হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
১৯৩০-২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে
বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, সাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির স্রষ্টা।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এরশাদ। পরে তাঁর পরিবার
রংপুর চলে এলে এখানে তিনি বড় হয়ে উঠেন। রংপুরে তিনি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চা মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে (কোহাটে অবস্থিত) প্রশিক্ষণের জন্য যান।  ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে কমিশন লাভ করেন।

রওশন এরশাদ

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রওশন এরশাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৬০ - ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কেন্দ্রে অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কোয়েটার স্টাফ কলেজ থেকে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন।

১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিয়ালকোটে ৫৪ ব্রিগেডের মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। এরপর ১৯৬৯ - ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অধিনায়ক ও ১৯৭১ - ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ৭ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে চলে আসেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। এই বছরের ১২ ডিসেম্বর তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন।

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন। এই বছরের ২৪শে আগস্ট তিনি সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। এই সময় তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং উপসেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। ১৫ই অগাস্ট সামরিক অভ্যুত্থানের পর এরশাদ বাংলাদেশের দিল্লি মিশনের মাধ্যমে দেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে বার্তা পাঠান।

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। উল্লেখ্য এই সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এই বছরের ডিসেম্বরে মাসে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে মে,  জিয়াউর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। এরপর রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিলেন- বিএনপি পক্ষীয় আব্দুস সাত্তার।

১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চ এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে অপসারিত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ২৭ মার্চ তিনি বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন। তবে বিচারপতি চৌধুরীর কোনো ক্ষমতা ছিল না। সামরিক আইনের অধীনে,  প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদের উপদেশ বা অনুমোদন ব্যতীত প্রেসিডেন্ট কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতেন না।

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে দেশ শাসন করেন। এরপর তিনি ১১ই ডিসেম্বর দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এফ.এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের অধিকারে নেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরিবর্তন আনেন। এর ভিতরে অন্যতম পরিবর্তন ছিল ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রবর্তি উপজেলা পদ্ধতি। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০টি ধাপে ৪৬০টি থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করার মাধ্যমে দেশে জেলার সংখ্যা ৬৪ করা হয়। নারীসমাজের আর্থ-সামাজিক স্বার্থ সমুন্নত রাখতে এরশাদ সরকার ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে একটি পৃথক মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর স্থাপন করে।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এই বছরে এরশাদ সরকারের অধীনে ৭ই মে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসন নিয়ে জয় লাভ করে। এই নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৬টি আসন। উল্লেখ্য, বিএনপি এই নির্বাচনটি বর্জন করেছিল। এই নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

এরপর থেকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। বিরোধী দলগুলোর প্রবল আন্দোলনের মুখে এরশাদ ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ বাতিল করেন। এরপর তিনি ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। অধিকাংশ বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করেছিল। ফলে জাতীয় পার্টি ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৫১টি আসন নিয়ে জয় লাভ করে। এরপর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর রূপ লাভ করতে থাকে। এই সময় এরশাদকে সরাসরি স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং তার সরকারকে অভিহিত করা হয় 'স্বৈরাচারী সরকার'। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চরমরূপ লাভ করে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং ৬ ডিসেম্বর তিনি ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ক্ষমতা হারানোর পর ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে এরশাদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি,  পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।  নির্বাচনে তিনি কারাগার থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। এই নিরাচনে বিএনপি জয়লাভ করে এবং বিএনপি সরকার এরশাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। এর ভিতরে কয়েকটি মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন।

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে অধিকাংশ দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। নির্বাচনে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি ২৭৮টি আসন লাভ করেছিল। এছাড়া ফ্রিডম পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০টি আসল লাভ করেছিল। এর বাইরে ১০টি আসনের ফলাফল অসমাপ্ত থাকে এবং আদালতের রায়ে একটি আসনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল। এই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রবল প্রতিবাদের সূত্রপাত হয়। এই প্রেক্ষিতে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ১৪৬টি আসন পেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যা গড়িষ্ঠতা পায়। নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল পায় ১১২টি এবং জাতীয় পার্টি পায় ৩২টি আসন। অন্যান্য নির্বাচনের মতই এরশাদ নিচে পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বিদিশা

দীর্ঘ ছয় বছর কারাভোগের পর ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে 'বিদিশা'র সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে তিনি বিদিশাকে বিবাহ করেন। উল্লেখ্য, নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে এদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে।

এরপর তিনি দলকে সাজানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু দলের ভাঙন ঠেকাতে ব্যর্থ হন। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ বিভাজনের সূত্রে মূল ধারার জাতীয় পার্টি নাম হয় 'জাতীয় পার্টি-এরশাদ'। এই দলের তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে থেকে যান। অন্য দুটি দলের নাম হয়- জাতীয় পার্টি  (নাজির) এবং জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে 'জাতীয় পার্টি-এরশাদ'-এর সাথে 'ইসলামী জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট' যুক্ত হয় এবং সম্মিলিতভাবে ১৪টি আসন লাভ করেছিল।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে 'জাতীয় পার্টি-এরশাদ' লাভ করেছিল ২৭টি আসন।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের পূর্বে, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জুন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাশ হয়। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও তার শরিক দলগুলো, নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা পুনরায় চালু করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। সরকারি দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চলমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেয়। এই সূত্রে নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচন পরবর্তী নির্বাচনের দিন সহিংসতায় নিহত হয় ১৯ জন। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও এই নির্বাচন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে মারা গেছেন ১২৩ জন। ভোটের দিন এতসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি এর আগে দেখা যায় নি।

এই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্রসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এছাড়াও নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় নির্বাচনটি নিয়ে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
এই নির্বাচন 'জাতীয় পার্টি-এরশাদ' ৩৪টি আসন লাভ করে। ফলে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি আত্মপ্রকাশ করে এবং তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হন।

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) লাভ করেছিল ২০টি আসন।

২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুন সকালে এরশাদ অসুস্থবোধ করলে তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। এই সময় তিনি রক্তে হিমোগ্লোবিন-স্বল্পতা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। এই বছরের ১ই জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।