নন্দনতত্ত্ব

দর্শনের একটি বিশেষ শাখা হলো নন্দনতত্ত্ব। বাংলা ভাষায় এই শব্দটি গৃহীত হয়েছে সংস্কৃত সমাসবদ্ধ পদ থেকে (নন্দন বিষয়ক তত্ত্ব/কর্মধারয় সমাস)। সংস্কৃত ক্রিয়ামূল নন্দ এর ভাবগত অর্থ হলো আনন্দ পাওয়া, আনন্দ দান করা। এর সাথে অন্ (ল্যুট) প্রত্যয় যুক্ত হয়ে 'নন্দন' শব্দ তৈরি হয়েছে।
               
নন্দ্ ( আনন্দ পাওয়া, আনন্দ দান করা) +অন্ (ল্যুট)= নন্দন

নন্দন শব্দের আরও একটি রূপতাত্ত্বিক রূপ রয়েছে। এই শব্দটি উৎপন্ন হয় ণিজন্ত
নন্দি ক্রিয়ামূল থেকে। এর সাথে ইন (ইনি) প্রত্যয় যুক্ত হয়েও নন্দন শব্দ তৈরি হয়।
                     
নন্দি +ইন (ইনি)=নন্দন

এই বিচারে নন্দন শব্দের অর্থ দাঁড়ায় যা থেকে আনন্দ পাওয়া যায় বা যার দ্বারা আনন্দ দেওয়া যায়। পুত্র সন্তানের দ্বারা আনন্দ লাভ হয়, এই অর্থে পুত্রসন্তানকেও নন্দন বলা হয়।

আলোচ্য নন্দনতত্ত্বে নন্দন শব্দের অন্য অর্থ হলো
সৌন্দর্য (সুসমন্বিত আনন্দের সমাহার) প্রদায়ক। এই বিচারে নন্দনতত্ত্বের আভিধানিক অর্থ হতে পারে সৌন্দর্যপ্রদায়ক তত্ত্ব। কিন্তু দর্শনবিদ্যার একটি বিশেষ শাখা হিসেবে নন্দনতত্ত্ব ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে। যতদূর জানা যায়, বাংলা ভাষায় 'নন্দনতত্ত্ব' শব্দটি প্রথম উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। 'পরিচয়' পত্রিকার ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের 'আধুনিক কাব্য' নামক প্রবন্ধে তিনি একটি বাক্যে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন এই ভাবে
        'নন্দনতত্ত্ব (
Aesthetics) সম্বন্ধে এজ্‌রা পৌণ্ডের একটি কবিতা আছে।'
রবীন্দ্রনাথ নন্দনতত্ত্ব এবং সৌন্দর্যতত্ত্ব দুটো শব্দই ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে
Aesthetics-এর বাংলা শব্দ 'নন্দনতত্ত্ব'-ই প্রচলিত।

এই শব্দটি নামবাচক বিশেষ্য। সত্তাতত্ত্ব অনুসারে এই শব্দের শ্রেণিকরণ করা হয় নিচের বিধি অনুসারে।

পদ: বিশেষ্য
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { নন্দনতত্ত্ব | মানবিক শাখা | জ্ঞানশাখা | জ্ঞানক্ষেত্র | প্রজ্ঞা | জ্ঞান | অভিজ্ঞা | মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্তা | সত্তা | }

এর ইংরেজি Aesthetics, esthetics। এই শব্দটির উৎস গ্রিক। গ্রিক  αἰσθητικός (aisthetikos, আইসথেটিকস), এর অর্থ হলো আমি অনুভব করি। এই শব্দটি প্রথম জার্মান ভাষায় গৃহীত হয়েছিল Æsthetik বানানে। ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জার্মান দার্শনিক আলেকজান্ডার গোট্টিলিয়েব বমগার্টন (Alexander Gottlieb Baumgarten) সৌন্দর্যবিদ্যার জন্য এই শব্দ ব্যবহার করেন। আধুনিক জার্মান বানান Ästhetik। একইভাবে ফরাসি শব্দ esthétique গৃহীত হয়েছিল গ্রিক থেকে।  ইংরেজি ভাষায় এই শব্দটি এসেছে জার্মান শব্দ থেকে।

