ছিল ওঁরাও এবং অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা।
২. খাঁটি অস্ট্রিক ভাষা। এর ভিতরে বঙ্গের কাছাকাছি জনগোষ্ঠী হলো সাঁওতাল , মুণ্ডা ইত্যাদির ভাষা।
৩. আদি প্রাকৃত ভাষা। খাঁটি দ্রাবিড়য়ান ভাষা এবং খাঁটি অস্ট্রিক ভাষার মিশ্রণে সৃষ্ট কথ্যরূপ।

উল্লিখিত তিনটি ধারার ভাষার ভিতরে আদি প্রাকৃত ভাষা থেকে উদ্ভব হয়েছিল বাংলা, হিন্দি, অহমিয়া ইত্যাদি ভাষা। বর্তমান অখণ্ড বঙ্গদেশ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের মিশ্র জনগোষ্ঠীর ভিতরে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের ভাষা ও সঙ্গীতের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। এই কারণে আদি বাংলা শব্দ বা দেশী শব্দ বলতে এখন আমার যা বলে থাকি, তার ভিতরে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীর অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষার শব্দ। বিশেষ করে সাঁওতাল, মুণ্ডা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর ভাষা। অন্যদিকে দ্রাবিড় গোত্রের ভাষার ভিতরে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল ওঁরাওঁ ভাষা।

ভাষাবিজ্ঞানীরা আর্য ভাষাভাষীদের আদিম ভাষার নাম দিয়েছেন ভারতীয়-আর্য ভাষা। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৮০০ অব্দের ভিতরে বেদ রচিত হয়। এই সময় ভারতীয়-আর্য ভাষার পরিবর্তন ঘটে। ভাষাবিজ্ঞানীরা এই পরিবর্তিত ভাষাকে বলে থাকেন বৈদিক ভাষা। পরে সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই ভাষা সংস্কৃত ভাষা হিসেবে পরিচিত লাভ করেছিল। সংস্কৃত ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সাথে দ্রাবিড় প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণে নব্য ভারতীয় জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে মিশ্র জনগোষ্ঠী সংস্কৃত ভাষাকে প্রশ্রয় দিয়েছিল বেশি। ফলে এসকল ভাষায় প্রবেশ করলো তৎসম, অর্ধ-তৎসম এবং তদ্ভব শব্দের। সব মিলিয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে নব্য আর্যভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছিল। ঠিক একই সময় আর্য-অনার্য সঙ্গীতের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল নব্য লোকসঙ্গীত। এই আদি লোকসঙ্গীতের অন্যতম ধারাই হলো 'ঝুমুর'।

আদি ঝুমুর পর্বে শিল্পী ও শ্রোতারা ছিলেন প্রান্তিক অর্থাৎ নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মানুষ। ধর্ম ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এরা ছিলেন অন্ত্যজ। এই সময়ে স্থানীয় কূর্মি, মাহাতো, কুমোর, রাজওয়ার, ঘাটাল, হাড়ি, মুচি প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল ঝুমুর। একই সময় ঝুমুর গান করতেন সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা ইত্যাদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।

