হাট
বানান বিশ্লেষণ: হ্+আ+ট্+অ
উচ্চারণ: ɦaʈ (হাট্)
শব্দ-উৎস:
সংস্কৃত হট্ট> বাংলা হট্ট, হাট
পদ: বিশেষ্য বিস্তারিত: হাট বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী পণ্য বিপণন ব্যবস্থা। ক্রেতার চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদক বা পণ্য ব্যবসায়ীরা সপ্তাহে এক বা একাধিক দিনে সুনির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়ে থাকে। গ্রাম বাংলায় ঐতিহ্যগতভাবে হাট-ভিত্তিক বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয়ের জন্য। প্রথাগত এই ধরনের হাট গ্রামবাংলার সর্বত্র পণ্য বিপণনের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এই হাটের সূত্রে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন অঞ্চলের গঞ্জ। হাটের আর একটি প্রকরণ মেলা। যেমন বৈশাখী মেলা বা বাণ্যিজ্য মেলা মূলত হাটেরই বিশেষায়িত রূপ।

গ্রামবাংলায় স্থানীয়ভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে হাট বসতো- কোনো বট বা পাকুড়ের মতো বড় গাছের নিচে। এ সব হাটে স্থায়ী কোনো ঘর ছিল না। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার প্রাকৃতিক প্রভাবে কারণে কোনো কোনো ব্যবসায়ী হাটে অস্থায়ী চালাঘর তৈরি করতো। হাটের দিন ছাড়া এসব ঘরগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকতো। পণ্যের বিচারে এসকল হাটে বিক্রেতারা মাছ, সবজি, দুধ, জ্বালানী কাঠ ইত্যদির জন্য আলাদা অংশে বসতো। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের পণ্য বহনের অন্যতম বাহন ছিল নৌকা। তাই বড় পরিসরে বহুবিধ পণ্যের হাট বসতো নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে। এই সকল হাটগুলো কালক্রমে স্থায়ী বাজারে রূপ নিয়েছিল। এরই সূত্রে বৃহত্তর পরিসরে গড়ে ওঠেছিল বাজারভিত্তিক নগর। পর্তুগিজ বণিকদের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল হাটের নগরী- 'গঞ্জ'। নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ নগরী এইভাবে সৃষ্টি হয়েছিল।

স্থায়ী পণ্য বিপণনের কেন্দ্র হিসেবে কোনো কোনো গ্রামে বাজার প্রতিষ্ঠিত হলে, সাপ্তাহিক বড় ধরণের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সে সকল বাজারে হাট চালু হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে এমন বহু হাট আছে যেগুলোতে সপ্তাহে এক বা একাধিক দিনে হাট বসে।

হাটের শ্রেণিকরণ: হাটের সময় এবং পণ্যের প্রকৃতি অনুসারে হাটকে নানাভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
  • সময়ভিত্তিক বিভাজন:
    • নিয়মিত হাট: কোনো অঞ্চলের কোনো স্থানে সুনির্দিষ্ট দিনে সাংবৎসরিক হাট বসে। দীর্ঘদিন ধরে এই ধরণের প্রচলিত হাট অনেক সময় আঞ্চলিক ঐতিহ্য হয়ে ওঠে। পণ্যের প্রকৃতি অনুসারে এই জাতীয় হাট নানা ধরনের হট। যেমন-
    • সাধারণ হাট: এই জাতীয় হাটে সকল ধরনের পণ্যের ক্রয়বিক্রয় হয়। মূলত এই জাতীয় হাটে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রয় হয়।
    • বিশেষায়িত হাট: এই জাতীয় হাটে কোনো বিশেষ ধরনের পণ্য বিক্রয় হয়। যেমন- গরুর হাট, বাঁশের হাট। এর ভিতরে কিছু কিছু হাট ঐতিহ্যগতভাবে বিখ্যাত হয়ে আছে। যেমন- টাঙ্গাইল ও শাহজাদপুরে কাপড়ের হাট, যশোরের ফুলের হাট, পিরোজপুরের নৌকার হাট ইত্যাদি।
    • অনুষ্ঠানভিত্তিক হাট: কোনো উৎসব বা কার্ক্রম অনুসারে এই হাটের ব্যবস্থা করা হয়। যেমন- কোরবানি ঈদের সময় কোরবানি পশুর হাট বসে।
  • পণ্যভিত্তিক হাট: পণ্যের প্রকৃতি অনুসারে এই হাটকে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। যেমন-
    • সাধারণ হাট: এই ধরনের হাটে সাধারণ মানুষের খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয়ের জন্য। এর পাশাপাশি গবাদি পশু, জ্বালানি বিশেষভাবে যুক্ত থাকতে পারে।
    • নির্দিষ্ট পণ্যের হাট: এই ধরনের হাট সুনির্দিষ্ট পণ্য-বিপণনের জন্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। যেমন- কাপড়ের হাট, পশুর হাট, বাঁশের হাট, কানসাট আমের হাট ইত্যাদি
  • প্রচারণামূলক হাট: পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বা বিপণন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এবং এদের জন্য এই ধরনের হাটের ব্যবস্থা করা হয়। এই হাটে পণ্য বিপণন হলেও মূলত উদ্দেশ্য থাকে পণ্যে প্রচার করা। এই ধরণের উল্লেখযোগ্য হাট হলো- বাণিজ্য মেলা। কম্পিউটার মেলা, বস্ত্র মেলা ইত্যাদি।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কিছু হাট:

  • কাইকারটেক হাট, সোনারগাঁও, ঢাকা
  • জিএম হাট ফুলগাজী, ফেণী
  • ধামইরহাট, নওগাঁ
  • মাজুর চৌধুরীর হাট, লক্ষ্মীপুর
  • সাভারের সাপের হাট

সূত্র:
  • চলন্তিকা। রাজশেখর বসু। এমসি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ। ১৪০৮।
  • বঙ্গীয় শব্দকোষ (প্রথম খণ্ড)। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমী। ২০০১।
  • বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানবাংলা একাডেমী, ঢাকা। মার্চ ২০০৫।
  • বাংলা বানান চিন্তা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)অধ্যাপক পি. আচার্য। জুলাই ১৯৯৭।
  • বাঙ্গালা ভাষার অভিধান । জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস। সাহিত্য সংসদ। নভেম্বর ২০০০।
  • ব্যবহারিক শব্দকোষ। কাজী আব্দুল ওদুদ। প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরী।
  • শব্দবোধ অভিধান। আশুতোষ দেব। দেব সাহিত্য কুটির। মার্চ ২০০০।
  • শব্দসঞ্চয়িতা। ডঃ অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়। নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি প্রাঃ লিমিটেড। ২৩শে জানুয়ারি, ১৯৯৫।
  • শব্দার্থ প্রকাশিকা। কেশবচন্দ্র রায় কর্মকার। দেব সাহিত্য কুটির। মার্চ ২০০০।
  • সংসদ বাংলা অভিধান। সাহিত্য সংসদ। শৈলেন্দ্র বিশ্বাস। মার্চ ২০০২।
  • সংস্কৃত বাংলা অভিধান। শ্রীঅশোককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, বইমেলা ১৪০৮
  • সরল বাঙ্গালা অভিধান। সুবলচন্দ্র মিত্র।
  • wordnet 2.1