ইউরোপে নন্দনতত্ত্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আধুনিক ইউরোপের ভাবনাচিন্তার সূতিকার হিসেবে প্রাচীন গ্রিসকে ধরা হয়। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো নন্দনতত্ত্বের প্রাথমিক ভাবনাগুলো এসেছে গ্রিক থেকেই। তবে এখনকার মতো প্রাচীন গ্রিসে আলাদা কোনো শাস্ত্র হিসেবে নন্দনতত্ত্ব কোনো বিশেষ মর্যাদা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল না।  গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি মতে, একবার প্যালাস এথেনা, হেরা এ্যাফ্রদাইতি  সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে প্যারিসের কাছে উপস্থিত হলে, প্যারিস এ্যাফ্রদাইতিকে সর্বশ্রেষ্ঠা সুন্দরী ঘোষণা করেন। এরপর তিনি প্যারিসের উপর খুশি হয়ে, পৃথিবীর শ্রেষ্ট সুন্দরী হেলেনকে উপহার দেন। হেলেনকে পরে প্যারিস অপহরণ করলে, ট্রয় যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনির সূত্রে বলা যায়, প্যারিস সুন্দর কি তা জানতেন। কিন্তু গ্রিক পুরাণ প্রণেতারা সুন্দর কি তা ব্যাখ্যা করেন নি।

গ্রিক দার্শনিক প্লেটো দর্শনের মূল পাঠ লাভ করেছিলেন তাঁর গুরু সক্রেটিসের কাছ থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৪৫০ অব্দের দিকে গুরুর আদর্শে তিনি রিপাব্লিক গ্রন্থে বলেন প্রতিটি মানুষ তাঁর জীবনের শিক্ষার শুরু থেকেই কল্যাণকে প্রাধান্য দেবে। প্রথম সে সুন্দরকে বুঝতে ও ভালোবাসতে শিখবে। আর এর ভিতর দিয়েই বুঝবে প্রতিটা বস্তুর সৌন্দর্য অপর কোনো সুন্দর বস্তুর সাথে কিভাবে সমন্বয় করছে। অন্যান্য গ্রিক দার্শনিকদের ভাবনাতেও সত্য ও সুন্দর উঠে এসেছে কিন্তু তাঁরা এর স্বরূপ ব্যাখ্যা করেন নি।

ফরাসি দার্শনিক দেকার্তের (১৫৯৬-১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) দর্শন একসময় ইউরোপে ব্যাপকভাবে আলোড়ন তুলেছিল। সেটা ছিল কিছু জড় ও মনোজগৎ সম্পর্কিত দর্শনের সূত্র। দেকার্ত  মনে করতেন
−−এ বিশ্বজগত দুটি সত্তায় বিভাজিত। এর একটি জড় অপরটি মন। আর জড় হচ্ছে মনের বিপরীত। জড়ের ধর্ম বিস্তৃতি গুণ আছে আর মনের ধর্ম হলো চেতনা। জড়জগৎ যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিত হয় আর মন উদ্দেশ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জগতে জড় এবং মন দুটি নিরপেক্ষ সত্তা। এই মতবাদের দ্বারা তিনি দ্বৈতবাদের (Dualism) সূচনা করেছিলেন।

দেকার্ত মনে করতেন আত্মা হলো সন্দেহাতীতভাবে একটি আধ্যাত্মিক বস্তু। তাঁর মতে আত্মার প্রধান ধর্ম চেতনা।
মানুষ যে সকল ভাবনা-চিন্তা করে এবং তার থেকে সিদ্ধান্ত নেয় 'আমি' নামক সত্তা। আমি হচ্ছে আত্মার নিয়ন্ত্রক। আত্মার চৈতন্যের স্থান হল মন। আমি মনকে নির্দেশ দেয়, আর মন তা সম্পন্ন করে। চেতনা ছাড়া আত্মা বা 'আমি'র অস্তিত্ব নেই। দেকার্তের বুদ্ধিবাদ
(Rationalism) গড়ে উঠেছে সন্দেহের উপর ভিত্তি করে। তাঁর মতে জগতের সকল কিছুকেই সন্দেহ করা যায়, কিন্তু নিজের অস্তিত্বকে সন্দেহ করা যায় না। 'আমি' আছি বলেই জগৎ আছে। এই সূত্রে তিনি তিনটি অস্তিত্ববাচক বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতেআমি অস্তিত্বশীল, ঈশ্বর অস্তিত্বশীল এবং বস্তুজগৎ অস্তিত্বশীল। এই সূত্র প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি তিনটি ধারণা অবতারণা করেন। এই ধারণা তিনটি হলো