বর্তমানে ঝুমুর অঞ্চল বলতে বুঝায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড রাজ্য, বিহারের মালভূম অঞ্চল। এই বিচারে ঝুমুর শুধুই পশ্চিম বাংলার লোকসঙ্গীত নয় বরং বলা যায় উত্তরভারতীয় লোকসঙ্গীতের ধারা। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে এর ব্যাপ্তী বাংলার রাঢ়অঞ্চল থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত। এর বাইরে পাওয়া পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসামের চা-বাগান ও অন্যান্য অঞ্চলে। ঝুমুর অঞ্চলের অভিজাত মানুষ, সংস্কৃত ভাষায় রচিত পৌরাণিক কাহিনী এবং রাগাশ্রয়ী গানের অনুরক্ত ছিল। বিশেষভাবে চর্চিত হয়েছে মুণ্ডা, ওঁরাও, ভূমিজ, মাহাতো, বাগাল, লোধা, কুর্মি, বাউরি জনগোষ্ঠীর ভিতর। মুসলমানদের বঙ্গদেশে আধিপত্য বিস্তারের আগে বাঙালি হিন্দুদের নিম্নবর্গের মানুষদের ভিতরে এই গানের চর্চা ছিল। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলা ঝুমুর প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজির বঙ্গদেশ অধিকার করার পর, বহু অন্ত্যজ হিন্দু ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ঐতিহ্যগতভাবে নব্য মুসলমানদের ভিতরে ঝুমুরের চর্চা ছিল। এই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া অঞ্চলে মুসলমান সমাজে বিয়ের গীত হিসেবে বিশেষ ধরনের ঝুমুর গান গাওয়ার রীতি ছিল। বর্ধমান এবং বীরভূম অঞ্চলে এখনও বিয়ের উৎসবে স্ত্রীআচার হিসেবে ঝুমুর ডালা এবং ঝুমুর খেলার চল রয়েছে।

১২০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দকে ভাষাতাত্ত্বিকরা অভিহিত করেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ হিসেবে। কারণ এই সময়ের মধ্য বাংলা সাহিত্যের কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি। নিঃসন্দেহে এই সময়ের ভিতরে বাংলার অস্থিতিশীল পরিবেশে লোক সঙ্গীতের ধারাও  বিঘ্নিত হয়েছিল। তবে লোকসংস্কৃতির ধারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সে কথা বলা যায় না।

১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের পরে নাগরিক সঙ্গীত ধারায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বিদ্যাপতির সূত্রে- বাংলা সাহিত্য এবং সঙ্গীতের নূতন অঙ্গ যুক্ত হয়। সংস্কৃত কাব্য গীতগোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং বিদ্যাপতির রচনার ভিতর দিয়ে কীর্তন-সাহিত্য এবং কীর্তন-গানের আদিপর্বের সূচনা হয়েছিল। এই ধারা বাংলা লোকসঙ্গীতের ঝুমুর গানে নতুন বিষয়বস্তু যুক্ত করার ক্ষেত্র রচনা করেছিল। কথিত আছে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে শ্রীচৈতন্য ঝাড়খণ্ডের ভিতর দিয়ে পুরী থেকে বৃন্দাবন যাত্রা করেন। এই সময় বৈষ্ণবদর্শন বা বৈষ্ণব গানের বিষয় ঝুমুরে সঞ্চালিত হয়। এই সূত্রে অনুষ্ঠাভিত্তিক গাহা গানে পৌরাণিক ভাব ধারা যুক্ত হয় এবং পৌরাণিক ঝুমুরের সূত্রপাত ঘটে। অন্যান্য লোকসঙ্গীতের মতই, ঝুমুরের আদি পর্বে গান রচিত হতো মুখে মুখে। এসকল গানে তখন ভনিতা ছিল না। ফলে ঝুমুর রচয়িতার নাম পাওয়া যায় না। সম্ভবত এই সময় থেকে ভনিতাযুক্ত ঝুমুরের রচনা শুরু হয়েছিল।

চৈতন্য পরবর্তী কালের ঝুমুরের বাণী ও সুরে ব্যাপক রদবদল ঘটেছে। এই কালপর্বকে বলা হয় ঝুমুর গানের মধ্যযুগ বা কাব্যযুগ। এই যুগে পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে পালাধর্মী ঝুমুর ও ছুট ঝুমুরের উদ্ভব ঘটে। পালাধর্মী ঝুমুর গানে কাহিনি ভিত্তিক আখ্যান যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি কাব্যের অলঙ্কার ব্যবহার হয়েছিল এই সময়। এই গান রচয়িতাদের বেশিরভাগই ছিলেন বৈষ্ণব। এর ফলে ঝুমুর গানে বৈষ্ণবদের ভক্তিগীতি, কীর্তনের ছায়া পড়েছিল ব্যাপকভাবে। এক্ই কারণে এই সময়ের ঝুমুরে রাধাকৃষ্ণ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছিল।

কালক্রমে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উচ্ছাসের সাথে, জনগোষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠানের রীতিনীতিও যুক্ত হয়েছে ঝুমুর গানে। এর সাথে পৌরাণিক ঝুমুরে সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল ঋতুভিত্তিক ঝুমুর। এসব গান হয়ে উঠৈছিল ধর্ম ও কর্মের গান। এসূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল ঋতু বা মাসকে উৎসব হিসেবে উদ্‌যাপনের উদ্দেশ্যে প্রকৃতি পর্যায়ের ঝুমুর। সাধারণভাবে বার মাসের বন্দনা দিয়ে গাঁথা গানকে বলা হয় বারমাস্যা। এর বাইরে ঋতু বা মাসের নামানুসারে এই ঝুমুরের নামকরণ করা হয়। যেমন- চৈতালি, বৈশাখি, আষাঢ়িয়া (আষাঢ় মাসের জন্য), ভাদরিয়া (ভাদ্র মাসের জন্য)।

এছাড়া ঝুমুর গানে স্থানীয় লৌকিক দেবদেবীর পুজা-অর্চনার বিষয় অঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই সূত্রে ধীরে ধীরে লোকউৎসব করম, ভাদু, টুসু, বাঁদনা এমনকি বিয়ের আসরেরও অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠেছিল ঝুমুর নাচ ও গান। মূলত এই সূত্রে ঝুমুর প্রায় সব স্তরের মানুষের গান হয়ে উঠেছিল।

মধ্যযুগী বাংলা ঝুমুরের ক্রমবিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল বৈঠকী ঝুমুর।  বৈঠকী ঝুমুরের শুরুর দিকে  স্থানীয় সামন্তপ্রভুরা বড় করে আসার বসিয়ে ঝুমুর গান শুনতেন। পরে এই ঝুমুর হয়ে উঠেছিল সামন্তপ্রভুদের নিজেদের আভিজাত্য বা ঠাট বজায় রাখার উপকরণ। তাঁরা বেশ জাঁকজমক করে ঝুমুরের আসর বসাতেন। এই সূত্রেই তৈরি হয়েছিল 'বৈঠকি ঝুমুর'। এসব আসরে লৌকিক ঝুমুর ও পৌরাণিক ঝুমুর- উভয়ই স্থান পেতো। এই ঝুমুর থেকেই তৈরি হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর দরবারি ঝুমুর।

বৈঠকি বা দরবারি
ঝুমুরের পাশাপাশি মধ্যযুগের অনুষ্ঠান বা পরব কেন্দ্রিক ঝুমুরের সূত্রে সৃষ্ট হয়েছিল তুসু-ভাদু, করম-জাওয়া, বান্দনা জাতীয় গানের ধারা। তবে এস ঝুমুর ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে স্বতন্ত্র লোকসঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। যেমন করম ঝুমুর থেকে উৎপত্তি হয়েছিল ডালধরা বা ডাইড়ধরা। পুরুলিয়া অঞ্চলের ভাদু গানের সাথে ঝুমুর মিশে তৈরি হয়েছে ভাদরিয়া।