১. আগন্তুক (adventitous): মানুষের দেহসত্ত্বার বাইরের উপকরণ, যার ধারণা ইন্দ্রিয় দ্বারা মানুষের মনে প্রবেশ করে। প্রাকৃতিক সকল উপকরণ সম্পর্কে যা ধারণা মানুষ লাভ করে, তার সবই আগন্তুক। মেঘ, আকাশ, নদী, পাহাড়, মাটি ইত্যাদি সবই আগন্তুক ধারণা।

২. কৃত্রিম (facititious): এই জাতীয় ধারণা মনের ভিতরে তৈরি হয় বা মানুষ মনের তৈরি করে। যেমন রূপকথার অলৌকিক কর্মকাণ্ড (পঙ্খিরাজ ঘোড়া, রাক্ষস, যাদুর কাঠি ইত্যাদি)। একালের বিজ্ঞান কল্পকাহিনিও এই পর্যায়ে পড়ে।

৩. সহজাত (innate): সহজাত ধারণা থেকে যার জন্ম হয়। এর ভিতরে রয়েছে অসীমতা, নিত্যতা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব ইত্যাদি।

দেকার্তের মতে ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্তজ্ঞান বস্তুর বাইরের পরিচয় দেয়, কিন্তু বস্তুর অন্তর্নিহিত বিষয়কে তুলে ধরতে পারে না। এমন কি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানও সন্দেহাতীত নয়। কারণ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানও দেশকালের বিচারে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। কিন্তু সহজাত জ্ঞান সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত। যেমন পাটিগণিত, জ্যামিতি ইত্যাদি। বুদ্ধির মাধ্যমে প্রাপ্তজ্ঞান পরিবর্তনশীল। তিনি ধারণার সন্দেহাতীত রূপ নির্ণয়ে গাণিতিক জ্ঞানের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।

অনেকে মনে করেন, নন্দনতত্ত্বের উপর প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন ফ্রান্সিস হাচিসন (১৬১৪-১৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দ)। ১৭২৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত এই গ্রন্থটির নাম 'এন ইনকুয়ারি ইনটু দ্যা অরিজিন অফ আওয়ার আইডিয়াজ অফ বিউটি এ্যান্ড ভার্চু'। হাসিসন মূলত জন লকের (১৬৩২-১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দ) দর্শনকে ভিত্তি করে, নন্দনতত্ত্বের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।  জন লক মনে করতেন মন চিন্তা করতে পারে। কিন্তু মনের কোনো সহজাত ধারণা নাই। সংবেদন এবং অন্তর্দর্শনের  মাধ্যমে মন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এক্ষেত্রে সংবেদন বহির্জগত সম্পর্কে এবং অন্তর্দর্শন মানুষের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। মূলত লক অভিজ্ঞতাবাদের (Empiricism) সুসংবদ্ধ রূপ দান করেন। এই কারণে তাঁকে অভিজ্ঞতাবাদের জনক বলা হয়। ফ্রান্সিস  সৌন্দর্যবোধকে সৌন্দর্য উপলব্ধি এবং তা গ্রহণ করার মানসিক ক্ষমতাকে বুঝিয়েছেন। উভয়ই লকের অভিজ্ঞাবাদের সূত্রকেই অনুসরণ করে। তিনি আনন্দময় ধারণা বলতে উল্লেখ করেছেন সামঞ্জস্যবোধকে। তিনি মৌলিক সৌন্দর্য এবং তুলনামূলক সৌন্দর্যের ভিতর একটি পার্থক্য গড়ে তুলেছেন।