১৮৫০-১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ঝুমুর কবিরা কাব্যধর্মী ঝুমুর রচনা করেছেন। এ সকল ঝুমুরে পাওয়া
যায় ভাব ও ভাষা শৈল্পিক পরিমিত বোধ। সাধারণ চটুল ছন্দের সস্তা চাল বর্জন করে, শব্দের নান্দনিক ধ্বনি ও অর্থের প্রাধান্য পেয়েছিল এই ঝুমুরে। এই জাতীয় ঝুমুর রচনা করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন ভবপ্রীতানন্দ ওঝা, রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলি, পীতাম্বর দাস, দুর্যোধন দাস, হাড়িরাম রায়, গফাধর চৌধুরী প্রমুখ।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকভারত বিভাজনের সূত্রে বাংলা ঝুমুর অঞ্চলটি ভারতের পশ্চিমবাংলায় পড়ে। ফলে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান ঝুমুর গানের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই সময়ের পর থেকে ঝুমুর অঞ্চলে বাণীতে যুক্ত হয়েছিল নগরকেন্দ্রিক জীবনযাপনের চিত্র। যাকে অনেক সময় ঝুমুর গানের আধুনিক যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পাক-ভারতের স্বাধীনতার পর, ঝুমুর গানে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। আধুনিক কালে এর ছাপ পাওয়া যায় রাজনীতি বিষয়ক, গল্পধর্মী ঝুমুর গানে। সলাবত মাহাত, কৃত্তিবাস কর্মকার, ধ্রুবসিং সরদার, কুচিল মুখোপাধ্যায়, সদানন্দ সিং মুড়া প্রমুখ ঝুমুরিয়ারা স্বনামধন্য হয়েছে এই জাতীয় ঝুমুরের মধ্য দিয়ে।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে কাব্যের কৃ্ত্রিম সৌন্দর্য থেকে বেরিয়ে এসে, আবার স্বাভবিক সৌন্দর্যের চর্চা শুরু হয় ঝুমুর গানে। এই গানে বিষয় উঠে এসেছে আধুনিক নগর জীবনের কথা, গ্রাম বাংলা মানুষের কথা। সকল ক্ষেত্রেই উঠে এসেছে আর্থ-সামাজিক সমস্যার কথা। এই শ্রেণির ঝুমুর রচয়িতাদের মধ্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন সলাবত মাহাত, কুচিল মুখার্জী, বিজয় মাহাত প্রমুখ।

ঝুমুরের বিষয়াঙ্গের প্রকরণ:
বিষয়াঙ্গের বিচারে ঝুমুরের ব্যাপ্তী বিশাল। কাল বিবর্তনের ধারায় ঝুমর অঞ্চলের মানুষের জীবযাত্রা পাল্টে গেছে। এর সাথে সাথে ঝুমর গানে নতুন নতুন বিষয়াঙ্গ যুক্ত হয়েছে। আদি ঝুমুরের বিষয়াঙ্গ ছিল কৃষিজীবী মানুষের কৃষির সাথে সম্পর্কিত বিষয় এবং নরনারীর প্রেম। চৈতন্যযুগের পর ঝুমুরে কীর্তনাঙ্গের ঝুমুর। একই সাথে বৈষ্ণবধারার বাইরে রচিত হয়েছিল নানা ধরনের পৌরাণিক ঝুমুর। আবার ব্রিটিশ ভারতে ঝুমুর গানে আধুনিক নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় নাগরিক জীবনের বিষয়াদি নিয়ে ঝুমুর রচিত হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছিল ঝুমুর অঙ্গের ছাদ পেটাইয়ের গান এবং অন্য শ্রমজীবী মানুষের গান। বাংলার বিভিন্ন দ্রোহ-মূলক গানেও ঝুমুরের প্রভাব পড়েছে। সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি উপলক্ষে ঝুমুর বা ঝুমুর অঙ্গের গান রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম গান 'তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে'- ঝুমুরের সুরের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

আদি কালে সাঁওতালদের ভিতরে এই গান এবং নাচ ধর্মীয় প্রথা বা আদর্শকে অনুসরণ না করে জীবনধর্মী গান হিসেবে বিকশিত হয়েছে প্রজন্ম-পরম্পরায়। কৃষিভিত্তিক সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ভিতরে ঝুমুর গান ও নাচের বিকাশ ঘটেছিল কর্মক্ষেত্রে। তারই অনুসরণে বাঙালিদের ভিতরে সৃষ্টি হয়েছিল 'হাকা' গান। হাকা অর্থ ডাক দেওয়া বা আহ্বান করা। গানের সুরে সুরে কাজে আসার আহবান করার মধ্য দিয়ে। কৃষিকাজের প্রকৃতি অনুসারে এই গানের তিনটি রূপ তৈরি হয়েছিল। এগুলো হলো-

আআবাইদা: আবাইদা হলো আবাদ করা বা চাষ করা। ভূমিকর্ষণের জন্য এই আবাহন গীত তৈরি হয়েছিল।
রুআ:
রুআ হলো রোপণ করা। ভূমিকর্ষণের পর ভূমিতে বীজ বপন বা চারা গাছ রোপনের জন্য এই আবাহন গীত তৈরি হয়েছিল। পুরুলিয়া অঞ্চলের ধান রুআ হাঁকা ঝুমুরের দুটি নমুনা তুলে ধরা হলো –
১. কই দিলহি বার আনা রে অতর,
    পলাস তলে রহইল বিছানা রে।
২. আইসব বলে কই আলি হে
     দরগাই হাথ কড়া পাইহ্রাল হে।

কাটা: ফসল কাটার মৌসুমে কৃষকদের সমবেত করার জন্য এই গান পরিবেশিত হতো।

কৃষিকাজের বাইরে পুরুষরা বিভিন্ন স্থানে নানা প্রয়োজনে স্বতন্ত্র 'হাকা' গান পরিবেশন করতো। বিশেষ করে, মানবিক প্রেমের আহ্বানের সূত্রে বহু ঝুমুর রচিত হয়েছে। এই ঝুমুর থেকে উৎপন্ন সৃষ্টি হয়েছিল টাঁড় ঝুমুর। বিভিন্ন ঝুমুর গবেষকরা ঝুমুর গানকে নানা ভাবে ভাগ করেছেন।

মানুষের প্রত্যাহিক জীব্নযাত্রা এবং ধর্মাভাব অনুসারে ঝুমুরকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগ দুটি লৌকিক ঝুমুর ও পৌরাণিক ঝুমুর। আবার আঞ্চলিক উচ্চারণ ও অর্থের বিচারে ঝুমুরকে বলা যায় ঝাড়খণ্ডী ঝুমুর, মুরশিদাবাদের ঝুমুর ইত্যাদি।

লৌকিক ঝুমুর

মধ্যযুগের প্রথমার্ধে জীবন-জীবিকার সূত্রে সৃষ্ট জীবনঘনিষ্ট ঝুমুর সাধারণ মানুষের কাছে আদরণীয় ছিল। সমাজের সাধারণ কৃষক, কামার কুমোর, জেলে ইত্যাদি ছিল এই জাতীয় ঝুমুরের শ্রোতা-দর্শক। ফলে এই গানে চটুলতা, প্রাত্যহিক জীবনের হাল্কা রসিকতা, আনন্দ-বেদনার কথা বিশেষভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের কথা, কর্মজীবনের কথা, প্রকৃতির বর্ণনা পাওয়া যায় এ সব ঝুমুর গানে। লৌকিক ঝুমুরের বিষয়ানুসারে কয়েকটি দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-

পৌরাণিক ঝুমুর:
ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিক্ষিপ্তভাবে দু'একটি রাধা-কৃষ্ণের লীলাভিত্তিক ঝুমুর গান তৈরি হয়েছিল। পরে পৌরাণিক আখ্যান নির্ভর ঝুমুর তৈরি হতে থাকে। বিশেষ করে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক ঝুমুরের বিকাশ ঘটেছিল উত্তরবঙ্গ, রাঢ় বাংলা এবং দক্ষিণ-মধ্য বঙ্গে। এক্ষেত্রে বৈষ্ণবধর্মাবলম্বীদের দ্বারা ঝুমর প্রভাবিত হয়েছিল। এর ফলে লৌকিক ভাদরিয়া ঝুমুরের অনুপ্রবেশ ঘটে 'পৌরাণিক ঝুমুর'-এর। সব মিলিয়ে ভাদরিয়া গান মধ্যযুগে হয়ে উঠেছিল ধর্ম-কর্মের গান। পৌরাণিক ঝুমুরের প্রধান ধারা রাধা-কৃষ্ণের লীলা। যেমন-