হাচিসন-এর নন্দনতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬) রচনা করেন 'ট্রিটাইজ ইউম্যান ন্যাচার' গ্রন্থটি। তাঁর মতে সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন বিশেষ রুচিবোধ। তাঁর মতে সৌন্দর্য এক ধরনের রূপ। যা আনন্দও দিতে পারে আবার বেদনার জন্ম দিতে পারে। হিউমের পরবর্তী গ্রন্থ 'ইনকোয়ারি কনসার্নিং দ্য প্রিন্সিপলস অফ মোরালস' প্রকাশিত হয় ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে। তবে নন্দনতত্ত্বের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থটি হলো 'অফ দ্যা স্ট্যান্ডার্ড অফ টেস্ট'। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থটি প্রকাশের পর, নন্দতত্ত্বের জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি এই গ্রন্থে সৌন্দর্যবোধ এবং রুচির বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করেন। সৌন্দর্যের আপেক্ষিক তত্ত্বকে তিনি বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেন। এডমন্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে) ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত 'এ ফিলসফিক্যাল ইনকুয়ারি ইন টু দ্যা অরিজিন অফ আওয়ার আইডিয়াজ অফ দ্যা সাবলাইম এ্যান্ড বিউটিফুল' প্রবন্ধে সাবলাইম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে
জার্মান দার্শনিক বমগার্টন (১৭১৪-১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর 'রিফ্লেকশান অন পোয়েট্রি' গ্রন্থে
Æsthetik শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর অসম্পূর্ণ গ্রন্থ 'এসথেটিকা' (aesthetica) -কবিতার বাইরে অন্যান্য বিষয়ের উপর সৌন্দর্য নিয়ে আলোকপাত করেন। এর সমসাময়িক উইংকেলম্যান (১৭১৭-১৭৬৭) সৌন্দর্যকে শিল্পের লক্ষ্য হিসেবে ব্যাখ্যা দেন। আরও পরে ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দ) সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নিরূপণের সংজ্ঞা নির্ধারণের সমস্যা নিয়ে 'ক্রিটিক অফ জাজমেন্ট' গ্রন্থ রচনা করেন। ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে 'অবজারভেশান অন দ্যা ফিলিং অগ দ্যা সাবলাইম এ্যান্ড দ্যা বিউটিফুল' গ্রন্থ প্রকাশের পর, নন্দনতত্ত্বে সাবলাইম নিয়ে নতুন করে ভাবনার বিষয় যুক্ত হয়। কান্ট তাঁর তিনটি ক্রিকিট গ্রন্থের সিরিজে নন্দনতত্ত্বের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন।

নন্দনতত্ত্বের উপর উল্লেখযোগ্য আলোচনা পাওয়া যায় জর্জ সান্টায়ানার 'দ্যা সেন্স অফ বিউটি' (১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রন্থে। অবশ্য সাবালইম নিয়ে তিনি বার্ককে অনেকাংশেই অনুসরণ করেছিলেন। এরপর থেকে ইউরোপে এই বিষয়ের উপর বিস্তর লেখা হয়েছে এবং বর্তমানে এটি একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে।

ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব
ভারতবর্ষে নন্দতত্ত্বের সূত্রপাত ঘটেছিল অলঙ্কার শাস্ত্রের সূত্রে। অবশ্য এর ক্ষেত্র ছিল কাব্য ও নাট্যজগৎ। এই শাস্ত্রের অগ্রগণ্য পুরষ ছিলেন ভরত মুনি। তিনি অলঙ্কার শাস্ত্রের দশটি গুণের উল্লেখ করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম
শতকের দিকে ভামহ অলঙ্কার শাস্ত্রকে কাব্যালঙ্কার থেকে পৃথক করে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দেন। সে সময় অলঙ্কার শাস্ত্র ব্যাকরণের অংশ হিসেবেই ছিল। ভামহ ভরতের দশটি গুণের ভিতর থেকে মধুর, ওজর ও প্রসাদ নামক তিনটি গুণকে গ্রহণ করেছিলেন। তবে খ্রিষ্টীয় নবম দশম শতাব্দীতে রাজশেখর সাহিত্যবিদ্যার ধারণা উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে যে বিদ্যা শব্দ ও অর্থের যথাযথ সহভাব  আনে তাই হলো সাহিত্যবিদ্যা।

দণ্ডী নামক অপর একজন ব্যাকরণবিদ ভরত ও ভামহ-এর সূত্রে দশটি গুণ ও অলঙ্কার এর সমন্বয়ে সাহিত্যের বিচার করেছেন। এর পরে আনন্দবর্ধন কাব্যের বহিরঙ্গ বাদ দিয়ে অন্তরঙ্গ হিসেবে ধ্বনিকে বিশেষভাবে মর্যাদা দেন। এবং রসের সাথে ধ্বনিগুণের সমন্বয় করে একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মহিম ভট্ট রসকে কাব্যের আত্মা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভরত থেকে পরবর্তী সকল ব্যাকরণবিদরাই রসকে কাব্যনাট্যে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। পরবর্তী সময়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে, লাবণ্য, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি অনেক কিছু। তবে সংস্কৃত পণ্ডিতদের অলঙ্কার শাস্ত্র এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় নিয়ে এক ধরনের ধারাবাহিকতা ছিল।
 