গোপী – গোবিন্দের লীলা
       নিরমল সুখশিলা
   শুদ্ধ জ্ঞান আছিল হে –
তিলমাত্র কাম গন্ধ না ছিল ।

বৈঠকী ঝুমুরে কীর্তনের প্রভাব ছিল। সেকারণে আদি ঝুমুরের বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি দরবারি ঝুমুরে কীর্তনের খোল ও করতালের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এছাড়া ঝুমুরের এই পর্যায়ে পুরাণ কাহিনির পাশাপাশি সহজিয়া বাউলতত্ত্বের অনুপ্রবেশ ঘটা শুরু হয়েছিল।

পরিবেশনগত অঙ্গ: ঝুমুরের পরিবেশনগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে নানা নামে অভিহিত করা হয়। যেমন-

ঝুমুর নাচ

সাঁওতাল ওঁরাও, মুণ্ডা ইত্যাদি আদিবাসী ঝুমুরের সাথে মেয়েরা দল বেঁধে নাচতো। পুরুষরা মূলত গান গাইতেন এবং ধামসা, মাদল সহযোগে এই গানের সঙ্গে সঙ্গত করতেন। রক্ষণশীল বাঙালিদের কারণে, বাংলা গাহা পর্যায়ের গানে নাচের ব্যবহার ততটা ছিল না বলেই অনুমান করা যায়। গাহা পর্যায়ে ঝুমুর নাচে মেয়েদের অংশগ্রহণ শুরু হয়েছিল ধনাঢ্যদের বৈঠকি ঝুমুরে। তবে ঝুমুর-গান একেবারে নৃত্যশৈলী-মুক্ত ছিল একেবারেই বলা যায় না। বরং ঝুমুর অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে নানা আঙ্গিকে ঝুমুর-নাচ বিকাশ লাভ করেছিল। এই নাচগুলোর ভিতরে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়, এমন নাচগুলো হলোছৌনাচ, নাচনী ঝুমুর, খেমটি নাচ, রণপা ঝুমুর নাচ, পাতা নাচের ঝুমুর, করম নাচ,  বুলবুলি নাচ, দাইড় নাচ


ভাদু-টুসু-করম-বাঁদনা পরবে ধর্মীয় আচারের অংশ হিসেবে গাওয়া হলেও, এসকল গানে গভীর আধ্যাত্মিক ভাবনা নেই। নিতান্তই আটপৌরে জীবনের বিষয়াদি নিয়ে এসব গান গাওয়া হতো। এসকল গানের দেবতা ছিলেন নিতান্তই পাড়ার মুরুব্বির মতো। তাই এসকল গানের নাচে চলে এসেছে সরল ছন্দ।

সাধারণভাবে ঝুমুর গানের সাথে ব্যবহৃত নাচকে ঝুমুর নাচ বলা যায়। কিন্তু বিষয়াঙ্গিকের বিচারে ঝুমুর নাচকে বিশেষ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।

 

ঋতু বা মাসভিত্তিক ঝুমুর:

 

আনুষ্ঠানিক ঝুমুর: পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানিদির জন্য ঝুমুর পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠানভিত্তিক ঝুমুরগুলোকে বলা হয়- বিবাহ, করম, বাঁদনা, অহিরা, সখেরল, জাওয়া ইত্যা দি।
 

স্থানভিত্তিক ঝুমুর:
বাংলার বাইরে রয়েছে ঝাড়খণ্ডি ঝুমুর। রাঢ় বাংলা নিকটবর্তী ঝাড়খণ্ডের নামে এই ঝুমুর পরিচিত। এই অঞ্চলের ঝুমুর গানে প্রচুর হিন্দি শব্দ পাওয়া যায়। এছাড়া এই অঞ্চলের চা-বাগানগুলোতে নানা ভাষার মানুষ কাজ করে। ফলে এদের ভিতরে, মিশ্রভাষায় ঝুমুর গানও পাওয়া যায়।

বাংলা লোকসঙ্গীতের এই বিশিষ্ট ধারা রাঢ় অঞ্চল ছাড়িয়ে বরেন্দ্রভূমির জনপদকে ছড়িয়ে পড়েছিল বটে। কিন্তু পূর্ববঙ্গ ও মধ্য-দক্ষিণ বঙ্গে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। একালের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের বাঁকুড়া, বীরভূম,  মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান ও চব্বিশ পরগণাকে ঝুমুরের মূল বিচরণক্ষেত্রে হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আঞ্চলিকতার কারণে ঝুমুরের শব্দের এবং উচ্চারণের প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। নিচে কয়েকটি অঞ্চলের ঝুমুরের নমুনা দেওয়া হলো।

 

মুর্শিদাবাদের ঝুমুর

তোদের তাল গাছে তালের মছা, শ্বশুর ওঝা বউ কেনে বাঁঝা

হুঁকো ফাটা কলকে বুচা খাগড়া খালের নল

ঐ দেখ তোর জামাই এল তামাক খেতে বল।
শাশুড়ীতে হুঁকা ধরায়, জামাই হাত বাড়ায়
বীরভূইঞা মুর্শিদাবাদে, হুঁকো খাইতে শ্বাশুড়ি সাধে।

বর্ধমানের ঝুমুর

আমার বঁধু মনে করেছে, কথা সে আর কইবে না, করছে আড়ি
মন উচাটন হয় যে আমার, কি দিয়ে তার মন পাব
বাজার থেকে শাড়ী এনে তাই দিয়ে সান ভাঙ্গাব
বঁধু করেছে আড়ি।
সোহাগ করতে গেছি তাকে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে
সাঁঝ বেলাতে চুল বাঁধেনি, চাঁদ মুখে কিরণ লেগেছে
সারা অঙ্গের গয়না গাঁটি রাগ করে খুলে ফেলেছে
বঁধু করেছে আড়ি।
মন হয়েছে বারি।

 

ঝাড়গ্রামের ঝুমুর

ঝাড়গ্রাম হাট যাইতে বিহাই এ ধরল হাতে
বিহাই ছাড় হাথ-ঝুড়ি ঝাঁটি বিকিই সাঁঝের ভাথ রং
দিনে ঝড়ে করম নাই সকাল সাঁঝে বনে যাই
পেটের জ্বালাই বনের কাঠরং
ছুট ছুট ছানা পনা অভাব স্বভাব বুঝে নাই
তক্ষের জ্বালাই কান্দে সারা রাইৎরং
উধার ধারের বালাই নাই কেমনে বাঁচব ভাই
মহাজনে বলে ছুটু জাইৎ রং

মেদিনীপুরের ঝুমুর

পাত তুলি নিতি নিতি ঝুড়ি ঝাঁটি দাঁতনকাঠি
আইজ কেনে বাবুই করে মানা গো –
উয়াদের বন নাইছিল জানা।
শাল পাত্রের পাতরি, দকান বাবুর দরবারি
লেতন পইসা নাই জানি গুনা গো।
সরু সরু শাল ঝাঁটি, ভাইঙ্গে করি দাঁতন কাঠি
দাঁতন বিকে হয় দু- চাইর আনা।
শাল ঝাঁটি বিকিকিনি ঘাম ঝিটা মাড়পানী
তাও কেনে করে জরিমানা।

চাবাগানের মিশ্র ভাষার ঝুমুর

আল কিনারে নাহর গাছে
বগা বগা ফুল
ফুল কে দেখিয়া ছুরি
ধ্যাচাকে চামড়াইল

 

ঝুমুর সুর ও তালের
ঝুমুরের সুর ও তাল একীভূত হয়ে একটি বিশেষ সঙ্গীত-বৈশিষ্ট্য তৈরি করে। যা শুনে ঝুমরকে পৃথকভাবে চেনা যায়।
মাঠের বা আঙিনার শ্রোতাদের শ্রবণযোগ্য করা জন্য উচ্চস্বরের গান করা হতো। এতে সুরের বা তালের জটিল বিন্যাস ছিল না। বেশিরভাগ সময়ে তার সপ্তকে গান হলেও মধ্য সপ্তকে সুরের বিরাম ঘটতো। মন্দ্র সপ্তকে এই ঝুমুর প্রায় গাওয়াই হতো না। এই গানে শুদ্ধ ও কোমল স্বরের সহজাত বিন্যাস ছিল। তবে এতে জটিল ও বক্রস্বরের প্রাধন্য ছিল না। যন্ত্রানুষঙ্গ হিসেবে ধামসা, মাদল, ঘুঙ্গুর, বাঁশী ব্যবহৃত হতো।

অধিকাংশ ঝুমরের শুরু হয় উচ্চস্বর থেকে তারপর ধাপে ধাপে ছন্দের দোলার উপর ভর করে নিচে নেমে আসে। এরপর যখন নিম্ন স্বর থেকে স্বরের আরোহণ ঘটে, তখনও তা ধাপে ধাপে ছন্দের দোলায় উপরে উঠে। আবার অনেক সময় নিম্ন স্বর থেকে এক ধাক্কায় উপরে উঠে যায়। পরে তা ধাপে ধাপে নামে। অনেক সময় উচ্চস্বর থেকে লম্বা দোলাযুক্ত মীড়ে ভর করে চট করে নেমে আসে। ফলে এই গানে দীর্ঘ মীড় পাওয়া যায় না। এছাড়া অনেক সময় কাছিকাছি দুটি স্বরের দোলায় সুর প্রলম্বিত হতে থাকে।

ঝুমরের ছন্দকে আন্দোলিত করে এর তাল প্রকরণ। প্রতিটি তালের চলনে আছে উৎফুল্ল চলন গতি। ৬ মাত্রার দ্রুত দাদরার মতো বিশেষ ধরনের ছন্দের তালকে ঝুমুর বলা হয়। যা উত্তর ভারতীয় দাদরার ছন্দের মতো নয়।

        ধিধিগ্   ধি      তাংতিদিগ্   তি   তাং
          ১        ২       ৩      ৪         ৫   ৬

এই বোলবাণী যখন মাদলে বাদিত হয়, তখন ছন্দের দোলা উপলব্ধি করা যায়। নাচের ঝন্দের সাথে এর তালের দীর্ঘ রূপ বাদিত হয়। যেমন-

        ধিগিন ধিতা -| ধিগি তা -|  ধিগি তা-| ধিগিন ধিতা-|

ঝুমুর গানের বাদ্যযন্ত্র
ঝুমুর গানের আদি দশায় হয়তো মূল বাদ্যযন্ত্র ছিল  তাল যন্ত্র। স্থানীয় তালযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো ধামসা, মাদল। পরবর্তী সময়ে বাংলা ঝুমুরের সাথে যুক্ত হয়েছে ঢোল, মন্দিরা। সম্ভবত ঝুমুরের আধুনিক সংস্করণে যুক্ত হয়েছে তবলা। শুষির যন্ত্রের মধ্যে শুরুর দিকে বাঁশি ছিল। পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছে শানাই। আধুনিক ঝুমুরে হারমোনিয়াম এবং কীবোর্ডও ব্যবহৃত হয়।

মুসলমান সমাজের ঝুমুর
পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া অঞ্চলে মুসলমান সমাজে বিয়ের গীত হিসেবে বিশেষ ধরনের ঝুমুরের প্রচলন রয়েছে। স্ত্রীআচার হিসেবে ঝুমুর ডালা এবং ঝুমুর খেলার চল রয়েছে। এই দুটি আচারের সাথে মেয়েরা নাচে ঝুমুর নাচ। এই গানগুলো গাওয়া হয় ঝুমুর তালে। এই গানের বাণী বিয়ের উৎসবের সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। মেয়ের এই গান পরিবেশন করে থাকেন অন্দরমহলে। বর্তমানে বর্ধমান এবং বীরভূম অঞ্চলে এখনও বিয়ের উৎসবে এই গান গাওয়া হয়।


সূত্র :