ইউরোপীয়
esthetics ধাক্কা দিয়েছিল জোড়সাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে সোরবানে ফরাসি দার্শনিক কুজ্যাঁ একটি ভাষণে 'সত্য-সুন্দর-ঈশ্বর' নিয়ে একটি বক্তৃতা দেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মূল ফরাসি থেকে এর ইংরেজি অনুবাদ করেন। এই প্রবন্ধটির নাম The True The Beutiful and The God পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের আলোকে এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সাহিত্য, সাহিত্যের পথে, আধুনিক সাহিত্য, ইত্যাদি রচনায়। রবীন্দ্রনাথের পরে ঠাকুর পরিবারের নন্দনতত্ত্বের উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ এই দুইজনের লেখা নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনাকে বেগবান করেছে বটে, এঁদের কেউই একটি ধারাবাহিকতার ভিতর দিয়ে শাস্ত্রীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন নি। আনন্দ কেন্টিশ কুমার স্বামী, যদিও তিনি শ্রীলঙ্কায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ভারতীয় দার্শনিক হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তিনিও শিল্পের জীবনমুখিতার বিষয়ে অধিকতর জোর দিয়েছিলেন।

নন্দনত্ত্বের অনুভূতিগত ভিত্তি
জীবমাত্রের সহজাত প্রবৃত্তিতে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে। জীবের দৈহিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রাথমিক পর্যায়কে বলা হয় জীবনধারণের প্রচেষ্টা। প্রতিটি জীবন তার অতিবাহিত জীবনকালের ভিতরে যা কিছু করে, তাহলো জীবনযাপন। জীবনধারণের মৌলিক সূত্রে সকল জীবই একই প্রকৃতির। শুধু জীবনধারণের প্রক্রিয়াটি  জীবভেদে ভিন্ন ভিন্ন রকম। কিন্তু জীবনযাপনের বিচারে মানুষ নামক প্রজাতি এবং মানবেতর প্রজাতিসমূহের ভিতরে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ মানুষের জীবনযাপনের মধ্যে রয়েছে শুধু খেয়ে পড়ে বাঁচা নয়, ভালোভাবে বাঁচা। এই ভালোভাবে বাঁচার প্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে মানুষের ভিতরে জন্ম নিয়েছে সুন্দরভাবে বাঁচা। নন্দনতত্ত্ব হলো সুন্দরভাবে বাঁচার শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণ মাত্র।

সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার গোড়াতে রয়েছে জীবনধারণের মৌলিক অবস্থা। যখনই কোনো কিছু জীবন ধারণের প্রতিকূলে যায়, তখনই মানুষের ভিতরে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা শুরু হয়। খুব ক্ষুদ্র পরিসরে জীবের ভিতরে তৈরি হয় অস্বস্তিবোধ। একই ভাবে কোনো মন্দ দশা থেকে সামান্য ভালোর দিকের উত্তরণ হলো- স্বস্তিবোধ। এই দুটি বোধের উচ্চতর অবস্থানে জন্ম দেয় আনন্দ-বেদনা। জীবমাত্রেরই তার জীবনযাপনের মধ্যে এসকল দশার অভিজ্ঞতা লাভ করে। বহুবিধ আনন্দের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের বিচারে এসে মানুষ মানবেতর প্রাণী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। মানবেতর প্রজাতিসমূহের ভিতরে সৌন্দর্য উপলব্ধির সহজাত চৈতন্য রয়েছে কিনা, তা আমাদের জানার বাইরেই রয়ে গেছে। মানুষের বিচারে সৌন্দর্যবোধ আছে। তাই মানুষ প্রাকৃতিক উপকরণের ভিতর এবং তার সৃজনশীলকাজের ভিতরে সৌন্দর্যের সন্ধান করে। এর সাথে যখন মানবিক বোধ যুক্ত হয়, তখন সে রসের সন্ধান করে। তাই নন্দনের ভিত্তি ধরা হয় স্বস্তি-অস্বস্তিবোধ। এর ভিতর দিয়ে পর্যায়ক্রমে উত্তরণ ঘটে আনন্দ-বেদনা, সুন্দর-অসুন্দর, রস এবং রসহীনতা।


সূত্র: